বাহিরী গ্রাম আমার পৈতৃক আবাস।
বাংলায় নন্দ উপাধিওয়ালাসমাজ পূর্ব মেদিনীপুরের দুটি গ্রামে বাস করছে একটি মুগবেড়িয়ায় - যেখানে প্রাক্তন মন্ত্রী কিরণ্ময়ের বাড়ি আর অন্যটি কাঁথির কাছে মারিসদা থেকে দেড় ক্রোশ দূরে বাহিরীতে।
একসময় মেদিনীপুর ছিল দণ্ডভূক্তির আধীন।
ফলে মেদিনীপুরের সঙ্গে - বিশেষ করে পূর্বউপকূলের মেদিনীপুরের সঙ্গে আজও ওডিসার আন্তরিক যোগাযোগ। মেদিনীপুরের বহু মানুষ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে আজও কটক যান।
তো এই গ্রাম বেশ পুরোনো।
এই গ্রামের কথা লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে বিনয় ঘোষ আর উল্লিখিত রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুজা পার্বন মেলায় মেদিনীপুর ভাগে।
তো এখানে জাহাজ বাঁধা তেঁতুলগাছ রয়েছে সেটি, মন্দির আর দেউলের ছবি দেওয়া গেল। ছোটবেলা থেকে শুনছি এই জাহাজ বাঁধা তেঁতুলগাছের যে কোটোর রয়েছে(ছবি দেখুন,) তার ভেতরে নাকি অতল গহ্বর রয়েছে। আর ভাষ্কর যখন লিখেছেন তখন জগন্নাথ দেবের দেউলটি সারানো হয় নি, দিন কয়েক আগে ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের মৃত্যু উপলক্ষ্যে গিয়ে দেখলাম তা সারানো হচ্ছে।
যে জগন্নাথ মন্দিরের ছবি দিলাম, সেখানে হয়ত আজ-কালের মধ্যেই দেড় বেলা আমাদের পরিবারের সেবার পালা পড়েছে।
সম্প্রতি বাহিরি গ্রাম নিয়ে ফেবু বন্ধু Punni Pukurএর ভাষ্করব্রত পতি গণশক্তি পত্রিকায় লিখেছেন - তার লেখা উল্লিখিত হল. ধন্যবাদ ভাষ্কর।
কাঁথির রসুলপুর নদীর মোহনায় হিজলীতে মকানগড়াতে জন্মগ্রহণ করেন দুই ভাই সেকেন্দার-ই আলি শাহ এবং মসন্দর-ই আলি শাহ। ফার্সি ভাষায় ‘মকান’ অর্থে ‘গৃহ’ এবং ‘গোড়া’ অর্থে ‘আদি’। অর্থাৎ আদিগৃহ। এই মসন্দর অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। আর সেকেন্দর ছিলেন যুদ্ধবিদ্যায় পটু। সেকেন্দর ৯১২ এবং ৯৫২ বিলায়তী সন অর্থাৎ ১৫০৫ ও ১৫৪৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সমগ্র হিজলী জেলা জয় করেন। এরপর ভাই মসন্দরকে হিজলীর দায়িত্ব দেন। সেসময় ওড়িশায় প্রচলিত ছিল বিলায়তী সন বা আমলি সন। যা বাংলা তারিখের চেয়ে একদিন বেশ এবং ভাদ্রমাসে নববর্ষ হয়।
তখন নবাব মসন্দর-ই আলি শাহর প্রভাব। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সেকথা। সুদূর ওড়িশার রাজা দেবরাজেরও কানে গেল তা। তিনি চাইলেন আক্রমণ করবেন হিজলী। দেবরাজের সেনাপতি ছিলেন বিভীষণ মহাপাত্র। তাকে পাঠানো হলো হিজলীর তথ্য আনতে। তাজ খাঁ মসনদ-ই আলির পিতামহ রহবৎ এলাকায় প্রচুর হিজল গাছের আধিক্য দেখে স্থানের নাম দেন ‘হিজলী’। কিন্তু রাজ্যের নাম হয় ‘চাকলে হিজলী সুবা মোতলকে উড়িষ্যা’। কিন্তু ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রাচীন পুস্তক ‘দেশাবলীবিবৃতি’-তে ‘হিজলী’-র বদলে ‘হিজ্জল’ নামের উল্লেখ রয়েছে। আবার প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ‘দিগ্বিজয়প্রকাশ’-এ ‘হিজলী’ কথিত আছে ‘হৈজল’ নামে। এখানে লেখা— ‘মণ্ডলঘট্ট দক্ষিণেচ হৈজলস্য চহ্যুত্তরে/তাম্রলিপ্তাখ্য দেশশ্চ বাণিজ্যানাং নিবাসভূঃ’। যাইহোক বিভীষণ মহাপাত্র কিন্তু হিজলীতে এসে মহানুভব রাজা মসন্দর-ই আলি শাহর কাজকর্ম দেখে শ্রদ্ধাবান হয়ে পড়েন। সেখানেই বসবাস শুরু করেন।
এদিকে রাজা দেবরাজ উদ্বিগ্ন। কেননা, বিভীষণের ফেরার নাম নেই। একদিন শুনলেন বিভীষণ যবন জাতির সভায় নিজেকে যুক্ত করেছেন। অগ্নিশর্মা রাজ তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করলেন স্বজাতিচ্যুত বিভীষণের জন্য ‘পুরী’ রাজ্যের দরজা বন্ধ। বিভীষণ তা জানতে পেরেই ফিরে চললেন ওড়িশা। রাজা মসন্দর-ই আলি শাহ সম্মতি দিলেন যাওয়ার। কিন্তু রাজা দেবরাজ অবশ্য বিভীষণকে ওড়িশা থেকে বিতাড়িত করেন। মনের দুঃখে বিভীষণ ফিরে এলেন হিজলীতে সেই মহানুভব মুসলিম রাজার কাছে। প্রিয় সাথী বিরহে অশান্ত রাজা যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। তিনি পুত্র বাহাদুর খাঁকে রাজপদে বসিয়ে বিভীষণকে সহযোগী করেন। এই বাহাদুর খাঁ ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে তথা বিলায়তী ৯৬৩ সালে রাজপদ পান। এ তথ্য মেলে ১৮১২ সালের ৩রা অক্টোবর সদর বোর্ড অফ রেভিনিউর কাছে হিজলীর তদানীন্তন কালেক্টর ক্রোমলীনের লেখা একটি চিঠি থেকে। যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৪এ বেইলী সাহেবের ‘জলামুঠা রিপোর্ট’ এবং ‘মাজনামুঠা রিপোর্ট’-তে। যাইহোক মুসলিম রাজার নির্দেশেই বাহিরী গ্রামেই বিভীষণ তৈরি করেন পুরীর মন্দিরের আদলে জগন্নাথ মন্দির। যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসামান্য নিদর্শন রূপে এখনও দাঁড়িয়ে বাহিরীতে।
১৫০৬ শকাব্দে বিভীষণ মহাপাত্র যে স্থাপত্য কীর্তি স্থাপন করলেন তা বঙ্গ-উৎকল স্থাপত্য শিল্পের এক অন্যতম নিদর্শন। বাহিরী নামে কোনও পৃথক গ্রাম নেই। পাশাপাশি থাকা পাইকবাড় (৪৩৭), বিধুবাহিরী (৪৩২), ডিহিবাহিরী, দেউলবাড় (৪৩৫) গ্রামগুলির মধ্যবর্তী স্থান ‘বাহিরী’ নামে পরিচিত। বাহিরীর আশেপাশে থাকা ফৌদারচক (৪৬৪), কর্পূরা, আঁউরাই, আবাসবেড়্যা, চিনাদাঁড়ি, মালবাড়ি (৪৩৮), জামুয়া (৪৬৫), বাড়চুনপাড়া (৪৩৩) গ্রামগুলি দ্বারা বেষ্টিত। তবে বাহিরী বলতে বোঝায় দেউলবাড় মৌজাকেই (জে. এল. নং-৪৩৫)। মোট ২১৫০ জন বাস করে এখানে। আয়তন ৩৩২ একর।
ওড়িয়া ভাষায় ‘ডিহু’ শব্দের অর্থ ‘ঘর’। ‘বাহির’ অর্থাৎ বাহিরের অংশ তথা জনপদের বাহিরের অংশ মিলে সৃষ্টি হয়েছে ‘ডিহিবাহিরী’। চারশো বছরের বেশি প্রাচীন ঐতিহাসিক ঘটনা এবং শিল্পকলার নিদর্শন বুকে নিয়ে টিকে আছে আজও লুক্কায়িত এক ইতিহাস। গবেষকদের অনুমান বাহিরীর ইতিহাস আরও প্রাচীন। কেননা, হিজলীর রাজা মসন্দর-ই আলি শাহ বিভীষণকে জগন্নাথ মন্দির তৈরির জন্য হিজলী থেকে বেশ কিছুটা দূরে ‘বাহিরী’ দান করেন এখানকার গুরুত্বের কথা ভেবেই। অন্যান্য এলাকার থেকে এখানকার পরিবেশ ছিল কিছুটা আলাদা। বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু কেন?
আসলে এখানেই নাকি একসময় গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতি। দাঁতনের মোঘলমারি, ময়নাগড়ের মতো এখানেও ছিল বৌদ্ধ সংঘারাম। ‘বাহিরী’ নামকরণেও তার সূত্র মেলে। সম্ভবত ‘বিহার’ শব্দ থেকেই ‘বাহিরী’-র উৎপত্তি। আর ‘বৌদ্ধ বিহার’ থেকে ‘বিধুবাহিরী’ গ্রামের নামকরণ হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। কালে কালে সমুদ্রের নিকটবর্তী এই বাহারী জনপদ সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কায় মাটির তলায় হারিয়ে গিয়েছিল বহুদিন আগে। তারই উপর গড়ে উঠেছে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম রাজার সহযোগিতায় হিন্দু ধর্মের স্থাপত্যকীর্তি। তবে অনেকের মতে সংস্কৃত ‘বহিঃ’ থেকে ‘বাহির’ এবং ওড়িয়ায় ‘বহির’ অপভ্রংশ হয়ে চিহ্নিত হয়েছে।
বাহিরীতে রয়েছে ৪টি বিশাল পুষ্করিণী— ভীমসাগর, হেমসাগর, চাঁদকোনিয়া এবং চোদ্দমানিয়া। রয়েছে চারটি মাটির উঁচু ঢিবি বা টিকরী— পালটিকরী, ধনটিকরী, গোধনটিকরী এবং সাপটিকরী। ‘টিকরী’ ওড়িয়া শব্দ। বিভীষণের পুত্র তথা হিজলীর দেওয়ান পরাক্রমশালী ভীমসেনের নামেই ভীমসাগর। এই ভীমসাগরেই তিনি আত্মবিসর্জন করেন। এখন এর আয়তন ১৫বিঘা। এগুলি সবই তৈরি করেন বিভীষণ মহাপাত্র। তারই আমলে বাহিরী হয়ে ওঠে ‘বাহারি গ্রাম’।
বাহিরীতে পুকুর খননকালে মিলেছিল প্রাচীন কূপের অস্তিত্ব। মাটির গভীরে ৭-৮ফুট নিচে প্রায়ই একটি কূপ দেখা গিয়েছিল। যা বৌদ্ধসংস্কৃতির নিদর্শন বলেই মনে করেন অনেকে। ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’-তে যোগেশচন্দ্র বসু উল্লেখ করেছেন সেকথা। কেননা মাটির মধ্যেই মিলেছে ঘর। পাতলা ইটের দেওয়াল। সেইসব ইটের গঠন প্রণালী অন্যরকম। কূপগুলিতে ব্যবহৃত ইটগুলি ১৩-১৪ ইঞ্চি দীর্ঘ, ৭ ইঞ্চি প্রস্থ এবং ২ ইঞ্চি পুরু অর্ধ বৃত্তাকার ধরনের। খননকালে মিলেছিল অসংখ্য পুঁথির মালা। প্রচুর পাথরের মূর্তিও পাওয়া গিয়েছিল সেসময়। কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে সেইসব সামগ্রী রক্ষিত। স্থানীয় বিবেকানন্দ সংগ্রহশালাতেও সংরক্ষিত রয়েছে বহু সামগ্রী। কারও কারও মতে এগুলো পাল অথবা সেনযুগ অথবা তারও আগেকার সময়ের। গবেষকদের অনুমান একদা এখানে বৌদ্ধ প্রভাব ছিল। ইতিহাসপ্রেমী ডঃ কমলকুমার কুণ্ডু জানান বাহিরীতে সত্যিই বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব ছিল কিনা তার সঠিক অনুসন্ধান আজও কেউ বিজ্ঞানসম্মতভাবে করেননি। অথচ ইতিহাসের কারণেই তা জানা জরুরী। তবে এ গ্রামের মৃত্তিকার অন্দরমহল থেকে প্রাপ্ত সামগ্রী কিন্তু এলাকার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে দাবিকেই জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তবে বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শন অবশ্য এখন এখানে মেলে না। কিন্তু এককালে মেদিনীপুরে অসংখ্য সঙ্ঘারামের উপস্থিতির বিবরণ পাওয়া যায় হিউয়েন সাঙয়ের লেখাতেও। যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন ‘‘একদিন হয়তো এখানে বুদ্ধদেবের মূর্তিই বিদ্যমান ছিল। শ্রমণগণ তাহারই পূজায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর কাটাইয়া দিতেন। আচার্য্যগণ সেই স্থানে বসিয়া গম্ভীর আরাবে নির্বাণ মুক্তির অপূর্ব সত্য দেশবাসীকে শুনাইয়া দিয়া ডাকিতেন, — এস এস নরনারী, আমরা অমৃত পাইয়াছি, সে অমৃত তোমাদিগকেও দিব।’’
বর্তমানে বিভীষণের তৈরি জগন্নাথ মন্দিরটি পরিত্যক্ত। সেখানে দেবতার মূর্তি নেই। কিন্তু শৈল্পিক চেতনা এবং সুষমামণ্ডিত কারুকার্যের দণ্ডায়মান পাষাণ হিসেবে ‘বাহারি গ্রাম’ বাহিরীতে অধিষ্ঠিত। কি করেছিলেন তখন বিভীষণ? শুধু মন্দির স্থাপন নয়। বাহিরী পরগনাকে জনবসতির উপযুক্ত করে তুলতে গড়, পুষ্করিণী, বাসস্থান, রাস্তাঘাট তৈরি করেন তিনি। চালু করেন চন্দনমেলা এবং রাসযাত্রা। সুদূর ওড়িশা থেকে নিয়ে আসেন শিল্পী এবং স্থাপত্য শিল্পের উপকরণ। জাহাজে করে আনা হয়েছিল সেসব। আজও টিকে আছে একটি তেঁতুলগাছ। লোকবিশ্বাস এই গাছেই জাহাজ বাঁধা থাকতো। নতুন জনবসতি গড়ে তোলেন তিনি। এজন্য বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে আসেন ওড়িশা থেকে। তারই আমন্ত্রণে তেলি, ডোম, চর্মকার, ব্রাহ্মণ, ছুতোর, ধোপা, মালি, তাঁতি, কুমোর, কামার, নাপিত, চাষীদের আগমন ঘটে এখানে। আজও তাই এখানে দেখতে পাওয়া যায় দাস, নায়ক, গিরি, জানা, চ্যাটার্জি, বেরা, প্রহরাজ, পণ্ডা, কয়াল, আচার্য, পাহাড়ী, করণ, মণ্ডল, নন্দ, ভট্টাচার্য্য, মাইতি পদবীর মানুষজনকে। বহু বছর আগে যুদ্ধজয়ের লক্ষ্যে এসে সেই স্থানেই এক অত্যাধুনিক জনবসতি গড়ে তুলতে যে অমোঘ কীর্তি স্থাপিত হয়েছিল তা আজও স্মরণযোগ্য।
বাহিরীর পূর্বমুখী জগমোহন সহ শিখর দেউলটি অবশ্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভুগছে। সারা গায়ে শ্যাওলার পলেস্তারা। রঙ নেই। মন্দিরের গায় অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। ঢোকার মুখে দরজার গায়ে কোনওরকমে আটকে আছে সুপ্রাচীন টেরাকোটার কয়েকটি ফুলের ছবি। বেশির ভাগই খোয়া গেছে। বাহিরীর এই প্রাচীন মন্দিরটির মূল অংশের উচ্চতা ১২.১ মিটার। এটি দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৭.৩ মিটার। জগমোহনটির উচ্চতা ১০.৬ মিটার এবং তা দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৫.১ মিটার। জগমোহনটি ‘পীঢ়া’ রীতির। ওড়িশার স্থাপত্যশৈলীর যোগ আছে। মূল মন্দির ও জগমোহনের মধ্যেকার ছাপ এ প্রাচীন হিন্দু স্থাপত্যশৈলীর ‘লহরা’ পদ্ধতির দেখা মেলে। ১৫৮৪ নাগাদ নির্মিত মন্দিরের শৈল্পিক গুরুত্ব অযত্ন, অবহেলা আর অপরিণামদর্শিতার ফলে ম্রিয়মাণ। গোপীজনবল্লভ লিখিত ‘রসিকমঙ্গল’ কাব্যে মেলে বাহিরীর রূপকার বিভীষণ মহাপাত্র ওরফে বিভীষণ দাসের নাম। মন্দিরের গর্ভে তিনটি পাথরে খোদাই করা ওড়িয়া হরফে লেখা তিনটি সংস্কৃত শ্লোকের লিপি রয়েছে। তবে দ্বিতীয় লিপির শ্লোকটি অবশ্য নষ্ট করে দিয়েছে বাসুদেবপুরের রাজারা। প্রথম এবং তৃতীয়টি এখনও আছে। কি আছে সেই লিপির শ্লোকগুলিতে?
প্রথম শ্লোকটি হলো ‘‘কাশীদাস কুলে বিভীষণ ইতি শ্রী পদ্মনাভাত্মজঃ শ্রীমান বিরভূদ চীকর দশৌ প্রাসাদ মুচ্চৈরিমং রামসয়েচ সুভদ্রয়া সহ জগন্নাথং ন্যধাসীদপি গোপাল প্রতিমাঞ্চ সম্যগ নয়োসদ্ভিঃ প্রতিষ্ঠাং দ্বিজৈঃ’’। অর্থাৎ কাশীরাম দাসের বংশে পদ্মনাথ দাসের পুত্র বিভীষণ দাস মহাপাত্র আবির্ভূত হয়েছিলেন। উচ্চপ্রাসাদ প্রস্তুত করেছিলেন। বলরাম, জগন্নাথ, সুভদ্রা ও গোপাল প্রতিমা স্থাপন করে ব্রাহ্মণ দ্বারা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে উল্লিখিত বিভীষণ দাস মহাপাত্র এবং বিভীষণ মহাপাত্র আসলে একই ব্যক্তি। আবার তৃতীয় শ্লোকটিতে লেখা আছে ‘‘পৌত্র শ্রীধরণী সুতো ভগবতঃ মনু দ্বিজন্মাগ্রণীঃ শ্রীমানার্জ্জুন মিশ্র ইত্যাভিহিত সাচার্য চূড়ামনে পুত্র চক্রধর কবীন্দ্র ইতি যশ্চানীৎ প্রতিষ্ঠা বিধৌ প্রাসাদস্য বিভীষণ সৎকৃত্বা বিরামঃ গভঃ।’’ অর্থাৎ ধরণী মিশ্রের পৌত্র ভগবান মিশ্রের পুত্র শ্রীমান অর্জুন মিশ্র তার পুত্র কবীন্দ্র চক্রধর মিশ্র বিভীষণের এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। প্রতিষ্ঠা করিয়া বিরামপুর শাসনে গিয়াছেন। তবে নষ্ট করে দেওয়া দ্বিতীয় শ্লোকটি থেকে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কাল জানা যায়। এতে লেখা ছিল ‘‘শকাব্দে রসশূণ্য বান ধরণী মানে তৃতীয়া তিথৌ বৈশাখ বুধবাসরে সুনিশিতে পক্ষে যুগাদৌশিতে শ্রীযুক্তায় গদাধরায় গুরুবে তদ্দেব তানং মুদে প্রত্তং গ্রাম বরোচিতং প্রতিদিনং তদ্দেউল বাড়খ্যকং’’। অর্থাৎ ১৫০৬ শকাব্দে বৈশাখ মাসে ৭ তারিখে বুধবার সত্য যুগাদি তৃতীয় তিথিতে শুক্লা পঞ্চমী গুরু শ্রী গদাধর নন্দকে প্রতিদিন সেবাপূজার জন্য দেউলবাড় গ্রাম সহ দান করেছিলেন।
এই গদাধর নন্দের উত্তরপুরুষ বর্ষীয়ান হরিহর নন্দ দেউলবাড় গ্রামেই এখন বাস করেন। একসময় বাহিরী হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি এখন জগন্নাথ ট্রাস্ট কমিটির সম্পাদক। জানান, বাহারি গ্রাম বাহিরী সত্যিই অভিনব এবং অত্যাধুনিক গ্রাম। শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান ছিলে এখানে। ওড়িয়া এবং বাঙালী সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছিল। একসময় বিভীষণ মহাপাত্র বাহিরীতে যে নতুন বসতি স্থাপন করেছিলেন তাতে ছিল যথেষ্ট চিন্তা এবং উন্নত মানসিকতার প্রভাব। তা আজও দৃষ্ট হয়। মন্দিরের প্রথম পূজক গদাধর নন্দের বংশধরেরা আজও প্রায় ২০০টি পরিবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে। হরিহর নন্দ জানান, একসময় এখানে সংস্কৃত শিক্ষা, সঙ্গীত শিক্ষার পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল। প্রচুর পুঁথি ছিল। ওড়িয়া, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় লেখা সেইসব প্রাচীন পুঁথির অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে অযত্নে। সেইসব পুঁথি আরও অনেক তথ্য দিতে পারত। বঙ্গ উৎকল সংস্কৃতির মিশ্রণ দানা বেঁধেছিল এখানে।
অনেকে বাহিরীকে ‘বিরাট রাজার গড়বাড়ি’ বলে অভিহিত করেন। তবে তার সাথে মহাভারতের কোনও সম্পর্ক নেই। একসময় মন্দিরের সম্পত্তি ছিল বাহান্ন বাটি অর্থাৎ ১০৪০ বিঘা। আজ সেসব দখল করে শুরু হয়েছে জনবসতি। সেসময় বিভীষণ মহাপাত্র তার নতুন জনবসতি রক্ষায় দুটি লোহার কামান ব্যবহার করেছিলেন বাহিরীতে। সেগুলি আজ অব্যবহৃত অবস্থায় অযত্নে নষ্ট হচ্ছে কাঁথির ফৌজদারি আদালতের সামনে। বর্তমানে বাহিরীতে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে পুষ্করিণী, টিকরী ছাড়াও দুটি মঠ। সুবিন্যস্ত রাস্তা। রাস্তার দুপাশে বাড়িঘর। পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি হাইস্কুল এবং একটি উপস্বাস্থকেন্দ্র রয়েছে।
অনুমান করা হয়, খ্রীষ্টীয় অষ্টম থেকে নবম শতকে বাহারীতে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু বৌদ্ধ সংঘারাম এবং বৌদ্ধস্তূপ। এর আগে সপ্তম শতাব্দীতে তাম্রলিপ্ত বন্দরে এসেছিলেন হিউয়েন সাউ। তমলুক অঞ্চলে তখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবল জোয়ার। সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাহারীতেও।
বাহারীর পাশ দিয়েই তাম্রলিপ্ত বন্দরগামী জাহাজ চলাচলের পথ। এখন অবশ্য বাহারি সমুদ্র থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। এখানে একটি তেঁতুল গাছে সমুদ্রগামী জাহাজ বাঁধা থাকতো বলে প্রচার আছে। অর্থাৎ সেই সময় সমুদ্রগামী জাহাজ এসে ভিড় করতো বাহারীতে। সেকারণেই এখানে গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধবিহার। তমলুক এলাকার বৌদ্ধ শ্রমণরা বাহারীতে এসে গড়ে তুলেছিল সংঘারাম। সেই ‘জাহাজ বাঁধা তেঁতুল গাছ’ আজও আছে।
লোকমুখে জানা যায়, জগন্নাথ নামে বাহান্নবাটিতলার একজনের এক হাজার চল্লিশ বিঘে জমি ছিল।বড় মঠ, ছোট মঠ, কর্পূরা মঠ, দেউলবাড় মঠ, বিধুবাহারী মঠ, পালটিকরী মঠগুলি বাহারীর সম্পদ। জগন্নাথ মন্দিরে দক্ষিণ দিকে বিরাট নিচু জলাভূমি এলাকা রয়েছে। তাকে বলে কালীদহ। এখানকার মানুষ বলেন ‘কালদা মাঠ’। এখানে নাকি প্রচুর সাপের বসবাস ছিল। তাই এ হেন নাম।
আজও রয়েছে ভীমসাগর পুকুর। তারই মধ্যস্থলে ছিল দেবালয়। এখনও জাল টানলে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগে এই পুকুরে চারটি ঘাট দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু আজও পর্যন্ত সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে বাহারীতে ঐতিহাসিক নিদর্শন খুঁজে বের করতে খননের কাজ চালানো হয়নি। গবেষকদের দাবি, বাহারীর প্রত্নসম্পদ খনন করে প্রকাশ্যে আনা উচিত। একসময় যে এই এলাকা কতখানি বাহারি ছিল তা খুঁজে দেখা দরকার।
নন্দকুমার দীঘা রাজ্য সড়কে মারিশদা বাসস্টপে নেমে পূর্বমুখী পিচ ঢালা রাস্তায় তিন কিমি গেলেই মিলবে আলোচিত বাহিরী। বট, অশ্বত্থের পাশে নিশ্চল নিস্তব্ধতাকে সঙ্গী করেই দাঁড়িয়ে আছে বাহিরীর পরিচায়ক শিল্পকর্মটি। চোখ মেললেই চারিদিকে কাঁটাবাঁশের ঝোপ। কিন্তু সর্বত্র যেন সুললিত ভাব। স্থানীয় জেলা পরিষদ সদস্য কালীপদ শীট-এর দাবি এই বাহিরীকে ঘিরে গড়ে উঠুক পর্যটনকেন্দ্র। রক্ষিত করা হোক এখানকার শিল্পকর্ম। পূর্ব মেদিনীপুরের পর্যটন মানচিত্রে এখনও ঠাঁই না পাওয়া ঐতিহাসিক বাহিরীকে দেওয়া হোক যোগ্য সম্মান। তবে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের অবশ্য বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে।
ভীমসাগরের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অন্যপ্রান্তে তাকাতে থাকলে হয়তো বা মনে পড়বে, একসময় এই জলেই চিরনির্বাণ নিয়েছিলেন ভীমসেন। যার পিতা বিভীষণ মহাপাত্র সুদূর ওড়িশা থেকে এখানে এসে বাহিরীকে ‘বাহারি গ্রাম’ আখ্যায়িত করার রসদ জুগিয়েছিলেন।
বাংলায় নন্দ উপাধিওয়ালাসমাজ পূর্ব মেদিনীপুরের দুটি গ্রামে বাস করছে একটি মুগবেড়িয়ায় - যেখানে প্রাক্তন মন্ত্রী কিরণ্ময়ের বাড়ি আর অন্যটি কাঁথির কাছে মারিসদা থেকে দেড় ক্রোশ দূরে বাহিরীতে।
একসময় মেদিনীপুর ছিল দণ্ডভূক্তির আধীন।
ফলে মেদিনীপুরের সঙ্গে - বিশেষ করে পূর্বউপকূলের মেদিনীপুরের সঙ্গে আজও ওডিসার আন্তরিক যোগাযোগ। মেদিনীপুরের বহু মানুষ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে আজও কটক যান।
তো এই গ্রাম বেশ পুরোনো।
এই গ্রামের কথা লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে বিনয় ঘোষ আর উল্লিখিত রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুজা পার্বন মেলায় মেদিনীপুর ভাগে।
তো এখানে জাহাজ বাঁধা তেঁতুলগাছ রয়েছে সেটি, মন্দির আর দেউলের ছবি দেওয়া গেল। ছোটবেলা থেকে শুনছি এই জাহাজ বাঁধা তেঁতুলগাছের যে কোটোর রয়েছে(ছবি দেখুন,) তার ভেতরে নাকি অতল গহ্বর রয়েছে। আর ভাষ্কর যখন লিখেছেন তখন জগন্নাথ দেবের দেউলটি সারানো হয় নি, দিন কয়েক আগে ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের মৃত্যু উপলক্ষ্যে গিয়ে দেখলাম তা সারানো হচ্ছে।
যে জগন্নাথ মন্দিরের ছবি দিলাম, সেখানে হয়ত আজ-কালের মধ্যেই দেড় বেলা আমাদের পরিবারের সেবার পালা পড়েছে।
সম্প্রতি বাহিরি গ্রাম নিয়ে ফেবু বন্ধু Punni Pukurএর ভাষ্করব্রত পতি গণশক্তি পত্রিকায় লিখেছেন - তার লেখা উল্লিখিত হল. ধন্যবাদ ভাষ্কর।
কাঁথির রসুলপুর নদীর মোহনায় হিজলীতে মকানগড়াতে জন্মগ্রহণ করেন দুই ভাই সেকেন্দার-ই আলি শাহ এবং মসন্দর-ই আলি শাহ। ফার্সি ভাষায় ‘মকান’ অর্থে ‘গৃহ’ এবং ‘গোড়া’ অর্থে ‘আদি’। অর্থাৎ আদিগৃহ। এই মসন্দর অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। আর সেকেন্দর ছিলেন যুদ্ধবিদ্যায় পটু। সেকেন্দর ৯১২ এবং ৯৫২ বিলায়তী সন অর্থাৎ ১৫০৫ ও ১৫৪৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সমগ্র হিজলী জেলা জয় করেন। এরপর ভাই মসন্দরকে হিজলীর দায়িত্ব দেন। সেসময় ওড়িশায় প্রচলিত ছিল বিলায়তী সন বা আমলি সন। যা বাংলা তারিখের চেয়ে একদিন বেশ এবং ভাদ্রমাসে নববর্ষ হয়।
তখন নবাব মসন্দর-ই আলি শাহর প্রভাব। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সেকথা। সুদূর ওড়িশার রাজা দেবরাজেরও কানে গেল তা। তিনি চাইলেন আক্রমণ করবেন হিজলী। দেবরাজের সেনাপতি ছিলেন বিভীষণ মহাপাত্র। তাকে পাঠানো হলো হিজলীর তথ্য আনতে। তাজ খাঁ মসনদ-ই আলির পিতামহ রহবৎ এলাকায় প্রচুর হিজল গাছের আধিক্য দেখে স্থানের নাম দেন ‘হিজলী’। কিন্তু রাজ্যের নাম হয় ‘চাকলে হিজলী সুবা মোতলকে উড়িষ্যা’। কিন্তু ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রাচীন পুস্তক ‘দেশাবলীবিবৃতি’-তে ‘হিজলী’-র বদলে ‘হিজ্জল’ নামের উল্লেখ রয়েছে। আবার প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ‘দিগ্বিজয়প্রকাশ’-এ ‘হিজলী’ কথিত আছে ‘হৈজল’ নামে। এখানে লেখা— ‘মণ্ডলঘট্ট দক্ষিণেচ হৈজলস্য চহ্যুত্তরে/তাম্রলিপ্তাখ্য দেশশ্চ বাণিজ্যানাং নিবাসভূঃ’। যাইহোক বিভীষণ মহাপাত্র কিন্তু হিজলীতে এসে মহানুভব রাজা মসন্দর-ই আলি শাহর কাজকর্ম দেখে শ্রদ্ধাবান হয়ে পড়েন। সেখানেই বসবাস শুরু করেন।
এদিকে রাজা দেবরাজ উদ্বিগ্ন। কেননা, বিভীষণের ফেরার নাম নেই। একদিন শুনলেন বিভীষণ যবন জাতির সভায় নিজেকে যুক্ত করেছেন। অগ্নিশর্মা রাজ তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করলেন স্বজাতিচ্যুত বিভীষণের জন্য ‘পুরী’ রাজ্যের দরজা বন্ধ। বিভীষণ তা জানতে পেরেই ফিরে চললেন ওড়িশা। রাজা মসন্দর-ই আলি শাহ সম্মতি দিলেন যাওয়ার। কিন্তু রাজা দেবরাজ অবশ্য বিভীষণকে ওড়িশা থেকে বিতাড়িত করেন। মনের দুঃখে বিভীষণ ফিরে এলেন হিজলীতে সেই মহানুভব মুসলিম রাজার কাছে। প্রিয় সাথী বিরহে অশান্ত রাজা যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। তিনি পুত্র বাহাদুর খাঁকে রাজপদে বসিয়ে বিভীষণকে সহযোগী করেন। এই বাহাদুর খাঁ ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে তথা বিলায়তী ৯৬৩ সালে রাজপদ পান। এ তথ্য মেলে ১৮১২ সালের ৩রা অক্টোবর সদর বোর্ড অফ রেভিনিউর কাছে হিজলীর তদানীন্তন কালেক্টর ক্রোমলীনের লেখা একটি চিঠি থেকে। যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৪এ বেইলী সাহেবের ‘জলামুঠা রিপোর্ট’ এবং ‘মাজনামুঠা রিপোর্ট’-তে। যাইহোক মুসলিম রাজার নির্দেশেই বাহিরী গ্রামেই বিভীষণ তৈরি করেন পুরীর মন্দিরের আদলে জগন্নাথ মন্দির। যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসামান্য নিদর্শন রূপে এখনও দাঁড়িয়ে বাহিরীতে।
১৫০৬ শকাব্দে বিভীষণ মহাপাত্র যে স্থাপত্য কীর্তি স্থাপন করলেন তা বঙ্গ-উৎকল স্থাপত্য শিল্পের এক অন্যতম নিদর্শন। বাহিরী নামে কোনও পৃথক গ্রাম নেই। পাশাপাশি থাকা পাইকবাড় (৪৩৭), বিধুবাহিরী (৪৩২), ডিহিবাহিরী, দেউলবাড় (৪৩৫) গ্রামগুলির মধ্যবর্তী স্থান ‘বাহিরী’ নামে পরিচিত। বাহিরীর আশেপাশে থাকা ফৌদারচক (৪৬৪), কর্পূরা, আঁউরাই, আবাসবেড়্যা, চিনাদাঁড়ি, মালবাড়ি (৪৩৮), জামুয়া (৪৬৫), বাড়চুনপাড়া (৪৩৩) গ্রামগুলি দ্বারা বেষ্টিত। তবে বাহিরী বলতে বোঝায় দেউলবাড় মৌজাকেই (জে. এল. নং-৪৩৫)। মোট ২১৫০ জন বাস করে এখানে। আয়তন ৩৩২ একর।
ওড়িয়া ভাষায় ‘ডিহু’ শব্দের অর্থ ‘ঘর’। ‘বাহির’ অর্থাৎ বাহিরের অংশ তথা জনপদের বাহিরের অংশ মিলে সৃষ্টি হয়েছে ‘ডিহিবাহিরী’। চারশো বছরের বেশি প্রাচীন ঐতিহাসিক ঘটনা এবং শিল্পকলার নিদর্শন বুকে নিয়ে টিকে আছে আজও লুক্কায়িত এক ইতিহাস। গবেষকদের অনুমান বাহিরীর ইতিহাস আরও প্রাচীন। কেননা, হিজলীর রাজা মসন্দর-ই আলি শাহ বিভীষণকে জগন্নাথ মন্দির তৈরির জন্য হিজলী থেকে বেশ কিছুটা দূরে ‘বাহিরী’ দান করেন এখানকার গুরুত্বের কথা ভেবেই। অন্যান্য এলাকার থেকে এখানকার পরিবেশ ছিল কিছুটা আলাদা। বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু কেন?
আসলে এখানেই নাকি একসময় গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতি। দাঁতনের মোঘলমারি, ময়নাগড়ের মতো এখানেও ছিল বৌদ্ধ সংঘারাম। ‘বাহিরী’ নামকরণেও তার সূত্র মেলে। সম্ভবত ‘বিহার’ শব্দ থেকেই ‘বাহিরী’-র উৎপত্তি। আর ‘বৌদ্ধ বিহার’ থেকে ‘বিধুবাহিরী’ গ্রামের নামকরণ হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। কালে কালে সমুদ্রের নিকটবর্তী এই বাহারী জনপদ সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কায় মাটির তলায় হারিয়ে গিয়েছিল বহুদিন আগে। তারই উপর গড়ে উঠেছে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম রাজার সহযোগিতায় হিন্দু ধর্মের স্থাপত্যকীর্তি। তবে অনেকের মতে সংস্কৃত ‘বহিঃ’ থেকে ‘বাহির’ এবং ওড়িয়ায় ‘বহির’ অপভ্রংশ হয়ে চিহ্নিত হয়েছে।
বাহিরীতে রয়েছে ৪টি বিশাল পুষ্করিণী— ভীমসাগর, হেমসাগর, চাঁদকোনিয়া এবং চোদ্দমানিয়া। রয়েছে চারটি মাটির উঁচু ঢিবি বা টিকরী— পালটিকরী, ধনটিকরী, গোধনটিকরী এবং সাপটিকরী। ‘টিকরী’ ওড়িয়া শব্দ। বিভীষণের পুত্র তথা হিজলীর দেওয়ান পরাক্রমশালী ভীমসেনের নামেই ভীমসাগর। এই ভীমসাগরেই তিনি আত্মবিসর্জন করেন। এখন এর আয়তন ১৫বিঘা। এগুলি সবই তৈরি করেন বিভীষণ মহাপাত্র। তারই আমলে বাহিরী হয়ে ওঠে ‘বাহারি গ্রাম’।
বাহিরীতে পুকুর খননকালে মিলেছিল প্রাচীন কূপের অস্তিত্ব। মাটির গভীরে ৭-৮ফুট নিচে প্রায়ই একটি কূপ দেখা গিয়েছিল। যা বৌদ্ধসংস্কৃতির নিদর্শন বলেই মনে করেন অনেকে। ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’-তে যোগেশচন্দ্র বসু উল্লেখ করেছেন সেকথা। কেননা মাটির মধ্যেই মিলেছে ঘর। পাতলা ইটের দেওয়াল। সেইসব ইটের গঠন প্রণালী অন্যরকম। কূপগুলিতে ব্যবহৃত ইটগুলি ১৩-১৪ ইঞ্চি দীর্ঘ, ৭ ইঞ্চি প্রস্থ এবং ২ ইঞ্চি পুরু অর্ধ বৃত্তাকার ধরনের। খননকালে মিলেছিল অসংখ্য পুঁথির মালা। প্রচুর পাথরের মূর্তিও পাওয়া গিয়েছিল সেসময়। কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে সেইসব সামগ্রী রক্ষিত। স্থানীয় বিবেকানন্দ সংগ্রহশালাতেও সংরক্ষিত রয়েছে বহু সামগ্রী। কারও কারও মতে এগুলো পাল অথবা সেনযুগ অথবা তারও আগেকার সময়ের। গবেষকদের অনুমান একদা এখানে বৌদ্ধ প্রভাব ছিল। ইতিহাসপ্রেমী ডঃ কমলকুমার কুণ্ডু জানান বাহিরীতে সত্যিই বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব ছিল কিনা তার সঠিক অনুসন্ধান আজও কেউ বিজ্ঞানসম্মতভাবে করেননি। অথচ ইতিহাসের কারণেই তা জানা জরুরী। তবে এ গ্রামের মৃত্তিকার অন্দরমহল থেকে প্রাপ্ত সামগ্রী কিন্তু এলাকার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে দাবিকেই জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তবে বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শন অবশ্য এখন এখানে মেলে না। কিন্তু এককালে মেদিনীপুরে অসংখ্য সঙ্ঘারামের উপস্থিতির বিবরণ পাওয়া যায় হিউয়েন সাঙয়ের লেখাতেও। যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন ‘‘একদিন হয়তো এখানে বুদ্ধদেবের মূর্তিই বিদ্যমান ছিল। শ্রমণগণ তাহারই পূজায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর কাটাইয়া দিতেন। আচার্য্যগণ সেই স্থানে বসিয়া গম্ভীর আরাবে নির্বাণ মুক্তির অপূর্ব সত্য দেশবাসীকে শুনাইয়া দিয়া ডাকিতেন, — এস এস নরনারী, আমরা অমৃত পাইয়াছি, সে অমৃত তোমাদিগকেও দিব।’’
বর্তমানে বিভীষণের তৈরি জগন্নাথ মন্দিরটি পরিত্যক্ত। সেখানে দেবতার মূর্তি নেই। কিন্তু শৈল্পিক চেতনা এবং সুষমামণ্ডিত কারুকার্যের দণ্ডায়মান পাষাণ হিসেবে ‘বাহারি গ্রাম’ বাহিরীতে অধিষ্ঠিত। কি করেছিলেন তখন বিভীষণ? শুধু মন্দির স্থাপন নয়। বাহিরী পরগনাকে জনবসতির উপযুক্ত করে তুলতে গড়, পুষ্করিণী, বাসস্থান, রাস্তাঘাট তৈরি করেন তিনি। চালু করেন চন্দনমেলা এবং রাসযাত্রা। সুদূর ওড়িশা থেকে নিয়ে আসেন শিল্পী এবং স্থাপত্য শিল্পের উপকরণ। জাহাজে করে আনা হয়েছিল সেসব। আজও টিকে আছে একটি তেঁতুলগাছ। লোকবিশ্বাস এই গাছেই জাহাজ বাঁধা থাকতো। নতুন জনবসতি গড়ে তোলেন তিনি। এজন্য বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে আসেন ওড়িশা থেকে। তারই আমন্ত্রণে তেলি, ডোম, চর্মকার, ব্রাহ্মণ, ছুতোর, ধোপা, মালি, তাঁতি, কুমোর, কামার, নাপিত, চাষীদের আগমন ঘটে এখানে। আজও তাই এখানে দেখতে পাওয়া যায় দাস, নায়ক, গিরি, জানা, চ্যাটার্জি, বেরা, প্রহরাজ, পণ্ডা, কয়াল, আচার্য, পাহাড়ী, করণ, মণ্ডল, নন্দ, ভট্টাচার্য্য, মাইতি পদবীর মানুষজনকে। বহু বছর আগে যুদ্ধজয়ের লক্ষ্যে এসে সেই স্থানেই এক অত্যাধুনিক জনবসতি গড়ে তুলতে যে অমোঘ কীর্তি স্থাপিত হয়েছিল তা আজও স্মরণযোগ্য।
বাহিরীর পূর্বমুখী জগমোহন সহ শিখর দেউলটি অবশ্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভুগছে। সারা গায়ে শ্যাওলার পলেস্তারা। রঙ নেই। মন্দিরের গায় অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। ঢোকার মুখে দরজার গায়ে কোনওরকমে আটকে আছে সুপ্রাচীন টেরাকোটার কয়েকটি ফুলের ছবি। বেশির ভাগই খোয়া গেছে। বাহিরীর এই প্রাচীন মন্দিরটির মূল অংশের উচ্চতা ১২.১ মিটার। এটি দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৭.৩ মিটার। জগমোহনটির উচ্চতা ১০.৬ মিটার এবং তা দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৫.১ মিটার। জগমোহনটি ‘পীঢ়া’ রীতির। ওড়িশার স্থাপত্যশৈলীর যোগ আছে। মূল মন্দির ও জগমোহনের মধ্যেকার ছাপ এ প্রাচীন হিন্দু স্থাপত্যশৈলীর ‘লহরা’ পদ্ধতির দেখা মেলে। ১৫৮৪ নাগাদ নির্মিত মন্দিরের শৈল্পিক গুরুত্ব অযত্ন, অবহেলা আর অপরিণামদর্শিতার ফলে ম্রিয়মাণ। গোপীজনবল্লভ লিখিত ‘রসিকমঙ্গল’ কাব্যে মেলে বাহিরীর রূপকার বিভীষণ মহাপাত্র ওরফে বিভীষণ দাসের নাম। মন্দিরের গর্ভে তিনটি পাথরে খোদাই করা ওড়িয়া হরফে লেখা তিনটি সংস্কৃত শ্লোকের লিপি রয়েছে। তবে দ্বিতীয় লিপির শ্লোকটি অবশ্য নষ্ট করে দিয়েছে বাসুদেবপুরের রাজারা। প্রথম এবং তৃতীয়টি এখনও আছে। কি আছে সেই লিপির শ্লোকগুলিতে?
প্রথম শ্লোকটি হলো ‘‘কাশীদাস কুলে বিভীষণ ইতি শ্রী পদ্মনাভাত্মজঃ শ্রীমান বিরভূদ চীকর দশৌ প্রাসাদ মুচ্চৈরিমং রামসয়েচ সুভদ্রয়া সহ জগন্নাথং ন্যধাসীদপি গোপাল প্রতিমাঞ্চ সম্যগ নয়োসদ্ভিঃ প্রতিষ্ঠাং দ্বিজৈঃ’’। অর্থাৎ কাশীরাম দাসের বংশে পদ্মনাথ দাসের পুত্র বিভীষণ দাস মহাপাত্র আবির্ভূত হয়েছিলেন। উচ্চপ্রাসাদ প্রস্তুত করেছিলেন। বলরাম, জগন্নাথ, সুভদ্রা ও গোপাল প্রতিমা স্থাপন করে ব্রাহ্মণ দ্বারা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে উল্লিখিত বিভীষণ দাস মহাপাত্র এবং বিভীষণ মহাপাত্র আসলে একই ব্যক্তি। আবার তৃতীয় শ্লোকটিতে লেখা আছে ‘‘পৌত্র শ্রীধরণী সুতো ভগবতঃ মনু দ্বিজন্মাগ্রণীঃ শ্রীমানার্জ্জুন মিশ্র ইত্যাভিহিত সাচার্য চূড়ামনে পুত্র চক্রধর কবীন্দ্র ইতি যশ্চানীৎ প্রতিষ্ঠা বিধৌ প্রাসাদস্য বিভীষণ সৎকৃত্বা বিরামঃ গভঃ।’’ অর্থাৎ ধরণী মিশ্রের পৌত্র ভগবান মিশ্রের পুত্র শ্রীমান অর্জুন মিশ্র তার পুত্র কবীন্দ্র চক্রধর মিশ্র বিভীষণের এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। প্রতিষ্ঠা করিয়া বিরামপুর শাসনে গিয়াছেন। তবে নষ্ট করে দেওয়া দ্বিতীয় শ্লোকটি থেকে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কাল জানা যায়। এতে লেখা ছিল ‘‘শকাব্দে রসশূণ্য বান ধরণী মানে তৃতীয়া তিথৌ বৈশাখ বুধবাসরে সুনিশিতে পক্ষে যুগাদৌশিতে শ্রীযুক্তায় গদাধরায় গুরুবে তদ্দেব তানং মুদে প্রত্তং গ্রাম বরোচিতং প্রতিদিনং তদ্দেউল বাড়খ্যকং’’। অর্থাৎ ১৫০৬ শকাব্দে বৈশাখ মাসে ৭ তারিখে বুধবার সত্য যুগাদি তৃতীয় তিথিতে শুক্লা পঞ্চমী গুরু শ্রী গদাধর নন্দকে প্রতিদিন সেবাপূজার জন্য দেউলবাড় গ্রাম সহ দান করেছিলেন।
এই গদাধর নন্দের উত্তরপুরুষ বর্ষীয়ান হরিহর নন্দ দেউলবাড় গ্রামেই এখন বাস করেন। একসময় বাহিরী হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি এখন জগন্নাথ ট্রাস্ট কমিটির সম্পাদক। জানান, বাহারি গ্রাম বাহিরী সত্যিই অভিনব এবং অত্যাধুনিক গ্রাম। শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান ছিলে এখানে। ওড়িয়া এবং বাঙালী সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছিল। একসময় বিভীষণ মহাপাত্র বাহিরীতে যে নতুন বসতি স্থাপন করেছিলেন তাতে ছিল যথেষ্ট চিন্তা এবং উন্নত মানসিকতার প্রভাব। তা আজও দৃষ্ট হয়। মন্দিরের প্রথম পূজক গদাধর নন্দের বংশধরেরা আজও প্রায় ২০০টি পরিবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে। হরিহর নন্দ জানান, একসময় এখানে সংস্কৃত শিক্ষা, সঙ্গীত শিক্ষার পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল। প্রচুর পুঁথি ছিল। ওড়িয়া, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় লেখা সেইসব প্রাচীন পুঁথির অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে অযত্নে। সেইসব পুঁথি আরও অনেক তথ্য দিতে পারত। বঙ্গ উৎকল সংস্কৃতির মিশ্রণ দানা বেঁধেছিল এখানে।
অনেকে বাহিরীকে ‘বিরাট রাজার গড়বাড়ি’ বলে অভিহিত করেন। তবে তার সাথে মহাভারতের কোনও সম্পর্ক নেই। একসময় মন্দিরের সম্পত্তি ছিল বাহান্ন বাটি অর্থাৎ ১০৪০ বিঘা। আজ সেসব দখল করে শুরু হয়েছে জনবসতি। সেসময় বিভীষণ মহাপাত্র তার নতুন জনবসতি রক্ষায় দুটি লোহার কামান ব্যবহার করেছিলেন বাহিরীতে। সেগুলি আজ অব্যবহৃত অবস্থায় অযত্নে নষ্ট হচ্ছে কাঁথির ফৌজদারি আদালতের সামনে। বর্তমানে বাহিরীতে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে পুষ্করিণী, টিকরী ছাড়াও দুটি মঠ। সুবিন্যস্ত রাস্তা। রাস্তার দুপাশে বাড়িঘর। পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি হাইস্কুল এবং একটি উপস্বাস্থকেন্দ্র রয়েছে।
অনুমান করা হয়, খ্রীষ্টীয় অষ্টম থেকে নবম শতকে বাহারীতে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু বৌদ্ধ সংঘারাম এবং বৌদ্ধস্তূপ। এর আগে সপ্তম শতাব্দীতে তাম্রলিপ্ত বন্দরে এসেছিলেন হিউয়েন সাউ। তমলুক অঞ্চলে তখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবল জোয়ার। সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাহারীতেও।
বাহারীর পাশ দিয়েই তাম্রলিপ্ত বন্দরগামী জাহাজ চলাচলের পথ। এখন অবশ্য বাহারি সমুদ্র থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। এখানে একটি তেঁতুল গাছে সমুদ্রগামী জাহাজ বাঁধা থাকতো বলে প্রচার আছে। অর্থাৎ সেই সময় সমুদ্রগামী জাহাজ এসে ভিড় করতো বাহারীতে। সেকারণেই এখানে গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধবিহার। তমলুক এলাকার বৌদ্ধ শ্রমণরা বাহারীতে এসে গড়ে তুলেছিল সংঘারাম। সেই ‘জাহাজ বাঁধা তেঁতুল গাছ’ আজও আছে।
লোকমুখে জানা যায়, জগন্নাথ নামে বাহান্নবাটিতলার একজনের এক হাজার চল্লিশ বিঘে জমি ছিল।বড় মঠ, ছোট মঠ, কর্পূরা মঠ, দেউলবাড় মঠ, বিধুবাহারী মঠ, পালটিকরী মঠগুলি বাহারীর সম্পদ। জগন্নাথ মন্দিরে দক্ষিণ দিকে বিরাট নিচু জলাভূমি এলাকা রয়েছে। তাকে বলে কালীদহ। এখানকার মানুষ বলেন ‘কালদা মাঠ’। এখানে নাকি প্রচুর সাপের বসবাস ছিল। তাই এ হেন নাম।
আজও রয়েছে ভীমসাগর পুকুর। তারই মধ্যস্থলে ছিল দেবালয়। এখনও জাল টানলে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগে এই পুকুরে চারটি ঘাট দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু আজও পর্যন্ত সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে বাহারীতে ঐতিহাসিক নিদর্শন খুঁজে বের করতে খননের কাজ চালানো হয়নি। গবেষকদের দাবি, বাহারীর প্রত্নসম্পদ খনন করে প্রকাশ্যে আনা উচিত। একসময় যে এই এলাকা কতখানি বাহারি ছিল তা খুঁজে দেখা দরকার।
নন্দকুমার দীঘা রাজ্য সড়কে মারিশদা বাসস্টপে নেমে পূর্বমুখী পিচ ঢালা রাস্তায় তিন কিমি গেলেই মিলবে আলোচিত বাহিরী। বট, অশ্বত্থের পাশে নিশ্চল নিস্তব্ধতাকে সঙ্গী করেই দাঁড়িয়ে আছে বাহিরীর পরিচায়ক শিল্পকর্মটি। চোখ মেললেই চারিদিকে কাঁটাবাঁশের ঝোপ। কিন্তু সর্বত্র যেন সুললিত ভাব। স্থানীয় জেলা পরিষদ সদস্য কালীপদ শীট-এর দাবি এই বাহিরীকে ঘিরে গড়ে উঠুক পর্যটনকেন্দ্র। রক্ষিত করা হোক এখানকার শিল্পকর্ম। পূর্ব মেদিনীপুরের পর্যটন মানচিত্রে এখনও ঠাঁই না পাওয়া ঐতিহাসিক বাহিরীকে দেওয়া হোক যোগ্য সম্মান। তবে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের অবশ্য বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে।
ভীমসাগরের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অন্যপ্রান্তে তাকাতে থাকলে হয়তো বা মনে পড়বে, একসময় এই জলেই চিরনির্বাণ নিয়েছিলেন ভীমসেন। যার পিতা বিভীষণ মহাপাত্র সুদূর ওড়িশা থেকে এখানে এসে বাহিরীকে ‘বাহারি গ্রাম’ আখ্যায়িত করার রসদ জুগিয়েছিলেন।