বাংলায় শেকড় ছড়াচ্ছে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন
আত্মজার
Arunava শেষ দেখেই ছেড়েছিল এক বছর আগে। এক বছর ধরে Audrey Truschkeর অড্রে ট্রুস্কের "আওরঙ্গজেব দ্য ম্যান এন্ড দ্য মিথ" বইটা প্রদর্শন/বিক্রি করেছে আত্মজা পাবলিশার্স। আমরা আওরঙ্গজেব পড়তে শিখেছি আচার্য যদুনাথ সরকার ইত্যাদির একমাত্রিক ঐতিহাসিক বয়ানে। ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব আওরঙ্গজেব সাদা-কালোয় চিত্রিত হয়েছেন। সেই ব্যতিক্রমী কাজ বাংলায় নিয়ে আসতে পেরে আনন্দ হচ্ছে।
একরামূল হক শেখদাদা,
DillUr এবং আরও অনেকেই স্বইচ্ছায় বইটির প্রচার দিয়েছেন, তাঁদের অজস্র কৃতজ্ঞতা।
বইটা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীদের খুব কাজের। সব থেকে আকর্ষণীয় দিক, এটা আম-জনতার পাদটিকাহীন সুস্বাদু তরতরিয়ে পড়া যায় এমন জীবনী পাঠের বই যেমন, তেমনি যারা পাদটিকা-রসে বঞ্চিত না থেকে মানুষটার ঐতিহাসিক তাত্ত্বিক রূপ রস গন্ধ খুঁজবেন, তারাও অসামান্য রসদ পাবেন। ট্রুস্কে বেশ কিছু ফার্সি ভাষার পাণ্ডুলিপি থেকে তথ্য আহরণ করেছেন যেগুলি আজও প্রকাশনার মুখ দেখে নি।
অড্রে বইতে সরাসরি বলেছেন আওরঙ্গজেব ইতিহাসের খলনায়ক কেন। তারমানে এই নয় অড্রে আওরঙ্গজেবকে মহান বানাবার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। নানান অনৈতিক কাজের সমালোচনা যেমন করেছেন তেমনি আওরঙ্গজেবকে যেভাবে ঔপনিবেশিক ইতিহাস খলনায়ক বানিয়ে তার প্রয়োজনীয় সম্মানটুকু থেকে বঞ্চিত করেছেন, তিনি সেই ঐতিহাসিক ভুলটা খণ্ডন করেছেন।
আশাকরি বাংলা প্রকাশনা জগতে ট্রুস্কের বইটা নতুন করে বিতর্ক জাগাবে এবং ইতিহাসে সব থেকে ঘৃণিত পাদশার অন্তঃস্থলে অবশ্যই পৌঁছবার চেষ্টা করবে বাঙালি। এইটুকু তো আশাই করা যায়!
----------------------------------------
স্পষ্ট করে কতগুলো কথা বলা দরকার। অড্রে ট্রুস্কে হিন্দুত্ববাদী এবং তাদের জনক ঔপনিবেশিক ইতিহাসকারদের কাছে ঘৃণিততম ব্যক্তিত্ব আওরঙ্গজেবকে নিয়ে কলম ধরেছেন। নেটে গেলে বুঝবেন কিভাবে হিন্দুত্ববাদী ওয়েবসাইটগুলো তার বিরুদ্ধে গোলাগুলি চালাচ্ছে। বলা দরকার হিন্দুত্ববাদীদের ঘৃণার বারুদে জল ছেটানোর কাজ করছেন ট্রুস্কে নিয়মিত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিপক্ষে লিখে।
আমাদের কাছে আওরঙ্গজেব এবং তাঁর সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেই যে আওরঙ্গজেব মারা যান পলাশী চক্রান্তের ঠিক ৫০ বছর আগে। ফলে আমরা যারা ঔপনিবেশিক পূর্ব সময়কে, উদ্বৃত্ত অর্থনীতির দেশ বাংলা তথা সামগ্রিক উপমহাদেশের অবস্থা কারিগরদের চাষীদের অবস্থা জানতে চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই আওরঙ্গজেবকে এবং তাঁর সময়কে জানতে হবে। এই উদ্বৃত্ত অর্থনীতির কিছুটা শ্রেয় আমাদের দিতে হবে আওরঙ্গজেবকেও। তাই ট্রুস্কের বইটাকে ধরা।
আরও একটা বড় ব্যাপার হল, সাধারণতঃ শিক্ষাক্ষেত্রের গবেষণা সংক্রান্ত বইগুলি হয় ধরিমাছ না ছুঁই পানি অথবা সরাসরি উপনিবেশের পক্ষে বিবৃতি দান গোছের। অড্রে ট্রুস্কে সে পথ সযত্নে পরিহার করেছেন, বরং সজোরে তাঁরা ধারণা প্রকাশ্যে বিবৃত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করেন নি।
অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব সংক্রান্ত গবেষণা কতটা সমসাময়িক সেটা বোঝা যায় এই তিন মন্তব্যে -
১) "ভদ্রবিত্তিয় দৃষ্টিভঙ্গীতে কোন এক বড় কাঠামোর পতনের কারণ(মোঘল সাম্রাজ্য পতনের কারণ) খোঁজার সমস্যার সমাধানের গল্প তৈরি হয় সেই ঝামেলার একটি নৈতিকতা নির্ভর গল্প তৈরি করে, সেই গল্পে, সেই পরিবেশে একজন নায়ককে দুর্বৃত্ত হিসেবে গুঁজে দিয়ে, সেই বেঁড়ে ব্যাটাকেই বিশাল বড় সাম্রাজ্যের পতনের মুল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করায়। আজকাল ইতিহাসে মুসলমানেদের দুর্বৃত্ত দেখানোটাই চল হয়েছে। আওরঙ্গজেবের ঐতিহাসিকদের সহজ টার্গেট হন তার গভীর ধর্মচর্চার কারণে।"
২) "আওরঙ্গজেবকে নিয়ে দুটি ভাষ্য বাজারে চালু রয়েছে – ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেব এবং ধার্মিক আওরঙ্গজেব। এই দুটোই বিভ্রান্তকারী – এবং বহু সময় বিধ্বংসীও বটে – যেভাবে অতীতে ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেবকে উপস্থাপন করা হয়েছে হিন্দু আর হিন্দুস্থানের ধ্বংসকারী হিসেবে। রাজনৈতিক নেতা এবং অন্যান্যরা ভারতে এই ধারনাটা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন মুসলমান বিরোধিতা এবং বিদ্বেষ চাগিয়ে তোলার জন্যে এবং ভারতীয় মুসলমানেদের দাগিয়ে দেন বিপজ্জনক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। আওরঙ্গজেব নিজে গোঁড়া মুসলমান ছিলেন এই ধারনাটাও সমস্যার – মহম্মদ ইকবালের ভাষায় Muslim—an Abraham in India’s idol house। এই ধারনাটির প্রতীতিটি হল মুসলমানেদের মূলত ধার্মিক বিশ্বাসেই নির্ভরতা এবং ইসলামের সঙ্গে হিন্দুত্বের সঙ্গে ইসলামের তফাত ঘোচার নয়। ভারতের ক্ষেত্রে এটার অর্থ সমঝে দেওয়া হয় মুসলমানেরা পুরপুরি ভারতীয় হতে পারে না, উল্টো দিকে পাকিস্তানের বয়ান বলে সব নাগরিককে একটা নির্দিষ্ট ধরণের ইসলামের অনুগামী হতেই হবে।"
এবং
৩) “তিনি আধুনিককালের আধুনিক মনন সঞ্জাত হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব তৈরিতে উৎসাহীই ছিলেন না – বরং তিনি যাকে ন্যয় বিচার বলে ভাবতেন সেটি দেওয়ার চেষ্টা করতেন, মুঘল প্রথা অনুসরণ করতেন এবং উপমহাদেশে তাঁর পকড় বজায় রাখার উপায় বার করতেন।”
গত এক বছর সহৃদয় পাঠকেরা নতুন এক আওরঙ্গজেবের জন্যে উৎসাহী হয়েছেন। যুবা প্রকাশককে ধন্যবাদ এ ধরণের ব্যতিক্রমী বই বাজারে আনার সাহস দেখাবার জন্যে।