Sunday, June 11, 2017

পাহাড় যুদ্ধ: এডভান্টেজ মমতা, ব্যাকফুটে গুরুং

সকালে প্রবীন সাংবাদিক দাদার সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল গোর্খা আন্দোলন বিষয়ে। আন্দোলনের ফলে পাহাড়ে আমাদের সাঙ্গঠনিক সমস্যা ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা হল - সেগুলো বর্তমানে অবান্তর। আন্দোলন বিষয়ে তাঁর কতগুলো মন্তব্য বিন্দু আকারে তুলে দিলাম-
১। ১৯৮২, ১৯৮৪র ভোটে পাহাড়ের তিনটে আসন সিপিএমেরই ছিল।
অথচ আগ্রাসী বাঙালিবাদী সিপিএমর নীতিতে(জঙ্গলমহল আর) পাহাড় হাতছাড়া হয়। ১৯৮৪র লোকসভা ভোটে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পাহাড়ে ৮০০০০ ভোট পেয়েছিলেন নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে কারণ ১৯৭৪ সালে তিনি একবার মন্ত্রীসভার বৈঠক দার্জিলিংএ করেছিলেন।
২। ১৯৮৬তে সামগ্রিক অবস্থা পাল্টে যায়। সুবাস ঘিসিংএর প্রাথমে আলাদা রাষ্ট্র পরে আলাদা রাজ্যের আন্দোলন ভিত্তি পেতে থাকে এবং বামফ্রন্ট দুর্বল হতে থাকে। তখন ৯ বছরের ভরা বামফ্রন্টীয় যৌবন। তামাং দাওয়া লামাকে পার্বত্য উন্নয়ন মন্ত্রী করেও সে ঢালের পথের ঠেলা সামাল দেওয়া যায় নি।
৩। লেনিন-স্তালিনের লাইনে জাতিসত্ত্বার অধিকারের প্রশ্ন তোলায় সিপিএমের রাজ্যসভার সদস্য টি এস গুরুং খুন হন - খুনের কিনারা হয় নি। পাহাড়ে সিপিএম দুভাগ হয় - আর বি রাই আর তামাং দাওয়া লামারা সিপিআরএম তৈরি করেন। পাহাড়ের সিপিএমএর রাজনৈতিক জমি জিএনএলফএর গোর্খা জাতিসত্ত্বা আর আধপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলন কেড়ে নেয়। কর্তৃত্ববাদী সিপিএম রাজনৈতিকভাবে হঠতে হঠতে বিজনবাড়িতে নেমে আসে। কিছুদিন পরে সেখানেও থাকতে পারে নি।
৪। এবারে সুবাস ঘিসিং আউট বিমল গুরুং ইন। ২০০৬, ২০০৯ ২০১১র ভোটে পাহাড়ের তিনটে বিধানসভা কেন্দ্র দার্জিলিং কালিম্পং কার্সিয়াংএ কংগ্রেস দেড় আর সিপিএম আড়াই শতাংশ ভোট পেল। বাকি ৯৩ শতাংশ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা(গজম) পেত। তারা তাই তুড়ি মেরে কখোনো কংগ্রেস কখনও বিজেপিকে জিতিয়েছে।
৫। ২০১৪ সাল থেকে পাহাড়ে তৃণমূল কংগ্রেস পা রাখে শক্ত করে। দার্জিলিং বিধানসভা অংশে ১৮.৫ কার্সিয়াংএ ২১ শতাংশ কালিম্পংএ ২০ শতাংশ ভোট পেল তৃণমূল। গজমএর বিরোধী ভোট আড়াই থেকে বেড়ে দাঁড়াল ২১ শতাংশে। বিমল গুরুং বুঝলেন তারা ক্ষয়িষ্ণু শক্তি আর তৃণমূল বাড়ছে।
৬। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনটে বিধানসভাতেই তৃণমূল প্রার্থী দিল। কালিম্পঙের হরকা বাহাদুর ছেত্রী গজম ভেঙ্গে জনআন্দোলন পার্টি তৈরি করলেন। তৃণমূলের সমর্থনে হরকা জিতলেন না, কিন্তু পেলেন ৪২ শতাংশ।
৭। তিনটেতেই গজম জিতলেও গুরুং বুঝলেন প্রতি ঘণ্টায় তিনি পিছোচ্ছেন। সিপিএম ১৯৮৬র পরে পাহাড় ছাড়লেও তৃণমূল কিন্তু পাহাড় আঁকড়ে পড়ে রইল। ২০১৪ থেকে পাহাড়ে দলের শাখা খুলে মিটিং মিছিল আরম্ভ করল।
৮। বাঙ্গালি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গোর্খারা যেমন লড়ছে, তেমনি গোর্খারা পাহাড়ের লেপচা ভুটিয়া তামাংএর মত অন্যান্য জাতির বিকাশের কাজে ব্রতী হচ্ছে না, অন্যান্য জনজাতিগুলোর বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে - এই অভিযোগ করে মমতা সরকার পাহাড়ের ১৫টা ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করে। ছোট ছোট জাতি গোষ্ঠীগুলিকে মুখ্যমন্ত্রী মর্যাদা দিলেন গোর্খা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। ফলে তৃণমূলের ভিত্তি বাড়ল। গজমর ভূমি ক্ষইতে থাকল।
৯। শঙ্কিত বিমল গুরুং পাল্টা বন্ধ ডাকেন। স্বাভাবিকভাবে রাজ্য সরকার বিরোধিতা করে। গুরুং ভয় পেয়ে আগের দিন বন্ধ তুলে নেন। বোঝা গেল তাঁর সমর্থনের ভিত্তিতে ধ্বস নেমেছে।
১০। ২০১১ থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘণঘণ পাহাড়ে যাচ্ছেন। ২০১১র সেপ্টেম্বরে ভূমিকম্পএ প্রথমে পার্থ চ্যাটার্জীকে পাঠিয়েও তিনি নিজে যান, বিজনবাড়িতে সেতু ভেঙ্গে পড়লে নিজে গেলেন, চা উৎসবে ছুটে গেলেন। সুখে দুঃখে আনন্দে বিপদে উনি পাহাড়ের হৃদয় ছুঁচ্ছেন। মাঝ রাস্তায় নেমে কথা বলছেন। চাই না চাই পাহাড়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
১১। গোর্খা নেতৃত্বের মধ্যে বুদ্ধিমান হরকা বাহাদুর অবস্থাটা দ্রুত পাল্টাচ্ছে বুঝছিলেন। নেতাদের বলছিলেন হ্যান্ডলিং অব কন্ট্রাডিকশন ভুল হচ্ছে। বিমল গুরুং, রোশন গিরিরা মানেন নি।
১২। সব শেষ পেরেকটা পোঁতা হল আট জুন বৃহস্পতিবার। মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকলেন। উদ্দেশ্য সরকারকে জনগণের কাছে নিয়ে আসা। পাহাড়বাসীকে বোঝানো সরকার পাহাড়িদের পাশে এসেছে শুধু নবান্নে বসে নেই।
১৩। পায়ের তলায় মাটি চলে যাচ্ছে দেখে গুরুং বিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাংলা অত্যাবশ্যক করার ডাকের বিরুদ্ধে পাহাড়ি অস্মিতার ডাক দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন পাহাড়ে বাংলা পড়া মোটেই বাধ্যতামূলক নয়। আমরা চাইছি বাংলা ভাষাটা যদি কেউ নিয়ে পড়তে চায় পড়তে পারে – পাহাড়ে এটা ঐচ্ছিক থাকবে – চাইলে নেবে না চাইলে নেবে না। সোজা কথা।
১৪। কেউ জানুক ছাই না জানুক এটা বলা দরকার দিনাজপুরের ইসলামপুরে, কলকাতার কিছু জায়গায় উর্দু দ্বিতীয় ভাষা। বাংলা বোর্ডের মত এত বিচিত্র ভাষা নিয়ে পড়ার সুযোগ ভারতে কম রয়েছে।
১৫। ভাষা চাপের মোকাবিলায় গুরুংএর উচিত ছিল মুখ্যমন্ত্রীকে একটা ডেপুটেশন দিয়ে এই ঘোষণাটা মন্ত্রীসভার বৈঠকে পাস করিয়ে নেওয়ার পাল্টা রাজনৈতিক চাপ দেওয়া। তিনি জিটিএ প্রধান হিসেবে সেই পথে না গিয়ে সরাসরি গজমর প্রধান হিসেবে রাস্তার হিংসায় গেলেন। গুরুং ভাবলেন ভাষাকে হাতিয়ার করে হারিয়ে যাওয়া জাতিসত্ত্বার আন্দোলনের পালে হাওয়া দেওয়া যাবে।
১৬। তো গজমর জোরদার আন্দোলনে অনেকের মনে হল পাহাড় হাসছে কোথায় সে তো কাঁদছে। কিন্তু সত্যি কি তাই? ১০ জুন গুরুং গজমর কেন্দ্রিয় কমিটির বৈঠক ডাকলেন এবং সেই বৈঠকে তিনি মুখরক্ষার সমাধান বার করতে চাইলেন। স্বাভাবিক – তিনি বহু গর্জেছেন, গজমর আন্দোলনের বিরোধিতায় রাজ্য সরকার সেনাবাহিনী ডেকেছে। তো এমনি দল রোজ ভাঙছে, তাঁর পরে কিছু না করলে দল রাখা দায়।
১৭। মুখ রক্ষায় গুরুং বললেন বন্ধ চলবে কিন্তু জিটিএ, কেন্দ্রিয় সরকারের আর রাজ্য সরকারের দপ্তরগুলো বন্ধ থাকবে। এমনিতেই জিটিএর মেয়াদ ফুরিয়েছিল – দপ্তর খোলা রাখা না রাখা সমান। কেন্দ্রিয় সরকারের দপ্তর বলতে শুধু রেল – কিন্তু টয় ট্রেনটা চালু থাকল। এমন একটা হাস্যকর বন্ধ ডাকা হল যেখানে গাড়ি ঘোড়া চলছে, দোকানপাট খোলা থাকছে, লোক যাতায়াত করছে, যা কোন দিন বাংলা দেখে নি।
১৮। এরকম বন্ধ কিন্তু সুবাস ঘিসিং ডাকেন নি। সুবাস ঘিসিং ১৯৮৬তে যখন তখন ৯৬ ঘন্টা বন্ধ ডেকে সফল করতেন। তাঁর বন্ধ সত্যিকারের বন্ধ আর এটা কুশলী বন্ধ।
১৯। কেননা যে মালবাহক ১৯৮৬ সালে টকটকে লাল রঙের দুটাকা বা একটাকার বিনিময়ে মাল বইতেন তিনি ২০১৭ সালে ১০০টাকার কমে মাল বহন করেন না। যে হোটেল ভাড়া ছিল ১০০টাকা আজ সেটা বেড়ে হয়েছে দেড় হাজার টাকা। পর্যটনকে কেন্দ্র করে পাহাড়ের অর্থনীতি বিরাটভাবে পালটে গিয়েছে। যে মালবাহক মাসে ১৫০০০ টাকা রোজগার করছেন, তিনি চাইবেন না যে যখন তখন বন্ধ ডেকে তাঁর রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাক। এই ভর ঘোরার মরশুমে রোজগার যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে যে পাথর একদা পুলিশের দিকে তাক করা ছিল, সেটা গুরুঙ্গের দিকে যাবে।
২০। এর সঙ্গে খাঁড়ার ঘা হিসেবে সঙ্গে যুক্ত হল পুরসভার হিসেব চাওয়া। ঘিসিংকে কোন দিন সিপিএম ঘাঁটায় নি - চোখ বুজে থেকেছে। মমতা সিপিএম নয়। হিসেব চাইলেন। গুরুং বুঝেছিলেন খেল খতম। তাই মরিয়া লড়াই দিলেন। কিন্তু চাহিদা মত ফল ফলল কি?
তাঁর সিদ্ধান্ত
আজ পর্যন্ত যা ঘটেছে তাতে আপাতত এডভান্টেজ মমতা। ব্যাকফুটে গুরুং।

No comments: