সুশীল চৌধুরী, অমিয় বাগচী এবং নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিনহা বেশ কিছু নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েছেন। উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের কাছে তাদের ব্যবহৃত তথ্যগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবসময় হয়ত সব তত্ত্বে মতের মিল নাও হতে পারে, বিশেষ করে ইওরোপিয় কেন্দ্রিভূত, বড় পুঁজি নিবেশিত আর বিদ্যুতিক প্রযুক্তি নির্ভর বিকাশের পথই এই তিন বাঙালি বিদ্বান মেনে নিয়েছেন। আমরা যারা কারিগর অর্থনীতিতে আস্থা পেশকরি, তাদের ভাবনাটা অনেকটা আলাদা। কিন্তু তারা বিভিন্ন মহাফেজখানা ইত্যাদি থেকে সংগ্রহ করে যে সব তথ্য ব্যবহার করেছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। কারিগর বা দেশিয় অর্থনীতি নিয়ে যে সব মানুষ উৎসাহী, তাদের এই সব তথ্য বিচার বিশ্লেষণ করে, নিজেদের তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা দরকার।
নরেন্দ্রকৃষ্ণ বাংলার অর্থনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলছেন কিভাবে পলাশীর পরে লুঠের পসরা সাজিয়ে বসল ব্রিটিশ। যদিও এর আগে দাদাভাই নৌরোজি বা বাংলার রমেশ দত্ত, কোম্পানি অর্থনীতিকে লুঠের রাজত্ব বলছেন, কিন্তু একই সঙ্গে রামবাগানের দত্তজ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে নির্দ্বিধায় সমর্থন করছেন, এবং শেষ অবদি মহারানীর উন্নয়নকর্মে তাঁর আস্থা অবিচল ছিল। আইসিএসগিরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি 'সুসভ্য' লন্ডনেই থেকে যান এবং জগদীশকে তিনি প্রায় লন্ডনের অধিবাসীই বানিয়ে তুলেছিলেন। যাই হোক নরেন্দ্রকৃষ্ণ কিন্তু একপ্রকার রাষ্ট্রবাদী মানুষ। এটা মূলত উপনিবেশের দান, বিশেষ করে বেকনিয় স্পিরিট। এই লুঠেরা বেকনিয় স্পিরিট থেকে বেরোনো খুব জরুরি।
দ্বিতীয়জন অমিয় কুমার বাগচী। সামগ্রিক ঔপনিবেশিক সময়কে কিভাবে দেখা দরকার, সেই চোখটি তিনি তৈরি করে দিয়ে যান। মার্ক্সবাদী হওয়ায় তাঁকে কেন বহুকাল এড়িয়েছিলাম এ কথা এর আগে বিশেষ করে ইরফান হাবিব বা ইতিহাস অর্থনীতি আলোচনায় বহুবার বলেছি। বলতে বিন্দুমাত্র বাধা নেই, তিনি আমায় কান ধরতে বাধ্য করেছেন। বইটি অসাধারণ বললে কম বলা হয়। ২০০ বছরের ব্রিটিশ রাজত্বকে নির্দ্বিধায় বিশ্বের সর্বপ্রথম স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসির সময় বলে আখ্যা দিয়েছেন। এক কথায় ঔপনিবেশিক সময় বুঝতে এর থেকে যোগ্য লব্জ আর নেই। আমার জ্ঞানে, তিনিই প্রথম ঔপনিবেশিক মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক, যিনি নতুন করে এঙ্গাস ম্যাডিসনকৃত জিডিপির অঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তৃতীয়জন বাংলার একদম নিজস্ব ইতিহাসকার সুশীল চৌধুরী। খুব কম পঠিত। আমি ঔপনিবেশিক বাংলা বুঝতে ওম প্রকাশ, কীর্র্তি নারায়ণ চৌধুরী, রজত রায়, তপন রায়চৌধুরী ইত্যাদির বাইরে বেরোতেই পারছিলাম না। অমিয় বাগচী দেরি করে পড়া যে কোনও উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মীর কাছে যেমন চরম ক্ষতিকর, তেমনি সুশীল চৌধুরী দেরি করে পড়া পলাশীপূর্ব বাংলার আসল চেহারা বুঝতে বাধা সৃষ্টি করে ফলে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করতে সমস্যা হতে পারে। পলাশীপূর্ব এক শতাব্দের অর্থনীতি, ইতিহাস এবং রাজনৈতিক অবস্থার যে সব ভুল তথ্য মাথায় থানা গেড়ে বসে থাকে প্রত্যেক ইংরেজি শিক্ষিত বাঙ্গালির তার ভিত আমূল নাড়িয়ে দেন অসামান্য তথ্য, যুক্তি আর উপস্থাপনার জোরে। আগেও বিশদে লিখেছি আবারও লিখছি, উপনিবেশপূর্ব বাংলা বুঝতে কেন সুশীল চৌধুরী অত্যাবশ্যক তার কয়েকটা কথা চুম্বকে উল্লেখ করে এই লেখায় ইতিটানব। ১/ সিংহাসনে বসা সিরাজ অন্য মানুষ; ২/ পলাশীর জন্যে ইংরেজ কোম্পানি এবং আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবার লালসা একমাত্র দায়ি; ৩/ কোনও ইওরোপিয় কোম্পানিই খুব ধনশালী ছিল না, তাদের থেকে অনেক গুণ বেশি ধনশালী ছিল দেশিয়/এশিয় বণিকেরা; ৪/ ব্রিটিশ কোম্পানির ব্যবসাটাই অনৈতিক। তারা জাল ফরমান, নিশান ইত্যাদি করে ব্যবসা করেছে; ৫/ বাংলার মত ব্যবসায় উদৃত্ত জনপদ বিশ্বে আর ছিল না; ৬/ কারিগরেরা স্বাধীন ছিল, তারা দাদন ফিরিয়ে দিতে পারত; হাত না বদল হওয়া অবদি সে ছিল তার পণ্যের মালিক, দাদন দেওয়া ব্যবসায়ী নয়; ৭/ বাংলার বহু পণ্য একচেটিয়া ব্যবসা করত সারা বিশ্বে; ৮/ বাংলার সঙ্গে ইওরোপিয় ব্যবসা ছিল মাত্র ১০%, বাকিটা নিজের দেশে এশিয়া আর আফ্রিকায় - এ কাজ এখনো হয় নি।
পলাশী দিবসে এই তিন পথিকৃতকে প্রণাম জানালাম।