জেমস হোলজম্যান(১৮২৫)
ভাবানুবাদ –
বিশ্বেন্দু নন্দ
অনুবাদকের আঙ্গটপাত
কলাবতী মুদ্রা "দ্বিতীয় ইতিহাসঃ লুঠেরা ইংরেজ, সাথী মধ্যবিত্ত, সাংস্কৃতিক গণহত্যা আর গ্রামীন স্বাধীণতা সংগ্রাম" নামক একটি অপ্রকাশিত খোঁজে বাংলার একটা সময় ধরতে চাইছে, যখন বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উত্তমর্ণ শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার গ্রামীন সমাজের তৈরি উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করে বাংলাকে পশ্চিমি, কেন্দ্রিভূত
অভিজাত-ভদ্র-মধ্যবিত্ত নির্ভর কর্পোরেট উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তিত করতে চাইল। পরিবর্তনের ধাক্কায় শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার গ্রামীন সমাজ অধঃপতিত হল এবং অভিজাত-ভদ্র-মধ্যবিত্তকে
সামনে রেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বকলমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে লুঠতে শুরু করে যাতে ইওরোপে বাংলার অযুত সম্পদ বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এবং লুঠেরা তথাকথিত শিল্পবিল্পবএর ভর্তুকি যোগাড় করা যায়।
সেই সঙ্গঠিত লুঠের ইতিহাস রমেশ দত্তর সময় থেকেই খুব ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে লেখা হয়েছে - এবং কাকে লুঠ বলা হবে তাই নিয়েও বিপুল বিতর্ক রয়েছে তিনি এবং পরবর্তীকালের মার্ক্সবাদীরা যেহেতু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে বাংলার পরিকাঠামো বিকাশ হিসেবে দেখেন, তাই এটা কোনদিনই লুঠ হিসেবে চিহ্নিত হয় নি - কিন্তু আমরা যারা গাঁইয়াদের সঙ্গঠন করি তারা কম্বুকণ্ঠে দাবি করছি - – কয়েকদিন আগের পাঁচটি ধারাবাহিকে এই নিয়ে যতটা পারা যায় আমাদের মত প্রকাশ করেছি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছাড়াও এই লুঠের কাজে গুরুত্বপূর্ন
ভূমিকা নিয়েছিলেন কোম্পানির কর্মকর্তারা যাদের কোম্পানি সাহিত্যে ইন্টারলোপার্স
আর নবোব বলে দাগানো হচ্ছে। ইন্টারলোপার্সরা হলেন কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাদের সমান্তরালভাবে ব্যবসা করা ব্রিটিশ আর নববেরা হলেন কোম্পানির বিভিন্ন পদে চাকরি করা কর্মচারি যারা কোম্পানির গোচরেই কোম্পানির ব্যবসা ব্যবস্থা নির্ভর করে নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যবসা করতেন আথবা ঘুষ বা অন্যান্যভাবে নিজেদের পদমর্যাদা ব্যবহার করে বিপুল ধানার্জন করে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হতেন।
কলাবতী মুদ্রার পক্ষ থেকে বিশ্বেন্দু নন্দ এবং পার্থ পঞ্চাধ্যায়ী এবং আরও কিছু মানুষ যৌথভাবে এই খোঁজের কাজটির দায়িত্বে আছেন। সেই খোঁজে ১৯২৫ সালে প্রকাশিত জেমস হোলজম্যানএর
নবোবস ইন ইংলন্ড – আ স্টাডি অব দ্য রিটার্নড এংলো-ইন্ডিয়ান ১৭৬০-১৭৮৫ বইটির মত অন্যান্য নবোব সম্বন্ধীয় বইও গুরুত্বপূর্ণ, কেননা লুঠের ইতিহাসে কোম্পানির কর্মচারীরাও বিপুল সম্পদ বাংলা থেকে লুঠে নিয়ে গিয়েছিল, যার সঙ্গঠিত ইতিহাস আজও লেখা হয় নি।
আশাকরি ওপরে উল্লিখিত বড় লেখাটির অংশ হিসেবে এই টুকরো ধারাবাহিকটি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে।
শুভেচ্ছা।
ভূমিকা
যতদিন না ক্লাইভের
বিচার শুরু হচ্ছে, ততদিন ব্যাঙ্গার্থে নবোব কথাটা ইংলন্ডে চালু হয় নি। ১৭৬১তে সালে
হোরেস ওয়ালপোল লিখছেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, কনকারারস, নবোব এন্ড ভিক্টোরিয়াস এডমিরালস
এটাক্টড এভ্রি বরো। কিন্তু লেখকের দাবি মোটামুটি ওয়ালপোল ১৭৬৪ থেকেই “মুঘল পিট
এন্ড নবোব বুটি” নামক একটি লেখায় এই শব্দটা নিয়মিত ব্যবহার করতে শুরু করেন। যদিও
বুটি কোনভাবেই নবোব ছিলেন না। য়ুল এবং বার্নলের হবসন-জবসনঃ আ গ্লসারি অব কলোকুয়াল
এংলো-ইন্ডিয়ান ওয়ার্ডস এন্ড ফ্রেজেসএ লিখছেন, অষ্টাদশ শতকে ক্লাইভ বিচার কাণ্ডে এই
শব্দটি তার বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার হওয়ার সময়, যারা পূব দেশ থেকে ফিরে আসতেন তাঁদের
উদ্দেশ্যে এবং (স্যামুয়েল) ফুটির নাটক দ্য নবোব(১৭৬৮) ব্যাপক প্রদর্শনের পর থেকেই
এই শব্দটা ইংলন্ডে বিপুল প্রচার পেতে শুরু করে। মোটামুটি পলাশীর পর থেকে যদিও
আস্তে আস্তে শব্দটা লন্ডনে শেকড় গাড়তে শুরু করেছিল। ১৭৭২এ যে সময় ফুটির নাটকটি
লন্ডনে মঞ্চস্থ হচ্ছে সেই সময়ে কিন্তু পার্লামেন্টে নবোবদের বিচারের প্রক্রিয়া
সারা বিশ্বের সামনে হাট হয়ে খুলে যাওয়ায় নবোব শব্দটার মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পরে নতুন
করে। এর আগে যারা এই শব্দটা ব্যবহার করেছেন তাঁদের অধিকাংশই কিন্তু উপাধি হিসেবেই
ব্যবহার করেছেন।
পলাশীর পরে যখন বেশ
কিছু ঘটনাক্রমে বেচারা জন কোম্পানির নৌকো টলমল করছে সে সময়েই নবোব শব্দটা লন্ডনে
জলচল হল। ১৭৭৩ সালে একজন বৃদ্ধ দুঃখ করছেন, নবোবদের রমরমার আগেই কিন্তু আমরা
ব্যবসায়িক মুনাফা (কমার্সিয়াল ডিভিডেন্ড) সহজে পেতাম। আদতে নবোব উপাধি ওয়ালা
মানুষেরা হলেন কোম্পানির কিছু ভৃত্য, যারা যারা ভারতে ব্রিটিশ রাজনৈতিক ক্ষমতাকে
ব্যবহার করে লাভবান হতে পারেন।
এই বইতে বলতে চেষ্টা
করছি কিভাবে নবোবেরা তাঁদের রোজগার খরচ করতেন। কিভাবে তারা সেই সম্পদ আহরণ করলেন,
সেটি কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসের অংশ – যদিও দুটি ব্যাপার একে অপরের সঙ্গে
অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, ফলে একের পর এক অধ্যায়ে আমি দেখাবার চেষ্টা করেছি কি করে
নবোবেরা সাফল্যের শিখরে চড়লেন।
ব্যবসায়ী আর
বিনিয়োগকারীদের(ফিনানসিয়ার্স) কাছে বরাবরই ভারত ছিল কয়েক প্রজন্মের পছন্দের এলাকা।
জশিয়া চাইল্ড এবং টমাস পিট নবোব-পূর্ব প্রখ্যাতদের মধ্যে অন্যতম। জশিয়া ভারতে না
গিয়েই প্রখ্যাত হন। আর পিট ইন্টারলোপার(হল কোম্পানির সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরালভাবে
ব্যবসা করা বণিক। সে কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার সনদ উপেক্ষা করে ব্যবসা করছে)
প্রথা অবলম্বন করে নিজের ভাগ্য ফেরান। ১৭৭২ সালে একজন ব্যঙ্গ চটি(প্যামফ্লেটিয়ার)
লেখক লিখলেন, খুব বেশি দূরের সময় নয় যখন পূর্বের দ্বীপপুঞ্জগুলিকে ধনার্জনের জন্য
ব্যবহার করা হত। কোম্পানির চাকরিতে ঢুকে কিছু মানুষ, যেমন রাষ্ট্র প্রধান তাদের
রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ধনী হয়ে ফিরতেন। যারা বিদেশে চাকরি করেছেন
তাঁরা কোম্পানির প্রতি আত্মসমর্পনের ঘোমটায় নিজেদের ভবিষ্যৎ পাকা করেছেন।
কোম্পানির চাকরিতে
কর্মিচারী নেওয়া হত সাধারণভাবে ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য। চাকুরেরা মোটামুটি
চারটে স্তরে বিভক্ত ছিলেন, রাইটার(করণিক), ফ্যাক্টর(কুঠিয়াল), জুনিয়ার মার্চেন্ট
এবং সিনিয়ার মার্চেন্ট। রাইটার হিসেবে চাকরি পেতে গেলে প্রাথমিকভাবে কোম্পানির
কোর্ট অব ডিরেক্টর্সে একটা বিশেষ বয়ানে আবেদন করতে হত। ...লেখা, অংক এবং সওদাগরী
হিসেবে(মার্চেন্টস একমপটস) আমি প্রথাগতভাবে শিক্ষিত হয়ে মান্যবরকে ভারতে কোম্পানির
প্রশাসনে করণিক পদে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার জন্য বিনীতভাবে আবেদন করছি এবং প্রয়োজনীয়
জামিন রাখার অঙ্গীকার করছি। এর সঙ্গে জুড়তে হত একটি জন্মপঞ্জী এবং যেখান থেকে পড়াশোনা
করেছে সেখানকার প্রধান শিক্ষকের একটি স্বাক্ষরিত প্রমানপত্র। চাকরির জন্য এই
আবেদনের পিছনে বা নিচে একজন না একজন ডিরেক্টরের স্বাক্ষর আবশ্যিক ছিল, না হলে
চাকরি হত না। চাকরিতে ঢোকার বয়স ছিল ষোল কি সতের।