Wednesday, December 7, 2011

Khon - Asor Bandana





Sunday, December 4, 2011

খন লোকনাট্যের বাজনদারেরা




মালাকার সম্প্রদায়ের সরতাজ শিল্পী মধুমঙ্গল মালাকারের দিনাজপুরের ইটাহারের কাছে মুষ্কিপুর গ্রামে কার্তিক পুজো হয়েছিল ১৭ থেকে ১৯ নভেম্বর, ২০১১. কলাবতী মুদ্রা এ বছর সেই পুজোর সাক্ষী ছিল. কাতিপুজোর নানান অভিজ্ঞতা, আলপনা, পুজোর উপাচারসহ বিসর্জনের ছবিও আমরা পরিবেশন করব এখানে. 
কিন্তু এখন বিসর্জনের পরেরদিন ঊষাহরণের একটি দল দিনাজপুরের লোকনাট্য খন পরিবেশন করে. এখানে খনের বাদ্যযন্ত্রীদের ছবি দেওয়া হল. ভবিষ্যতে নাট্যের নানান ছবি পরিবেশন করা যাবে 

Saturday, December 3, 2011

মধুমঙ্গল মালাকারের সম্মাননা




দক্ষিণ দিনাজপুরের সাংবাদিকদের সংস্থা বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের অন্যতম সম্পাদক মধুমঙ্গল মালাকারকে সম্বর্ধনা দিলেন.
আমরা সংস্থার সদস্যবৃন্দ এবং বাংলার তাবত লোক শিল্পী, তাঁর এই সম্মাননায় সম্মানিত. 

Tuesday, November 1, 2011

এডামের শিক্ষা প্রতিবেদন৫

ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের উচ্চ পাঠশালাগুলির বিভাগকরণ
১. শিখ দেশি পাঠশালা – গুরমুখী
২. মুসলমান দেশি শিক্ষা ব্যবস্থা – মক্তব, মাদ্রাসা(ধর্মীয়, অধর্মীয়), কোরাণ পাঠশালা
৩. হিন্দু দেশি পাঠশালা – চাটশালা(ব্যবসায়ীগের জন্য), পাটশালা(ধর্মীয়), পাটশালা(আধা ধর্মীয়), বিভিন্নস্তরের অধর্মীয় পাঠশালা
৪. মেলানো মেশানো দেশি পাঠশালা – পারসি পাঠশালা, ভারনাকুলার পাঠশালা, এংলো-ভার্নাকুলার পাঠশালা
৫. মেয়েদের জন্য দেশি পাঠশালা – শিখ মেয়েদের জন্য, মুসলমান মেয়েদের জন্য, হিন্দুমেয়েদের বাড়িতে পড়ার জন্য
তাঁর করা বাংলার এবং দেশের নানান প্রান্তের সমীক্ষা ভিত্তি করে এডাম দেশিয় পাঠশালাগুলোর আরও বিশদ বিভাগ তৈরি করেছেন
ক)মক্তব অথবা মাদ্রাসা – ১. বিভিন্ন স্তরের এবং নির্দিষ্ট বিষয় পড়াবার জন্য আরবি পাঠশালা(স্কুল) আর উচ্চ পাঠশালা(উচ্চতর পাঠশালা) ২। বিভিন্ন স্তরের এবং নির্দিষ্ট বিষয় পড়াবার জন্য পারসিক-আরবি পাঠশালা(স্কুল) আর উচ্চ পাঠশালা(উচ্চতর পাঠশালা) ৩. কোরাণ পাঠশালা- শুধুই কোরাণ পড়াবার জন্য ৪. পারসিক-কেরাণ পাঠশালা, ৫. কোরাণ-আরবি পাঠশালা, ৬. পার্সি-কোরাণ-আরবি পাঠশালা, ৭. পারসিক পাঠশালা, ৮. পারসি-উর্দু পাঠশালা, ৯. পারসি-উর্দু-আরবি পাঠশালা, ১০. আরবি বৈদ্য উচ্চ পাঠশালা, ১১. পার্সি-আরবি বৈদ্য উচ্চ পাঠশালা,
খ) গুরমুখী পাঠশালা – ১২. গুরমুখী পাঠশালা ১৩. গুরমুখী এবং ল্যান্ডে পাঠশালা
গ) মহাজনী পাঠশালা – ১৪. বিভিন্ন ধরনের ল্যান্ডে পাঠশালা(চাটশালা), ১৫. নাগরি ল্যান্ডে পাঠশালা, ১৬. পার্সি ল্যান্ডে পাঠশালা
ঘ) পাঠশালা- ১৭. নাগরি-সংস্কৃত পাঠশালা ১৮. সংস্কৃত ধর্মীয় পাঠশালা, ১৯. সংস্কৃত অ-ধর্মীয় পাঠশালা(বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয়), ২০. সংস্কৃত আধা-ধর্মীয়(সেমি-সেকুলার) পাঠশালা, ২১. সংস্কৃত বৈদ্য পাঠশাশালা(চিফলি) ২২. হিন্দি সংস্কৃত পাঠশালা, ২৩. সংস্কৃত জোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষবিদ্যা পাঠশালা(চিফলি)
ঙ) মহিলাদের দেশি পাঠশালা(আগে বলা হয়েছে)
যে সব সংস্কৃত পুঁথি পড়ানো হত
বালবোধ, অক্ষর দীপিকা
১.ব্যকরণ- সারস্বত, মনোরমা, চন্দ্রিকা, ভাষ্য, লঘু কৌমুদী, পাণীনি ব্যকরণ, কৌমুদী, সিদ্ধান্ত কৌমুদী, শেখর, প্রাকৃত প্রকাশ
২. শব্দার্থবিদ্যা(লেক্সিকলজি) - অমর কোষ, মালিনী কোষ, হলায়ুধ
৩. কবিতা, নাটক এবং ধর্মীয় ইতিহাস – রঘুবংশ, মহাভারত, মেঘদূত, বেণীসংহার, মাঘ, শকুন্তলা, কীরাত অর্জুণ, নৈষধ চরিত, রামায়ণ, মৃচ্ছকটিক, শ্রীমদ ভাগ্বত, কুমার সম্ভব, অন্যান্য পুরাণ
৪. রেটরিক – কাব্য দীপক, কাব্যপ্রকাশ, সাহিত্য দর্পণ, দশরূপ, কুবলয়ানন্দ
৫. অঙ্ক, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষবিদ্যা- সিদ্ধান্ত শিরেমণি নীলকান্তি, শীঘ্রবোধ, বৃহত্ জাতক, পারাশরীয়, গর্ভলগ্ন
৬. বৈদ্যবিদ্যা – শ্যামরাজ, নিঘান্ত, শুশ্রুত, শারঙ্গধর, চরক, ভাষ্য পরিচ্ছেদ, মাধব নিদান, ভাগবত
৭। ন্যায় – ন্যায় শ্রুত বৃত্তি, গদাধরী, ভূতপ্রতিবাদ, তর্কালঙ্কার, তারক সংগ্রহ, কারিকাবলী,
৮. বেদান্ত – আত্মবোধ শরীরক, পাঁচদশী
৯. স্মৃতি – মনুস্মৃতি, পরাশর স্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক গৌতম, মীতাক্ষর
১০. দর্শণ – সাংখ্য তত্ব কৌমুদী, পতঞ্জলী ভাষ্যসহ সূত্র বৃত্তি সূত্র, সাংখ্য প্রবচণ ভাষ্য যোগ সূত্র, বেদান্ত- ভাষ্যান্তর, বৈশেষিক- সিদ্ধান্ত মুক্তাবলী সূত্রসহ ভাষ্যসহ বিবৃতি(আ কমেন্ট্রি), মীমাংসা সূত্রসহ ভাষ্য অর্থসংগ্রহ
১১. প্রসডি – শ্রুত বোধ, ভৃত্য় রত্নাকর
১২. গদ্য সাহিত্য – হিতোপদেশ, দশাবতার, দশকুমার চরিত
১৩. ধর্ম(রেলিজিয়ন) – ঋগ্বেদ সংহিতা, সংবাদ – মন্ত্রভাগ, যয়ুর্বেদ, শুক্ল য়জুর, ছন্দস্য আচারিকা(বেশি পড়ানো হয় না), বাজস্নেয়ী(Vajasneyi) সংহিতা।

এডামের শিক্ষা প্রতিবেদন৪

কলকাতা এবং ২৪ পরগণায় হিন্দুদের কতগুলি পাঠশালা ছিল এ তথ্য এডাম জানাতে পারেননি। তবে তিনি ১৮১৮ সালের উইলিয়ম ওয়ার্ডের একটি সমীক্ষা তুলেধরে বলছেন কলকাতার আশেপাশে ২৮টি পাঠশালা ছিল। ওয়ার্ড প্রত্যেকটি পাঠশালার শিক্ষকের নাম, কোন অঞ্চলে সেগুলির অবস্থান এবং কত বটু এই পাঠশালাগুলিতে পাঠ নিত তার উল্লেখ করেছেন। এই সব বিদ্যালয়ে ন্যায় আর স্মৃতিশাস্ত্রের পাঠদান হত। মোট বটুর সংখ্যা ছিল ১৭৩জন। উচ্চ পাঠশালাগুলিতে তিন থেকো ১৫জন বটু একজন শিক্ষকের কাছে পাঠ গ্রহণ করত। এদের নামগুলি
শিক্ষককের নাম এলাকা বটুর সংখ্যা
অনন্তরাম বিদ্যবাগীশ হাতিবাগান ১৫
রামকুমার তর্কালঙ্কার ঐ ৮
রামতোষন বিদ্যালঙ্কার ঐ ৮
রামদুলাল চুড়ামণি ঐ ৫
গৌরমণি ন্যায়লঙ্কার ঐ ঐ
কাশীনাথ তর্কবাগীশ ঘোষালবাগান ৬
রামসেবক বিদ্যাবাগীশ শিকদারেরবাগান ৪
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বাগবাজার ১৫
রামকিশোর তর্কচূড়ামণি ঐ ঐ
রামকুমার শিরোমণি ঐ ৪
জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন তালেরবাগান ৫
শম্ভু বাচষ্পতি ঐ ঐ
শিবরাম ন্যায়বাগীশ লালবাগান ১০
গৌরমোহন বিদ্যাভূষণ ঐ ঐ
হরিপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন হাতিবাগান ৪
রামনারায়ণ তর্কপঞ্চানন সিমলা ৫
রামহরি বিদ্যাভূষণ হরতুকিবাগান ৬
কমলাকান্ত বিদ্যালঙ্কার আড়কুলি ৬
গোবিন্দ তর্কপঞ্চানন ঐ ৫
পীতাম্বর ন্যায়ভূষণ ঐ ৫
পার্বতী তর্কভূষণ ঠনঠনিয়া ৪
কাশানাথ তর্কালঙ্কার ঐ ৩
রামনাথ বাচষ্পতি সিলমা ৯
রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত মলঙ্গা ৬
রামতনু বিদ্যাবাগীশ শোভাবাজার ৫
রামকুমার তর্কপঞ্চানন বীরপাড়া ৫
কালিদাস বিদ্যাবাগীশ ইটালি ৫
রামধুন তর্কবাগীশ সিমলা ৬
এডাম, ১৮০১সালের হ্যামিলটনের সমীক্ষা ভিত্তি করে বলছেন, কলকাতার আশেপাশে এবং সমগ্র ২৪ পরগণা জুড়ে ১৯০টি সনাতন উচ্চশিক্ষার পাঠশালা ছিল, যেখানে স্মৃতি, ব্যকরণ আর সাংখ্য পড়ানো হত।
ওয়ার্ডএর সমীক্ষা থেকে ধার করে এডাম নদিয়া জেলায় ৩১টি উচ্চশিক্ষার বিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করছেন। সব মিলিয়ে ৭৪৭জন বটু পাঠ নিত। ওয়ার্ডের সমীক্ষা অনুসারে নদিয়ার যে সব উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রের কথা বলছেন তা তুলে দেওয়া গেল
ন্যায় পাঠশালা
গুরুর নাম ছাত্রের সংখ্যা
শিবনাথ বিদ্যাবাচষ্পতি ১২৫
রামলোচন ন্যায়ভূষণ ২০
কাশীনাথ তর্কচূড়ামণি ৩০
অভয়ানন্দ তর্কলঙ্কার ২০
রামশরণ ন্যায়বাগীশ ১৫
ভোলানাথ শিরোমণি ১২
রাধানাথ তর্কপঞ্চানন ১০
রামমোহন বিদ্যাবাচষ্পতি ২০
শ্রীরাম তর্কভূষণ ২০
কালীকান্ত চূড়ামণি ৫
কৃষ্ণকান্ত বিদ্যাবাগীশ ১৫
তর্কালঙ্কার ১৫
কালিপ্রসন্ন ১৫
মাধব তর্কসিদ্ধান্ত ২৫
কোমলকান্ত তর্কচূড়ামণি ২৫
ঈশ্বর তর্কভূষণ ২০
কান্ত বিদ্যালঙ্কার ৪০

স্মৃতির উচ্চতর পাঠশালা
রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত ৪০
গঙ্গাধর শিরোমণি ২৫
দেবী তর্কালঙ্কার ২৫
মোহন বিদ্যাবাচষ্পতি ২০
গাঙ্গুলি তর্কলঙ্কার ১০
কৃষ্ণ তর্কভূষণ ১০
প্রাণকৃষ্ণ তর্কবাগীশ ৫
পুরোহিত ৫
কাশীকান্ত তর্কচূড়ামণি ৩০
কালীকান্ত তর্কপঞ্চানন ২০
গদাধর তর্কবাগীশ ২০
কাব্য পড়ানোর উচ্চতর পাঠশালা
কালীকান্ত তর্কচূড়মণি ৫০
জ্যোতির্বিদ্যা পড়ানোর উচ্চতর পাঠশালা
গুরুপ্রসাদ সিদ্ধান্তবাগীশ ৫০
ব্যকারণ পড়ানোর উচ্চতর পাঠশালা
শম্ভুনাথ চূড়ামণি ৫

এডামের শিক্ষা প্রতিবেদন৩

তিনি গুরুমশাইদের পাওয়া মাইনের সঙ্গে গ্রামের প্রায় একই স্তরের কাজ করা মানুষের রোজগারের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। স্থানীয় জমিদারদের নানান কাজে যারা নিযুক্ত হতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন পাটওয়ারি, আমিন, শুমারনাভি আর খামারনভিস। পাটওয়ারির কাজ ছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে জমিদারদের খাজনা উশুল করা, মাইনে পেতেন দুটাকা আট আনা সঙ্গে রায়তদের কাছথেকে শষ্য উঠলে বেশ কিছু জিনিষপত্তরও যার প্রায় মূল্য আট আনা, সবে মিলিয়ে তিন টাকা। আমিনদের কাজ ছিল জমিদারদের পক্ষে গ্রমের জমিজমার পরিমান মেপে বিবাদের সমাপ্তি ঘটাতেন। তিনি পেতেন মাসে সাড়ে তিন টাকা থেকে চার টাকা। শুমারনভিস পাটওয়ারিদের আদায়ের হিসেব রাখতেন, পেতেন পাঁচ টাকা প্রতি মাসে। আর অনেক জমিদার জমির ফসল থেকেই যখন খাজনা আদায় করার জন্য খামারনভিস রাখতেন তারা অনেক কম অর্থ পেতেন। জমিদারিতে যেসব আমলা কাজকরতেন তাদের অনেকেরই উপরি আয়ের সুযোগ থাকত, যে সুযোগটি এই গুরুমশাইদের ছিলনা।
গ্রামে পাঠশালার জন্য আলাদা করে গৃহ স্থাপিত হত না। যে স্থানে বটুরা পাঠ নিত সেই স্থানটি নানান কাজে নানাম সময়ে ব্যবহৃত হত। কেউ কেউ চন্ডিমন্ডপেই পাঠদিতেন, পাঠগ্রহণ ছাড়াও সেখানে সারা বছর নানান ধরনের পুজো, পার্বন ও অনুষ্ঠান হত। কোথাও কোথাও গ্রামের আড্ডার জন্য নির্দিষ্ট বৈঠকখানায়ও এই পাঠশালা আয়োজিত হত। কোনো কোনো পৃষ্ঠপোষক আবার নিজের বাস্থানের এক অংশ ছেড়ে দিতেন পাঠশালের জন্য। ৩০-৪০বটর জন্য যে সব পাঠশাল, সেগুলো বছরের শুকনো সময়ে খোলা যায়গায় আর বর্যার সময় তিন চারটি অস্থায়ী পাতায় ছাওয়া কুঁড়ে ঘরে হয়। বেশি বর্যা এলে বটুদের পাততাড়ি্ গুটেতে হত। ছাপার হরফে পুস্তকের কথা গ্রামাঞ্চলে কেউ জানতইনা বলা চলে। তবে কিছু কিছু ছাপাই পঞ্জিকা(এলম্যনাক) অবস্থাপন্ন পরিবারের গৃহস্থরা কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে যেতেন। একজনও গুরুমশাই ছাপার বই দেখেননি। এডাম এদের স্কুল বুক সোসাইটির প্রকাশনায় পুস্তক দেখান। গুরুমশাইরা এগুলো খুবেশি গুরুত্ব দেননি। সোসাইটি বইগুলি বিক্রির জন্য বাউলিয়ায় একজন দালাল ঠিক করেছে বলেও তিনি জানান। প্রত্যেক গুরুমশাই তাঁর স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে পাঠদান করতেন। পাঠশাল শেষ হত স্বরস্বতী বন্দনা দিয়ে। একজন নেতা পোড়ো এই বন্দনা আবৃত্তি করত, বটুদের প্রত্যেককে ভুঁইএ মাথা ঠেকিয়ে বন্দনার একটার পর একটা স্তবক আবৃত্তি করতে হত যাতে এই বন্দনাটি তাদের স্মরণে থাকে। এছাড়াও ছড়ায় ছড়ায় শুভঙ্করী(এডামের ভাষায় ককার অব বেঙ্গল)ও শেখানো হত।
বাঙলা মাধ্যমে শিক্ষাদানের চারটি স্তর ছিল। প্রথম পর্বে মাটিতে বাঁশের বাঁখারি বা লাঠি দিয়ে আঁক কেটে অক্ষর শেখানো হত। জেলায় সাধারণতঃ অর্থ সাশ্রয়ের জন্য বালির বেদি ব্যবহার করা হত। এই পর্ব দশ দিনের বেশি চলত না। দ্বিতীয় পর্বে তালপাতার ওপর লেখা আর অক্ষরের উচ্চারণ শেখানো হত। এসময় অক্ষরগুলোর মাপ শেখানো হত না। এই পর্ব চলত দুবছর থেকে চার বছর পর্যন্ত। এ সময় যুক্তাক্ষর, স্বরভক্তি(syllables formed by the junction of vowels with consonants), সাধাহর স্থান নাম, ব্যক্তির নামও শেখানো হত। অন্য গ্রামগুলিতে জাতি, নদী, পর্বত এত্যাদের নামও শেখানো হত। কড়ি আর শতকিয়াও শেখানো হত। কাথা(জমির মাপ) তালিকা, সের তালিকা(ওজনের মাপ)ও শেখানো হত। তৃতীয় স্তরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ। এ সময় প্ল্যানটোন পাতা(কলাগাছের পাতা!) দিয়ে শব্দ দিয়ে সরল বাক্য শেখানো হত। শব্দের কথ্য আর লেখন পার্থক্যও মুখে শেখানো হত(abbreviated in speech by the omission of a vowel or a consonant, or by the running of two syllables into one)। এই শেখাকে লিখতেও শেখানো হত। correct orthography of words of Sanscrit origin which abound in the language of the people। এই সময়ে বটুদের শেখানো হত সরল অঙ্ক, যোগ-বিয়োগ। কিন্ত গুণ আর ভাগ আলাদা আলাদা করে শেখানো হত না। গুনের নামতা ২০ অবদি মুখস্ত করতে হত। রোজ পাঠশালা শুরু হওয়ার পরই এই নামতা পড়ানো হত।
সাধারণ অঙ্ক শেখার পর কৃষি আর সাধারণ বাণিজ্যের অঙ্কও শেখানো হত। কৃষিতে বা বাণিজ্যে জমা-খরচের খাতা কীভাবে রাখতে হয়, তাও শেখানো হত। দৈনিক মজুরির হার থেকে মাসিক অথবা বার্ষিক মজুরির হার বার করতে হত। কাঠা আর বিঘার মধ্যেকার সম্পর্কও অঙ্ক কষে বার করতে হত। দৈর্ঘ, প্রস্থ দেওয়া থাকলে একটি জমির সাধারণ ক্ষেত্রফল কী হবে তাও জানতে হত। একটি নির্দিষ্ট পরিমান জমি থেকে কত খাজনা দেয় হয় তাও জানতে হত বটুদের। খাতা রাখার সাধারণ হিসেবও শিখতে হত বটুদের। সের মনএর মধ্যেকার আর তোলা আর ছটাক সম্পর্কও কষতে হত। প্রত্যক টাকায় আনা আর কড়ির সংখ্যাও শেখানো হত। এক টাকার সুদও কষতে হত। একটাকার কমের মুদ্রামানের বিনিময় মূল্য – বাটাও শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। চতুর্থ বা শেষস্তরে দুই বা তিন বছরের মধ্যে শেষ হত। এই পর্বে থাকত ব্যবসার পদ্ধতি, ব্যবসার চিঠি, গ্রান্ট, লিজ, একসেপটেন্স, হাত চিটা ইত্যাদি শেখানো হত। এক বছরের মধ্যে যে বটু নিজে নিজেই এ সমস্ত লিখতে পারত তাকেই কৃতকার্য রূপে ধরে নেওয়া হত। এছাড়াও রামায়ন মনসা মঙ্গলের নানান ছত্রও আবৃত্তি করতে হত।
সমীক্ষা অনুসারে বাংলায় তিন ধরণের উচ্চশিক্ষার উচ্চ পাঠশালা ছিল। কোথাও ব্যকরণ, অলঙ্কার, আর কোথাও কোথাও পৌরাণিক কাব্যও পড়ানো হত। দ্বিতীয়গুলিতে স্মৃতি আর কিছুটা পৌরাণিক কাব্য পড়ানো হত। তৃতীয় উচ্চ পাঠশালাগুলি লজিককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত। এই তিনধরণের বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট কিছু পাঠ্য পড়ানো হত। গুরুমশাই কিন্তু এই সব পাঠদান কেন্দ্রে দীর্ঘ বক্তৃতা দিতেন না। পাঠশালাগুলিতে ছাত্ররা নানান প্রশ্ন করত আর গুরুমশাই তার উত্তর দিতেন। প্রত্যেক শ্রেণীকক্ষে নির্দষ্ট মানের ছাত্রদের তাদের পাঠগ্রহণের ক্ষমতা অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে বসানো হত। সামনে পুঁথি খুলে সবথেকে ভাল পড়তে পারা ছাত্রটি সশব্দে পাঠগুলি উচ্চারণ করত, শিক্ষক তার উত্তর দিতেন। এই ভাবে পড়াশোনা এগোত। সাধারণ ব্যকরণ শিখতে দুই থেকে ছয় বছর পর্যন্ত সময় লাগত, কিন্তু পাণিনী শিখতে নিদেন পক্ষে লাগত দশ বছর কখোনো আবার বারো বছরও। ব্যকরণ শেখার পর কাব্য, মীমাংসা আর দর্শণও পাঠ নিতে পারত। যে সব ছাত্র ন্যায় অথবা মিমাংসা পড়ত তাদের সময় লাগত ছবছর পর্যন্ত। এমনকী তাকে অন্য বিদ্যালয়েও যেতে হত। ওয়ার্ড বলছেন একলাখ ব্রাহ্মণের মধ্যে এক হাজারমাত্র সংস্কৃত ব্যকরণ শিখতেন, এদের মধ্যে চারশ থেকে পাঁচশ কাব্য পড়তেন, পঞ্চাশ জন হয়ত অলঙ্কার শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। এই হাজারের মধ্যে শচারেক স্মৃতির পাঠোদ্ধার করতে পারতেন। এদের মধ্যে মাত্র জনা দশেক তন্ত্র সম্বন্ধে বিশারদ ছিলেন। ন্যায় বিশারদ ছিলেন শতিনেক, পাঁচ থেকে ছজন শুধু মিমাংসা, বেদান্ত, পতঞ্জলি, বৈশেষিক অথবা বেদ পড়াতে পারতেন। দশজন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। পঞ্চাশ জনের কাছাকাছি শ্রীভাগবত বা পুরাণ মুখস্ত করতেন।

এডামের শিক্ষা প্রতিবেদন২

এডাম পাঁচটি জেলায় যে বিষয়গুলি নিয়ে বিশদে তথ্য গ্রহণ করেন, ১) বুনিয়াদি পাঠাশালা আর বটুদের জাত বিভাগ, ২) ঐ আর গুরুমশাইদের জাত বিভাগ, ৩) কী ধরনের পাঠদানব্যবস্থা ছিল, ৪) সংস্কৃত শিক্ষার অবস্থা কী ছিল, ৫) সংস্কৃত শিক্ষায় কী ধরনের বই ব্যবহৃত হত, ৬) পারসিক আর আরবি উচ্চ পাঠশালাগুলির বিশদ ৭) এই উচ্চ পাঠশালাগুলোতে কী ধরনের বই ব্যবহার হত ইত্যাদি। পাঠশালাগুলি নিয়ে এডাম কী বলছেন একটু শুনি। তাঁর মতে বাংলা আর বিহার মিলিয়ে, ১,৫০,৭৭৪টি গ্রামে বাংলা-বিহারে এক লাখেরও বেশি পাঠশালা রয়েছে। সবকটি গ্রামে নাথাকলেও অধিকাংশতেই পাঠশালা বিদ্যমান। কোনো কোনো গ্রামে ছটাও পাঠশালার খবর পাওয়া যাচ্ছে। পাঠশালাগুলির উপযোগিতা নিয়ে এডামের বক্তব্য, It is not, however, in the present state of these schools, that they can be regarded as valuable instruments for this purpose। The benefits resulting from them are but small, owing partly to the incompetency of the instructors, and partly to the early age at which through the poverty of the parents the children are removed।
পাঠদান শুরু হত পাঁচ বা ছবছরেই। এই বুনিয়াদি শিক্ষাদান চলত পাঁচ বছর ধরে। বটুদের দেয় অর্থের ওপরেই গুরুমশাইদের দিনগুজরান হত। নিজেদের রোজগার বাড়াবার জন্য গুরুমশাইরা প্রতিবেশি অঞ্চল থেকে সম্মানীয় বা অর্থবান পরিবারের বটু ভর্তি করত। পাঠদানপদ্ধতি নিয়েও এডাম বিশদে বলেছেন। স্বরবর্ণ শিক্ষা সমাপ্ত হলে ব্যাঞ্জনবর্ণ শিক্ষাদান হত। মাটিতে বালি লেপে তার ওপরে আঙুল অথবা লাঠি্দিয়ে এই বর্ণগুলি মকশ করা হত। এরপর মাটিতে সাদা লাঠি দিয়ে ফুটিয়ে তোলাহত বর্ণগুলোর চেহারা। এই কাজটি চলত আট থেকে দশদিন পর্যন্ত। এরপর লালা রঙএ খাগের কলম তালুতে(এডাম স্পষ্ট বলছেন আঙুলে নিয়ে নয়) ধরে সেটি তালপাতার ওপর কালোরঙএর ভুসো কালিতে চুবিয়ে, স্বরবর্ণের সঙ্গে ব্যাঞ্জন বর্ণের মিলন, যুক্তবর্ণ, স্বরভক্তি(সিলেবল), শব্দ শিখতে হত। এ ছাড়াও তারা শিখত নিউমারেশন, টাকা, ওজন(ওয়োটস ওন্ড মোজার্স) আর বিভিন্ন ব্যক্তি, জাতি, ও স্থানের নাম সঠিকবর্ণে সঠিকভাবে লিখতে পারা শেখানো হত। এই কাজগুলি চলত এক বছর ধরে। এরপর এডভানসড স্টাডি। বাতির কালোশিষ ধরে কলাপাতায় শেখানো হত সাধারণ যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ। এরপর খুব সরল জমি, বাণিজ্য ও কৃষিকাজের জন্য পাটিগণিত শেখানো হত। গ্রামের পাঠশালাগুলিতে কৃষিবিযয়ক অঙ্ক বিশেষ করে করানো হত। আর শহরে নানান বাণিজ্যে দিকগুলি নিয়ে অঙ্ক শেখানো হত। তিনি বলছেন বটুদের নীতি শিক্ষা দেওয়ার জন্য কোনো বিদ্যালয়েই পাঠ্যপুস্তকের প্রচলন ছিলনা। তাঁর মতে এতে বটুদের নীতিশিক্ষা হত না।
তিনি বলছেন হিন্দু আইন অনুযায়ী বটুদের পাঠগ্রহনের প্রবেশের বয়স ছিল পাঁচ বছর। পাঁচবছরে না হলে, সাত বা নয়, বিজোড় বছরেও পাঠ শুরু হত। বছরের এক নির্দিষ্ট মাস, মাসের এর নির্দিষ্ট সপ্তাহ আর সপ্তাহের এক নির্দিষ্ট দিনেই একটি ছাত্রের পাঠদানপ্রক্রিয়া শুরু হত। এই দিনেই পরিবারের পুরোহিত, দেবী সরস্বতীর পুজো দিয়েই ছাত্রের হাত ধরে বর্ণের ওপর মকশ করিয়ে সেগুলি উচ্চারণ করতে বলতেন। তবে প্রত্যেক হিন্দুই যে এ ধরণের পুজো-অর্চনা পালন করত তা বলা যায় না, যাদের বিশেষরূপে পাঠদানের সামর্থ রয়েছে, একমাত্র তারাই এ ধরনের পুজার্চনা করতেন এবং পরেরদিন থেকেই সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতেন। তবে রাজসাহিতে এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট বয়স দেখিনি। ছাত্রের পাঠ গ্রহণ ক্ষমতা অথবা পরিবারের আর্থিক সামর্থের ওপরেই নির্ভর করত পাঠশালায় প্রবেশের বয়স। তবে কোন বয়সে শুরু করছে, তার ওপরেই নির্ভর করত কবে সে উচ্চ পাঠশালা থেকে কবে ছাড়া পাবে। তিনি নাটোরএর ১৭৬টি পাঠশালার উল্লেখ করছেন, যেখানে পাঠশালায় প্রবেশর বয়স পাঁচ থেকে শুরু করে দশ বছর পর্যন্ত ছিল। কোনো শিক্ষক থেকে শিক্ষকে পাঠদানের সময়সীমা বদলাত – পাঁচ থেকে দশ বছর।
শিক্ষকেরা তরুণ থেকে প্রবীণ পর্যন্ত হতেন। তারা সরল, সধারণ, অজ্ঞ(ইগনোরেন্ট) এবং গরীব তাই অন্য কোনো পেশায় প্রবেশের সুযেগ থাকে না। কিন্তু যে অঞ্চলে তাঁরা পাঠদান করেন সেই অঞ্চলে তাঁদের সম্মান ছিল অপরিমিত। তারা অনেকেই জানতেন না কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাঁরা করছেন। যে কাজ করছেন, তার পেছেনে তাদের খুব একটা ভাবনা চিন্তাও ছিল না। বটুদের ওপরেও তাদের প্রভাবও বেশি হত না। এছাড়াও শিক্ষকদের সম্বন্ধে তিনি খুব একটা উচ্চধারণা পোষণ করতেন না তা তাঁর প্রতিবেদন থেকেই স্পষ্ট। শিক্ষকদের সাম্মানিক আসত শুধুমাত্র বিভিন্ন সূত্রে। দুজন শিক্ষক তাঁদের সমগ্র আর অন্যরা সাম্মানিকটুকুর একাংশ পেতেন গ্রামের কোনো সহৃদয় দানশীল ব্যক্তির দান থেকে। এক চতুর্থাংশের সাম্মানিক আসত বটুদের দেয় অর্থের থেকে। অন্যান্যদের সাম্মানিক আসত কিছুটা অর্থ আর কিছুটা পণ্যদ্রব্যের বিনিময়ে। সাধারণ ভাবে তিনটিস্তরে পড়াবার মাধ্যমের বিস্তৃতি ছিল, প্রথমটি মাটি, তালপাতা, শেষ মাধ্যম ছিল কাগজ। প্রত্যেক স্তরে পাঠাদানের শুরু থেকে আরও একটু বেশি মাইনে ধার্য হত। কোথাও কোথাও প্রথম আর দ্বিতীয়স্তর একটিস্তর হিসেবেই দেখা হত। কোথাও কোথাও দ্বিতীয় আর তৃতীয়স্তরে একই মাইনে দাবি করা হত। কোথাও আবার প্রত্যক স্তরের জন্য একই অর্থের মাইনে ছিল। তবে সাধারণঃ প্রত্যেকস্তরের জন্য আলাদা আলাদা পরিমান অর্থই দাবি করা হত। আবার বটুদের পরিবারের স্বচ্ছলতার ওপর নির্ভর করত মাইনে। অর্থবানদের তুলনায় গরীব বটুদের কখোনো অর্ধেক, কোথাও একচতুর্থাংশ, কোথাও আবার একতৃতীয়াংশ অর্থ মাইনে হিসেবে নেওয়া হত।
গুরুদের মাইনে মাসে চার আনা থেকে শুরু করে পাঁচ টাকা পর্যন্ত হত। যারা কম অর্থ পেতেন তাদের কাপড় দেওয়া হত, আর চাষীদের কাছ থেকে চাষের জিনিষও পেতেন। এছাড়াও কেউ হয়ত শুধুই প্রতিদিনকার খাদ্য পেতেন, কেউবা এর সঙ্গে পরিধেয় ধোয়া, অথবা তাঁর সমস্ত খরচপাতিও পেতেন। যিনি খাদ্যপেতেন তাঁর হয় নিজের বাসস্থান থাকত অথবা গ্রামের অবস্থাপন্ন ব্যক্তির ভদ্রাসনে থাকতেন। সামগ্রিকভাবে শুধু আর্থিক অথবা কিছুটা আর্থিক আর কিছুটা অন্যান্যভাবে যাঁরা রোজগার করতেন, তাঁদের প্রত্যেক মাসের রোজগার ছিল তিনটাকা আটআনা থেকে সাত টাকা আট আনা পর্যন্ত, গড়ে পাঁচটাকার বেশি সকলেই রোজগার করতেন। তিনি উদাহরণস্বরূপ ধারাইলের বিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এই গ্রামে চৌধুরিদের চারটি পরিবার বাস করত। এরাই গ্রামের সম্ভ্রান্ত। কিন্তু এদের আর্থিক অবস্থা এত ভাল ছিলনা, যে অন্যান্যদের সাহায্য ব্যাতীত তাঁরা গুরুমশাই নিয়োগ করতে পারেন। এংরা বাড়ির এক অংশে গুরুমশাইএর থাকার ব্যবস্থা করেন, যেখানে বটুরা পড়াশোনাও করত। এই স্থানটি পুজোর জন্যও ব্যবহার হত আবার অতিথি নিবাসও ছিল। দুটি পরিবার চারআনাকরে, তৃতীয় পরিবার আটআনা আর চতুর্থজন বারো আনা এই কাজে দিতেন। এর বাইরে তাঁরা আর কোনো কিছুই দিতেন না। এই অর্থে পাঁচটি বটু বাঙলা ভাষায় শিক্ষা পেত। কিন্ত এই অর্থে গুরুমশাইএর চলা মুশকিল ছিল, তাই তিনি অন্য পরিবার থেকে বটুর ব্যবস্থা করতেন – এক বটু দিত একআনা, একজন তিন আনা, পাঁচজন চার আনা করে গুরুমশাইকে মাসে সাম্মানিক দিত। এর বাইরে নানান শষ্য, মাঠ, চাল আর কখোনো কখোনো কেউ রুমাল(গামছা!), ফতুয়ারমত(আপার গার্মেন্ট) নানান পরিধেয়ও দিত। কাগবাড়িয়ার দুটি পরিবারের পাঁচটি বটু ধারাইল পাঠশালায় পাঠ নিত। এই দুই গ্রামের মধ্যে প্রায় এক মাইলের পার্থক্য।

এডামের শিক্ষা প্রতিবেদন১

অষ্টাদশ শতাব্দ পর্যন্ত নানান সামাজিক-অর্থনৈতিক ঝড়-ঝাপটা সহ্যকরে বাংলার সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়িয়েছিল মাথা উঁচু করে। উইলিয়ম এডাম ১৮৩৫-৩৮ পর্যন্ত সমীক্ষা করে বাংলা-বিহারে অন্ততঃ এক লাখ পাঠশালা দেখেছেন। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই রেভারেন্ড এফ ই কে লিখছেন, “there was---, before the British Government took over the control of education in India, a widespread, popular, indigenous system। It was not confined to one or two provinces, but was found in various parts of India, though some districts were more advanced than others। In the inquiry made for the Madras Presidency in 1822-26, it was calculated that rather less than one-sixth of the boys of school-going age received education।।। In the similar inquiry made for the Bombay Presidency (1823-28), the number of boys under instruction was put down to about one in eight।।।” ১৮১৪ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরদের পাঠানো প্রথম এডুকেশন ডেসপ্যাচ এপর নির্ভর করে এ পি হাওয়েল ১৮৫৪তে বলবেন, “There is no doubt that from time immemorial indigenous schools have existed।।। In Bengal alone, in 1835, Mr। Adam estimated their number to be 100,000; in Madras, upon an inquiry instituted by Sir Thomas Munro in 1822, the number of schools was reported to be 12,498, containing 188,650 scholars; and in Bombay, about the same period, schools of a similar order were found to be scattered all over the Presidency।
এর থেকে পরিষ্কার ভারতের প্রায় প্রত্যেক প্রান্তে দেশিয় পাঠশালার অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। প্রত্যেক অঞ্চলের বিদ্যালয়ের শিক্ষা কাঠামো, পাঠদান বা অন্যান্য পরিকাঠামো আলাদা আলাদা, সেই অঞ্চলের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে, ষ্পষ্টতঃই তখোনো বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রিটিশ প্রণীত এককেন্দ্রিকতা গড়ে ওঠেনি। শেখার বিষয় হিসেবে মগধে পড়ানো হত তুলসিদাস রামায়ণের নানান ঘটনাবলী নির্ভর দান লীলা, সুদামা চরিত, রাম জনম। বাংলায়ও একই জিনিষ পড়ানো হত, তবে ভাষা আলাদা, বাংলা। ত্রিহুতের শিক্ষার মাধ্যম ছিল মৈথিলি বা ত্রিহুতিয়া। এই উচ্চ পাঠশালাগুলোতে সংস্কৃত বা পারসিক মাধ্যমে পড়ানো হত না। বাংলা প্রদেশের অভিজ্ঞতা থেকে পরিস্কার, বাংলার গ্রামে গ্রামে দেশজ ভাষায় পড়ানোর একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসন আমলের অনেক আগে থেকেই। কারা পড়তেন! এডাম বলছেন, “Commercial accounts।।। are chiefly acquired by the class of money-lenders and retail traders, agricultural accounts।।। by the children of those families whose subsistence is exclusively drawn from the land, and both accounts by those।।। who expect to gain their livelihood as writers, accountants, etc। গ্রামের পাঠশালাগুলো ছিল গ্রামের নানান শ্রেণীর মানুষের চাষী, কর্মকার, শিল্পী আর ব্যবসায়ীদের সন্তানদের শিক্ষা কেন্দ্র। আর এস শর্মা বলছেন ছ শতাব্দ থেকে গ্রামের সমষ্টির মধ্যে শ্রেণীগত ঐক্য গড়ে উঠেছিল, আর গ্রামের নানান উত্পাদনের প্রক্তিয়ার মধ্যে দিয়ে গ্রামীণদের মধ্যে আত্মীয়তার আর পণ্যদ্রব্যগুলির প্রতি অধিকারবেধের গর্ববাখান তৈরি হচ্ছিল। কৃষির সঙ্গে কর্মশালার সরাসরি মেলবন্ধনে গড়ে উঠছিল নিজে কাজ করার গর্ব, কাজের প্রতি অধিকারবোধ, নিজের কৌমের প্রতি ভালবাসা এবং স্বনির্ভর গ্রাম গোষ্ঠী। গ্রামে জাতিবিভেদ ছিল কিন্তু গ্রামের সামগ্রিকতাবোধ এতই জোরালো ছিল যে, এই ভেদাভেদ উত্পাদনের কাজকর্মে খুব একটা বড় হয়ে দেখা দিত না। আর আমরা জানি কৃষি আর শিল্পে, উভয়ের বিকাশে গ্রাম পঞ্চয়েতের বড় একটা ভূমিকা ছিল। পঞ্চায়েত নিজের রোজগারে সেচ ব্যবস্থা, সাধারণ পতিত জমি উদ্ধারেরমত নানান কাজে অংশ নিত সরাসরি।
এডামের শিক্ষা সমীক্ষায় বলাহচ্ছে মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম বা ত্রিহুতেরমত জেলাতে বিস্তৃতভাবে সমীক্ষা করে লিখছেন, একলাখ পাঠশালায় গুরুমশাইদের কখোনো অর্থে আবার বা কখোনো পণ্যে বিদায় দেওয়া হত। পাঠশালার স্থান নির্বাচন করতেন গ্রামের মানুষেরাই। তিনি স্পষ্টভাবে লিখছেন, "indigeneous elementary schools।।। are those ।।। in which instruction in the element of knowledge is communicated, and which have been originated and are supported by the natives themselves, in contradistinction from those that are supported by religious or philanthropic societies"। এই উচ্চ পাঠশালাগুলি চালানোর দায় ছিল গ্রাম সমষ্টির। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আরও একটা বড় প্রচার ছিল যে, বাংলার হিন্দু-মুসলসমানের মুখ দেখাদেখি ছিলনা। এই ধারণা সর্বৈব মিথ্যে। এই পাঠশালাগুলোর বটুদের মধ্যে দুই ধর্মেরই শিশু পাঠ নিত এক সঙ্গে বসে। গুরুজীর সামনে সমাজের নানান বর্ণের বটুরা একসাথেই পাঠ নিত আট বছর পর্যন্ত। দক্ষিণ বিহারের এক পাঠশালার হিসেব দিচ্ছেন এডাম। শিক্ষকদের মধ্যে মুসলমান ছাড়াও ছিলেন কায়স্থ, মগধ, গন্ধবণিক, তিলি, কোইরি, সোনার শ্রেণীর। হিন্দুদের বটুদের মধ্যে ছিল দেসাধ, পাসি, সুশাহর, ধোবি, তাঁতি, কালাবর, বেলদার, গোয়ালা, নাপিত, কাহার, কুর্মি, কোইরি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ইত্যাদি। বীরভূমে তিনি হিন্দু, মুসলমানএর সঙ্গে খ্রিষ্টিয় শিক্ষকের নাম পাচ্ছেন(এ সব সত্বেও সাম্রাজ্যবাদীদের অনুসরণ করে মেকলের পুত্রকন্যাদের বলতেই হবে, বাংলা তথা ভারতের সমাজ ছিল জাতপাত ভিত্তিক, একজাতের লোক অন্যজাতের ছোঁয়া পর্যন্ত মাড়াত না)। ৪০০ জন শিক্ষক ছিলেন হিন্দু এদের মধ্যে ছিল ২৪টি জাতি – চন্ডাল(হায়! আমি চন্ডালের কন্যাও লিখেফেল্লেন নোবেলিয় কবি, না হলে নোবেল লাভ!), ধোবি, তাঁতি, কৈবর্ত, গোয়ালাও। বটুদের মধ্যে ছিল মুসলমান, খ্রিস্টান, সাঁওতাল, ধাঙড়, ডোম, চন্ডাল, তেলি, ব্যধ, যুগি, তাঁতি, হাড়ি, কুর্মি, মালি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ প্রভৃতি। এডাম স্পষ্ট লিখছেন, "Parents of good caste do not hesitate to send their children to schools conducted by teachers of an inferior caste and even of different religion। For instance, the Musalman teacher।।। has Hinuds of good caste among his scholars and this is equally true of the Chandal and other low caste teachers enumerated। ।।। "the Musalman tecahers have Hindu as well as Musalman scholars and the different castes of the former assemble in the same school-house, receive the same insturctions from the same teacher, and join in the same plays and pastimes। অথচ উন্নতিশীল বাংলার মধ্যবিত্ত আর বুদ্ধিজীবিদের প্রচেষ্টায় উঠেগেল বাংলার সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা। মেকলের আগেও জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশনের সদস্য হোল্ট ম্যাকেঞ্জি ১৮৩২এ বলছেন To provide for the education of the great body of the people seems to be impossible। আদতে পার্মানেন্ট সেটলমেন্টএর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাত ধরে তৈরি হল এক শ্রেণীর জমিদার গোষ্ঠী, যাদের জমির মালিক হিসেবে অধিকার দেওয়া হল, যাদের গ্রামগুলোর উন্নয়ণে কোনও উত্সাহ ছিল না। গ্রামে যতরকম এজমালি, নিষ্কর জমি ছিল সব প্রায় দখল নিয়ে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা হল। গ্রাম সমাজের সলিল সমাধির সঙ্গে ভেঙেগেল সমাজের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থার যত পরিকাঠামো, যা গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার বছর ধরে তিল তিল করে গ্রামীণদের অনবরত প্রচেষ্টায়।

Friday, October 14, 2011

এক যে ছিলেন প্রিন্স১০ - জবাব চায় বাংলা


জবাব চায়
পলাশির পর সোজা বাঁকা দুই পথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিন্দুকে যে টাকা ঢুকল, সে অর্থ হিসেব করে দেখা গেল তা দিয়ে ভারতে ব্যবসার তিন বছরের ইনভেস্টমেন্টএর অর্থ উঠে এসেছে তখন থেকে কোম্পানি এ দেশে রূপো আনা বন্ধ করে দিল দেওয়ানির সনদ হাতে আসারপর এই ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে উঠল সে সময় কোম্পানি চিনের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছে চিন থেকে ইংলন্ডে চা রপ্তানি হত ইংলন্ডে চায়ের বাজার তখন চাঙ্গা বললে কম বলা হয় রূপো দিয়েই সে চা কিনতে হত এখন বাংলায় রূপো আনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কোম্পানির তখন উদ্দেশ্য হল চিনেও রূপো পাঠানো বন্ধ করতে হবে তৈরি হল কোম্পানি ষড়যন্ত্র
বাংলার রাজস্ব হাতে পাওয়ার পর ইংলন্ড বাংলা আর চিনের মধ্যে সে এমন এক বাণিজ্য ত্রিভূজ গড়ে তুলতে শুরু করল, যাতে নিজেদের দেশ থেকে কোনো বিনিয়োগ না করেই চিন থেকে সে চা কিনতে পারে পলাশির চক্রান্তে সফল হয়ে বাংলা থেকে চিনে রূপো পাঠিয়ে সেখান থেকে দামি পণ্যগুলো সংগ্রহ করত ঠিক হল এমন এক কল করতে হবে, যাতে রূপে বাংলা থেকে আর চিনে না পাঠিয়ে ইংলন্ডে নিয়ে যাওয়া হবে অথচ চিনের সঙ্গে বাণিজ্যও ঠিকঠাক চলতে থাকবে ভারতের খাজনা তোলার টাকায় চিনে সুতির কাপড় আর আফিম যেতে শুরু করল ক্যন্টনে বাংলা থেকে পাঠানো আফিম বাণিজ্যকে আকাশ ছোঁয়ানোর পরিকল্পনা করা হল সেই বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত অর্থের অদ্ভুত রসায়নে, বাংলা বিহারের চাষীর রক্ত ঝরানো আফিম চিনেদের রক্তে ঢুকে পড়ল বাংলা-চিনের আফিমের ব্যবসা শুরু হল ক্রমশঃ চিন থেকে আফিম ব্যবসার উদ্বৃত্তে বহুমূল্য চা কিনতে শুরু করল ব্রিটেন চিনেও রূপো আনা বন্ধ করে দিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এশিয়া লুঠ করে তার সম্পদ ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দেশ থেকেও কিন্তু দামি ধাতু এশিয়ায় আসা বন্ধ হয়ে গেল এশিয়ায় ব্যবসা করতে আর রূপো আনার আর প্রয়োজন হল না এশিয়ার লুঠের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার বছর ধরে বিকশিত নানান শিল্প পরিকাঠামোও ভেঙে দিল ব্রিটেন ফলে এশিয়া-ইওরোপের বাণিজ্য নতুন পথ ধরে যাওয়া শুরু হল এতদিন প্রযুক্তি, শিল্প দ্রব্যের এশিয়ার বাজার ছিল ইওরোপ, পলাশির ৭০ বছরের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসের চাকা দ্রুত ঘুরে গেল, এশিয়া অধমর্ণ হল আর ইওরোপ হল উত্তমর্ণ
একদা সনাতন বাংলার সামাজিক পরিমণ্ডলে এবং বৈদ্যদের রোগ সারানোয় আফিমের ভূমিকা অবসংবাদী ছিল ভারতের নানান প্রান্তে কৃষকেরা এই চাষ করত সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের থেকে আফিম কিনে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করতেন এই পুস্তকে ইংরেজদের আর বাঙালি-পার্সি ইংরেজ বন্ধুদের আফিম ব্যবসায় নিয়ে অনেক কথা আগেই বলা হয়েছে, কেননা এই অমানবিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন রামমোহন, দ্বারকানাথেরমত বাংলার নানান স্বনামধন্য জগতখ্যাত ব্যক্তিত্ব, আজকের মুম্বইএর গোড়া পত্তন করেছিলেন এমন কিছু মানুষ যারা আজ ভারতের ব্যবসা জগতে নিজস্ব আলোয় ভাস্বর তাঁদের শুরু কেমন হয়েছে তা আমাদের যেমন জানতে হবে, তেমনি যাঁরা বাংলার একদা জনজাগৃতি এনেছেন বলে আজও খ্যাত, তারাও শুধু বাংলার চাষীদের পীড়ন করেই ধনী হয়েই খান্ত থাকেন নি, তাদের একটা বড় অংশ ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চিনে আফিম রপ্তানি করেছেন স্ব-ইচ্ছায়, দুদুটো যুদ্ধ বাধিয়েছেন, চিনের জনগণকে আফিম খাইয়ে ইওরোপকে ধনী করার চক্রান্তে, আর সেই বাণিজ্য থেকে নিজেদের সিন্দুক ভরার স্বার্থে
অস্বস্তিকর এই কথাগুলি আজ একমাত্র বাঙালিদের কম্বু কণ্ঠেই বলতে হবে, নিজেরদের আত্মশুদ্ধি আর বিগত আড়াইশ বছর ধরে ব্রিটিশ প্রণোদনায় গ্রামীণ বাংলা ধংস করার প্রকল্পে সামিল হওয়ার বিবেকের তাড়নার জবাবদিহিতে ব্রিটিশদের অত্যাচারে বাংলার খুন হয়ে যাওয়া কোটি কোটি বাঙলার হতভাগ্য খেটে খাওয়া জনগণে আজ জবাব চায়, সেই সময়ের শহুরে ধনী বাংলা-বাঙালি উত্তরাধিকারীদের কাছে, যারা ব্রিটিশের অত্যাচারের পাশে দাঁড়িয়ে, বাঙলার রক্তে সরাসরি হাত রাঙিয়ে আফিম, নুন আর আফিম ব্যবসা এবং নীল চাষ করে ধণ উপার্জণ করেছেন হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা, বাঙলার শিল্প, কারখানা আর সামাজিক পরিকাঠামোকে ধংস করেছেন, সমাজ নবীকরণের নামে রিফর্ম ছিল সে যুগের অত্যন্ত আদরনীয় শব্দবন্ধগুলির মধ্যে অন্যতম কোম্পানির শাসনকালে, বানিয়া ব্রিটিশদের এবং ব্রিটিশপদপ্রান্তে প্রণত শহুরে বাঙালিদের অমিত ধণার্জণ এবং বিত্তবাসনা, ইংরেজদের বাংলার শিল্প ধংসকরণ প্রকল্পে স্ব-ইচ্ছায় অংশগ্রহণ, এই ধংসযজ্ঞকে আরও দ্রুত ত্বরান্বিত করে, অবশ্যম্ভাবী করে তোলে এই ধংস যজ্ঞের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গ্রামীণ বাংলা বুক চিতিয়ে লড়াই দিয়েছে আগ্রাসী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে শহুরে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশ প্রসাদপুষ্ট জনসাধারণ একবারও স্বাধীণতা সংগ্রামীদের পাশে এসে দাঁড়াবার কথা ভাবেননি ধংস হয়ে যাওয়া এইসব শিল্প-ব্যবসা-সামাজিক রীতিনীতিগুলি ভিত্তি করে বেঁচে থাকা লাখো লাখো স্বাধীণতা সংগ্রামী শ্রমিক-শিল্পী, তাদের পরিবার এবং এই কাজের ওপর নির্ভর করে পরোক্ষে জীবিকা নির্বাহ করা হাজারও মানুষ খুন হলেন, জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হলেন, শিল্পী থেকে পথের ভিখারি হলেন, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমনাগরিকে রূপান্তরিত হলেন ভারতের শিল্প পরিকাঠামো ধংস করে, ইংলন্ডে শিল্প পরিকাঠামো গড়তে, এই শিল্পীদের জীবনে, নতুন নতুন ধরনের অমিত-পাশবিক অত্যাচার নামিয়ে এনে গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রামীদের জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে সরাসরি, যে কাজে সর্বান্তকরণে সমর্থন দিয়েছেন বাংলার শহুরে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সাম্রাজ্যের বন্ধুরা ব্রিটিশদের অমানুষিক অত্যাচারে, কখোনো শহুরে বাঙালির ঔদাসিন্যে, কখোনোবা তাদের প্রত্যক্ষ মদতে, কোটি কোটি সাধারণ মরে হেজে যাওয়া গ্রামীণ বাঙালি, যারা জানল না কি দোষে তাদের খুন হতে হল অথবা ছেলেমেয়েবউনিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হল, অথবা খেতমজুরি করে খেতে হল আজ তারা জবাব চায় বাঙলার নবজাগরণের গুরুঠাকুরদের উত্তরাধিকার যাঁরা বহন করছেন সেই উজ্জ্বল ইংরেজি শিক্ষিত উচ্চবর্ণের মানুষদের থেকে উত্তমর্ণ অর্থনীতির উদ্বৃত্ত শিল্পোন্নত দেশ থেকে অধমর্ণ বাংলাকে, ইওরোপের সংস্কৃতি-অর্থনীতির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল দেশে পরিণত করার জন্য বাংলার চিরাচরিত প্রতিবাদী শিল্পী-কারিগরেরা শহুরে ধনী বাঙালিদের কাছে জবাব চায় জবাব চায় ভারতীয় সমবায়ী সমাজের হাজার হাজার কৃষক-শিল্পী-মজুর, যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীণতা সংগ্রামের ঝান্ডা তুলে তোপেরমুখে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন, রাইফেলের বেয়নেটের আঘাত খেয়েও লুঠ হয়ে যাওয়া সমাজমাতৃকার সম্মান রক্ষায় ব্যক্তিগাত লাভলোকসানের সমঝোতার হিসেবের কড়ির কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেনা-পুলিশের অত্যাচারে খুন হয়েছেন, অথচ মাথা বিকিয়ে দেননি বিদেশি লুঠেরা সাম্রাজ্যের শক্তির পায়ে তাঁরা তত্কালীন ইংরেজ সাম্রাজ্যের বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে চায়, কী তাদের দোষ, কার দোষে তিল তিল করে গড়ে তোলা দেশটির এই হাঁড়ির হাল শহুরে বাঙালিরা চিনেরমত প্রতিবেশী দেশকে আফিম খাওয়ানোর ইংরেজ প্রকল্পে সামিল হয়েছিলেন কেন সেই স্পর্ধিত প্রশ্ন তারা করতে চাইছে আজ শহুরে বাঙালিদের পূর্বজরা, নিজেদের এবং নিজেদের পরিবারকে ধনী করার জন্য, সমাজে আরও একটু প্রতিপত্তি লাভের জন্য, নিজের দেশ, নিজের হতভাগ্য মানুষ, নিজের প্রতিবেশী দেশের প্রতি যে অন্যায়-অবিচার সংগঠিত করে গিয়েছেন, ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, সেই কর্মকে প্রত্যেক বাঙালির আজ প্রশ্ন করা প্রয়োজন আজও বাংলার খ্যাতিমানেরা ব্রিটিশ প্রণোদিত বাংলা ধংস প্রকল্পের সফল কৃতকর্মের জন্য বাংলা তথা ভারতে পুজ্য, প্রণম্য এবং আদরনীয়, অথচ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছেন বাংলার বিদ্রোহী আদিবাসী আর লৌকিক সমাজ ভাল রে ভাল! স্বাধীণতা সংগ্রামী বাংলা আজ জবাব চায় সব হারানোর হিসেব নিকেষ করতে চায়

এক যে ছিলেন প্রিন্স৯


মুখ লুকেনো বাঙালি নেতারা
আফিম ব্যবসার পাশাপাশি চলছিল অমানবিক এই ব্যবসার বিরোধিতাও ১৮৯৩তে গ্ল্যাডস্টোন সরকার একটি রাজকীয় আফিম কমিশন(রয়েল কমিশন অন ওপিয়াম) গঠন করে কমিশন তার সমীক্ষা প্রকাশ করে সরাসরি জানাল, As the result of a searching inquiry, and upon a deliberate review of the copious evidence submitted to us, we feel bound to express our conviction that the movement in England in favour of active in terference on the part of the Imperial Parliament for the suppression of the opium habit in India, has proceeded from an exaggerated impression as to the nature and extent of the evil to be controlled The gloomy descriptions presented to British audiences of extensive moral and physical degradation by opium, have not been accepted by the witnesses representing the people of India, nor by those most responsible for the government of the country
আফিমবাদীদের আতঙ্ক জাগিয়ে পার্লামেন্টারি কমিটিটির সমীক্ষা ধরে পার্লামেন্ট জনগণকে জানিয়ে দিল আফিম বেচতে সরকার আর বলপ্রয়োগের দ্বারস্থ হবে না কিন্তু আফিম ব্যবসায় যাঁদের প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষ স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে তারা কী ছেড়ে কথা বলবেন আফিম থেকে তখন কোটি কোটি ডলার লুঠ করা ভারত সরকার, সেসময়ের আবসৃত উচ্চপদস্থ এক রাজকর্মচারী জেমস লায়ালকে ব্রিটেনে নিযুক্ত করল তাদের স্বার্থ দেখার জন্য ভারতেও লড়াই করার জন্য সরকার মাদ্রাজের দ্য হিন্দু সংবাদপত্রকে নিয়েগ করল ১৮৯৫তে দ্য হিন্দুতে লেখাহল, “Opium may be a great evil, but national bankruptcy is a greater evil” তত্কালীন কংগ্রেস সদস্যদের সসোমিরা আবস্থা তারা যেকোনো আফিম ব্যবসা বিরেধী আন্দোলনের পক্ষে নন, এ কথা সরাসরি জানাতেও যেমন পারছেন না, তেমনি আবার জনগণের ইচ্ছেও অমান্য করতে পারছেন না এ বড় আজব কুদরতি
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই কমিশনে সদস্যতা মোট নয় সদস্যের মধ্যে ভারতীয় সদস্য থাকার কথা দুজনের ভারত সচিবকে দুজন সদস্য মনোনীত করতে বলা হল তত্কালীন বাংলার লেফটেনেন্ট গভর্ণর ম্যাকডোনেল জানালেন, ভারতীয় নেতারা আফিম ব্যবসা বিরোধিতা পছন্দ করেন না, তবে তাঁরা পার্লামেন্টের রাডিক্যাল সদস্যদের ভারতবন্ধু বলে মান্য করেন There is no Bengali whom I would recommend to your Excellency for nomination to the Opium Commission There are several who are of the standing requisite, and whose views on the question are reasonable, such as Sir Jotendro Mohun Tagore and Sir Romesh Chunder Mitter But they will not themselves, or run the risk of putting themselves, into opposition to the anti-opiumists, who are at the same time, like Mr Caine, M P Congress men They condemn the antiopium agitation, but will not oppose it at the risk of alienating their English supporters in “Congress” matters
সে সময়ের আগে প্রায় এক শতক ধরে সত্যি সত্যিই কলকাতা এবং মুম্বাইএর শহরেরে কোনো না কোনো উদ্যমী পরিবার হয় আফিম, নয় নীল অথবা নুনের ব্যবসা অথবা রপ্তানির কাজে সরাসরি জড়িয়ে ছিলেন সমাজে তাঁদের মতামত এতই গুরুত্বপেত যে, সে সময় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতাতে কোনো বাঙালিই সেই লবির বিরুদ্ধাচরণ করতে রাজি হননি এটাই বাস্তব যে, ভারতীয় সমাজ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর অথবা রমেশ মিত্ররমত গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও আফিমপন্থীদের প্রতীকী বিরুদ্ধাচরণও করতে পারেন নি তাঁদের কাছে প্রস্তাব গেলে তাঁরা সরাসরি না করে দিয়েছেন রামমোহন, দ্বারকানাথের আগেও কলকাতার নামী পরিবারগুলি জমিদারি, গোমস্তাগিরি, দেওয়ানি, বেনিয়ানি আর মুতসুদ্দিগিরি করে, যে সনাতন ভারত মারার ব্যবসার মুখপাত করে গিয়েছেন, সেই ট্রাডিশন বজার রেখে ভারতের জমিদারদের একতা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সদস্যরা নীলকরদের কৃতকর্মের সমালোচনা করলেও, আফিমবিরোধী কমিশনের সদস্য হতে পারেন নি তাঁরা সরাসরি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন
এর সঙ্গে শুধু কয়েকটি শুকনো তথ্যের জন্য বলা যাক, দুর্জয় বাঙালিদের মুখলুকোনো প্রত্যাখ্যানে ভারতের ভাইসরয় তখন দ্বারভাঙার মহারাজা লক্ষ্মীশ্বর সিংএর দ্বারস্থ হলেন তবে দ্বারভাঙার মহারাজের কোনো প্রজাই আফিম উত্পাদনে যুক্ত ছিলেন না লক্ষ্মীশ্বর নিজে জমিদারদের সংঘ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং বিদেশে যথেষ্ট পরিচিত মুখ তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকও বটে রয়েল কমিশনে সদস্য হওয়ার সময় তিনি ভাইসরয়কে এডাভাইসারি গ্রুপ সুপ্রিম লেজিসলেটিভ কাউন্সিলেরও সদস্য ছিলেন ম্যকডোনেল তাঁর পক্ষ থেকে মহারাজার নাম গুরুত্বসহকারে সুপারিশ করলেন, The only man of sufficient standing and strength of character whom I know to be willing to take a nomination to the Opium Commission is the Maharajah of Durbhungah His views are in favour of the maintenance of the opium revenue; and I think he would assert these views on the Commission, though I am not prepared to say that the anti-opiumists and pro-Congress people, such as Mr Caine, may not influence him But I should be disposed to run that risk, and I should be very glad to see Durbhungah get some mark of your Excellency’s confidence… [H]e is a man of wide influence here, and I think he can be, if he likes, of great help to us He and I are personally good friends and I find him very reasonable,… সুপারিশপত্র থেকে পরিস্কার তত্কালীন রাজনীতিতে মহারাজার গুরুত্ব কতখানি তবে রয়েল কমিশন ভারতে ভ্রমণ কালে মহারাজার বুকের অসুখ বেড়ে যাওয়ায় তিনি তার সঙ্গে ঘুরতে পারেন নি, না কংগ্রেসিদের নানান চাপে চাননি তা বলা মুশকিল দ্বিতীয় মনোনীত সদস্য ছিলেন গুজরাটের জুনাগড় রাজত্বের প্রাক্তণ প্রধাণমন্ত্রী হরিদাস বিহারিদাস ব্রিটিশ সরকার তাঁকে এই কমিশনে নিয়েছিল মালব আফিম এলাকার উত্পাদক-ব্যবসায়ীদের খুশি করতে, তবুও হরিদাসের রাজত্বও কিন্তু আফিম উত্পাদনে যুক্ত ছিল না

বেম্বাইএর আফিম বোম্বেটে
এ প্রসঙ্গে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ অজানা তথ্য জানা যাক আজকের বোম্বাই বা মুম্বই নামে যে শহরটিকে অনেকেই চেনেন ভারতের আর্থিক সম্পদের রাজধানীরূপে, সেটি আদতে গড়ে উঠেছিল মালব অঞ্চলের উত্পাদিত আফিম, মুম্বই হয়ে চিনে পাঠাবার উদ্বৃত্তের গুড়ে ১৮২০ নাগাদ কলকাতার বাঙালি ভদ্রলোকেদের আফিম ব্যবসার পথ ধরে, ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের পার্সি, গুজরাটি বানিয়া, কোঙ্কনি মুসনমানেদের এক বিশাল গোষ্ঠী মালব আফিম ব্যবসার পরতে পরতে জুড়ে ছিলেন ১৮৩০, এই দশকটিতে ৪২টি বিদেশি কোম্পানি এই ব্যবসাটি চালাত, তার মধ্যে ২০টির সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল পার্সিদের হাতে তত্কালীন ভারতের সমুদ্র পরিবহন আর আফিম ব্যবসা ছিল একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠমাত্র সব থেকে বড় জাল ছড়ানো ছিল জামসেদজী জিজিবয়ের(১৭৮৩-১৮৫৯) তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সব থেকে বড় এজেন্সি হাউস, জার্ডিন ম্যাথিসনের অন্যতম অংশিদার ব্রিটিনের সর্বোচ্চ নাইট(১৮৪২), ব্যারণ(১৮৫৭) উপাধি পাওয়া প্রথম ভারতীয় আফিম পরিবহনের জন্য তাঁর অনেকগুলি জাহাজও ছিল, আর তিনি ছিলেন ব্যাঙ্ক অব বোম্বের ছজন নির্দেশকের মধ্যে অন্যতম
দশকের পর দশক জুড়ে অবৈধ আফিম ব্যবসার লাভ থেকেই আজকের দক্ষিণ বম্বের বিশাল বিশাল প্রাসাদোপম হর্ম্যগুলি গড়ে ওঠে আজকের ধণতান্ত্রিক ভারতের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র বম্বে শহরটির ভ্রুণটি তৈরি হচ্ছিল ১৭৯০ থেকে ১৮৪০এর মধ্যে অবৈধ আফিম ব্যবসার অপরিমিত লাভের পাহাড়ের ওপর বসে মনে রাখতে হবে ১৮২০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে, বম্বেতে অবৈধ আফিম ব্যবসা থেকে যে রূপো আসত তার পরিমান দ্বারকানাথেরমত কলকাতার ইংরেজ-বাঙালি ব্যবসায়ীদের লাভ্যাংশের থেকে অনেক অনেক বেশি কলকাতা থেকে যে সরকারি আফিম চিনে অবৈধভাবে সরাসরি রপ্তানি হত, তার লাভের হকদার ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কোম্পানি সরকার, ছিটেফোঁটা লাভের গুড়ের অংশিদার হতেন সেই ব্যবসাকে সাজনোগোজানের প্রক্তিয়াতে জুড়ে থাকা দালালেরা এদের এরাংশ আবার ছিলেন বাঙালি
কিন্তু বম্বের বিষয়টা ছিক উল্টো সরাকারকে নির্দিষ্ট একটা অংশ কর দিয়ে এই লাভের গুড়ের পুরো অংশটাই যেত এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পার্সি অংশিদারদের সিন্দুকে বেচারা চিনেদের আফিমের মৌতাতে রেখে পার্সিদের সেই লাভের অর্থে গড়ে উঠেছে মালাবার হিল, কাম্বালা হিল, ব্রিচ ক্যান্ডি, আঙ্ক্লেশ্বরেরমত জনপদসমূহ পরে সেই অঞ্চলের বিলাসবহুল পার্সি বাংলোগুলো লিজে দেওয়া হয়েছে ইওরোপিয়দের ১৮৩০-১৮৪০এর মধ্যে এই পার্সিরাই গড়ে তুলেছিলেন বম্বের শহরতলী অঞ্চলগুলো যেমন কার্সেটজী মানকজীর অধিকার ছিল অনিকের, ঢাকজী দাদাজীর ভারাসাভি(আজকের ভারসোভা), ফারমজী কাওয়াসজীর পোয়াই লেন, জামসেদজী বোমানজীর ভিলে পার্লে, জুহু, কারসেটজী কাওয়াসজীর জর্জগাঁও, রতনজী এদুলজীর ঘাটকোপর, কৃষণরাও রঘুনাথের বোরবিদে এবং লক্ষ্ণণ হরিচাঁজদীর চিনচোলি
সে যুগের আফিম চোরাচালানে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বোম্বের প্রায় প্রত্যেক পার্সি পরিবার অন্যান্য ভাই বেরাদারের আফিম ব্যবসা থেকে টাটারাও পিছিয়ে ছিলেন না সাধরণের প্রচলিত বিশ্বাস টাটারা অনেক রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে তবে আজকের ভারতের প্রধাণতম শিল্পপরিবার রক্ত-ঘাম তাঁরা ঝরিয়েছিলেন, তবে তা চিনের সাধারণকে আফিম সেবন করাতে গুজরাটের অধিবাসী জামশেদজী টাটার বাবা যোরাথ্রুষ্টবাদী পার্সি পুরোহিত নাসিরনজী টাটা এই পরিবারের স্রষ্টা নাসিরনজী তার পুত্র জামশেদজী এবং অন্যান্য ভাইদেরকে হংকং, সাংহাই এবং ইংলন্ডে আফিম ব্যবসার দপ্তর খুলে দিলেন
আগেই বলা হয়েছে বম্বে শহরটি গড়ে উঠেছে বাঙালি-বিহারি, সিন্ধ্রি রক্ত জলকরা আফিম চাষী, পার্সি আফিম ব্যবসায়ী আর চৈনিক আফিমখোরদের তৈরিকরা অর্থিক লাভের বনিয়াদের ওপর বসে ঐতিহাসিকেরা সাধারণতঃ নতুন বম্বের সঙ্গে আফিমের সম্পর্ক দেখাতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেক পার্সি পরিবারের নামোল্লেখ করলেও সাধারণতঃ তারা টাটা পরিবারের নাম উল্লেখ করতে ভুলে যান, তাঁদের প্রচার যন্ত্রের রিরুদ্ধে লড়তে না পেরে মুদ্রা রাক্ষসের ঝনঝনানিতে প্রলুদ্ধ হয়ে তাঁদের আদত ব্যবসার কথা উল্লেখ করতে ভুলে যান এটি উদ্দেশ্য পূর্ণ কীনা বলা মুশকিল এমনকী বামপন্থীরাও এই পথের পথিক অনেক বামপন্থীই টাটা পরিবারকে আদতে ভারতের পুঁজিপতিদের মধ্যে প্রহ্লাদরূপে দেখতে চান বাংলার তদানীন্তন বামপন্থী সরকারের ন্যানো মোটর গাড়ির কারখানা করার উদ্যমেই তা স্পষ্ট ভারতীয় টাটা পরিবারের সঙ্গে ব্রিটিশ বামপন্থার যোগাযোগ অনেক দিনেরই, বলছেন মেরি এল কিয়েনহোলজ তাঁর ওপিয়াম ট্রেডার্স এন্ড দেয়ার ওয়ার্ল্ডস ভলিউম টু-  আ রিভিসনিস্ট এক্সপোজার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট ওপিয়াম ট্রেডার পুস্তকে  পুঁজিপতি জামশেদজী টাটার ছোট পুত্র স্যর রতন টাটা গোপাল কৃষ্ণ গোখলের সঙ্গে মিলে সোসালিস্ট সার্ভেন্টস অব ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠন করেন জামশেদজীর পুত্র বামপন্থীদের দুর্গ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সএর একটি চেয়ারেরও স্রষ্টা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল রতন এবং দোরাবজী টাটার কাজিন শাপুরজি সাকলতওয়ালা (১৮৭৪-১৯৩৬), যিনি টিসকোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম কমিউনিস্ট সদস্য তিনি একাদিক্রমে ১৯১৪ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত ব্যাটারসি(লন্ডনের একটি বরো) থেকে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন জামশেদজী টাটাই ব্রিটিশ আমলে চিনের সঙ্গে আফিম ব্যবসার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন এমন নয়, বম্বের কম করে পঞ্চাশটি পার্সি পরিবার এই চোরাচালানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল এরা প্রায় সকলেই ম্যানিয়ার এন্ড কোংএর আফিমব্যবসার সঙ্গী ছিলেন হাতে গোণা কয়েকজন যুক্ত ছিলেন রাসেল এন্ড কোম্পানির সঙ্গে
আফিম ব্যবসার আরএক প্রবাদপুরুষ, এক সময়ে কলকাতায় ব্যবসা করা, জামশেদজী জিজিবয়(১৭৮৩-১৮৫৯) নিজে, জামশেদজী টাটার থেকে অনেক বেশিভাবে ডেভিড সাসুনের বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন জিজিবয় শিশুকাল থেকেই অনাথ কৈশোরের আগেই চিনের পথে পাড়ি দেন নানান ঝড়ঝঞ্ঝা সয়ে তিনি এক ডেনিস ব্যবসায়ীর নজরে পড়েন এবং ১৮৩৬এই অমিতপরিমান সম্পদের উত্তরাধিকারী হন অমিত অর্থের অধিকারী তাই, তাঁর জাবনীকারদের দাবি, তিনি কোম্ব্রিজে পাঠগ্রহণ করেছেন কিন্তু এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে তিনি প্রথম নাইট উপাধি পাওয়া ভারতীয় জামশেদজী জিজিবয় গুড সাকসেসএরমত অনেকগুলি জাহাজের মালিক ছিলেন এই ব্যবসায় এত লাভ করেন যে তিনি বম্বে এবং পার্সি সমাজের উন্নতির জন্য ২,৩০,০০ পাউন্ড দান করেন সে সময় দু লাখ তিরিশ হাজার পাউন্ড বেশ ভাল রকমই
জামসেদজীর সঙ্গে মোতিচাঁদ আমিরচাঁদ, হরমুসজী দোরাবজীকে বম্বের আফিম ব্যবসার তিন বড় মাথা হিসেবে ধরা হয় দাদাভাই রুস্তমজীর রুস্তমজী এন্ড কোম্পানি ১৮২০ থেকেই চিনে আফিম ব্যবসা করত তিনি নিজে চিনে যান ১৮২৭এ মারিওয়ানজী মানকজী এবং জোহাঙ্গী ফ্রেমজী ১৮২১ থেকেই চিনে আফিমের ব্যবসায় লেগে পড়েন মানকজীর পুত্র করসেটজী মানকজী পরে বম্বের বিচারক হন করসেটজী বম্বের গভর্ণর এন্ড্রু রামসের রাইটার হিসেবে জীবন শুরু করে বাংলা আর আরবের সঙ্গে ব্যবসার সূত্রে বিশাল পোতের মালিক হন দাদাভাই রুস্তমজী, জোহাঙ্গী ফ্রেমজীর আত্মীয় ফ্রেমজীর বাবা রুস্তমজা কাওয়াসজী বানাজীর অনেকগুলি আফিম পরিবহনের জাহাজ ছিল এরমধ্যে বিখ্যাততম হল দাদাভোই, বাংলার দেশি নৌকো
২৫০ টনের আফিম ক্লিপার মেরি গর্ডন মাজগাঁও ডকে তৈরি করান ফুরডনজী লিমজী, ১৭জুলাই, ১৮৩৯এ চিনের দিকে রওনা হয় খিদিরপুর ডকে এর কিছুদিন আগে তৈরি হয় রুস্তমজী কাওয়াসজী ১২ জুলাই ১৮৩৯এ চিনে রওনা হয় প্রথম আফিম যুদ্ধে স্যর রবার্ট সেপিংস এই জাহাজটি ভাড়া করেন সিল্ফ জাহাজটি অনেকে বলেন বানাজী পরিবারের সম্পত্তি তবে এই জাহাজটি জার্ডিন-ম্যাথিসন কোম্পানি তাদের চিনে আফিম ব্যবসায় ভাড়া খাটাত অনেকে বলেন এটি নাকি জার্ডিন-ম্যাথিসনরই সম্পত্তি