Friday, February 4, 2011

সাম্রাজ্যের বন্ধুরাঃ উচ্চ-মধ্যবিত্তের ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ১০


১৯২৯এর ১৫ ডিসেম্বরএ টাউন হলে নীলচাষের পক্ষে আয়োজিত এক সভায় রামমোহন বলেন তিনি বাংলা আর বিহার ঘুরে দেখেছেন নীল চাষী রায়তেরা বেশ সুখে স্বচ্ছন্দে দিনযাপন করছে, ভাল জামাকাপড় পরছে সেই সভাতেই দ্বারকানাথ বলেন তাঁর বাংলার নানান এলাকায় জমিদারি রয়েছে, আর নীলচাষে রায়ত আর নীলকর উভয়েই লাভবান হয়েছে এরপর রামমোহন আর দ্বারকানাথের সই করা একটি প্রস্তাবনা লর্ড বেন্টিঙ্কের চরমতম সুপারিশ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠানো হয় নীলকরেরা কিন্তু ১৮৩০এর বেন্টিঙ্কের পঞ্চম আইনেও খুশি ছিল না এই আইনে বলা ছিল, দাদন নেওয়ার পর যদি কেনও রায়ত নীল চাষ না করে, তাহলে তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে সোপার্দ করা যাবে
নীলকরদের আরও বেশি অত্যাচারকে আইনি বৈধতা দেওয়ার ব্রিটিশ-শহুরে ভারতীয়দের আন্দোলন পার্লামেন্টেও পৌঁছয় ১৯৩১এ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটি রামমোহনকে সনদসহ নানান বিষয়ে ৫৪টি মূল আর ১৩টি অতিরিক্ত প্রশ্ন করে একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভারতে ইওরোপিয়দের জমি কেনার ফলে শিক্ষাবিস্তার, শিল্পায়ণ, কৃষিতে বিনিয়োগএরমত নয়টি সুফল ভোগকরতে পারে ভারত এই ভাষাতেই আজকের বিদেশি বিনিয়োগের প্রবক্তারা ওকালতি করেন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের যদিও তিনি কয়েকটি নগন্য কুফলের কথাও বলেন রামমোহনের বক্তব্য পার্লামেন্ট রিপোর্টে গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হলে, এর বিরুদ্ধে বাংলার জমিদারেরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রতিবাদপত্র পাঠান এমনকী লর্ড মেকলেও রায়তদেরপ্রতি নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেন ১৮৩৩এর সনদের ৮১ থেকে ৮৬ ধারা ভারতে ব্রিটিশ নাগরিকের যথেচ্ছ জমি কেনার আর বসবাসের সুযোগ এনে দেয় ১৮৩৩এর সনদের প্রভাব ভারতীয় সমাজ অর্থনীতিতে সূদূর প্রসারী হবে এই কজে, রামমোহন-দ্বারকানাথ জুটিটি সাম্রাজ্যের যে দায় নিজেদের বৃষসমস্কন্ধে তুনে নেবেন, তা আগামী দিনে ভারতে ঔপনিবেশিক দর্শনের ভিত গড়তে যোজনপ্রমাণ সাহায্য করবে
১৮০০ শতক পর্যন্ত ভারতের বাজারে ব্রিটিশ দ্রব্যের চাহিদা ছিলই না প্রায় তাই ভারতে প্রবাদ প্রতীম ম্যানচেস্টারের মিলগুলি প্রায় ধুঁকছিল ১৭০০, ১৭২০তে দুবার ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় বস্ত্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয় ১৭৫৭ পর্যন্ত ব্যবসাটা প্রায় একতরফা ছিল নানান দ্রব্যের বিনিময়ে ভারত বিদেশ থেকে সোনা আনত ৫৭রপর ভারতই ব্রিটেনে একমাত্র উপনিবেশ যাকে চালানোর সাম্রাজ্যকে অর্থ ব্যয় করতে হত না, বরং ভারত থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ নিয়ে ব্রিটেনের অর্থনীতির চাকাতো চলত বটেই, এমনকী অন্যান্য উপনিবেশের অর্থনীতিও গড়গড়িয়ে চলত ১৮৩৩এর সনদ (আর এর সঙ্গে রামমোহন-দ্বারকানাথের সরাসরি ওকালতি) গৃহীত হওয়ার পরেই ভারত থেকে ব্রিটেনে কাঁচামালের রপ্তানির বহর বেড়ে যায় বহুগুণ ভারত থেকে ব্রিটেনে ১৮১৩তে ৯ মিলিয়ন পাউণ্ডের সুতো রপ্তানি হত ১৮৩৩এ তার পরিমান বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ মিলিয়ন আর ১৮৪৪ সালে সেই রপ্তানির পরিমান দাঁড়ায় ৮৮ মিলিয়ন পাউণ্ড সনাতন ভারতের কারখানাগুলোর শ্মশান যাত্রা শুরু হয়, গ্রামীণ বাজার ধংস হয় ভারতের বাজার ব্রিটিশ উত্পাদনে ছেয়ে যায় ব্রিটিশ সভ্যতার অসীম অত্যাচার সয়েও ভারতীয় শিল্প যতটুকু উত্পাদন করছিল তার অধিকাংশ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে গ্রামে গ্রামে সমাজে সমাজে এই সময় থেকেই ব্রিটেনের জিডিপি দুই অংকের ওপরে উঠতে শুরু করে(এ প্রসঙ্গে ১৯১৩কে ভিত্তিবর্ষ ধরে ব্রিটেনের ঐ সময়ের জিডিপির ইতিবৃত্ত ১৭২০-২১ ২.১, ১৭৬০-৬১ ২.৬, ১৭৭০-৭১ ৩.৩,, ১৭৮০-৮১ ৩.৫, ১৭৯০-৯১ ৪.৬, ১৮০০-০১ ৫.৭, ১৮১০-১১ ৭.১, ১৮২০-২১ ৯.৭, ১৮৩০-৩১ ১৮.৩, ১৮৪০-৪১ ১৯.৬ লক্ষ্য করুন ১৮০০র পর থেকে জিডিপি ৫এর উর্ধমুখী আর ৩০এর পর লাফিয়ে দুই অংক ছাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে কুড়ির ঘরে প্রবেশ করেছে) শিল্পবিপ্লবের বেশকিছু হাতিয়ার যেমন স্পিনিংজেনি - স্বচলমাকু, ৭০ বছর আগে আবিষ্কার হলেও, পড়েছিল ঠাণ্ডাঘরে তাকে চালানোর জন্য ভর্তুকির অর্থনীতির বাজারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল একটু একটু করে- সাম্রাজ্যের পাখির চোখ ছিল ভারতীয় বাজারেই দিকেই ১৮৩৩ থেকে সেই ভারতীয় বাজারে লুঠপ্রতীমব্যবসা আর চিনকে ঘাড় ধরে আফিমে বুঁদ রাখার ব্রিটিশ ব্যবসারঘোমটারআড়ালে লড়াই(যদিও দুবার আফিম যুদ্ধও হয়েগেছে) - যার অন্যতম বাঙালি অংশিদার দ্বারকানাথ-রামমোহনসহ বেশকিছু ব্রিটিশ রেনেসাঁর উপজাত শহুরে জনগোষ্ঠী আর পারসি সমাজের অংশিদার, কামা, জেজে, টাটারা (ব্যবসায়ী পারসিদের আফিম ব্যবসার অর্থে গড়ে উঠেছে আজকের মুম্বই) - খুলেদিল শিল্পবিপ্লবের হাঁ মুখ ব্রিটিশ লুণ্ঠনে ৭০ সাল ধরে একাদিক্রমে ভারতীয় শিল্পধংসকরণ প্রক্রিয়ায় ভেঙেপড়া ভারতীয় শিল্প সমাজের জ্বলন্ত চিতায় শেষ কাঠ ১৮৩৩এর সনদ আর সাম্রাজ্যের আফিম আর নীলকরদের ভারতীয় বন্ধুদের উপনিবেশ গড়ার আন্দেলনের চক্রান্ত ভেঙেদেবে সনাতন ভারতীয় সমাজের শেষতম শিক্ষাব্যবস্থা আর শিল্প কাঠামোটিও এর পরই ত্রিশের দশকের শেষ থেকে ম্যানচেষ্টারের মিলগুলোতে স্বচলমাকু ঘুরতে থাকবে দুর্দম গতিতে, প্রায় বিনাব্যয়ে ব্রিটেনে পাঠানো ভারতীয় কাঁচামালের ওপর ভিত্তিকরে
রামমোহন আর দ্বারকানাথ, ভারত সমাজ ধংসে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেও আধুনিক ভারতের প্রথম আধুনিক কারিগর-বুদ্ধিজীবি হয়ে উঠতে পারেন, আর যে সব নীলচাষী তাদেরমত আধুনিক মানুষের অত্যাচার সয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন তারা থেকে যান নীরবে নীল বা আফিম বিদ্রোহের কেনো স্মরণ তিথিও পালিত হয়না কার্ল মার্কসএর ভাবশিষ্য সুশোভন সরকারও রামমোহন-দ্বারকানাথপ্রমুখদের এই বিদ্রোহ বিরোধী, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদপন্থী আন্দোলনের পথ সরাসরি সমর্থন করতে বাধ্যহন কেননা তাঁদের গুরুঠাকুর কর্ল মার্কস নিজেই ভারতকে পশ্চাদপদী দেশ হিসেবে অভিহিত করে গিয়েছেন, তাই তাকে চোখের মাথা খেয়ে অস্বস্তিকরভাবে সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুদের সমর্থন করতে হয় এ পাপ তোমার এ পাপ আমার!
মনেরাখতেহবে, গ্রামীণ সমাজ লুঠেরা ব্রিটিশকে এক দিনও সুখে থাকতে দেয়নি বছরের পর বছর ধরে তারা হাতে অস্ত্র তুলেছে, ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে সরকারকে কোটি কোটি গ্রামীণ বিদ্রেহী বাঙালির সঙ্গে যুদ্ধে রক্ত হোলি খেলেছে ব্রিটিশ, মন্বন্তরের পর মন্বন্তরে নির্বিকারে কোটি কোটি বাঙালি আর ভারতীয় মেরেও সে সভ্য জাতি জগত্সভার হর্তাকর্তাবিধাতা সে সমাজের জাগতিক সম্পদ লুঠ, সমাজের জ্ঞাণ-প্রযুক্তি চুরি আর সমাজের হাজার হাজার বছর ধরে যে শিল্প পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল, তাকে ধংস করার প্রতিক্রিয়ায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ঘড়ুই বিদ্রোহ, খয়রা মাঝি বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ, নীল ও আফিম চাষী বিদ্রোহ, মালঙ্গী বিদ্রোহ, পাহাড়িয়া বিদ্রোহ, সুবান্দিয়া বিদ্রাহ, নায়েক বিদ্রাহ, গারো বিদ্রাহ, ওয়াহবী বিদ্রাহ, ফরাজী বিদ্রোহ, সাঁওতাল-মুণ্ডা বিদ্রাহ, সিপাহি বিদ্রোহের পর বিদ্রোহের আগুনে যখন ফেটে পড়ছ ভারতীয় সনাতন সমাজ, তখন কলকাতায় বসে রামমোহন আর দ্বারকানাথের সুযোগ্য নেতৃত্বে বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা প্রাণপনে চেষ্টা করে চলেছেন কীভাবে ব্রিটিশ সরকারের আরও ভালভাবে সেবা করা যায়, ব্রিটিশ চক্রান্তে সমাজেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলার সরকারি কোম্পানির পরিকল্পনায় যথাসাধ্য বুদ্ধি নিয়োগ করে রাজাবাহাদুর, রাযবাহাদুর, রাজা উপাধি অর্জন করা যায়, সরকারের সঙ্গে মিলে মানুষ লুঠের ব্যবসায় আরও ধনী হওয়া যায়
রামমোহন বা দ্বারকানাথ শুধু নয়, সে সময় অধিকাংশ শহুরে মধ্যবিত্তই ব্রিটিশদের প্রশ্রয়ে সনাতন ভারতের বিদ্রোহের বিরুদ্ধে প্রাণপাত করে উপনিবেশের পক্ষে সবলভাবে দাঁড়িয়েছেন কেউ জানেন না নীল বিদ্রোহের সাহিত্যিক রূপকার দীনবন্ধু মিত্র শেষ বয়সে লুসাই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে রায়বাহাদুর উপাধি অর্জন করেন দুর্জনদের বক্তব্য দীনবন্ধু কুকি বিদ্রোহের সময় আসমের ডাক প্রধান ছিলেন তিনি কুকি বিদ্রোহীদের চলাচলের সংবাদ ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিক্রয় করে বিদ্রোহ ধংসের অন্যতম কারবারি হয়ে ওঠেন শেষ বয়সে কোম্পানি সরকার নীল দর্পণের লেখককে তার বিদ্রোহ দমনের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সরকারি রায়বাহাদুর উপাধি দান করেন আর ভারতের গ্রামীণ সমাজের প্রতিনিধি, তিতুমীর নীল চাষীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে নারিকেলবাড়িয়ায় কর্নেল স্টুয়াটের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বাহিনীর মোকাবিলা করেনবীর তীতুমীর যুদ্ধ শহীদ হনতার প্রধান অনুচর ও সহকারী গোলাম মাসুম ৩৫০ জন বিদ্রোহীসহ বন্দী হলেনগোলাম মাসুমকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয় শহুরে ব্রিটিশ বন্ধুদের মুখোশ না খুলতে পারার লজ্জা তার সঙ্গে বিদ্রাহীদের স্মরণ না করার লজ্জা, এই দুই লজ্জা আজও অধিকাংশ শহরবাসীকে কুরে কুরে খায় না চক্রান্ত কী আজও চলছে না!
শিক্ষত পূর্বজদের সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে, নতমস্তকে আর বিনীতভাবে বলা যাক, এই সামান্য লেখায়, ক্ষুদ্র সামর্থে বাংলার যেসব স্বাধীনতাপ্রিয় সমাজ, পলাশি চক্রান্তের পর থেকে কোম্পনির শাসনের বিরুদ্ধে জান-প্রাণের পরোয়া না করে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছে, নতুন সময়ে বসে নতুন করে স্মরণ করতে চেষ্টা করি, শ্রদ্ধা জানাই সেইসব আপাতশান্ত অথচ স্বভাববিদ্রাহী সমাজের কাণ্ডারীদের, যারা তিল তিল করে পূর্বজদের বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলা বাংলার সমাজের একটির পর একটি গ্রন্থি ভাঙতে দেখে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়ে ছিলেন উপনিবেশের গ্রাস থেকে তাঁরা বাংলার সমাজ বাঁচাতে হয়ত সফল হননি, কিন্তু ব্রিটিশতামুকখাওয়া শহুরে ভারতের তৈরি সর্বগ্রাসী উপনিবেশিকতাবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে প্রায় দেড়শ বছর ধরে বিদ্রোহী সমাজগুলির মাথারা উপনিবেশিক সরকারের তৈরি রূদ্ধপথভাঙার পথ তৈরি করে গিয়েছিলেন, তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাকে ভালবাসার শপথ গ্রহণের স্বোচ্চার বাণী বিপ্লবী আন্দোলনের বিপরীতে শহুরে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে সরাসরি জড়িয়ে পড়ার কর্মকাণ্ডও বিচার করার চেষ্টা করাযাক বিপ্লবের আয়নায়
সেই প্রতিবাদী অথচ ভালবাসার পথ, মাঝখানের বছরগুলোতে একটু একটু করে ইওরোপিয় সাম্যবাদের প্রচণ্ডতায়, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু মৌলবাদের হুঙ্কারে সাময়িকভাবে হারিয়ে যেতে যেতে কিন্তু আবার নতুন করে জীবন ফিরে পাচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসন পাকা করতে কোম্পানির অর্থ-দাক্ষিণ্যেপুষ্ট মহাপণ্ডিত হয়েওঠা জোনস বা ভারতভাঙার কারিগর ম্যাক্সমুলারের নানান ভাষা বা দার্শনিক তত্ত্বের তথাকথিত গবেষণামূলক আবিষ্কারে আজও ব্রিটিশ অনুগামী বাঙালি বুদ্ধজীবি মহল চমত্কৃত বিশ্বে অন্যপথের দিশারী ঋষি কার্ল মার্কস পর্যন্ত ভারতের সনাতন সমাজ ভাঙার কাজে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের মদত দিয়েছেন, বলেছেন অপচয়ের এই বুর্জোয়া সমাজ উন্নততর সমাজ ব্যবস্থা সেই সব ভাবনারমূলে বাঙলায় খুব একটা কুঠারাঘাত না হলেও বাঙলার বাইরের নানান কাজে সনাতন ভারত আবিষ্কারের পথ নতুন করে খুলছে সাম্রাজ্যের বন্ধুদের নতুন করে চেনার কাজ শুরু হচ্ছে, নতুন করে দাবি উঠছে কৃতকর্মের জন্য সাম্রাজ্যের আজকের প্রতিনিধিদের ক্ষমা ভিক্ষার আজ ঔপনিবেশিকতাবাদের বাইরে বেরিয়ে সনাতন বাংলার নিজস্ব জ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প চর্চার নথিকরণের কাজ হচ্ছে তবে সেই কাজ আরো ভালভাবে সুসম্পন্ন হতেপারে যদি বিদ্রোহী বাংলার উত্তরসূরীরা ঔপনিবেশিক বাংলার কুজ্ঝ্বটিকা সরিয়ে বিদ্রোহের ইতিহাস রচনা আর বিদ্রোহীদের চরিতবাখানে কম্বুকণ্ঠ হন আর তথাকথিত আধুনিকতার ধ্বজাধারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বন্ধুদের চক্রান্তের মুখোশ খুলে দিতে পারেন

সাম্রাজ্যের বন্ধুরাঃ উচ্চ-মধ্যবিত্তের ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ৯


এই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য দুশো বছরের ব্রিটিশ সরকার, ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবি আর তার ভারতীয় অনুগামীরা বাংলা তথা ভারতের সমাজের দর্শণ, প্রযুক্তির ন্যুনতা অন্বেষণে, সনাতন সমাজ ভাঙার প্রচেষ্টায় যে নিরবিছিন্ন প্রচার চালিয়েছেন তার ভিত্তিমূলকেই প্রশ্ন তোলা ব্রিটিশ আর পশ্চিমি সভ্যতার নির্দেশিত পথে ইওরোপিয়ভাবনায় শহুরে ভারত গড়ার কারিগরেরা এতদিন প্রণম্য ছিলেন, তাঁদের অবদানের কথা বহু আলোচনা হয়েছে, কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন গড়ে তুলতে, বিদ্রোহী ভারতের বিরুদ্ধে পরেক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করতে তাঁদের অবদান কী তা না জানলে বিদ্রোহী বাংলার প্রতি যে সুবিচার অপেক্ষা করে রয়েছে তাকে সম্মান জানানো যাবে না
বিদ্রোহী বাংলা অথবা বাংলার প্রযুক্তি-দর্শণ নিয়ে অসত্য তথ্যের পাহাড় সরানোর কাজে আজ ব্রতী হওয়া দরকার সর্বাগ্রে আদিবাসী সমাজকে বাগে না আনতে পেরে, বেশকিছু আদিবাসী সমাজকে জন্ম অপরাধীর ছাপ মেরে দেওয়ারমত ব্রিটিশ সরকারি কাজের চক্রান্তমূলক সমর্থন এসেছে বর্ণ বাঙালিদের সমাজ থেকেই বাংলার লৌকিক আদিবাসী গ্রামীণ সমাজের বিদ্রোহ দমন করতে ব্রিটিশ সভ্যতা যে হোলি খেলেছে, তার প্রচারও খুব একটা হয়নি, যে রক্তের ছিটের দাগ আজও লেগে রয়েছে ইংরেজি জানা বর্ণহিন্দুর গায়ে, সে দাগ সহজে ভারতীয় সভ্যতা মুছতে দেবেনা এই কলমচির গায়েও সেই দাগ লেগে রয়েছে যে গনগনির মাঠে হাজার হাজার বিদ্রাহীকে ফাঁসি দেওয়া হয়, সেই গনগনিরমাঠ আজ অবহেলায় পড়ে রয়েছে বিদ্রোহীদের রক্তচিহ্নবুকে ধরে সারা বিশ্বে তার কৃতকর্মের জন্য অতীতের নানান সম্রাজ্য বিভিন্ন সমাজের কাছে ক্ষমা চাইলেও, বাংলার একের পর এক মন্বন্তর ঘটিয়েও, সামাজিক ভারতের গ্রামীণের অর্বুদ-পদ্ম পরিমাণ অর্থ লুঠ করে, জ্ঞান চুরি করে, সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে, ব্রিটিশ হৃদয় নিষ্কলঙ্ক থাকে, শহুরে, দেশ ছাড়া বুদ্ধিবিভাষাময় বাঙালিরাও ব্রিটিশ অর্থে চিনির পলেস্তেরা ফেলা গবেষণা কর্ম করে নোবেল পান ভারতে বা বাংলায় তাদের কৃতকর্মের জন্য রাণীকে ক্ষমা চাইতে বলার সাহস এ কজন আন্তর্জাতিক নোবেলীয় ব্যক্তিত্বের হয় না
বাংলার বৌদ্ধিক জগতে একটি নির্জলা মিথ্যে প্রচারিত রয়েছে যে, বাংলা তথা ভারত নিরুপদ্রবে ব্রিটিশ শাসন মেনে নিয়েছিল লৌকিক ভারত নয়, এই শাসন মেনে নিয়েছিল প্রথমে শহুরে বাংলা, পরে শহুরে ভারত বাংলার রেনেসাঁর নাম করে গত দেড়শ বছর যে বৌদ্ধিক পিটুলি গোলা বিশ্ব তথা বাংলাকে মানতে বাধ্য করেছে ব্রিটিশ অনুগামী বুদ্ধিবিভাষা, যে প্রচারে সমগ্র বাংলা আজও বুঁদ, সেই অতিকথার হাওয়া-বেলুন চুপসে দেওয়ার কাজ করা আজ সর্বস্তরের ভারতসমাজপ্রেমী মানুষের অবশ্য কর্তব্য যখন হাজার হাজার সরল লৌকিক বা আদিবাসী সমাজ ঔপনিবেশিক ব্রটিশদের প্রতি ঘৃণায় হাতে অস্ত্রের তুলে নিযেছে, অবলীলায় প্রাণ দিচ্ছেন হাজার হাজার গ্রামীণ নর-নারী, তখন শহুরে ভারতীয় বুদ্ধিবিভাষার প্রধাণ পুরুষ রামমোহন আর তার অনুগামী দ্বারকানাথ আর তাঁদের শিষ্যগোষ্ঠী শিল্পবিপ্লবীয় দর্শনের পথে অতুলনীয় ধণে ধনী হতে গিয়ে প্রথমে লুঠেরা ব্রিটিশদের বেনিয়ানি করে, চাকরি করে, পর্বত প্রমাণ অর্থ অর্জন করেন
পরে সেই উত্পাতের অর্থে জমিদারি কিনে ভারতীয় রায়তদের শুধুই জোর করে আফিম বা নীল চাষ করতে বাধ্য করেন নি, আফিম আর নীল বিদ্রাহীদের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন, বিদ্রোহীদের পরোক্ষে ঠেলে দিয়েছেন বাংলা জুড়ে তাণ্ডবলীলা চালানো ব্রিটিশ সেনার সামনে, লবন বিদ্রোহীদের বিরোধিতা করে, সরকারের লবন নীতির সমর্থন করে বুক ফুলিয়ে লবন ব্যবসা করেছেন, ভারতে ব্রিটিশদের জমি কেনার জন্য, দিল্লিশ্বরের জন্য কোম্পানির বরাদ্দ অর্থ বাড়াতে মহারাণীর কাছে লণ্ডনে দালালি করেছেন, চিনের সঙ্গে অনৈতিক আফিম ব্যবসায়ে সরাসরি জড়িত থেকেছেন, ভাইবেরাদারদের নিয়ে ব্যাঙ্ক খুলে আর কার টেগোর নামক কোম্পানি তৈরি করে নীল আর আফিম ব্যবসায় টাকা নিয়োগ করছেন, নীল চাষীদের রক্তে বোনা নীল রংএর ব্রিটিশ বণিক সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যবসায়ে বাংলায় বড়তম অংশিদার ছিলেন, মহামান্য কেম্পানি বাহাদুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সরাসরি ভারতীয় সভ্যতার নামে ঘৃণা ছড়িয়ে অজস্র আস্থা অর্জন করেছেন, গ্রামীণ বাংলার সমাজিক বনিয়াদ ধ্বংস করে তার চরিত্র পাল্টে দেওয়ার কাজে সরাসরি যুদ্ধ করা ব্রিটিশ সেনারা যখন বিদ্রাহীদের রক্তে হোলি খেলছে, মেকলে, ট্রভলিয়নেরমত জাতিবিদ্বেষী ব্রিটিশ সরকারি আমলারা যখন কলকাতায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হাজার হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতার মুখে কালি ছেটাচ্ছেন, তখন ইংরেজি শিক্ষিত ভারতসমাজবিদ্বেষী বর্ণকুলীন নবজাগরণের বাঙালি কর্ণধার আর অগ্রদূতেরা রামমোহনের সাক্ষাত শিষ্য দ্বারকানাথ বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে অশ্লীল নাচের আসর বসিয়ে মেকলেকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন মদের ফোয়ারা ছুটিয়ে, অজস্র অর্থ ব্যয় আর নষ্ট করেছেন অপচয়ের চরমে উঠে এ দেশে দ্বারকানাথ আর তার অস্বস্তির অপৌত্তলিকগুরু রামমোহনের যত জীবনী প্রকাশ হয়েছে, তাতে প্রায় প্রত্যেক লেখক উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তাঁর বেনিয়ানি করে ঘুষ গ্রহণ, নুন আর আফিম বোর্ডে দেওয়ানি করে বামহস্তক্রিয়ায় বাস্তবে পাওয়া মাইনে থেকে অত্যন্ত বেশি আয় করা, ভারতে অত্যাচারী ব্রিটিশ নীলকরদের পক্ষ নেওয়া, নুন ব্যবসায় তার বিরুদ্ধে মালঙ্গীদের আন্দোলন নিয়ে সাধারণেই নীরব থেকেছেন
কুড়ির দশকেই নীলকরদের অত্যাচারে বাংলার চাষীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় মনেরাখতে হবে বাংলার চাষীর একটা বড় অংশ ইসলামধর্মী তিতুমীর ছিলেন তাঁদের অন্যতম নেতা ততকালীন ভারতে নীলকরেরা কোম্পানি সরকারের কাছ থেকে কোনো আইনি রক্ষাকবচ পেত না ব্রিটিশ নাগরিকেরা ভারতভূমিতে জমিও কিনতে পারত না নীলকরেরা আইনি সুরক্ষা দাবি করলেন এটি উপনিবেশ গড়ার(কলোনাইজেশন) আন্দোলন নামে পরিচিত এই তত্বে রামমোহন দিয়েছেন সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তিভূমি আর দ্বারকানাথ দিয়েছেন অর্থনৈতিক বনিয়াদ দ্বারকানাথের লেখায় বারবার উল্লিখিত হয়েছে নীল চাষে তিনি আর তার আত্মীয়দের অর্থনৈতিক উন্নতির সুগভীর বর্ণনা ১৮৩৩ সালের ভারতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার সনদ নতুনভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত হওয়ার আগে থেকেই ভারতে জমি কেনার অধিকার পাওয়ার জন্য ব্রিটিশ নীলকর আর আফিম চাষীরা কোম্পানিকে যথাসম্ভব চাপ দিচ্ছিল রামমোহন আর দ্বারকানাথ সেই গোষ্ঠীরই পক্ষেই আন্দোলন করছিলেন তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ ব্রিটিশ আফিম আর নীল চাষীদের সঙ্গে জড়িত শিয়ালদায় সব থেকে বড় নীলের গুদাম ছিল দ্বারকানাথের ১৯২৩এর বড়লাট আমহার্ষ্ট-এর ষষ্ঠ আইনে বলা হল, সুদ-আসল তুলতে নীলকরেরা মামলা করতে পারবে ১৮২৮এ সংবাদ কৌমুদি ভারতে নীলকরেরা জোর করে ধানের জমি দখল করে নীল চাষ করানোর সংবাদ প্রকাশ করে ঐ বছরেই ২৬ ফেব্রুয়ারি দ্বারকানাথ ঠাকুর পত্রিকাটিতে একটি চিঠি প্রকাশ করে সংবাদের বিরুদ্ধমত প্রকাশকরে ভারতে ব্রিটিশ প্রজাদের, আদতে আফিম চাষী আর নীলকরদের জমি কেনার সপক্ষে সওয়াল করেন দ্বারকানাথের দাবি, এতে নীলকর জমিদারদের যেমন উপকার হবে তেমন গরীব চাষীদেরও একটু বেশি রোজগার হবে।। Rammohun believed that, the presence of British settlers would force the government to broaden political participation & to introduce British political institution in India, creating in the process a true British-Indian Empire… Rammohun suggested that immigration to be limited to Europeans of the high & better educated class -  খোলাখুলি বলছেন elite-পন্থী দ্বারকানাথের ব্রিটিশ জীবনীকার ব্লেয়ার বি ক্লিং তার Partner in Empire: Dwarakanath Tagore & the age of enterprise in Eastern India বইতে ব্লেয়ার যত সহজে রামমোহন বা দ্বারকানাথের পক্ষনিয়ে পরোক্ষে ব্রিটিশ সভ্যতার জয়গান আর ভারত ধংসের বীনা বাজাতে পারেন পারেন, শহুরে ভারতীয়রা পরবর্তীকালে ঠিক তত সহজ দক্ষতা নিয়েই ব্লেয়ারদের সুরে সুর মিলিয়ে সেই ধংসতত্ব সমর্থন করবেন! দ্বারকানাথের এই দাবির প্রতিধ্বনি তার দেড়শ বছর পর কন্ট্রাক্ট ফার্মিংএর প্রবক্তারা নতুন করে তুলবেন

সাম্রাজ্যের বন্ধুরাঃ উচ্চ-মধ্যবিত্তের ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ৮


তখনও ভারতীয় সমাজ, লেখাপড়ার সঙ্গে গাড়ি চড়ার অস্বস্তিকর সম্পর্ক গড়ার থেকে, বিদ্যা আর্জণ করে বিনয়ী হতে বেশি অভ্যস্ত কিন্তু শহুরে ভারতীয়দের নিদান হল, হাজার হাজার বছরের জ্ঞাণ চর্চার পদ্ধতি ছেড়ে নিতে হবে সাগর পারের ভুঁইফোঁড় বিদ্যাচর্চা পদ্ধতি জোর যার মুলুক তার ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি বিনীত হতে শেখায় না, অধিকার করতে শেখায়, বিনা প্রতিবাদে অনুগামী হতে বাধ্য করে মানি আর না মানি, বিগত প্রায় দুশো বছর ধরে শহুরে ভারত ইওরোপিয় জ্ঞাণ চর্চার ধারাকে বহন করে চলে ভারত রাষ্ট্র ক্রমশঃই পিছিয়ে পড়ছে প্রযুক্তির বিকাশে সে আজকের বিশ্ব-প্রযুক্তিতে ইওরোপ থেকে কম করে চল্লিশ বছর পেছনে পড়ে ৪০ বছর আগে ইওরোপ চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল, আজ ভারত শুধু চাঁদে মানুষহীন রকেট পাঠিয়েই খুশি
আজ বাংলার হাতে গোণা মানুষ ডোকরা শিল্প দিয়ে বাড়ি সাজালেও, জানেই না বাংলায় ডোকরা কামারেরা জং ছাড়াই লোহার সামগ্রী তৈরি করতে আজও সক্ষম, সেই প্রযুক্তি এখনও বাংলার শিল্পীর দখলে রয়েছে আজও বাংলার বহুপ্রান্তে দলমাদল বা বাচ্চাওয়ালিরমত বহু কামান ছড়িয়ে ছিটিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবহেলায় পড়ে রয়েছে, অথচ এক ফোঁটাও জং পড়েনি ইওরোপে যখন টিকা দেওয়ার প্রচলন হয় নি তখন বাংলার ব্রাহ্মণেরা সফলভাবেই টিকা দিতে জানতেন খুব কম ক্ষেত্রে বিফল হত তাঁদের টিকাদান বাংলার নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, হাতিবাগান, বর্ধমান, বাঁকুড়ার বিস্তির্ণ অঞ্চলে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়প্রতীম শিক্ষাদান কেন্দ্র শহরের মানুষের অবহেলায় সেগুলি কোথাও আজ জীর্ণ - অধিকাংশ স্থানে মুছে গিয়েছে ভারতীয় বিদ্যামানচিত্র থেকে বাংলার মসলিন, বালুচরী প্রবাদ প্রতীম, কিন্তু বাংলার পটুয়া(মষ্করী) আর ভাষ্করদের হাতে অজন্তা-ইলোরা বা অঙ্কেরভাটেরমত নানান স্থাপত্য রূপ পেয়েছে, দীনেশ সেনমশাই সে তথ্য বলে গেলেও আজও তা খুব একটা সর্বজনবিদিত কী? বিশ্বের বাজারে বাংলার গৌড়ি মদের, চিনির, নুনের, সুপুরির, হাতির, ধাতুর, শিল্পকলার একদা যে সমাদর ছিল তাও কেউ জানি কীনা জানিনা পাশ্চাত্য মার্কসীয় সাম্যবাদী দর্শনের আদ্যপান্ত অন্ধ অনুগামী অথচ লৌকিক বাংলার বিনম্র পুজারী বিনয় ঘোষ দেখেছেন পাঁচ রংএর সিল্কএর বর্ণনাবিশিষ্ট পুঁথি, রাণীগঞ্জে বাংলার পোড়ামাটির স্থাপত্যের প্রযুক্তি নিয়ে মুকুল দে মশাইএর কাজ কয়েকজন বিদগ্ধজনের বাইরে ঠাঁই হয়নি দিল্লির লৌহস্তম্ভ বাঁকুড়ার পেখন্না গ্রামের কর্মীদের তৈরি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবিষ্কার করা এ তথ্য কোনো এক অজানা কারণে বাংলাতেও খুব একটা প্রচার পায়নি বাংলার সুপ্রাচীণ লাঙল যে প্রযুক্তি বিদ্যার এক চরমতম নিদর্শণ কজন জানি সেচের কাজে আসা ব্রিটিশ প্রযুক্তি ভোলকার সরকারকে জানিয়েছিলেন বাংলার সেচ ব্যবস্থা ভারতীয় প্রযুক্তিরবিদ্যার চরমতম নিদর্শণ
বাংলার বাইরে বিশেষ করে এক হাতে ধরমপালজী আর তার সঙ্গীসাথীরা অথবা আলমোড়ার লোক বিজ্ঞান কেন্দ্র বা দক্ষিণ ভারতের নানান শিকড়ে যাওয়ার আন্দোলনে ভারতের সনাতন সমাজ, দর্শণ, ঐতিহ্য, প্রযুক্তির নথিকরণ করেছেন দায়বদ্ধভাবে এই বাংলার অন্তরকে জানাতে চেয়ে যে কাজের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র, অক্ষয় কুমার দত্ত, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেন অথবা নির্মল চন্দ্র বসুরমত মানুষ, সেই কাজের এক অংশের দায়ভাগ আজকের প্রজন্ম তুলে নিলেও, বাংলার ন্যুনতা নিয়ে ব্রিটিশ মিথ-মিথ্যাকে খণ্ডন করার কাজ খুব একটা আগ্রসর হয়নি শহুরে বাংলার শিক্ষায়, জ্ঞানে, বুদ্ধির রণ্ধ্রে রণ্ধ্রে যে উপনিবেশবাদ ঢুকে রয়েছে, তাকে বিনাশ আর খণ্ডন করা অত্যন্ত জরুরিকর্ম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ঔপনিবেশিকতাবাদের নগ্নতম রূপ দেখে, সারা জীবন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কাজ করা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদেরমত মানুষ শেষ বয়সে এই দর্শনের খণ্ডনকার্যটি হাতে নিতে চাইছিলেন(১৯১০ সালের কাছাকাছি এসে তিনি জানান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুফল না বলতে দিয়ে, যদি কেউ তাকে কুফল বলাতে চান, তাহলে তিনি স্বস্তিবোধ করবেন) চাইলেও তিনি পারেন নি পারেননি তাঁ অনুগামীরাও এটাই চরমতম ঐতিহাসিক সত্য এই খণ্ডনকর্ম করতে গেলে আজ প্রয়োজন ইওরেপিয় জ্ঞান আর ইতিহাস চর্চার মিথ-মিথ্যাগরীমাকে প্রশ্ন করা, যা আম বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের স্বপ্নেরও অগম্য
বিগত দুশো বছরের ইওরোপিয় জ্ঞাণ-বিজ্ঞাণ-প্রযুক্তির আধিপত্যবাদ নিয়ে জ্ঞাণচর্চার ইতিহাস যে নির্জলা অসত্য প্রচার করেছে, সেই প্রচার ভারতীয় ইংরেজি শিক্ষিত বর্ণকুলীন বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে, আজও নিচ্ছে কেরল অঙ্কবিদ্যার যে ভিত্তিভূমি আজ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে প্রমাণিত যে, কলন বিদ্যার সূত্র ধরেই তৈরি হয়েছে পশ্চিমি গণিতের অন্যতম ভিত নিউটন বা লিবনিত্জকে কলণবিদ্যার জনক বলার কোনো হেতু নেই কেরলিয় গণিতই ইওরোপে নিউটনিয় অংক নামে পরিচিত আজ ভারতীয় কলণ বিদ্যাকে ইওরোপ-পূর্ব কলন বিদ্যার ছাপ মেরে দেওয়া হচ্ছে, কেননা ভারত কখোনোই ইওরোপেরমত লিমিটের ধারণা প্রয়োগকরে কলন বিদ্যার চর্চা করে নি তার আলাদা প্রকার কলন চর্চার ইতিহাস রয়েছে যে ইতিহাস আজ এক কলণবিদ্যার ছাত্রেক কাছে অজানা আজ যে কোনো ভারতীয় বিদ্যালয়ের পাঠ্য অঙ্ক পুস্তকে বলা হয় ত্রিকোণোমিতির উদ্গাতা গ্রীক সভ্যতাশ্রিত মিশরের আলেজান্দ্রিয়া পাঠ্যবইতে তাঁদের যে ছবি ছাপা হয় সবই ককেসাসিয়ান চেহারার অথচ আলেকজান্দ্রিয়ায় যে মানুষেরা অঙ্কবিদ্যা চর্চা করছেন তাঁরা সকলেই আদত আফ্রিকার অধিবাসী, তাঁদের চেহারায় আফ্রিকার ছাপ থাকার কথা কিন্তু ব্রিটিশ তথা পশ্চিমি প্রচারে তাঁরা সকলেই ইওরোপিয় চেহারার অধিকারী, ব্রিটিশদের সেই প্রচার শহুরে শিক্ষিত আমরা নির্বিবাদে গ্রহণ করেছি এক সাধারণ যাজক কোপার্নিকাস ইওরোপিয়দের প্রচারে হয়ে উঠেছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী তিনি শুধুমাত্র ল্যাটিনে অনুবাদ করেছেন ইবন শাতির আর নাসিরুদ্দিন তুসির রচনার গ্রীক সংস্করণ আর ইওরোপিয়দের প্রচারে প্রভাবিত হয়ে অধিকাংশ বাঙালি বুদ্ধিজীবি আজও তথাকথিত কোপার্নিকাসীয় বিপ্লবের ধারণায় বুঁদ হয়ে থাকেন আর ভাবেন ইওরোপিয় ইতিহাসের ভুল ধরারমত ভুল আর বিশ্বে কিছুই নেই সকলেরই ধারনা ইওরোপীয় সব বচনই সত্য আর সব মিথ্যা সবই ব্যাদে আছে - অসামাজিক ব্যাঙ্গটিতে নিজের সনাতনী সমাজের প্রতি যে দুর্দমনীয় অশ্রদ্ধা প্রকাশ ঘটেছে তা আদতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সভ্যতার দান আজ ভারতের অধিকাংশ অংকবিদ জানলেও বলেন না ইওরোপিয় পদ্ধতিতে অংক কষার বাইরেও একটা অংক চর্চার অ-ইওরোপিয় ইতিহাস রয়েছে

সাম্রাজ্যের বন্ধুরাঃ উচ্চ-মধ্যবিত্তের ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ৭


অথচ শাসন করতে আসা এই ব্রিটিশরাই জানত, বিধিনিষেধেভরা প্রাণচঞ্চল গ্রামীণ সমাজ ছিল জাগতিক বা বুদ্ধিবিভাষাময় ভারতীয় সভ্যতার ভিত্তিভূমি সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতার বহুপূর্ব থেকেই যে ভারতীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে, সে সভ্যতাকে কব্জা করা খুব একটা সহজ কাজ হবে না, এ তথ্য হাড়ে হাড়ে ব্রিটিশরা টের পেয়ে গিয়েছিল ভারত ঘুরে ঘুরে চিরাচরিত জ্ঞাণভাণ্ডার নকল করতে থাকা (এমনকী বাংলার কোন অঞ্চলের কী ধরনের লাঙল ব্যবহার হয়, সে তুচ্ছ অথচ সাধারণ তথ্যও তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন) ব্রিটিশগুণিরা এ তথ্য বুঝেছিলেন বলেই, ব্রিটিশ সরকারের প্রাথমিক কাজ ছিল ভারতীয় সমাজের তাবত্ মানুষের নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়া তাই প্রয়োজন হয়েছিল ভারতভূমিতে অজ্ঞাতকুলশীল সম্রাজ্যবাদীঅভিঘাতে রান্নাকরা আর্যতত্বকে রোপণ করার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতার ন্যুনত্বের ধারণা শহুরে ভারতীয়দের মনের অন্তঃস্থলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত রূপায়ণের আপামর গ্রামীণ ভারতবাসী আকাশ থেকে খসে পড়া সে তত্বে বিশ্বাস না করলেও, শহুরে শেকড় ছেঁড়ারা যে তাতে আস্থা রাখবেন, এ বিশ্বাস ব্রিটিশ শাসকদের ছিল আজ প্রমাণিত শহুরে ভারতের ওপর ভরসা রেখে ভারত সমাজ ভাঙার কাজে লিপ্ত ব্রিটিশ খুব কিছু ভুল কাজ করেনি
বিশ্ব বিজেতা হতেগেলে বাজারে প্রতিযোগী থাকলেই বিপদের সম্ভাবনা অথচ বুদ্ধিজীবি ব্রিটিশেরা দেখেছিলেন ন্যুনতমটুকু সম্পদ আর সাধারণ জ্ঞাণ সম্বল করে কীই না জাগতিক আর পারমার্থিক সম্পদ তৈরিতে দক্ষ সরল ভারতীয় সমাজ এর পাশাপাশি পশ্চিমি সভ্যতার প্রযুক্তিতে অজস্র ফাটাফুটো ভারতীয় প্রযুক্তির আশেপাশে আসতে পারতনা সে সময়কার ব্রিটিশ প্রযুক্তি এ তথ্য বিশ্বকে জানানোর অর্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কফিনের শেষ পেরেক ঠোকা তাই দরকার এক সভ্যতার, যে সভ্যতা দর্শণে-জ্ঞাণে-প্রযুক্তিতে উত্তমর্ণ সে সভ্যতা ভারত সে সমাজ থেকে সমস্ত জ্ঞাণ আহরণ করা প্রয়োজন
ঠিক হল নকলের কোনো সূত্র না রেখেই আহরণ করা হবে ভারতীয় জ্ঞাণ আর ভাঙা হবে সেই জ্ঞাণের ধাত্রীভূমি ভারতীয় সনাতন সমাজ জ্ঞাণ ভিত্তি করে হাজার হাজার বছরের যে সামাজিক শিল্পকারখানাগুলো গড়ে উঠেছে বাংলা তথা ভারতের নানা প্রান্তে, তাকেও শেকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে, তবেই হবে বিশ্ব জয়, তবেই পরের দুশে বছর ধরে দর্শনের-বিজ্ঞানের-প্রযুক্তির ইতিহাস বলতে বোঝাবে শুধুই ইওরোপিয় জ্ঞান চর্চার ইতিহাসকে, শুধু ভারত নয়, বিশ্বের অ-ইওরোপিয় জ্ঞাণ চর্চার ইতিহাস শুধুই থাকবে পাদটিকারূপে(সাদামানুষদের বিশ্লষণের জন্য তৈরি হল সমাজবিদ্যা অন্য সবার জন্য নৃতত্ব, আর ইওরেপিয় সঙ্গীতই একমাত্র ধ্রুপদী গান আর স-অ-ব ফোক শহুরে ভারতকে সন্তুষ্ট রাখতে ভারতীয় রাগ সংগীতমাত্র পেল ধ্রুপদী আখ্যা তবে উপরি পাওনা ভারতীয় রাগের আঞ্চলিক খণ্ডীকরণ - উত্তরভারতীয় আর কর্ণাটকী রাগে ভেঙে ফেলা হল রাগ সংগীতকে) বিপরীতে অপচয়মুখী পাশ্চাত্যদর্শণভিত্তিক যে সমাজ গড়তে ব্রিটিশ শহুরে সভ্যতা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সেই শেকড় ছেঁড়া সমাজ ঢলে পড়ল ব্রিটিশের পায়ে নতুন এই সভ্যতাকে চালাতে চাই সে দেশের মানুষের অংশগ্রহণ প্রকল্পটিতে হাত দিতে না দিতে, ব্রিটিশদের পাতে না চাইতেই জল প্রাথমিকভাবে সঙ্গ পেল শহুরে বাংলার এই শহুরে মধ্যবিত্তকে ঢাকের বাঁয়া হিসেবে গড়েতোলাই ছিল কোম্পানি সরকার প্রাথমিক প্রচেষ্টা সে কাজে কোম্পানি বাহাদুর একশো শতাংশ সফল প্রথমে কলকাতা, পরে বম্বে আর মাদ্রাজের ইংরেজি শিক্ষিত সম্রাজ্যসাথীরা এই কালাপাহাড়ি কাজের সাথী হয়ে উঠেছিলেন ক্রমশঃ
সে সময় বিশ্বরাজনীতিতে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য করতে থাকা ব্রিটিশ রাষ্ট্র বুঝেছিল, লুঠের দর্শনে যে ভঙ্গুর সভ্যতা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকে বৈধতা দিতে প্রয়োজন শহুরে ভারতীয় সমাজে এক জাতি, এক আইন, এক ভাষাভিত্তিক নতুন জাতি রাষ্ট্রের ধারণার শিকড় গজানোর অথচ সনাতন কাল থেকেই ভারতীয় সমাজ বহুধা বিভক্ত কেউ জাতির ধারণায়, কেউ ভাষা ভিত্তিতে আবার বা কেউ কোনো এক ধর্মের নির্দিষ্ট ব্যখ্যার ভিত্তিতে আবার কেউবা অন্য কোনো ভাবনার ভিত্তিতে এক এক সমাজে এক এক দর্শন কোথাও মেয়েদের জন্য পর্দা প্রথা কঠোরভাবে প্রচলিত আবার বহু সমাজই সমাজিকভাবে মাতৃতান্ত্রিক, কোনো সমাজের এক ক্ষুদ্র অংশে বিধবাদের পোড়ানোর নিদান দেওয়া হয় আবার কোনো সমাজে বিধবা বিবাহ এক সাধারণ ঘটনা ভারতীয় সমাজ চিরকাল নানান সমাজ-দার্শনিক-শাস্ত্রীয়-ভাষার বৈচিত্র্যের মধ্যে থেকেই পারস্পরিকতার লেনদেন করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে বোধ করে নি(নানান ভাষায় বিভক্ত ভারতবর্ষে ভ্রমণকরে শ্রীমন্ত শংকরদেব, শংকরাচার্য, শ্রীচৈতন্য, বিবেকানন্দও মহামানব হয়ে উঠেছেন ভাষার অসুবিধে সত্বেও তাঁরা সাধারণের সঙ্গে আলাপচারিতা করেছেন ভাবপ্রকাশে ভাষা কোনো সমস্যা হয়ে ওঠেনি) এমনকী ভারতের চার প্রান্তে গঠিত শঙ্করাচার্যের মঠের ভাষ্যও ভারতীয় সব ব্রাহ্মণ্য সমাজে গ্রহণীয় নয় সর্বজনপাঠ্য রামায়ণও ভারতের নানান প্রান্তে নানান ভাবে, নানান দৃষ্টিতে পঠিত হয় সমাজ শাসনে স্থানীয় পঞ্চায়েতের ভূমিকাই ছিল চূড়ান্ত সাধারণতঃ সে অঞ্চলের পঞ্চায়েতকে এড়িয়ে সেই জনপদের বা শহরের শাসক, উচ্চ কোনো বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক নিদান দিতে পারত না ভারতীয় সমাজ জানত একটি নির্দিষ্টমাত্র দর্শণের নিগড়ে সমস্ত ভারতীয় সমবায়ী সমাজকে বাঁধা যায় না, উচিতও নয়, সভ্যতার বিস্তৃতিই ঘটে অসংখ্য বৈচিত্র্যের বিকাশের মধ্যে
অথচ বাইবেলভিত্তিক খ্রিষ্টিয় নিদানের ওপর গড়ে ওঠা ব্রিটিশরা সমগ্র ভারতকে একটিমাত্র হিন্দু বিপরীতে শরিয়তি আইনে বাঁধতে চাইল প্রণীত হল আ কোড অব জেন্টু ল তাতেও সমাধান হল না বিচার ব্যবস্থাকে সরাসরি নির্ভর করতে হল পণ্ডিতদের ব্যাখ্যার ওপর ভাগ্যান্বেষণে ভারতে এসে কোম্পানি সরকারের দয়ায়, ভারতীয়দের শিরদাঁড়া বাঁকানোর প্রকল্পে মহাপণ্ডিত বনে যাওয়া, উইলিয়ম জোনস ভারতীয় পণ্ডিতদের দিয়ে অনুবাদ করিয়ে মনুস্মৃতির অনুবাদক অখ্যা পেয়ে গেলেন যাইহোক, ভারত সমাজ ভাঙতে নব্যসৃষ্ট ভারতবিদ্যায় হঠাত্ই খ্যাতি অর্জন করল মনুস্মৃতি অথচ বহু সমাজেই মনুস্মৃতির ব্যবহার নেই ঔপনিবেশিক ভারত বিশ্লষণেরত পণ্ডিতদের কাজকর্মে হঠাত্ই যেন শীতঘুম ভেঙে সমাজবিধাতার সম্মান পেয়ে গেলেন মনু মশাই সমাজ ভাঙার কাজের আর এক পদক্ষেপ ভারতীরা ব্রিটিশের কল্কে পেয়ে মহাখুশি তাঁরাও মনুস্মৃতিকে সনাতন উচ্চমধ্যবিত্তভারতের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বেদবাক্যগ্রন্থ বানিয়ে দিতে কসুর করলেন না ভারতীয় সমাজগুলোয় প্রায় ঠাণ্ডাঘরে চলে যাওয়া এই গ্রন্থটিই পরবর্তীকালে হয়ে উঠবে উপনিবেশ চর্চার ভিত্তিপুস্তক জোনসএর দেখানো পথে ভারতীয় পণ্ডিতদের কাঁধে চেপে কোলব্রুক স্বীকৃত হবেন মিতাক্ষরা আর দায়ভাগএর অনুবাদকরূপে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে হিন্দুদের বিচার করার এক আইন তৈরির কাজ শুরু হল - যার কয়েক দশকের মধ্যেই শিক্ষাপ্রস্তাবে যুগান্ত আনা মেকলে তৈরি করবেন ভারতের প্রথম এক কেন্দ্রিক আইনভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা সনাতন বহু ভারতীয় সমাজের নিজস্ব নীতি-আইন ভেঙে ভারতের সমাজে অনৈতিক আর সচেতনভাবে জাতপাতের বিষ ঢোকানোর যে কাজ ব্রিটিশরা ক্রমান্বয়ে করে চলেছিল তাকে সরাসরি সমর্থন জানালেন, বহন করলেন শহুরে ভারতীয় বুদ্ধিজীবিরা অথচ নিজস্ব পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় অভ্যস্ত গ্রামীণ সমাজ পলাশির প্রথম দিন থেকেই ব্রিটিশের অনৈতিক শাসন আর বিচার পদ্ধতির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত এক রাষ্ট্রের আওতায় গ্রামীণ ভারতীয়দের নতুন পশ্চিমি সভ্যতায় অভ্যস্ত করাতে প্রয়োজন নতুন বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর, যারা আগামী দিনে ভারত রাষ্ট্রের সুবৃহত গ্রামীণদের পশ্চিমি দর্শনে দীক্ষিত করাতে পারে শহুরে ভারত রাষ্ট্র আপন করে নিল বিদেশি বিচার ব্যবস্থাকেও কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বিনতমস্তকে

সাম্রাজ্যের বন্ধুরাঃ উচ্চ-মধ্যবিত্তের ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ৬


বাংলায় এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী টিকা দেওয়ার বিদ্যা জানতেন তাই সমাজ সেই ব্রাহ্মণদের ভরণ পোষনের দায় নিত অর্থাত সমাজের কাজে লাগা নানান কাজের বিশেষজ্ঞরা সামাজিকভাবে শুধু বেঁচে থাকার নিরাপত্তা পেতেন তাই নয়, তাঁরা জ্ঞাণ ব্যবহার আর নিজের অধীত জ্ঞাণের চর্চার সুযোগও লাভ করতেন অবাধে, সামাজিক নানান বিধিনিষেধের আওতায় থেকেই ভারত বহুকাল ধরেই সমুদ্র বাণিজ্য করতে আফ্রিকা পর্যন্ত ধাওয়া করেছে কিন্তু ভারত চেনার নতুন খুঁজতে গিয়ে পথ ভুল করে আমেরিকা আবিষ্কার করে বসেনি, বা সেদেশের অধিবাসীদের সভ্যতা ধংস করে সাদা চামড়ার সভ্যতা গড়ে তোলেনি ভারতে বা চিনে বারুদের প্রচলন থাকলেও বারুদ মানুষমারার কাজে ব্যবহার হয়নি বিশ্বখ্যাত দামাস্কাস তরোয়ালের মূল পিণ্ডটি কিন্তু তৈরি করত ভারতের সনাতন আকরিকবিদেরা যারা সনাতন কাল থেকেই ডোকরা কামার নামে পরিচিত যাদের তৈরি ধাতুপিণ্ডতে আজও জংএর চিহ্ণমাত্র নেই ভারতের বস্ত্র বয়ন শিল্পতো প্রবাদ প্রতীম যে তাঁতে এক ব্রিটিশ তাঁতি কোরা চটও বুনতে অক্ষম, সেই তাঁতেই বাঙালি তাঁতিরা কিন্তু মসলিন, বালুচরি, কোরিয়াল বুনতেন যন্ত্রের সূক্ষতার ওপর আজও নির্ভর করে না উত্পাদনের গুণমান প্রয়োজন হয় উত্পাদকের জ্ঞাণ, কাজের প্রতি ভালবাসা আর সামাজিক সুরক্ষার ধারণা সারা ভারত জুড়ে সামাজিক উদ্যমে গড়ে উঠেছিল এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সেচ ব্যবস্থা যে সময় ব্রিটিশেরা ভারতীয় সমাজে আধুনিকতা আর ব্রিটিশ আধিপত্যের জীবানুটি অনুপ্রবেশ ঘটাতে প্রাণপাত করে চলেছেন, সে সময়েও সময়েও কাটা নাক জোড়া লাগাতে(রাইনোপ্লাস্টি), চোখের চিকিত্সায়, বসন্তের বিরুদ্ধে টিকা দিতে, মাথার ব্যামো সারাতে, ভাঙা হাড় জুড়তে, সাধারণ রোগের নিদানে ভারতীয় সমাজ মাহির ছিল আর সে সমাজের অংক কষার কথা আমরা অনেকেই জানি দীনেশ সেন মশাই বলছেন তাঁর এক ভারতীয় আত্মীয় আগের শতকেই জার্মানীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষেতে বসে যে পদ্ধতিতে দ্রুত মানসাঙ্ক করতে পারতেন তা পশ্চিমিদের কাছে জাদুবিদ্যারমত মনেহত
ব্রিটিশ শাসনকালে গ্রামীণ ভারত ছাড়া শহুরে সকলেই ধরে নিয়েছিলেন ব্রিটিশ সভ্যতা এসেছে নতুন প্রযুক্তি, দর্শণ, জ্ঞাণ নিয়ে যার আদত নাম আধুনিকতা কাব্য করে গলাকাঁপিয়ে বলাহল ...পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার অথচ পশ্চিমের জ্ঞান, প্রযুক্তির এক বিশাল অংশ ভারত-চিন-আরবসহ নানান প্রচলিত সভ্যতার সমাজ থেকেই আহরণ করা ভারতীয় লৌকিক-আদিবাসী সমাজের নাচের পদসঞ্চার আর গানের সুর ধারকরা মুম্বাইএর হিন্দি সিনেমার নাচ-গান অনুসরণ করে(আজ গান কিন্তু শুধুই দেখার সামগ্রী), সেই চলচ্ছবিতে ব্যবহৃত নাচাগানায় মুগ্ধ হয়ে আবার লৌকিক সমাজ তাঁদের সমাজেরই একদা নকলের নকল আজ কাল বাজারে ছাড়ছেন আধুনিকতার ধারণা প্রচার-প্রসারে যে পশ্চিমি আর ভারতীয়দের অপদান সবথেকে বেশি তাঁরা সকলেই ব্রিটিশ সরকারি যন্ত্রের সরাসরি মদতপুষ্ট, সরকারি চক্রান্তের সরাসরি ভাগিদার আধুনিক আর সনাতন ভারতের পাঁচ প্রবক্তা - জন ও জেমস স্টুয়ার্ট মিল, উইলিয়াম জোনস, মেকলেআর ফ্রেডরিশ ম্যাক্স মুলার ছিলেন হয় কোম্পানির উচ্চবেতনের চাকুরে(মেকলে এক চিঠিতে বলছেন তার ৫ বছরের ভারতে কেম্পানির চাকুরিরকালে তিনি সরকারিভাবে(বেসরকারি রোজগার কত কে আর জানছে) এতই অর্থ রোজগার করবেন, যে তার থেকে অধিকাংশই সঞ্চয় করে দেশে ফিরে গিয়ে স্বচ্ছলভাবে অবসরকালীন জীবনযাপন করতে পারবেন) অথবা কোম্পানির আর্থিক বদান্যতাভুক্ত বুদ্ধিজীবি(মুলার সম্পাদিত খগ্বেদের প্রকাশ হয় ইস্ট ইণ্ডিয়া কেম্পানির অর্থ দাক্ষিণ্যে যার ফলে তিনি ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে বিভেদ আনতে সংস্কৃতকে ইন্দো-ইওরোপিয় ভাষাগোষ্ঠীর) - অন্যদিকে রামমোহন, দ্বারকানাথ এমনকী বিদ্যাসাগমশাইএরমত পথভেঙেপথতৈরিকরা নানান মানুষজন, সকলেই ছিলেন কোম্পানির চাকুরে, বেনিয়ান বা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে চলতে থাকা নুন, নীল বা আফিমেরমত নানান লুণ্ঠন ব্যবসার যেমন অংশিদার, আর তেমনিই ইংরেজি শিক্ষা ভারতে প্রসারের অন্যতম সহায়ক আর সুপ্রাচীণ ভারতীয় সভ্যতার গালে তীব্র চড় মারার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুগভীর প্রকল্পের সরাসরি অংশিদার যে কোম্পানি ভারত তথা বাংলাকে ছিবড়ে করেছে, সেই কোম্পানির বিনিয়োগের ফলে তিল তিল করে গড়ে তোলা পশ্চমি দর্শনেই গড়ে উঠেছে এক অন্ধপাশ্চাত্য অনুগামী সমাজ যারা ব্রিটিশ ভারত ছাড়ার অর্ধশতক পরেও ব্রিটিশিয় কায়দার পশ্চিমি আধিপত্য আর শিল্পবিপ্লবনির্ভর সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের ধোঁকার টাটিটি সযত্নে সগৌরবে বহন করে চলেছেন
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সুফল বর্ননা করতে গিয়ে বলাহয়, ব্রিটিশেরা ভারতে রেলসহ নানান শিল্পবিপ্লবে বিনিয়োগ করে ভারতকে আধুনিক বিকাশের যুগে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে John A. Hobsonএর Imperialism: A Studyরমত মগজ ধোলাইকরা দার্শনিক পুস্তকে প্রভাবিত হয়ে এক শ্রেণীর শহুরে ভারতীয় পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, ভারতেরমত উপনিবেশগুলোতে ব্রিটিশ, মুক্ত বাণিজ্যের ধারণা এনেছে(যা আদতে সর্বৈব মিথ্যা), যার সুফল পেয়েছে উপনিবেশিক দেশগুলো আদতে এটি উপনিবেশের সুফলের একটি তৈরি করা প্রচারমাত্র একসময়ে ভারতে রেলপথ বিকাশে যে মূলধণ বিনিয়োগ হয়েছে সেই বিনিয়োগের ওপর বাত্সরিক অতিরিক্ত ৫ শতাংশ হারে  নিশ্চিত ফেরতের গ্যারান্টি পেয়েছেন ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা(ঠিক এই ধরণের গ্যারেন্টি চাইছে ভারতে ব্যবসা করতে এসে ফেলকরা বিদেশি কোম্পানিগুলি) এ দেশে রেল বা সড়ক পরিকাঠামো তৈরি করার জন্য একটাও অনুসারী শিল্প গড়ে ওঠে নি কাঠ আর শ্রমিক ছাড়া সমস্তকিছু কাঁচামাল আর যন্ত্রপাতি আনাহত ব্রিটেন থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত রেলপথ চালানোর জন্য যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতিপূরণ করতে হয়েছে ভারতীয়দের ওপর কর চাপিয়ে এ ছাড়াও ব্রিটিশ রেলপথ যে অঞ্চল দিয়ে গিয়েছে, সেসব অঞ্চলে কমবেশি ২৫০টিরমত মন্বন্তর ঘটেছে, কোথাও ছোট, কোথাও বড় ব্রিটেনের মধ্যউচ্চবিত্তকে আরও একটু ভাল রাখার জন্য ভারতীয় সমাজের মানুষ সরাসরি প্রাণ দিয়েছেন সাম্রাজ্যের জন্য যত সেনাবাহিনী প্রয়োজন হয়েছে, ব্রিটেনে যত আমলা ইণ্ডিয়া হাউসে ভারতের সাম্রাজ্যের কাজে ব্যবহৃত, হতেন তাদের বেতন হত ভারতের জনগণের দেওয়া করে

সাম্রাজ্যের বন্ধুরাঃ উচ্চ-মধ্যবিত্তের ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ৫


অথচ ব্রিটিশরা ভারতে শাসন ক্ষমতায় এসে একাদিক্রমে বেছে বেছে তাদের সভ্যতার বিকাশে প্রয়োজনীয় জ্ঞাণ প্রযুক্তি নথিভুক্ত করে, সংগ্রহ করে, ধ্বংস করে নিয়ে গেল নিজের দেশে, কোনো সূত্র না রেখেই নৌপরিচালন বিদ্যাই হোক, চিকিত্সা বিদ্যাই হোক, ধাতুবিদ্যাই হোক, অংক বিদ্যাই হোক, এলাহাবাদের বরফ তৈরির প্রাকৃতিক প্রযুক্তিই হোক বা মাদ্রাজের শিশু শিক্ষাদানের পদ্ধতিই হোক, সে সব প্রযুক্তি বা গ্রন্থিত ভাবনা, সাধারণ মানুষমারা শিল্পবিপ্লবেমাতোয়ারা ব্রিটিশ সভ্যতার সমাজ-সম্পদ বিকাশের কাজে লেগেছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ধরমপালজী বছরের পর বছরের পরিশ্রমে বিশ্ব যাতে সেই জ্ঞানের সূত্র চিনতে না পারে, তাই বুদ্ধিমান ব্রিটিশ জ্ঞাণীদের কাজ ছিল, টুকলি করা জ্ঞানগুলিকে আর সেই জ্ঞাণের আধার সমাজগুলোকে ধংস করা, সেই জ্ঞাণ কোথাথেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তার সামাজিক-ভৌগোলিক সূত্র উত্পাটন করে ফেলা অথচ শুধু যদি ইওরোপিয় অংক বিদ্যার কথাই বলি, তার মূল সূত্রটি কিন্তু ইওরোপে গিয়েছে আরব সভ্যতার হাত ধরেই আরব কখোনোই তার জ্ঞাণ অর্জনের সূত্রটিকে গোপণ রাখতে চায়নি ব্রিটিশ সভ্যতার দেখানো জ্ঞাণ চুরির পথে না হেঁটে, সে সারা বিশ্বকে বলেছে যে ভারত থেকেই সে তার প্রথমিক অংকের জ্ঞাণটি অর্জন করছে
ব্রিটিশ ভারত, সমাজের বৈদেশিক বাণিজ্যের মূল অক্ষদণ্ড শিল্পসমাজকেই তাদের চিরাচরিত জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করেছে, যাতে সমাজের মেরুদণ্ডকেই চিরতরে বাঁকিয়ে দেওয়া যায়, যাতে ভারতের সমাজগুলো অবার নতুন করে গড়ে উঠতে না পারে আর যদি কখোনো ভারত আবার তার ভূমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে তবে সে বিকাশ হবে ব্রিটিশের দেখানো শিল্পবিকাশের দর্শণের অনুসারী ভারতের সনাতন নিয়ন্ত্রিত সমাজভিত্তিক বিকাশ নয় সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে দাঁড়িয়ে, অধিকাংশ মানুষের আত্মবিশ্বাস লুণ্ঠনকারী দর্শন প্রয়োগ করে, মাটিরতলার সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত আহরণ, আর অপচয়ভিত্তিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক মুনাফা আরও মুনাফার হাতছানি যা আদত ভারতীয় প্রজ্ঞা বিরোধী দর্শণ, যে দর্শণে ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন তত্কালীন ব্রিটিশের দয়ায় জাবিকা অর্জন করা শহুরে বর্ণকুলীনেরা, যাদের উত্তরাধিরারীরা তার একশ নব্বই বছর পরে ব্রিটিশদের দেখানো পথে ভারত শাসনের, ভারত রাষ্ট্র বিকাশের অধিকার অর্জন করবেন
ইংরেজ আর ইওরোপকেন্দ্রীয় ঐতিহাসিক-সমাজবিদ-অর্থনীতিবিদের কল্যানে ঔপনিবেশিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেরই বিশ্বাস ভারতীয় সভ্যতার মূল ছিল কৃষিভিত্তি এই ধারণা আরও গভীরে শেকড় পেয়েছে বিগত প্রায় এক শতাব্দের মার্কসীয় পাণ্ডিত্যে তাঁর এক ভাবশিষ্য, বিদ্রোহী পূর্বভারতের সুনিপুণ চিত্র আঁকা সুপ্রকাশ রায় বলছেন ..তখন মানব সমাজের ইতিহাসে উন্নততর বুর্জোয়াশ্রণীর অভ্যুদয় ও আধিপত্যের যুগ আরম্ভ হয়ে গিয়াছে এই নতুন যুগের সঙ্গে ভারতের প্রাচীণ গ্রাম-সমাজের ব্যবস্থা ছিল সামঞ্জস্যহীন ভারতীয় সমাজে অগ্রগতির পথে এই অচল ও অপরিবর্তনীয় সমাজব্যবস্থা একটা বিরাট বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল এই অচল ও অপরিবর্তনীয় সমাজব্যবস্থা, যার ভিত্তিভূমি কৃষি, সেই সভ্যতা ভাঙতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বৈত ভূমিকার কথা একদা ঋষি মার্কস, আজও তাঁর অনুগামীরা কম্বুকণ্ঠে উদগাত করে থাকেন শুধু ইওরোপিয় বামপন্থীদের পাঠ থেকে ভারতীয়রা নিজেদের সমাজকে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে শুধুই অচল ও অপরিবর্তনীয় সমাজব্যবস্থা বলে অভিহিত করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমালোচনা করেও বৌদ্ধকভাবে উন্নততর বুর্জোয়াশ্রণীর প্রতিনিধি ব্রিটিশ পোষিত বণিক সমাজের দেখানো পথকেই নিজেদের পথ হিসেবে ভাবতে পছন্দ করতেন, নিজের সমাজের তুলনায় সে সমাজের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ছিল অমিতপ্রায় অথচ ভারতীয় সমাজের ভিত্তি কৃষি হলেও শিল্পকলা, বিদ্যাদান আর নানান ধরণের কারখানার উদ্যমের মাধ্যমেও একটি বড় অংশের মানুষ নিজের জীবিকা অর্জণ করতেন ভারতের প্রায় সব সমাজেই কৃষিতে নিযুক্ত মানুষের থেকে অন্যান্য জীবিকায় নিযুক্ত মানুষের সংখ্যাই ছিল বেশি সনাতন ভারতাত্মা আবিষ্কারে প্রাণ ঢেলেদেওয়া ধরমপালজীর আবিষ্কৃত চেঙ্গলপট্টুর এক ব্রিটিশ সমীক্ষা থেকে এই তথ্যের প্রমাণ উঠে আসে ১৭৬২ থেকে ১৭৬৬ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের এক সমীক্ষায় প্রকাশ, কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকরা ছিল ৩০ শতাংশের আশেপাশে মাত্র, বাকিরা অন্য জীবিকায় চেঙ্গলপট্টুর মন্দিরগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জমিগুলির অভিধা ছিল মান্যম যত বিশালকায় মন্দির তত বেশি বেশি মান্যমের পরিমান তত বেশি তার সামাজিক দায় মান্যমের আয় থেকেই এই মন্দিরগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতেন সামাজিক প্রযুক্তি, বিদ্যা, কারখানা, শিল্পকলাসহ নানান কার্যে নিযুক্ত পেশাদার মানুষদের যদিও এই সব জীবিকায় নিযুক্ত বিশেষজ্ঞরা কেউই মাইনে করা কর্মচারী ছিলেন না এমনই ছিল তাঁদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সমাজিক নিয়ন্ত্রণে থেকেও তারা সকলেই সমাজ বিকাশের গতিশীল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমনকী মান্যমের বরাদ্দ থেকে বাদ পড়তনা মসজিদও মন্দির-মসজিদকে কেন্দ্র করে যে অসম্ভব গতিশীল এক সংস্কৃতি ভারতীয় সমাজ হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠছিল ব্রিটিশরা শাসন ক্ষমতা পাওয়ার পর প্রত্যেক মন্দিরের বরাদ্দ হল ১৭০০ ডলারের কাছাকাছি অর্থ যা ব্রিটিশ ভারতের শাসনক্ষমতার কাঠামো ছেড়ে যাওয়ার পরও বর্তমান ছিল ভারতীয় সমাজ ভাঙার দিকে আর এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং এই কাজে শহুরে কোনো শিক্ষতসমাজই প্রতিবাদ করে নি স্বাধীনতার পর সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন ব্রিটিশ দেখানোর পথ সম্পদ বাঁচানোর পাশাপাশি যথাসম্ভব উপযুক্ত পরিমান ব্যয় করে, সামাজিক কৃতিগুলি রক্ষা করার কাজে অননুকরণীয়ভাবে দক্ষ, ভারতীয় সমাজকে মাটিতে মেশানোর কাজ করে গিয়েছে ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে শিক্ষিত বাঙালি অথবা ভারতীয় মান্যবরেরা সে সময় ব্রিটিশপথানুগামীহতে গিয়ে, ব্রিটিশ চক্রান্তে সামিল হতে গিয়ে গান্ধীর ঘোষিত শত্রু নোবেলবিজয়ী চার্চিল অথবা তার উত্তরাধিকার বহনকরা শ্রমিক দলের প্রধাণমন্ত্রী এটলিও গান্ধীর থেকে বেশি পছন্দ করতেন আদ্যপান্ত পশ্চিমি আর ভারতে ব্রিটিশ সভ্যতার উত্তরাধিকারের চাকা চালুরাখায় দায়বদ্ধ জবাহরলালকেই তাই ভারত পিঠেভাগের সময় জবাহরলালগোষ্ঠীর কথা শুনতেন মাউন্টব্যাটেনসাহেব

সাম্রাজ্যের বন্ধুরাঃ উচ্চ-মধ্যবিত্তের ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ৪


পরে শহুরে এংলিসিস্টদের ইংরেজবাদী আন্দোলনের সরাসরি অভিঘাতে বেন্টিঙ্ক, ট্রেভলিয়ান বা মেকলেরমত সাম্রাজ্যবাদীদের হাত ধরে, দেশের গ্রামীণ চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে ভেঙে ফেলে, যে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা পদ্ধতি ভারতের শহরগুলোয় প্রবেশ করবে, ভারত স্বাধীণ হওয়ার পরও তার সুফল ভোগ করে দেশ শাসনের অধিকারী হবে ব্রিটিশপথানুগামী ছদ্ম-ঔপনিবেশিক বাঙালি তথা শহুরে ভারতীয়রা আজ জোর দিয়ে বলা দরকার, এংলিসিস্টদের আন্দেলন কিন্তু শুধু ইংরেজি মাধ্যমে পঠন-পাঠন ব্যবস্থা চালুকরার দাবিমাত্র ছিল না, বরং সে আন্দোলন ছিল আরও বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন সৃষ্টিকারী - ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতিকে নতমস্তকে ভারতের মাটিতে শেকড় গজানোর, ভারতীয় সাম্রাজ্যে শেকড় বিছোনোর সরাসরি উচ্চ-মধ্যবিত্তিয় চক্রান্ত অনেক দশক পরের ভারতআত্মাসন্ধানী বহু লেখক-গবেষক-উত্সাহী সে সময়কার এংলিসিস্টদের আন্দেলনের বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশজ সংস্কৃত বা আরবি-ফারসী মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার ওরিয়েন্টালিস্টদের আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন দৃঢ়ভাবে বাস্তব হল, দুপক্ষই আদতে ধণিক-বণিক-মধ্যউচ্চশ্রেণীর শহুরে সীমিত শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে অন্ততঃ ব্রিটিশ  সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে মাসিক প্রায় পাঁচহাজার টাকা রোজগার করেও সে ধন ব্যক্তিগত বা পরিবারের সদস্যদের ভোগকরতে না দেওয়ারমত নতুন পথ তৈরি করা বিদ্যাসাগরমশাই নিজেই সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন মেকলের শিক্ষা প্রস্তাবের সমর্থনে লৌকিক ভারতজুড়ে যে সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার শেকড় প্রোথিত হয়েছিল সমাজের অন্তঃস্থলে, কয়েক হাজার বছরের গ্রামীণ ভারতের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, এই দুই আন্দোলন আদতে সেই হাজার হাজার বছরের প্রচেষ্টায় গড়ে-বেড়ে ওঠা সার্বজনীন সমাজভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার চরম বিরোধিতার পথে হেঁটে ভারতকে বিশেষ করে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শে ঢেলে সাজাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে গিয়েছে
মনে রাখতে হবে পাদরি এডামের রিপোর্ট শুধু বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলে তাই নয়, এর পাশাপাশি ভারতের অন্যদুই প্রান্ত মাদ্রাজ আর পাঞ্জাবের দুটো রিপোর্ট যথাক্রমে Survey of Indigenous Education in the Madras Presidency in 1822-26 এবং G.W. Leitner-এর  History of Education in the Punjab since Annexation and in 1882-এও সার্বজনীন সামাজিক শিক্ষার পরিবেশের বর্ণনা পাই তত্কালীন উচ্চবেতনে নিযুক্ত কোম্পানির সরকারি উচ্চ পদের আমলাদের, ভারত ভাঙার প্রকল্পে উঠে আসা তথ্য নির্ভর, ভারতীয় সমাজ বিশ্লেষক, ব্রিটিশ কোম্পানি আর রাজ শাসনের কঠোরতম সমালোচক, ঋষি মার্কসের ভারতের সমাজের কাঠামো ভাঙা আর গড়ার প্রায়-নির্দেশিত পথে অসি হাতে ব্রিটিশরা ভারতীয় সমাজের ভিত্তিভূমি ভাঙার কাজ করেছে, চিরাচরিত জ্ঞাণ ভাণ্ডারে চৌর্যবৃত্তি করে তাকে নিজের করে নেওয়ার কাজে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তি, লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়োজিত রেখেছে দুর্ভাগ্য ভাঙন-কর্মটির ঐতিহাসিক দায় পূরণ করেছেন সে সময়ের ভারতীয়রা মসিঅস্ত্রমাত্রটি হাতে নিয়ে, নিজের সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে - শুধু এইটুকু বলে দায় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা যদি এই স্বাধীণ ভারতেও চলতে থাকে, তাকে ব্রিটিশ-ভারতীয় মধ্যবিত্তের যৌথ চক্রান্ত ছাড়া আর কী ভাষায়ইবা অভিহিত করা সমীচীন হতে পারে কে জানে বলাযাক, শুধুই ভারতীয়রা বললে শিল্পবিপ্লবের ধাত্রীভূমি ব্রিটিশিয় পদ্ধতিতে সত্যের অপলাপ হবে, অন্যান্য ভারতীয় সমাজকে হেয় করা হবে বলাভাল, প্রথম সত্তর বছরে সম্রাজ্যের এ সমাজভাঙার চক্রান্তের কাজে সর্বান্তকরণে ব্রিটিশ সহযোগী হয়েছিলেন বর্ণকুলীন শহুরে বাঙালি ব্যবসায়ী-চাকুরিজাবি সমাজ চক্রান্তের ভাগিদারির সুফলও পেয়েছেন শহুরে সমাজ হাতে গরমে সমাজভাঙার কাজ করে কেউবা হয়েছেন কেউকেটা, কেউবা পেয়েছেন ব্যবসার অংশিদারিত্ব, কেউবা পেয়েছেন সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূতের সম্মান, আবার কেউবা চিরযুবার মুকুট(ইয়ং বেঙ্গল)
পাদরি এডামের সমীক্ষা ধার করে যে তথ্য কয়েক ছত্র আগে বলাগিয়েছে, সে তথ্যকথা আবারও নতুন করে তুলে আনা যাক এংলিসিস্টদের আন্দেলনের একটি পরোক্ষ বক্তব্য ছিল সনাতন ভারতীয় জ্ঞান, গুরু আর ধর্মমুখী শুধু নয়, ভারতের পঠশালার অন্যতম সুবিধেভোগী ছিলেন ভারতের উচ্চবংশীয়রা গ্রামীণ তথা শহুরে বাংলার পাঠশালাগুলোতে নিম্নবর্ণের ছাত্রদের প্রবেশাধিকার ছিলনা এংলিসিস্টরা সে সময় খোঁজ করে দেখেন নি, ইংলন্ডের অক্সফোর্ড বা গ্রামার স্কুলগুলোতে প্রবেশাধিকার পেতেন দেশের অর্থবান আর সমাজবর্ণকুলীন পরিবারের সন্তানেরা কিন্তু এডামের রিপোর্টে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্ণনায় ঠিক এরই উল্টো তথ্যকথা বলা হয়েছে স্পষ্ট করে দুর্ভাগ্যের বিষয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপকারিতায় আস্থারাখা এডামের রিপোর্টের সঠিক বিশ্লেষণ শহরের সামাজিক পরিসরে খুব একটা হয়নি প্রাথমিকভাবে ধরমপালজী আর দুএকজন ব্যতিক্রমী বিশ্লেষক-গবেষক-উত্সাহী ছাড়া, ভারত তথা বাংলার সনাতন সমাজের প্রতি অশ্রদ্ধায়, দায়সারা কাজেলিপ্ত নানান বর্ণকুলীন গবেষক তাদের গবেষণার কাজে নমঃনমঃকরে সমীক্ষার কথা তুলেইমাত্র কাজের অভিমুখ অন্যপানে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছেন পূর্ববাংলার বার্মাপ্রান্তথেকে বিহার পর্যন্ত, আবার জোর দিয়ে উল্লেখ করি, সমাজ পেষিত প্রায় প্রত্যেকটি পাঠশালায় যে সব ছাত্র পড়াগ্রহণ করত তাদের একটা বড় অংশ আজকের লব্জে নিম্নবর্ণের
হাজার হাজার বছর ধরে ভারত সমাজ যে জ্ঞাণ বিতরণ করে এসেছে সারা বিশ্বে, সেই জ্ঞাণকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত অসীম পরিমান লাভ আর মুনাফার পাহাড় তৈরি করার অধিকার শহুরে সমাজের হাতে অর্পণ করেননি সমাজের ধারক বাহকেরা ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, পাল আমলে সমাজ পোষিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজারা পরিদর্শনে এলে ছাত্রছাত্রীরা রাষ্ট্রের অছি, রাজাকে সম্মান-অভ্যর্থনা জানাতেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই পাঠে বিঘ্ন ঘটিয়ে, পাঠ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রণাম জানানোর রীতি ছিল না এমনই প্রায়-সার্বভৌম অধিকার ছিল সমাজের সনাতন সমাজ তার অর্জিত জ্ঞাণ-প্রযুক্তি শিক্ষার অধিকার বিদেশিকেও দিয়েছিল ভারতে নালন্দারমত বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ছাত্ররা পড়াশোনা করে জ্ঞান আহরণ করে দেশি মাটিতে ফিরে গিয়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বিদেশে ব্যবসা করতে গিয়ে জ্ঞাণ বিতরণ করছেন এমন তথ্যও সুলভ পাঁচশো বছর আগেও জেসুইট পাদরিরা অংক বিদ্যা, পর্তুগিজরা চিকিত্সা বিদ্যাসহ ভারতের নানান জ্ঞাণ-প্রযুক্তি নথিবদ্ধ করে নিয়ে গিয়েছেন নিজেদের দেশে তখন ভারতীয় সমাজ তখন প্রায় সব কিছুতেই উত্তমর্ণ মেধাস্বত্বের নাম করে জ্ঞাণ নিয়ে ব্যবসার পথে হাঁটতে ঘৃণা করেছে জ্ঞাণ তাপস ভারতীয় সমাজ জ্ঞাণকে কুক্ষিগত করার পথে কদাচ হাঁটেনি সারা বিশ্বে শুধুই জ্ঞাণ বিলিয়েছে সে পাদরি এডামএর সমীক্ষায় সেই প্রমাণটি আবারও নতুন করে সামনে এল যতই বিলোবে জ্ঞাণ, তত যাবে বেড়ে এই সরল অথচ সাধারণ সামাজিক দর্শণে বলীয়ান ছিল বাংলার আর ভারতের নানান সমাজ জ্ঞাণ, দর্শণ আর প্রযুক্তির স্বভাবিক লেনদেন ছিল ভারতীয় আন্তঃসমাজেও নানান তীর্থস্থান, মেলা, উত্সবসহ বিভিন্ন কারণে যখন গ্রামীণ ভারতীয়রা একত্রে জড়ো হতেন, তখন তাঁরা আদান প্রদান করতেন পারস্পরিক অর্জিত জ্ঞান-বিদ্যা-প্রযুক্তি-ভাবনার এই চর্চা ব্রিটিশরা আসার আগে পর্যন্ত ভারতীয় সমাজে সজীব ছিল, কেননা রাষ্ট্রের ক্ষমতা ছিলনা এধরণের সামাজিক উদ্যমে হস্তক্ষেপ করা, অথবা সমাজের অনুমতির বাইরে গিয়ে নীতি প্রণয়ন করার যে সমাজ সারা বিশ্বকে একদা জ্ঞাণ-প্রযুক্তি অবলীলায় দান করেছে, সেই সমাজকে অমানবিক অশ্রদ্ধায়, পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে পিছিয়ে পড়া, সামন্ততান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন বলে দাগিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত আজ আজও একটু নতুনকরে ভেবে দেখি

সাম্রাজ্যের বন্ধুরাঃ উচ্চ-মধ্যবিত্তের ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ৩


১৮৩৮এ পাদরি উইলিয়ম এডামের শিক্ষা সমীক্ষা নিয়ে, পরে স্বাধীনভারতে নানান স্তরে বেশ কৌতুহল উদ্রেক হবে এবং ভারত সমাজের অন্তরাত্মা উদ্ধারক শ্রীধরমপালজী সেই তথ্য ব্যবহার করবেন তার দ্য বিউটিফুল ট্রি বইখানিতে অপূর্ব দক্ষতায় এডাম প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কার্যকারিতায় বেশ আস্থাভাজন ছিলেন ১৮১৮ সালে ভারতে ধর্মপ্রচার করতে আসা ব্যাপটিসিট মিশনারি এডাম পরে ধর্মপ্রচারের থেকে যে কাজটি বেশি করেছেন সেটি হল সাংবাদিকতা এডাম, তার কাজের তাত্বিক রসদ সংগ্রহ করতেন সাম্রাজ্যবাদী উইলিয়ম উইলবারফোর্স, মেকলে আর বড়লাট উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের দর্শণ থেকে যদিও এটি সরকারিভাবে তত্কালীন সরকারের সমীক্ষা না হলেও গভর্ণর জেনারেলের বেন্টিঙ্কের আদেশবলে এবং কোম্পানির আর্থিক সহায়তায়, কোম্পানির ফরমায়েসে তিনি ১৮৩৬ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত সমীক্ষা করেন, যে সমীক্ষার পরে পেষাকি নাম হবে Reports on the State of Education in Bengal 1836 and 1838 ১ জুলাই ১৮৩৬ প্রথম(বাংলার বিভিন্ন জেলায় প্রথাগত শিক্ষা পদ্ধতির হাল হকিকত আর তথ্যাবলী বর্ণনা), ২৩ ডিসেম্বর ১৮৩৬ দ্বিতীয়(রাজসাহী জেলীর নাটোর থানার সেসময়কার শিক্ষা ব্যবস্থার লেখাজোখা), ২৮ এপ্রিল ১৮৩৮ তৃতীয় ও শেষ(মুর্শিদাবাদের একাংশ, গোটা বীরভূম, বর্ধমান, দক্ষিণ বিহার ও ত্রিহুতের শিক্ষা ব্যবস্থার সমীক্ষার সঙ্গে যোগ হয়েছে এডামের বিশ্লেষণ, সুপারিশ, সমীক্ষার ইতিটানন), এই তিন দফায় জমা পড়া সমীক্ষায় যে সনাতন বাংলা-বিহার সমাজের শিক্ষাদানব্যবস্থার তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছেন পাদরিমশাই, মনেরাখতে হবে, সেই সমাজকে ব্রিটিশেরা কিন্তু ততদিনে শোষণ করে ছিবড়ে করে ফেলেছে, সমাজ বাঁধনের গ্রন্থিগুলো আলগা করে পটাপট ছিঁড়ে ফেলছে সরাসরি অস্ত্র নিয়োগ করে, বাংলা সুবা থেকে বছরে কোটি কোটি ডলারের অর্থ, কাঁচামাল চালান হয়ে চলেছে ব্রিটিশ মুলুকে বাঙালি মধ্যবিত্তের বৌদ্ধিক সহায়তায়, আরও গভীরভাবে বলাভাল ব্রিটিশ-বাঙালির যৌথ চক্রান্তে, যার ছিটেফোঁটালভ্যাংশগুড়ের ভাগ পেয়েছে চক্রান্তের সম্রাজ্যের সরাসরি বন্ধু বাঙালি মধ্যউচ্চবিত্ত দল আর গোষ্ঠীপতিরা ভারতীয় সমাজ, বিশেষ করে বাংলা সুবার প্রত্যেকটি অঞ্চলের তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রকৃতিক সম্পদ, জ্ঞাণ, সামাজিক উত্পাদনের শেষবিন্দু পর্যন্ত লুণ্ঠন করে, সমাজের সঙ্গে একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে রক্ত হোলি খেলে, সনাতন সমাজের শিল্প আর শিক্ষা পরিকাঠামো ভেঙে, নিজেদের দেশেও হাজার হাজার খেটে খাওয়া মানুষের শবদেহের ওপর গড়ে উঠছিল মানুষমারা ব্যক্তিকেন্দ্রিক মুনাফাভোগী শিল্পবিপ্লবের ভিত্তিপ্রস্তর যে সভ্যতা তার গড়ে ওঠার দুশো বছরের মধ্যেই ত্রাহি ত্রাহি রবে ভেঙে পড়তে শুরু করবে চুরচুর হয়ে
পাদরি এডামএর সমীক্ষা থেকেই অনেকগুলো অবাক করা তথ্য বেরিয়ে আসে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হল, বেশ কয়েকটা লুঠেরা মন্বন্তর, বিদ্রোহ আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারি সহায়তায় মধ্যবিত্তের সরাসরি উদ্যোগে দেশজ শিল্পধংসকরণপ্রকল্প পেরিয়ে আসা সেই ছিবড়ে সমাজ এক লক্ষেরও বেশি পাঠশালার ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা ধরত সে আন্তরিক উদ্যম তখনও সে ভেঙে যাওয়া বাংলা সমাজের ছিল শোষিত, লাঞ্ছিত বাংলার বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজ তখনও সেই পাঠশালাগুলি, বিদ্যাকেন্দ্রগুলি বুকে ধরে, সযত্নে বাঁচিয়ে রাখার দায় নিয়েছিল অসীম মমতায় এই পাঠশালাগুলোতে পড়ানো হত সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার নৈতিক-দার্শনিক সূত্রাবলী ছাড়াও নানান পর্যায়ের বিভক্ত কারিগরী-প্রযুক্তির জ্ঞাণ বাংলার অনেক গ্রামে তখন একটিরও বেশি, কোনো কোনো কসবায়(সমৃদ্ধশালী বড়গ্রাম) ছটিও পাঠশালার অস্তিত্ব উল্লেখ করেছেন পাদরিমশাই তার তিনদফা সমীক্ষায় লৌকিক বাংলার এই শিক্ষাসাজ, সমাজের সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার দর্শণ, সমাজের সবার জন্য শিক্ষাসত্রে পাঠদানের আয়োজন, আজও আশ্চর্যজনক শুধু নয়, বাস্তবে এক মহতি উদ্দেশ্যওবটে অথচ ব্রিটিশ অনুগামী শহুরে-বাংলা আর কোম্পানি সরকার এই সনাতনে সার্বজনীন জ্ঞাণদান কাঠামো ভেঙে যে ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি ভারতে রোপণ করতে চাইছিল, সেই সময়কার ব্রিটেনের শিক্ষাব্যবস্থায় তখনও সার্বজনীন শিক্ষার ধারণাটাই আসেনি, শিক্ষা ছিল মুষ্টিমেয়র ক্রয় যোগ্যবস্তু, এমনকী পঞ্চদশশতক থেকে বাইবেলও পড়ার অধিকার ছিলনা জনগণেশের বলা হয়ে ছিল, ‘that the English Bible should not be read in churches. The right of private reading was granted to nobles, gentry and merchants that were householders. It was expressly denied to artificers’ prentices, to journeymen and serving men “of the degree of yeomen or under”, to husbandmen and labourers’ so as ‘to allay certain symptoms of disorder occasioned by a free use of the Scriptures.’(ধরমপালজীর দ্য বিউটিফুল ট্রি বইটি থেকে গৃহীত) অন্যদিকে এই গুরুভার তথ্য লুকোতে ব্রিটিশ আর তার লুঠেরা সাম্রাজ্যে সহচর-অনুচর হয়ে খুদকুঁড়ো অর্জন করে ধনলাভ- খ্যাতিলাভ করা বাঙালিরা ধুয়ো তুলেছিল ভারতে নাকি নিম্নবর্ণের শাস্ত্রপাঠ নিষেধ আর তার সঙ্গে চিলচিত্কারে উঠছিল সনাতন সমাজের নানান ধরনের রিফর্মের দাবি! চালুনির আবার ছুঁচের বিচার!