Sunday, December 1, 2019

তৈমুরী বংশের সিংহাসনের লড়াই - আওরঙ্গজেবের দায়

Abhishek Sarkar ভায়ের সঙ্গে মাস ছয়েক আগে দারা আওরঙ্গজেব বিষয়ে বেশ আকর্ষণীয় বিতর্ক হচ্ছিল। শুরুতে তার বয়ানের এক অংশ দিলাম। বলা দরকার ওর সাথে অনেকটা একমতও, আবার নয়ও।
অভিষেকের বয়ান-
দারা তো জানেন আপনারা, শাহজাহানের সেই ছেলে, তীব্র ধর্মান্ধতার মোহে আপন ভাই ঔরঙ্গজেব যাকে কোতল করান। তখতের জন্য বড়ো বেমানান এমন মানুষ তিনি।
<<তারপরে আমাদের প্রতিবাদ ছিল। উত্তরে অভিষেক লিখলেন >>
সময়টা ভাবুন বিশ্বেন্দুদা। দারাকে মহান সন্ন্যাসী বলছি না। কিন্তু যে সময় সবার উচ্চাশা তাদের কিছুক্ষণের জন্য হলেও অমন করে তোলে সেখানে দারা একটা মিশ্র সভ্যতার স্তম্ভগুলো খুঁজছেন, ভাবছেন নৈকট্যর কথা- তাও আবার মাটিতে নয় রাজবংশে থেকে! এইটা বিপুল একটা অগ্রতা নয়!
এই কারণেই বেমানান বলছি। দারা তখতে আসলে ভারতের ভবিষ্যৎ অন্যরকম হত বলছি না। বলছি উনি তখত চালাতেই পারতেন না। সাম্রাজ্য আরও আগেই পড়ত। নাদির শাহ মাফিক কেউ আরও আগেই আসত।
আমি বুঝছি আপনি ইউরোপমন্য গুড মুসলিম ও ব্যাড মুসলিমের ভ্রান্ত তত্ত্ব থেকে সাবধান করতে চাইছেন। কিন্তু রোম্যান্টিকতা বাদ দিলেও মাজমার অপরিসীম গুরুত্ব আজকের যুগে ব্যক্ত হওয়া প্রয়োজন। দারার স্বার্থে নয়, দেশেরই স্বার্থে।
এবারে আমাদের বয়ান-
তৈমুরী বংশে প্রত্যেক শাহজাদাকে নিজেকে প্রমান করেই সিংহাসন দখল করতে হয়েছে এবং এটা বরাবরই রক্তক্ষয়ী ছিল। আমরা ইতিহাসে শুধু আওরঙ্গজেবের দোষ দেখি।
অবশ্যই আওরঙ্গজেব তখতলোলুপ ছিলেন। কে ছিলেন না? আকবর ছিলেন না? আকবর ভাইদের, সাথীদের খুন করেন নি? শুধুই আওরঙ্গজেব ধান্ধাবাজ ছিলেন? তৈমুরী বংশে কে ছিলেন না? আওরঙ্গজেব মহান ছিলেন না। তার ক্ষমতার ক্ষুধা ছিল। ভারতীয় কোন রাজবংশে কার ছিল না। তাঁর অনেক কাজই সমর্থন করা যায় না, কিন্তু তিনিই একাই কুলাঙ্গার ছিলেন এটা একপেশে যদুনাথীয় বয়ান হয়ে গেল। তিনি প্রচুর পাপ কাজ করেছেন সন্দেহ নেই। যে লড়ায়ের কাজটা বংশের প্রথা, সেটি জন্যে আওরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ বলাটা চরমতম অনৈতিহাসিক এবং অন্যায়।
তৈমুর বংশে সিংহাসনের সঙ্গে জুড়ে থাকা আত্মীয়রা সিংহাসনের জন্যে প্রতিযোগিতা করতে পারত। শাহাজাদাদের জীবন তত্ত্ব আলোচনায় মুনিস ফারুখি দেখাচ্ছেন স্বয়ং আকবর তাই করেছিলেন এবং এই প্রথা আওরঙ্গজেবের পরের সময় অবদি চালু ছিল। আকবর তাঁর সিংহাসন দখল নিষ্কন্টক করার জন্যে যত প্রতিযোগী হতে পারে তাদের হত্যা করেন। তাঁর সময় তুতো ভাইরাও সিংহাসনের দাবিদার ছিল। তৈমুর বংশের বংশলিকার ওপরের অংশ ছাড়া বংশের কেউ আগামী দিনে সিংহাসনের জন্যে লড়াই করতে পারবে না, অর্থাৎ তুতোভাইদের সিংহাসনের লড়াই থেকে বার করে দেওয়ার নিয়ম চালু করলেন আকবর। প্রতিযোগিতা শুধু সম্রাটের পুত্র, আইনি উত্তরাধিকারীদের জন্য নির্দিষ্ট হল। তাঁর উত্তরাধিকারীদের জন্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটা ছোট করে দিলেন, লড়াই কমল। কিন্তু মূল নিয়ম বদলাল না। আবারও বলি মহান আকবরও তাই করেছেন, আমরা মহান টহান বলে এড়িয়ে যাই।
এবারে অড্রের বয়ান -
"আওরঙ্গজেবের আত্মীয়-হত্যাকর্ম অবশ্যই আধুনিক পাঠকের বিবিমিষা উদ্রেক করবে, কিন্তু প্রশ্ন হল তার ভায়েরা ক্ষমতায় এলে কি অন্য কোন পথ নিতেন? মানুচি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে এই বিষয়টা ধরেছেন। মৃত্যুদণ্ডের দিন আওরঙ্গজেব দাদাকে প্রশ্ন করলেন, তিনি কি করতেন যদি পাশার দান পাল্টে যেত? দারা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করেই উত্তর দিলেন তিনি আওরঙ্গজেবের দেহ খণ্ড খণ্ড করে কেটে দিল্লির সদর দরজায় ঝুলিয়ে রাখতেন। আওরঙ্গজেব দাদার মৃতদেহ হুমায়ুনের সমাধি পাশে কবর দ্যান।
মুঘল প্রথা অনুসরণ করে আওরঙ্গজেব দারা শুকোর সমর্থক এমন কি তার অন্য ভাইদের প্রতি ধৈর্য এবং বিবেচনাও প্রদর্শন করেন। তিনি তার ভায়ের সৈন্যবাহিনী এবং পরামর্শদাতাদের নিজের প্রশাসনে যোগ দিতে সাদরে আহ্বান জানান। মুরাদ গুজরাটি ধনী জৈন সওদাগর শান্তিদাসের থেকে যে বিপুল অর্থ ধার নিয়েছিলেন, সে ধার আওরঙ্গজেব শোধ করে দ্যান। ১৬৭০ সালে আওরঙ্গজেব তার কন্যা জুবদাতুননিসা সাথে দারার ছোট ছেলে সিপিহার শুকোর আর সুলেইমান শুকোর কন্যার সঙ্গে শাহজাদা আকবরের বিবাহ দ্যান। দারার ধর্মগুরু শরমাদএর মত আরমেনিয় ইহুদি, যিনি অভক্ত নামে পরিচিত, তার মত কয়েকজন মাত্র হাতে গোনা আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণ্য পায় নি। ইনি আওরঙ্গজেবের দাদার জয়ের দৈববাণী করেছিলেন। ১৬৬১তে আওরঙ্গজেব শরমাদকে হত্যা করেন।"
----
জগদীশ নারায়ণ সরকারের মীর জুমলা, মুনিস ফারুখি এবং অড্রে ট্রুস্কে বা আমার অনুবাদ করা আহকমইআলমগিরির(আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান) গপ্প আর তথ্যগুলি পড়লে দারার মূল চরিত্র স্পষ্ট হয়।

No comments: