Tuesday, June 20, 2017

বাম দৃষ্টিভঙ্গীতে চিরস্থায়ী ব্যবস্থাঃ লুঠ না গ্রাম বিকাশের হাতিয়ার৪

তথ্যভিত্তি - সামাজিক ইতিহাসের ধারাঃ বিনয় ঘোষ
পলাশির পরের লুঠ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে ১১৭৬ সালে বাংলায় মন্বন্তর, আমাদের ভাষায় গণহত্যা অনুষ্ঠিত হয় – সেই সময় সব থেকে বেশি রাজস্ব আদায় হয়। দেশজুড়ে তখন ফকির-সন্ন্যাসীদের ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই। লুঠ, খুন আর অত্যাচারের আবহে ফিলিপ ফ্রান্সিস আসেন ১১৮১ সালে। দুবছর পরে তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কাছাকাছি একটা প্রস্তাব পেশ করেন। ১১৯৭তে দশসালা পরিকল্পনা আর ১১৯৯ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা হল। বিনয় ঘোষ বা অন্যান্য নিম্নবর্গএর ঐতিহাসিকদের বক্তব্য ছিল ব্রিটিশ এই কাজটা করেছিল কেননা তাদেরে ধারনা ছিল রাজস্ব সুনির্দিষ্ট করে দিলে জমিদার জমিদারি সুষ্ঠুভাবে চালাতে উতসাহিত হবেন, চাষবাসের উন্নতি হবে, গ্রাম সমাজের উন্নতি হবে এবং দেশের শ্রীবৃদ্ধি হবে – লুঠেরা অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাসীদের ওপর তাদের কী আশা! কিন্তু তাদের কারোর চোখে পড়ল না যে এই পরিকল্পনাটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক বাংলা লুঠের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর আগে বহুবার ব্রিটিশদের চাপে পড়ে মীরজাফর থেকে মীর কশিম, জমিদারদের রাজস্ব বাড়িয়ে, জমিদারদের বকলমে রায়তদের শেষণ করেছেন। রয় মক্সহ্যাম দেখালেন যে, নুনের ওপর কয়েক শতগুণ শুল্ক চাপানোয়, তার দাম হেস্টিংসের সময় এতই বেড়ে যায়, আর রায়তদের রোজগার এতই কমে যায় যে রায়তেরা নুন খাওয়া কমিয়ে দেয়।
লুঠ চলতেই থাকে। অনুপস্থিত জমিদারদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। জমিদারির ভাগ হতে হতে জমিদারির সংখ্যা দ্রুত হারে বেড়ে চলতে থাকে। প্রায় বিশ বছর পর সিলেক্ট কমিটির ফিফথ রিপোর্টে বলা হল বহু অযোগ্য জমিদারদের হাতে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে এদের কোন যোগ্যতাই নেই। বুদ্ধিহীন, নির্বোধ, উচ্ছৃঙ্খল বিলাসী অমিতব্যয়ী স্বেচ্ছাচারী নিষ্ঠুর স্বার্থপর ডাকাত পোষক অভধায় জমিদারদের অভহিত করল ফিফথ রিপোর্ট।
জমিদারি না চলার সমস্ত দায় বিনয়বাবুরা চাপিয়ে দিয়েছেন শুধুই জমিদারদের ওপরে – ব্রিটিশদের তিনি খোলা ছাড় দিয়ে রেখেছেন। বইতে তিনি মন্তব্য করছেন, এই অভিধায় অভিযুক্ত জমিদারশ্রেণীর হাতে ইংরেজ শাসকেরা গ্রাম্য সমাজের দায়িত্ব অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হলেন। এবং তিনি আরও বলছেন যে জমিদারদের এমন কতগুলি ক্ষমতা দেওয়া হল যাতে তারা নিজেদের অস্তমিত সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারেন। কিন্তু চিরদিনের বিলাসিতার অভ্যাস ও স্বভাবশৈথিল্যের জন্য জমিদারদের অনেকেই নির্দিষ্ট দিনক্ষণে দেয় রাজস্ব মেটাতে পারে নি – তাদের অজুহাত প্রজাদের দুরবস্থা ও খাজনা অনাদায়। বিনয়বাবুদের তার মনোভাবটা এমন যে ব্রিটিশ জমিদারদের যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিল তা জমিদারেরা সঠিকভাবে পালন করতে পারেন নি।
দায় মেটাতে পারে নি বলেই সূর্যাস্ত আইনে জমিদারি সম্পত্তি লাটে ওঠে ও অন্য কারোর কাছে বিক্রি হয়ে যায়। ঠিক এইরকমভাবে রামমোহন তার পিতার দায়িত্বপ্রাপ্ত জমিদারির খাজনা সময় মত না শোধ করায় পিতা কারারুদ্ধ হন এবং না দেয় সেই উদ্বৃত্ত অর্থ অবলম্বন করে কুসীদজীবিতায় অবতীর্ণ করেন। আদতে এই সব জমিদারি যারা কেনেন, তাদের অধিকাংশ ইংরেজদের দয়ায় দেওয়ানি-বেনিয়ানি-মুচ্ছুদ্দিগিরি করে, হাট-বাজারের ইজারা নিয়ে প্রচুর ধন আহরণ করেছেন। ইংরেজদের বদান্যতায় পলাশীর পরে বঙ্গ লুঠেরা বাবুদের উত্তরপুরুষদের সিন্দুকে অমিত ধন সঞ্চিত ছিল। কর্নওয়ালিস এবং সাম্রাজ্য এই তত্ত্ব জানতেন এবং কর্নওয়ালিস ১২০০ সনে ডিরেক্টরদের একটা চিঠিতে লেখেন, দেশিয়দের হাতে যে বিপুল পরিমান অর্থ জমে আছে, তার বিনিয়োগের যায়গা নেই...আমরা যদি জমিদারির সময় নির্দিষ্ট করে আয় নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে এই বিপুল অর্থ জমিদারিতে বিনিয়োজিত হবে।
ব্রিটিশেরা তো গ্রামের উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করার পাশাপাশি রাজস্ব লুঠছিল। সে সময় ব্রিটেনে বিপুল ভর্তুকি দিয়ে তৈরি হচ্ছে লুঠেরা শিল্প বিপ্লব ব্যবস্থা। এবারে তাদের চোখ পড়ল বাবুদের সিন্দুকে। সারা বাংলা তখন ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইতে থরথর। প্রয়োজন ছিল গ্রাম বাংলার রায়তদের ব্রিটিশ বিরোধী লড়ায়ের সামনে জমিদারদের এনে ফেলা যাতে স্বাধিনতাকামীদের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্রিটিশ না লড়ে বাঙালি জমিদারদের লড়িয়ে দেওয়া যায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামদুলাল দে, মতিলাল শীল, লাহা, মল্লিক, পাইকপাড়ার সিংহরা, হাটখোলার বা রামবাগানের দত্তরা সকলেই সঞ্চিত লুঠেরা অর্থ বিনিয়োগ করল জমিদারিতে। লুঠের বৃত্ত পূর্ণ হয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলল।
১২৯০ সনের জর্হ ক্যাম্ব্যালের বাংলা সরকারের প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে জমিদারির সংখ্যা দেড় লক্ষেরও বেশি হয়। তার মধ্যে ৫৩৩টা হল বর জমিদারি ২০ হাজার একরের ওপরে, ১৫৭৪৭টা মাঝারি ২০ হাজার থেকে ৫০০ একরের মধ্যে আর ১৩৭৯২০৩ হল ছোট জমিদারি – ৫০০ একর বা তার কম।
১২৮৯সনের বেভারলের সেন্সাসে কৃষক আর জমিদারদের মধ্যবর্তী কর্মচারীদের একটা পরিচয় কৃষক – ৬৩৯১০৭৪, জমিদার – ৪২৬১৮, ইতমামদার – ৫৪৬, ঠিকাদার – ৩০৩, ইজারাদার – ৩৩৫৪, লাখেরাজদার – ২৩০৭০, জায়গিরদার – ৩৬৫, ঘাটোয়াল – ৬৬৮, আয়মাদার – ২০০৪, মকরারিদার – ৯৯৩৩, তালুকদার – ৯৬০৫০, পত্তনিদার – ৩৩৭২, কোদকস্তপ্রজা – ৭৫৫২, মহলদার – ১১২৮, জোতদার – ১৯৫৬৪, গাঁতিদার – ৩৮২৪, হাওলাদার – ৯৩৪৩, গমস্তা -১৮৪৭২, তহশিলদার – ১০৪৫৬, পাটোয়ারি – ১৩৭৩, পাইক – ১৪৭৯৭, জমিদারের ভৃত্য – ১১০৩০, দফাদার – ২০২, দেওয়ান – ১০৪, মণ্ডল – ১৬২০, নায়েব – ৫৮১, এস্টেট ম্যানেজার – ২১।

No comments: