কয়েকদিন পুর্বে বন্ধু সৈকত ভট্টাচার্য কোরিয় রাজবংশে ভারতীয় এক রাজকন্যার বিবাহের সূত্র পাঠান। সেই সুত্র ধরে ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে ফিরে যাওয়ার সে গল্প আপনাদের জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না।
৪৮ সালে অযোধ্যার রাজারাণী স্বপ্নাদিষ্ট হলেন তাদের কন্যার জন্য দূর দেশের এক রাজা অপেক্ষা করছে। তাকে সেখানে বিয়ের জন্য পাঠাতে হবে। কোরিয় দেশেও এক আকাশজাত রাজা কিইম সুরোও একই প্রত্যাদেশ পান।
স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী রাজকন্যা সুরি রত্ন - শ্রী রত্ন পূর্ব ভারতের কোন এক বন্দর থেকে রওনা হন। কোরিয়া পৌঁছন - মনে রাখতে হবে কোরিয়ায় বৌদ্ধপন্থ গিয়েছে তারও ৩৫০ বছর পর। তাঁদের বিবাহ হয় - সন্তানদের কেউ কেউ মায়ের উপাধি বহন করেন। আজও। দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের ৫০-৬০ লক্ষ মানুষ মনে করেন তারা সুরিরত্নের উত্তরাধিকার বহন করছেন।
ভারতীয়রা ভুলে গেলেও কোরিয়রা সেই স্মৃতি আজও ভোলেন নি। তারা রাজা সুরো আর রাণী সুরির বিবাহের দিন স্মরণ করতে ফাল্গুণ চৈত্র মাসে অযোধ্যায় আসেন। গোষ্ঠী অধিপতিরা সেখানে রাণীর একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে দিয়েছেন।
এই সাধারনতম চমকহীন গল্প বিশ্লেষণের দুটি অংশ একটা ভারত-কোরিয়া দৌত্য অন্যটি পূর্ব ভারতের দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার ইতিহাস। আমাদের আকর্ষণের অংশ দ্বিতীয়টি। অযোধ্যা কিন্তু উপকূল থেকে বহুদূরে অন্তত ৫০০ ক্রোশ। তাও ষোড়শী রাজকন্যা বা তার পিতামাতা সমুদ্র যাত্রায় পরান্মুখ হন নি - এবং যে দেশে যাচ্ছেন সেটাও পূর্ব ভারতের আকছার সমুদ্র যাত্রা করা নাবিকদের কাছে খুব চেনা দেশ নয় - প্রতিবছর নাবিকেরা ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া বা চম্পা পর্যন্ত সহজেই যেতেন বাণিজ্য বা দৌত্য বা যুদ্ধ যাত্রায় - কিন্রু কোরিয়ায় খুব যেতেন এম্ন ইতিহাস বোধহয় নেই - কিন্তু সেটাও তারা করলেন। মনে হয় ভারতে তখন সমুদ্র যাত্রা খুব সাধারণ ঘটনা ছিল - তা রাজ্যবেষ্টিত অযোধ্যা হলেও রাজারানী কিন্তু মেয়েকে দীর্ঘ তিনমাসের সমুদ্র যাত্রায় পাঠাতে দুবার ভাবেন নি।।
আমরা কল্পনা করতে পারি, সুরি রত্ন আর তার সঙ্গীরা বঙ্গোপসাগরের পুরী বা তাম্রলিপ্ত থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ এবং উত্তর চীন সমুদ্র হয়ে দীর্ঘ তিন মাসের সমুদ্র পথ পেরিয়ে পৌছলেন কোরিয়ায় এবং সেখানে সাদর আমন্ত্রণ পেলেন। দুহাজার বছর আগে খুব সাধারণ ঘটনা ছিল না।
বা এই ধারণা 'দুহাজার বছর আগে খুব সাধারণ ঘটনা ছিল না'ভাবাটা হয়ত আজ ঔপনবেশিক আমার ভদ্রলোকিয় মেকলের উত্তরাধিকার বহনের মানসিকতা - তিনি বা ট্রেভলয়নের তৈরি করা পশ্চিমি বিশ্ব-ইতিহাস প্রযুক্তির বিকাশের একরৈখিক ভাবনা গাঁথা মনে তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু তখন হয়ত বণিক-নাবিকরা শুদ্রদের বিকশিত কলন আর মহাকাশ বিদ্যা চর্চা করতেন অবলীলায় - তাদের কাছে তা ছিল জলবত্তরলং।
কোরিয়ায় সুরি রত্নের একটি সমাধি রয়েছে রবং তা ভারতীয় এবড়োখেবড়ো পাথরে তৈরি - সেই পাথরটির আশ্চর্য নাম সমুদ্র দেবতাকে শান্ত করা পাথর। সেই পাথর কিন্তু আশ্চর্য কন্যা শ্রীরত্ন নিজে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের ধারণা তার যাত্রাপথ সুরক্ষার একটা ব্যবহারিক কারণের জন্যও বটে। সেগুলি জাহাজের খোলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যাতে সমুদ্র পথে তীব্র ঝড়ঝঞ্ঝায় জাহাজ উলটে না যায় - দাঁড়িয়ে থাকে। ততদিনে নাবিকদের দীর্ঘ দিনের সমুদ্রযাত্রা পথে জাহাজের খোল ভারি করার অভিজ্ঞতাটি হয়ে গিয়েছিল - ঠিক যেমন করে ডাচেরা বাঙলার সোরা সরকার সারণ থেকে জাহাজের খোল ভারি করে নিয়ে যেতেন তার প্রায় দেড় হাজার বছর পরে ভারতীয় নাবিকদের দেখান রাস্তায়।
অর্থাৎ গল্পগুলি নতুন করে আমাদের বের করা দরকার। দরকার এই জনই যে দীর্ঘদিন ধরে দেশিয় জ্ঞানচর্চা নিয়ে ইতিহাস রচনায় ভদ্রলোকিয় ঔপনিবেশিক অবহেলা থেকে বেরোনো আর নিজেদের ঐতিহ্যকে সুকঠিন এক ভিত্তিভূমিতে দাঁড় করানো।
জয়াদি বলেন যে নিজের ইতিহাস জানেনা সে খড়ের মানুষ।
আমরা নিজেদের ইতিহাসে ফিরতে চাই।
সুরি রত্নের ইতিহাস আলোচনা সেপথে আমাদের এগিয়ে দেয়।