Sunday, October 30, 2016

দেশজ ইতিহাস চর্চা- বাহিরি গ্রাম

বাহিরী গ্রাম আমার পৈতৃক আবাস।
বাংলায় নন্দ উপাধিওয়ালাসমাজ পূর্ব মেদিনীপুরের দুটি গ্রামে বাস করছে একটি মুগবেড়িয়ায় - যেখানে প্রাক্তন মন্ত্রী কিরণ্ময়ের বাড়ি আর অন্যটি কাঁথির কাছে মারিসদা থেকে দেড় ক্রোশ দূরে বাহিরীতে।
একসময় মেদিনীপুর ছিল দণ্ডভূক্তির আধীন।











ফলে মেদিনীপুরের সঙ্গে - বিশেষ করে পূর্বউপকূলের মেদিনীপুরের সঙ্গে আজও ওডিসার আন্তরিক যোগাযোগ। মেদিনীপুরের বহু মানুষ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে আজও কটক যান।
তো এই গ্রাম বেশ পুরোনো।
এই গ্রামের কথা লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে বিনয় ঘোষ আর উল্লিখিত রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুজা পার্বন মেলায় মেদিনীপুর ভাগে।
তো এখানে জাহাজ বাঁধা তেঁতুলগাছ রয়েছে সেটি, মন্দির আর দেউলের ছবি দেওয়া গেল। ছোটবেলা থেকে শুনছি এই জাহাজ বাঁধা তেঁতুলগাছের যে কোটোর রয়েছে(ছবি দেখুন,) তার ভেতরে নাকি অতল গহ্বর রয়েছে। আর ভাষ্কর যখন লিখেছেন তখন জগন্নাথ দেবের দেউলটি সারানো হয় নি, দিন কয়েক আগে ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের মৃত্যু উপলক্ষ্যে গিয়ে দেখলাম তা সারানো হচ্ছে।
যে জগন্নাথ মন্দিরের ছবি দিলাম, সেখানে হয়ত আজ-কালের মধ্যেই দেড় বেলা আমাদের পরিবারের সেবার পালা পড়েছে।


সম্প্রতি বাহিরি গ্রাম নিয়ে ফেবু বন্ধু Punni Pukurএর ভাষ্করব্রত পতি গণশক্তি পত্রিকায় লিখেছেন - তার লেখা উল্লিখিত হল. ধন্যবাদ ভাষ্কর।
কাঁথির রসুলপুর নদীর মোহনায় হিজলীতে মকানগড়াতে জন্মগ্রহণ করেন দুই ভা‍‌ই সেকেন্দার-ই আলি শাহ এবং মসন্দর-ই আলি শাহ। ফার্সি ভাষায় ‘মকান’ অর্থে ‘গৃহ’ এবং ‘গোড়া’ অর্থে ‘আদি’। অর্থাৎ আদিগৃহ। এই মসন্দর অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। আর সেকেন্দর ছিলেন যুদ্ধবিদ্যায় পটু। সেকেন্দর ৯১২ এবং ৯৫২ বিলায়তী সন অর্থাৎ ১৫০৫ ও ১৫৪৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সমগ্র হিজলী জেলা জয় করেন। এরপর ভাই মসন্দরকে হিজলীর দায়িত্ব দেন। সেসময় ওড়িশায় প্রচলিত ছিল বিলায়তী সন বা আমলি সন। যা বাংলা তারিখের চেয়ে একদিন বেশ এবং ভাদ্রমাসে নববর্ষ হয়।
তখন নবাব মসন্দর-ই আলি শাহর প্রভাব। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সেকথা। সুদূর ওড়িশার রাজা দেবরাজেরও কানে গেল তা। তিনি চাইলেন আক্রমণ করবেন হিজলী। দেবরাজের সেনাপতি ছিলেন বিভীষণ মহাপাত্র। তাকে পাঠানো হলো হিজলীর তথ্য আনতে। তাজ খাঁ মসনদ-ই আলির পিতামহ রহবৎ এলাকায় প্রচুর হিজল গাছের আধিক্য দেখে স্থানের নাম দেন ‘হিজলী’। কিন্তু রাজ্যের নাম হয় ‘চাকলে হিজলী সুবা মোতলকে উড়িষ্যা’। কিন্তু ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রাচীন পুস্তক ‘দেশাবলীবিবৃতি’-তে ‘হিজলী’-র বদলে ‘হিজ্জল’ নামের উল্লেখ রয়েছে। আবার প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ‘দিগ্বিজয়প্রকাশ’-এ ‘হিজলী’ কথিত আছে ‘হৈজল’ নামে। এখানে লেখা— ‘মণ্ডলঘট্ট দক্ষিণেচ হৈজলস্য চহ্যুত্তরে/তাম্রলিপ্তাখ্য দেশশ্চ বাণিজ্যানাং নিবাসভূঃ’। যাইহোক বিভীষণ মহাপাত্র কিন্তু হিজলী‍‌তে এসে মহানুভব রাজা মসন্দর-ই আলি শাহর কাজকর্ম দেখে শ্রদ্ধাবান হয়ে পড়েন। সেখানেই বসবাস শুরু করেন।
এদিকে রাজা দেবরাজ উদ্বিগ্ন। কেননা, বিভীষণের ফেরার নাম নেই। একদিন শুনলেন বিভীষণ যবন জাতির সভায় নিজেকে যুক্ত করেছেন। অগ্নিশর্মা রাজ তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করলেন স্বজাতিচ্যুত বিভীষণের জন্য ‘পুরী’ রাজ্যের দরজা বন্ধ। বিভীষণ তা জানতে পেরেই ফিরে চললেন ওড়িশা। রাজা মসন্দর-ই আলি শাহ সম্মতি দিলেন যাওয়ার। কিন্তু রাজা দেবরাজ অবশ্য বিভীষণকে ওড়িশা থেকে বিতাড়িত করেন। মনের দুঃখে বিভীষণ ফিরে এলেন হিজলীতে সেই মহানুভব মুসলিম রাজার কাছে। প্রিয় সাথী বিরহে অশান্ত রাজা যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। তিনি পুত্র বাহাদুর খাঁকে রাজপদে বসিয়ে বিভীষণকে সহযোগী করেন। এই বাহাদুর খাঁ ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে তথা বিলায়তী ৯৬৩ সালে রাজপদ পান। এ তথ্য মেলে ১৮১২ সালের ৩রা অক্টোবর সদর বোর্ড অফ রেভিনিউর কাছে হিজলীর তদানীন্তন কালেক্টর ক্রোমলীনের লেখা একটি চিঠি থেকে। যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৪এ বেইলী সাহেবের ‘জলামুঠা রিপোর্ট’ এবং ‘মাজনামুঠা রিপোর্ট’-তে। যাইহোক মুসলিম রাজার নির্দেশেই বাহিরী গ্রামেই বিভীষণ তৈরি করেন পুরীর মন্দিরের আদলে জগন্নাথ মন্দির। যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসামান্য নিদর্শন রূপে এখনও দাঁড়িয়ে বাহিরীতে।
১৫০৬ শকাব্দে বিভীষণ মহাপাত্র যে স্থাপত্য কীর্তি স্থাপন করলেন তা বঙ্গ-উৎকল স্থাপত্য শিল্পের এক অন্যতম নিদর্শন। বাহিরী নামে কোনও পৃথক গ্রাম নেই। পাশাপাশি থাকা পাইকবাড় (৪৩৭), বিধুবাহিরী (৪৩২), ডিহিবাহিরী, দেউলবাড় (৪৩৫) গ্রামগুলির মধ্যবর্তী স্থান ‘বাহিরী’ নামে পরিচিত। বাহিরীর আশেপাশে থাকা ফৌদারচক (৪৬৪), কর্পূরা, আঁউরাই, আবাসবেড়্যা, চিনাদাঁড়ি, মালবাড়ি (৪৩৮), জামুয়া (৪৬৫), বাড়চুনপাড়া (৪৩৩) গ্রামগুলি দ্বারা বেষ্টিত। তবে বাহিরী বলতে বোঝায় দেউলবাড় মৌজাকেই (জে. এল. নং-৪৩৫)। মোট ২১৫০ জন বাস করে এখানে। আয়তন ৩৩২ একর।
‍‌ওড়িয়া ভাষায় ‘ডিহু’ শব্দের অর্থ ‘ঘর’। ‘বাহির’ অর্থাৎ বাহিরের অংশ তথা জনপদের বাহিরের অংশ ‍‌মিলে সৃষ্টি হয়েছে ‘ডিহিবাহিরী’। চারশো বছরের বেশি প্রাচীন ঐতিহাসিক ঘটনা এবং শিল্পকলার নিদর্শন বুকে নিয়ে টিকে আছে আজও লুক্কায়িত এক ইতিহাস। গবেষকদের অনুমান বাহিরীর ইতিহাস আরও প্রাচীন। কেননা, হিজলীর রাজা মসন্দর-ই আলি শাহ বিভীষণকে জগন্নাথ মন্দির তৈরির জন্য হিজলী থেকে বেশ‍‌ কিছুটা দূরে ‘বাহিরী’ দান করেন এখানকার গুরুত্বের কথা ‍‌ভেবেই। অন্যান্য এলাকার থেকে এখানকার পরিবেশ ছিল কিছুটা আলাদা। বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু কেন?
আসলে এখানেই নাকি একসময় গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতি। দাঁতনের মোঘলমারি, ময়নাগড়ের মতো এখানেও ছিল বৌদ্ধ সংঘারাম। ‘বাহিরী’ নামকরণেও তার সূত্র মেলে। সম্ভবত ‘বিহার’ শব্দ থেকেই ‘বাহিরী’-র উৎপত্তি। আর ‘বৌদ্ধ বিহার’ থেকে ‘বিধুবাহিরী’ গ্রামের নামকরণ হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। কালে কালে সমুদ্রের নিকটবর্তী এই বাহারী জনপদ সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কায় মাটির তলায় হারিয়ে গিয়েছিল বহুদিন আগে। তারই উপর গড়ে উঠেছে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম রাজার সহযোগিতায় হিন্দু ধর্মের স্থাপত্যকীর্তি। তবে অনেকের মতে সংস্কৃত ‘বহিঃ’ থেকে ‘বাহির’ এবং ওড়িয়ায় ‘বহির’ অপভ্রংশ হয়ে চিহ্নিত হয়েছে।
বাহিরীতে রয়েছে ৪টি বিশাল পুষ্করিণী— ভীমসাগর, হেমসাগর, চাঁদকোনিয়া এবং চোদ্দমানিয়া। রয়েছে চারটি মাটির উঁচু ঢিবি বা টিকরী— পালটিকরী, ধনটিকরী, গোধনটিকরী এবং সাপটিকরী। ‘টিকরী’ ‍‌ওড়িয়া শব্দ। বিভীষণের পুত্র তথা হিজলীর দেওয়ান পরাক্রমশালী ভীমসেনের নামেই ভীমসাগর। এই ভীমসাগরেই তিনি আত্মবিসর্জন করেন। এখন এর আয়তন ১৫বিঘা। এগুলি সবই তৈরি করেন বিভীষণ মহাপাত্র। তারই আমলে বাহিরী হয়ে ওঠে ‘বাহারি গ্রাম’।
বাহিরীতে পুকুর খননকালে মিলেছিল প্রাচীন কূপের অস্তিত্ব। মাটির গভীরে ৭-৮ফুট নিচে প্রায়ই একটি কূপ দেখা ‍গিয়েছিল। যা বৌদ্ধসংস্কৃতির নিদর্শন বলেই মনে করেন অনেকে। ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’-তে যোগেশচন্দ্র বসু উল্লেখ করেছেন সেকথা। কেননা মাটির মধ্যেই মিলেছে ঘর। পাতলা ইটের দেওয়াল। সেইসব ইটের গঠন প্রণালী অন্যরকম। কূপগু‍‌লিতে ব্যবহৃত ইটগুলি ১৩-১৪ ইঞ্চি দীর্ঘ, ৭ ইঞ্চি প্রস্থ এবং ২ ইঞ্চি পুরু অর্ধ বৃত্তাকার ধরনের। খননকালে মিলেছিল অসংখ্য পুঁথির মালা। প্রচুর পাথরের মূর্তিও পাওয়া গিয়েছিল সেসময়। কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে সেইসব সামগ্রী রক্ষিত। স্থানীয় বিবেকানন্দ সংগ্রহশালাতেও সংরক্ষিত রয়েছে বহু সামগ্রী। কারও কারও মতে এগুলো পাল অথবা সেনযুগ অথবা তারও আগেকার সময়ের। গবেষকদের অনুমান একদা এখানে বৌদ্ধ প্রভাব ছিল। ইতিহাসপ্রেমী ডঃ কমলকুমার কুণ্ডু জানান বাহিরীতে সত্যিই বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব ছিল কিনা তার সঠিক অনুসন্ধান আজও কেউ বিজ্ঞানসম্মতভাবে করেননি। অথচ ইতিহাসের কারণেই তা জানা জরুরী। তবে এ গ্রামের মৃত্তিকার অন্দরমহল থেকে প্রাপ্ত সামগ্রী কিন্তু এলাকার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে দাবিকেই জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তবে বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শন অবশ্য এখন এখানে মেলে না। কিন্তু এককালে মেদিনীপুরে অসংখ্য সঙ্ঘারামের উপস্থিতির বিবরণ পাওয়া যায় হিউয়েন সাঙয়ের লেখাতেও। যোগেশচন্দ্র বসু ‍‌লিখেছেন ‘‘একদিন হয়তো এখানে বুদ্ধদেবের মূর্তিই বিদ্যমান ছিল। শ্রমণগণ তাহারই পূজায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর কাটাইয়া দিতেন। আচার্য্যগণ সেই স্থা‍‌নে বসিয়া গম্ভীর আরাবে নির্বাণ মুক্তির অপূর্ব সত্য দেশবাসীকে শুনাইয়া দিয়া ডাকিতেন, — এস এস নরনারী, আমরা অমৃত পাইয়াছি, সে অমৃত তোমাদিগকেও দিব।’’
বর্তমানে বিভীষণের তৈরি জগন্নাথ মন্দিরটি পরিত্যক্ত। সেখানে দেবতার মূর্তি নেই। কিন্তু শৈল্পিক চেতনা এবং সুষমামণ্ডিত কারুকার্যের দণ্ডায়মান পাষাণ হিসেবে ‘বাহারি গ্রাম’ বাহিরীতে অধিষ্ঠিত। কি করেছিলেন তখন বিভীষণ? শুধু মন্দির স্থাপন নয়। বাহিরী পরগনাকে জনবসতির উপযুক্ত করে তুলতে গড়, পুষ্করিণী, বাসস্থান, রাস্তাঘাট তৈরি করেন তিনি। চালু করেন চন্দনমেলা এবং রাসযাত্রা। সুদূর ওড়িশা থেকে নিয়ে আসেন শিল্পী এবং স্থাপত্য শিল্পের উপকরণ। জাহাজে করে আনা হয়েছিল সেসব। আজও টিকে আছে একটি তেঁতুলগাছ। লোকবিশ্বাস এই গাছেই জাহাজ বাঁধা থাকতো। নতুন জনবসতি গড়ে তোলেন তিনি। এজন্য বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে আসেন ওড়িশা থেকে। তারই আমন্ত্রণে তেলি, ডোম, চর্মকার, ব্রাহ্মণ, ছুতোর, ধোপা, মালি, তাঁতি, কুমোর, কামার, নাপিত, চাষীদের আগমন ঘটে এখানে। আজও তাই এখানে দেখতে পাওয়া যায় দাস, নায়ক, গিরি, জানা, চ্যাটার্জি, বেরা, প্রহরাজ, পণ্ডা, কয়াল, আচার্য, পাহাড়ী, করণ, মণ্ডল, নন্দ, ভট্টাচার্য্য, মাইতি পদবীর মানুষজনকে। বহু বছর আগে যুদ্ধজয়ের লক্ষ্যে এসে সেই স্থানেই এক অত্যাধুনিক জনবসতি গড়ে তুলতে যে অমোঘ কীর্তি স্থাপিত হয়েছিল তা আজও স্মরণযোগ্য।
বাহিরীর পূর্বমুখী জগমোহন সহ শিখর দেউলটি অবশ্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভুগছে। সারা গায়ে শ্যাওলার পলেস্তারা। রঙ নেই। মন্দিরের গায় অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। ঢোকার মুখে দরজার গায়ে কোনওরকমে আটকে আছে সুপ্রাচীন টেরাকোটার কয়েকটি ফুলের ছবি। বেশির ভাগই খোয়া গেছে। বাহিরীর এই প্রাচীন মন্দিরটির মূল অংশের উচ্চতা ১২.১ মিটার। এটি দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৭.৩ মিটার। জগমোহনটির উচ্চতা ১০.৬ মিটার এবং তা দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৫.১ মিটার। জগমোহনটি ‘পীঢ়া’ রীতির। ওড়িশার স্থাপত্যশৈলীর যোগ আছে। মূল মন্দির ও জগমোহনের মধ্যেকার ছাপ এ প্রাচীন হিন্দু স্থাপত্যশৈলীর ‘লহরা’ পদ্ধতির দেখা মেলে। ১৫৮৪ নাগাদ নির্মিত মন্দিরের শৈল্পিক গুরুত্ব অযত্ন, অবহেলা আর অপরিণামদ‍‌র্শিতার ফ‍‌লে ম্রিয়মাণ। গোপীজনবল্লভ লিখিত ‘রসিকমঙ্গল’ কাব্যে মেলে বাহিরীর রূপকার বিভীষণ মহাপাত্র ওরফে বিভীষণ দাসের নাম। মন্দিরের গর্ভে তিনটি পাথরে খোদাই করা ওড়িয়া হরফে লেখা তিনটি সংস্কৃত শ্লোকের লিপি রয়েছে। তবে দ্বিতীয় লিপির শ্লোকটি অবশ্য নষ্ট করে দিয়েছে বাসুদেবপুরের রাজারা। প্রথম এবং তৃতীয়টি এখনও আছে। কি আছে সেই লিপির শ্লোকগুলিতে?
প্রথম শ্লোকটি হলো ‘‘কাশীদাস কুলে বিভীষণ ইতি শ্রী পদ্মনাভাত্মজঃ শ্রীমান বিরভূদ চীকর দশৌ প্রাসাদ মুচ্চৈরিমং রামসয়েচ সুভদ্রয়া সহ জগন্নাথং ন্যধাসীদপি গোপাল প্রতিমাঞ্চ সম্যগ নয়োসদ্ভিঃ প্রতিষ্ঠাং দ্বিজৈঃ’’। অর্থাৎ কাশীরাম দাসের বংশে পদ্মনাথ দাসের পুত্র বিভীষণ দাস মহাপাত্র আবির্ভূত হয়েছিলেন। উচ্চপ্রাসাদ প্রস্তুত করেছিলেন। বলরাম, জগন্নাথ, সুভদ্রা ও গোপাল প্রতিমা স্থাপন করে ব্রাহ্মণ দ্বারা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে উল্লিখিত বিভীষণ দাস মহাপাত্র এবং বিভীষণ মহাপাত্র আসলে একই ব্যক্তি। আবার তৃতীয় শ্লোকটিতে লেখা আছে ‘‘পৌত্র শ্রীধরণী সুতো ভগবতঃ মনু দ্বিজন্মাগ্রণীঃ শ্রীমানার্জ্জুন মিশ্র ইত্যাভিহিত সাচার্য চূড়ামনে পুত্র চক্রধর কবীন্দ্র ইতি যশ্চানীৎ প্রতিষ্ঠা বিধৌ প্রাসাদস্য বিভীষণ সৎকৃত্বা বিরামঃ গভঃ।’’ অর্থাৎ ধরণী মিশ্রের পৌত্র ভগবান মিশ্রের পুত্র শ্রীমান অর্জুন মিশ্র তার পুত্র কবীন্দ্র চক্রধর মিশ্র বিভীষণের এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। প্রতিষ্ঠা করিয়া বিরামপুর শাসনে গিয়াছেন। তবে নষ্ট করে দেওয়া দ্বিতীয় শ্লোকটি থেকে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কাল জানা যায়। এতে লেখা ছিল ‘‘শকাব্দে রসশূণ্য বান ধরণী মানে তৃতীয়া তিথৌ বৈশাখ বুধবাসরে সুনিশিতে পক্ষে যুগাদৌশিতে শ্রীযুক্তায় গদাধরায় গুরুবে তদ্দেব তানং মুদে প্রত্তং গ্রাম বরোচিতং প্রতিদিনং তদ্দেউল বাড়খ্যকং’’। অর্থাৎ ১৫০৬ শকাব্দে বৈশাখ মাসে ৭ তারিখে বুধবার সত্য যুগাদি তৃতীয় তিথিতে শুক্লা পঞ্চমী গুরু শ্রী গদাধর নন্দকে প্রতিদিন সেবাপূজার জন্য দেউলবাড় গ্রাম সহ দান করেছিলেন।
এই গদাধর নন্দের উত্তরপুরুষ বর্ষীয়ান হরিহর নন্দ দেউলবাড় গ্রামেই এখন বাস করেন। একসময় বাহিরী হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি এখন জগন্নাথ ট্রাস্ট কমিটির সম্পাদক। জানান, বাহারি গ্রাম বাহিরী সত্যিই অভিনব এবং অত্যাধুনিক গ্রাম। শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান ছিলে এখানে। ওড়িয়া এবং বাঙালী সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে‍ছিল। একসময় বিভীষণ মহাপাত্র বাহিরীতে যে নতুন বসতি স্থাপন করেছিলেন তাতে ছিল যথেষ্ট চিন্তা এবং উন্নত মানসিকতার প্রভাব। তা আজও দৃষ্ট হয়। মন্দিরের প্রথম পূজক গদাধর নন্দের বংশধরেরা আজও প্রায় ২০০টি পরিবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে। হরিহর নন্দ জানান, একসময় এখানে সংস্কৃত শিক্ষা, সঙ্গীত শিক্ষার পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল। প্রচুর পুঁথি ছিল। ওড়িয়া, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় লেখা সেইসব প্রাচীন পুঁথির অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে অযত্নে। সেইসব পুঁথি আরও অনেক তথ্য দিতে পারত। বঙ্গ উৎকল সংস্কৃতির মিশ্রণ দানা বেঁধেছিল এখানে।
অনেকে বাহিরীকে ‘বিরাট রাজার গড়বাড়ি’ ব‍‌লে অভিহিত করেন। তবে তার সাথে মহাভারতের কোনও সম্পর্ক নেই। একসময় মন্দিরের সম্পত্তি ছিল বাহান্ন বাটি অর্থাৎ ১০৪০ বিঘা। আজ সেসব দখল করে শুরু হয়েছে জনবসতি। সেসময় বিভীষণ মহাপাত্র তার নতুন জনবসতি রক্ষায় দুটি লোহার কামান ব্যবহার করেছিলেন বাহিরীতে। সেগুলি আজ অব্যবহৃত অবস্থায় অযত্নে নষ্ট হচ্ছে কাঁথির ফৌজদারি আদালতের সামনে। বর্তমানে বাহিরীতে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে পুষ্করিণী, টিকরী ছাড়াও দুটি মঠ। সুবিন্যস্ত রাস্তা। রাস্তার দুপাশে বাড়িঘর। পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি হাইস্কুল এবং একটি উপস্বাস্থকেন্দ্র রয়েছে।
অনুমান করা হয়, খ্রীষ্টীয় অষ্টম থেকে নবম শতকে বাহারীতে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু বৌদ্ধ সংঘারাম এবং বৌদ্ধস্তূপ। এর আগে সপ্তম শতাব্দীতে তাম্রলিপ্ত বন্দরে এসেছিলেন হিউয়েন সাউ। তমলুক অঞ্চলে তখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবল জোয়ার। সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাহারীতেও।
বাহারীর পাশ দিয়েই তাম্রলিপ্ত বন্দরগামী জাহাজ চলাচলের পথ। এখন অবশ্য বাহারি সমুদ্র থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। এখানে একটি তেঁতুল গাছে সমুদ্রগামী জাহাজ বাঁধা থাকতো বলে প্রচার আছে। অর্থাৎ সেই সময় সমুদ্রগামী জাহাজ এসে ভিড় করতো বাহারীতে। সেকারণেই এখানে গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধবিহার। তমলুক এলাকার বৌদ্ধ শ্রমণরা বাহারীতে এসে গড়ে তুলেছিল সংঘারাম। সেই ‘জাহাজ বাঁধা তেঁতুল গাছ’ আজও আছে।
লোকমুখে জানা যায়, জগন্নাথ নামে বাহান্নবাটিতলার একজনের এক হাজার চল্লিশ বিঘে জমি ছিল।বড় মঠ, ছোট মঠ, কর্পূরা মঠ, দেউলবাড় মঠ, বিধুবাহারী মঠ, পালটিকরী মঠগুলি বাহারীর সম্পদ। জগন্নাথ মন্দিরে দক্ষিণ দিকে বিরাট নিচু জলাভূমি এলাকা রয়েছে। তাকে বলে কালীদহ। এখানকার মানুষ বলেন ‘কালদা মাঠ’। এখানে নাকি প্রচুর সাপের বসবাস ছিল। তাই এ হেন নাম।
আজও রয়েছে ভীমসাগর পুকুর। তারই মধ্যস্থলে ছিল দেবালয়। এখনও জাল টানলে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগে এই পুকুরে চারটি ঘাট দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু আজও পর্যন্ত সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে বাহারীতে ঐতিহাসিক নিদর্শন খুঁজে বের করতে খননের কাজ চালানো হয়নি। গবেষকদের দাবি, বাহারীর প্রত্নসম্পদ খনন করে প্রকাশ্যে আনা উচিত। একসময় যে এই এলাকা কতখানি বাহারি ছিল তা খুঁজে দেখা দরকার।
নন্দকুমার দীঘা রাজ্য সড়কে মারিশদা বাসস্টপে নেমে পূর্বমুখী পিচ ঢালা রাস্তায় তিন কিমি গেলেই মিলবে আলোচিত বাহিরী। বট, অশ্বত্থের পাশে নিশ্চল নিস্তব্ধতাকে সঙ্গী করেই দাঁড়িয়ে আছে বাহিরীর পরিচায়ক শিল্পকর্মটি। চোখ মেললেই চারিদিকে কাঁটাবাঁশের ঝোপ। কিন্তু সর্বত্র যেন সুললিত ভাব। স্থানীয় জেলা পরিষদ সদস্য কালীপদ শীট-এর দাবি এই বাহিরীকে ঘিরে গড়ে উঠুক পর্যটনকেন্দ্র। রক্ষিত করা হোক এখানকার শিল্পকর্ম। পূর্ব মেদিনীপুরের পর্যটন মানচিত্রে এখনও ঠাঁই না পাওয়া ঐতিহাসিক বাহিরীকে দেওয়া হোক যোগ্য সম্মান। তবে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের অবশ্য বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে।
ভীমসাগরের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অন্যপ্রান্তে তাকাতে থাকলে হয়তো বা মনে পড়বে, একসময় এই জলেই চিরনির্বাণ নিয়েছিলেন ভীমসেন। যার পিতা বিভীষণ মহাপাত্র সুদূর ওড়িশা থে‍‌কে এখানে এসে বাহিরীকে ‘বাহারি গ্রাম’ আখ্যায়িত করার রসদ জুগিয়েছিলেন।

Saturday, October 29, 2016

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা অসত্যের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে টাটা কোম্পানির ভিত - প্রমথ নাথ মিত্রের খনি আবিষ্কারের কথা স্বীকার করে নি টাটা কোম্পানি

এই ব্লগেই বহু আগে জানিয়েছি টাটা কোম্পানি কি করে অনৈতিকভাবে চিনে আফিম চালান করে বিপুল অর্থ লাভ করেছিল।
আজ দেখাব টাটা আয়্রন এন্ড স্টিল কোম্পানি শুরুর জন্য দায়ী গুরুমহিষাণী খনির লৌহ আকরিক। তাঁদের এই তথ্য দেওয়ার পথিকৃত বাঙালি প্রমথ নাথ বোস। টাটারা শুধু তার প্রাপ্যই মেরে দেয় নি, বহুকাল পর্যন্ত তার অবদানটাও স্বীকার করে নি।
প্রমথবাবুর পুত্র পরিচালক মধু বসু আত্মজীবনী আমার জীবনএ এই বিষয়টা বিশদে লিখে গিয়েছেন। আড়াই পাতা ব্যাপী এই লেখাটা একটু বড়ই হবে - ইতিহাসের পাতা যাতে নিষ্কলঙ্ক থাকে, তার জন্য মুধু বসুর সেই ইতিহাস চর্চা এখানে উল্লিখত হল -প্রত্যেক বাঙ্গালীর এই সত্য জানা প্রয়োজন -

...এটা ঐতিহাসিক সত্য যে জামশেদপুরের টাটা কোম্পানীর বিরাট লৌহ কারখানার জন্য খনিজ লৌহ যেখান থেকে আসে, সেই গুরুমহিষাণীর আবিষ্কারক হচ্ছেন আমার বাবা। একটা গুজব প্রচলিত আছে যে, এই আবিষ্কারের জন্য তিনি নাকি একটা মোটা টাকা পেয়েছিলেন। এমন কি অনেকের মনে এমন ধারণাও আছে যে আমরা এখনও পর্যন্ত নাকি টাটা কোম্পানীর কাছ থেকে বেশ মোটা রকম একটা মাসোহারা পেয়ে থাকি। এই ধারণাটা আবশ্য সাধারণ লোকের মনে আসা আস্বাভাবিক নয়। আজ যে কোম্পানি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে, লক্ষ লক্ষ লোকের অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করছে, সেই বিরাট মহীরুহের বীজটি যিনি বপন করেছিলেন, তাঁর প্রতি কোম্পানীর একটা কর্তব্য থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে এই।
আমি আগেই বলেছি, ১৯০৩-০৪ সালে ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের গুরুমহিষাণীতে লৌহ আকর আবিষ্কার করেছিলেন আমার বাবা। সেই সময়ে বোম্বায়ের বিখ্যাত ব্যবসায়ী জামশেদজী নাসেরওয়ানজী টাটা বিরাটভাবে বিলাতী আদর্শে একটা লৌহ কারখানা স্থাপন করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এ পরিকল্পনায় তাঁকে উপদেশ ও পরামর্শ দিচ্ছিলেন সি পি পেরীন ও সি এম ওয়েল্ড। এঁরা মধ্যপ্রদেশের ঢুল্লি ও রাজহরায় প্রচুর লৌহ আকরের সন্ধান পেলেন। কিন্তু এই স্থান দুটি বহু পূর্বে ১৮৮৭ সালে বাবা আবিষ্কার করে জিওলজিক্যাল সার্ভের রেকর্ডে প্রকাশ করে রেখেছিলেন(ভাইড রেকর্ডস দ্য জিওলজিক্যাল সার্ভে, ভল ২০, পার্ট১) বর্তমানে ভিলাই লৌহ ও ইস্পাত কারখানায় এই রাজহরা ও ঢুল্লি থেকেই আকরিক লৌহ চালান আসে।
যখন জামশেদজী টাটা জানতে পারলেন যে বাবা এই জায়গা দুটিতে লৌহ আকরের আবিষ্কারক, তখন তিনি বাবাকে চিঠি লিখে এই স্থানে লৌহ কারখানা স্থাপন করার ব্যপারে তাঁর মতামত চাইলেন। তার উত্তরে বাবা জামশেদজী টাটাকে ২০।২।১৯০৪ তারিখের চিঠিতে জানালেন যে ময়ূরভঞ্জ স্টেটের গুরুমহিষাণীতে প্রচুর লৌহ আকরের সমাবেশ রয়েছে। ঢুল্লি রাজহরা থেকে গুরুমহিষাণীতে কাজ করার সুবিধে এই জন্য বেশী যে বাংলাদেশের কয়লাগুলি এর খুব নিকটেই। এই চিঠি পাওয়ার পর শ্রীটাটা খুবই আকৃষ্ট হলেন এই প্রস্তাবে এবং বাবার সঙ্গে পত্রালাপ শুরু করলেন। ময়ূরভঞ্জের মহারাজা রামচন্দ্র ভঞ্জদেওয়ের পক্ষে বাবা এবং শ্রীটাটার পক্ষে শ্রীদোরাবজী টাটা, সি পি পেরীণ, সি এম ওয়েল্ড ও মি শাকলাতওয়ালা আলোচনা চালান, কিন্তু কোনরকম বন্দোবস্ত পাকাপাকি হওয়ার আগেই শ্রীজামশেদজী টাটা মারা যান ১৯০৪ সালে। এর পর তাঁর ছেলেরা বাবার সঙ্গে আলোচনা চালান। মহারাজা রামচন্দ্র ভঞ্জদেও বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি টাটা কোম্পানীর কাছ থেকে যে রয়ালটি পাবেন, তার থেকে বাবাকে কিছু অংশ দেবেন। মহারাজের প্রতিশ্রুতির কথাটা লেখাপড়া করে রাখার জন্য বাবার বহু আইনজ্ঞ বন্ধু ও হিতৈষীরা অনুরোধ করেন। কিন্তু বাবা বললেন, মহারাজা যখন বলেছেন, তখন তাঁর কথায় আবিশ্বাস করব কী করে? লেখা পড়ার দরকার নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মহারাজা এক শিকার দুর্ঘটনায় মারা যান। পরে মহারাজার উত্তরাধিকারীরা এ বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেন নি। বাবা যাতে তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত না হন, তার জন্য তাঁর দু’একজন আইনজ্ঞ বন্ধু বাবাকে এই সম্পর্কে আদালতে এফিডেভিট ক’রে রাখার পরামর্শ দেন। কিন্তু বাবা কোর্টে যেতে বরাবরই গররাজী, তাই তিনি তাঁদের কথায় কর্ণপাত করেন নি।
ব্যাপারটা ওখানেই চাপা পড়ে গেল। এর অনেক দিন পরে ১৯০৭ সালে টাটা আয়রণ এন্ড স্টীল কোম্পানী এক প্রস্পেক্টাস বের করে। মজার কথা এই যে, তার কোনখানেই বাবার নামের উল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। তার ওপর তার ভিতরে বহু ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছিল। যে গুরুমহিষাণী লৌহসম্পদের ফলে টাটা কোম্পানী আজ ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প-প্রতিষ্ঠান, সেই লৌহ সম্পদের আসল আবিষ্কারকের নাম না থাকায় বাবা অতিশয় ক্ষুব্ধ হন, এবং স্বর্গত জে এন টাটার সেক্রেটারী মিঃ বি জে পাদসাকে প্রস্পেক্টাসের ভুলগুলি সংশোধন করে একটি চিঠি লেখেন,
সেই চিঠির সব শেষে তিনি লেখেন, I hope, in justice to me and in the interest of the truth you will be revise your prospectus in the light of these facts.
সেই চিঠির উত্তরে মি পাদশা ১৯০৭ সালের ৩রা জুলাই যে চিঠি লেখেন সেটাকে ব্যবসায়িক কূটনীতির চূড়ান্ত নিদর্শন বলা যেতে পারে। মি পাদশা লিখলেন,
In the commercial document one is not always able to reserve place for giving due credit to everyone but it is perfectly fair that the document should not be so worded as to imply that credit elsewhere than where it is due.
এর পরেও আমার সেজোমেসো(ক্ষীরোদ বিহারী দত্ত) বাবাকে অনেক করে বললেনঃ একটা কিছু করার দরকার। একটা এফিডেভিট করে চুপ করে বসে থাকা – বাকী সবকাজ আমরা করে দেব – তোমার এক পয়সাও খরচ হবে না। তোমার ন্যায্য প্রাপ্য এভাবে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।
বাবার সেই এক কথা – কোর্টে তিনি কখোনোই যাবেন না। ব্যাস, বাবার নাম ও অর্থ দুইই চাপা পড়ে গেল কূটনৈতিক চালের ধাক্কায়।
কিন্তু সত্য একদিন না একদিন সাধারণ্যে প্রকাশ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন পরে টাটা কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার মিঃ কিনানকে ১৯৩১ সালের ২৯ আগস্ট তারিখের এক চিঠিতে মার্কিন লৌহ বিশেষজ্ঞ মঃ সি পি পেরীন জানান-
‘আপনি হয়ত জানেন না যে ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের ভূতত্ত্ববিদ ছিলেন মিঃ পি এন বোস। গুরুমহিষাণীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে তিনিই আমাদের প্রথম মনোযোগ আকর্ষণ করেন এবং পৃথিবীর সেই প্রান্তে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ীই আমি যাই। তাঁর আবিষ্কারের জন্য আজ ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের লৌহ-আকরের এই বিরাট প্রতিষ্ঠান। এই ঘটনাগুলি না ঘটলে আজকের এই বিরাট টাটা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হতো কিনা সন্দেহ।’
এর পরেও বাবার আবদানের কথা টাটা কোম্পানী স্বীকার করে নি। বাবার মৃত্যুর তিন বছর পর যখন জামশেদপুরে তাঁর এক মর্মর মূর্তি স্থাপন করা হয়, তখন উদ্বোধনের সময় টাটা কোম্পানীর পক্ষ থেকে বাবার আবিষ্কারের কথা স্বীকার করা হয়। এই স্বীকৃতির বেশী আর কিছুই পাওয়া যায় নি টাটা কোম্পানীর কাছ থেকে।

Friday, October 28, 2016

রাভা, মেচ সমাজ, ওয়াটাগ, সংঘ এবং কলাবতী মুদ্রার পক্ষে বন্ধুদের কাছে প্রস্তাব -


আমরা গোঁসাইহাট রাভা বস্তি এবং মধ্যনারারথলীর মেচ সমাজ সামগ্রিকভাবে নিজেদের জমিতে তুলো চাষ করব, সুতো কাটছি, এবং সুতো রং(এইটা নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হবে) করছি, এবং কাপড় বুনছি, তা হলে পরিধেয় তৈরির উপকরণের জন্য একবারও বাজারের ওপর নির্ভর করতে হবে না, বরং সেই উতপাদন বাজারে বিক্রি করতে খোলা বাজারকে ব্যবহার করতে পারব নিজেদের মত করে – রোজগার করব নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে – রক্ষা করতে পারব আমাদের দীর্ঘকালীন বয়ন ঐতিহ্য, নিজেদের মত করে কোন দাতা সংগঠনের অনুদান ছাড়াই, বন্ধুদের সহায়তায়
এছাড়াও আমরা সংঘকে এবং ওয়াটাগকে প্রস্তাব দিচ্ছি যদি সম্ভব হয় আমাদের সমাজের বয়ন নকশা নকল আটকাতে ভৌগোলিক চিহ্ন হিসেবে গোঁসাইহাট বনবস্তির রাভাদের এবং মধ্যনারারথলীর মেচ সমাজের তৈরি বস্ত্রকে জিআই পঞ্জীকরণ করতে দুই সমাজকে সাহায্য করুক। তাতে সমাজের বুননের যেমন নিজস্বতা বজায় থাকবে ঠিক তেমনি বড় পুঁজি এই ছোট উতপাদন ধ্বংস করতে যে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে, সমাজের বয়ন নকশাগুলি ব্যবহার করে ব্যাপক নকল কাপড় তৈরি কাজের আশ্রয় নেয়, তাও আটকানোর চেষ্টা করা যাবে।
এই প্রস্তাবের পাশে দাঁড়িয়ে সংঘের এবং কলাবতী মুদ্রার প্রস্তাব এবং আশা ওয়াটাগের সম্মানীয় উপদেষ্টা দীপঙ্কর দে মহাশয় এবং তার কর্মস্থলের সম্মানীয় সহকর্মী এবং ছাত্রছাত্রীরা – যাঁরা ওয়াটাগ তৈরিতে নিজেদের সামাজিক অবদান পেশ করেছেন অতি দক্ষতায়, যাঁদের একজন ওয়াটাগের অছিও বটে, যাঁরা এখনকার ব্যবসা ব্যবস্থাপনা পড়েন এবং পড়ান এবং এ বিষয়ে আসীম দক্ষতা অর্জন করেছেন এবং অধ্যাপক দে’র নেতৃত্বে এরাই সামাজিক মাইক্রো ব্র্যান্ডিংএর অন্যতম প্রধান প্রবক্তা - নিশ্চই রাভা এবং মেচ কাপড়ের মাইক্রো ব্রান্ডিং তৈরিতে সক্রিয় হবেন তাঁদের অধীত দক্ষতার ছোঁয়ায় গড়ে উঠবে নতুন বাঙলার প্রাচীনতম সমাজগুলির নিজস্ব দক্ষতায় গয়ে উঠেও রাষ্ট্রিক অসহযোগিতায়, বড় পুঁজির আক্রমনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অসাধারণ বয়ন ব্যবস্থা, প্রাণ পাবে জঙ্গলে বাস করা বাঙলার দক্ষ মানবিকতম প্রকৃতির সন্তান
রাভা সমাজের পক্ষে ওয়াটাগের এবং সংঘের এবং কলাবতী মুদ্রার এবং আমাদের বন্ধুদের কাছে আরেকটি অনুরোধ, গোঁসাইহাট রাভা বন বস্তি বাঙলার সুন্দরতম স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। রাভা সমাজ একে কারু ভ্রমণ অঞ্চল হিসেবে খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে উপস্থাপন করতে চাইছি – বিশেষ করে যারা অন্য ধরণের যায়গা দেখতে চাখতে এবং তার স্বাদ অনুভব করতে চান। তার জন্য গোঁসাইহাট রাভা বস্তি কোন এক/দুজনের সদস্যের বাড়ির একটি ঘর সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনা করেছি –যারা এই অঞ্চল ভ্রমণ করতে আসবেন তারা সেই বাড়িতে থাকবেন, পরম্পরার খাবার খাবেন।  গয়েরকাটা ছাড়াও এর ৭৫ কিমির মধ্যে বিভিন্ন জঙ্গল – যেমন বক্সা, চিলাপাতা, গরুমারা ইত্যাদি এবং ভূটানের ফুন্টসিলিং আর ১০০ কমি গেলে অসাধারণ রসিক বিল দেখতে পারবেন। যদি তারা শুধুই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এই জঙ্গল ঘেরা গ্রামে গিয়ে দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা বা হিমালয়ের সৌন্দর্য এবং তার সঙ্গে জঙ্গলে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘোরার অনুভূতি অর্জন করতে চান তাহলে গোঁসাইহাট ফরেস্ট বস্তি একমাত্র তাদের গমন এলাকা। অবশ্যই এখানে যারা আসবেন তাদের রাভা সমাজে অর্থ দেওয়া ছাড়াও তাঁর অধীত কোন জ্ঞান সমাজের সঙ্গে অংশিদারি করে নিতে হবে। এই ঘোরা শুধু দিন কাটানো ভ্রমণ নয়, এটি দায়িত্বপূর্ণ ভ্রমণের অঙ্গ করে গড়ে তুলতে চাইছে রাভা সমাজ। কিন্তু এই ভ্রমণ উদ্যমটি কোন লাভজনক ব্যবসা কর্মরূপে বিবেচিত হবে না – তাহলেই সাধারণ ভ্রমণকারীদের উতপাত বাড়বে – যাদের উৎসাহ রয়েছে নির্জনতা উপভোগ আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শুধু তাদের জন্যই এই ভাবনা এবং পরিকল্পনা রূপায়ন।
কলাবতী মুদ্রা এবং সংঘের পক্ষ থেকে বন্ধুদের কাছে আরো একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব – সৌমিকদা অসাধারণ দক্ষতায় জড়ো করেছেন দেশের তুলোর বীজ – বড় পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইএর দুরন্ত হাতিয়ার – তিনি জোগাড় করেছেন দেশি রঙ্গীন তুলোর বীজ – ছাই আর গৈরিক। কিন্তু নীল আর অন্য রঙ্গের বীজ যা পাওয়া যেত বাংলায় তা আর পাওয়া যায় না – শোনা গিয়েছে তা বলিভিয়া দেশে পাওয়া যায়। যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তির সেই দেশে কোন যোগাযোগ থেকে থাকে তিনি যেন বলিভিয়ার রঙ্গিন তুলোর বীজ এদেশে আনতে চেষ্টা করেন। তাতে আমার চাষী, আমাদের বস্ত্র উতপাদন ব্যবস্থা জোরদার হবে। 
আমরা সক্কলে এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঐতিহ্য এবং উতপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই অদম্য, অসম সাহসী, দক্ষতা সম্পন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়াতে সাহায্যের হাত বাড়াই। এই কাজে যৌথভাবে রাভা, মেচ সমাজ, কলাবতী মুদ্রা, বঙ্গীয় পারম্পরিক সংঘ বন্ধুদের সাহায্য চাইছি – সম্পদ সংগ্রহ এবং বুনন আর সামাজিক ভ্রমন কর্মসূচী রূপায়নে
শহুরে আর জঙ্গলের মানুষদের প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং যৌথ দক্ষতায় নতুন বাংলা নতুনতমভাবে সেজে উঠবে নতুন করে নতুন সময়ে।
রাভা সমাজের পক্ষে  সিতিন রাভা ও গনাত রাভা
মেচ সমাজের পক্ষে রাজীব ঠাকুর ও মধুসূদন ঈশ্বরারী
বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের পক্ষে মধুমঙ্গল মালাকার
জয় বাংলা!
জয় পরম্পরার জ্ঞানের, প্রজ্ঞার, দক্ষতার!!

বাঙলার ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামীন পরিকাঠামো বিকাশ উদ্যম২


মেচ বাঁশের মাছ ধরার ফাঁদ কর্মশালা
১৮ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর,
মধ্যনারারথলি, কুমারগ্রাম, আলিপুরদুয়ার
রাভা বয়ন শিল্পের কর্মশালার প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কলাবতী মুদ্রা, ভারতীয় মানব বিজ্ঞান সর্বেক্ষণকে বাঙলার নতুন জেলা আলিপুর দুয়ারের মধ্যনারারথলীর মেচ গ্রামে তাদের ভুলে যাওয়া বাঁশের মাছ ধরার ফাঁদ তৈরির কর্মশালার প্রস্তাব দেয় এবং পূর্বাঞ্চলের অবরনির্দেশক কাকলী চক্রবর্তী সেই প্রস্তাবটি সানন্দে গ্রহণ করেন। শর্ত হল কর্মশালার ব্যয়বরাদ্দ এবং সেই কর্মশালার খরচ ভারত সরকারেরে এই সঙ্গঠনটি নিজেরাই নিজেদের হাতে করবেন। যেহেতু কলাবতী মুদ্রা এবং বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ মূলত চাঁদা ভিত্তিক সংগঠন, সেহেতু এই প্রস্তাবে তাদের কোন সমস্যাই হয় নি।
তো রসিক বিল আর কামাক্ষ্যাগুড়ির থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এবং ৩১সি জাতীয় সড়ক থেকে কয়েক মিটার দূরত্বে অবস্থিত মধ্যনারারথলী গ্রামে মেচ বা মেচিয়া সমাজের বাস। এরা গয়েরকাটা জঙ্গলের উপকণ্ঠে বাস করা গোঁসাইহাট রাভা বস্তির রাভা সমাজের মত জঙ্গল ভিত্তিক নয় –যদিও কয়েক প্রজন্ম পূর্বে তারা তা ছিল – যা আমাদের জানিয়েছিলেন মেচ সমাজের প্রয়াত মাথা দারেন্দ্র ঈশ্বরারী মশাই কয়েক বছর আগে – যদিও সমাজের সামাজিক বন্ধন যথেষ্ট দৃঢ, কিন্তু জীবনযাত্রায় এঁদের শহুরে প্রভাব বেশ জোরদার। খাওয়াদাওয়ায় অনেকটা বাঙ্গালি প্রভাব। রাভাদের মতই তারা নিজেদের বুননটা হয়ত ভোলেন নি, কিন্তু গত দুদশক তা আর নিজেদের হাতে করেন না।
১৮ তারিখ সর্বেক্ষণের অবরপ্রধান, স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত বোড়ো সাহিত্য সভা এবং কলাবতী মুদ্রার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কর্মশালাটির উদ্বোধন হয়। সেদিন দুপুরের খাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় কর্মশালার কাজ।
কিন্তু সুখের বিষয় হল বাঁশ দিয়ে মাছ ধরার ফাঁদ তৈরির কর্মশালার ভাবনা বাড়তে বাড়তে কিন্তু চলে যায় তাদের জীবনের আচারের সঙ্গে যুক্ত বাঁশ দিয়ে তৈরি নানান ধরণের উপকরণ তৈরির কর্মশালায়। দ্রুত খবর ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেচ/বোড়ো সমাজের নানান ধরণের প্রতিনিধির উপস্থিতির বহর বাড়তে থাকে ক্রমশ। তাঁরাও সহর্ষে, সগর্বে অংশগ্রহণ করতে থাকেন এই কাজেএই সাধারণ ছোট্ট কর্মশালাটি দাঁড়িয়ে যায় সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের কর্মকাণ্ডে।
সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। উদ্বোধনের দিনই যদিও কর্মসূচীতে ছিল না, তবুও তারা একটি তাঁত এনে বসিয়ে দিয়েছিলেন, কর্মশালাটি যেখানে হচ্ছে - মধ্যনারারথলীর মানসিং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে উঠল তাঁদের বাথৌ আচারের প্রাণকেন্দ্র সিজ মনসা গাছের নিচে থাকা বাঁশের তৈরি বিশেষ ঘেরাটোপ, চাষের মই, সুতো কাটা মাকু, বাঁশি, বাচ্চাদের খেলনা আরও সব নাজানি কিএ সব তৈরি হতে থাকল মেচ সমাজের যুবকদের অংশগ্রহণে। 
























অংশগ্রহণকারী অনেকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাভা গ্রামের বয়ন কর্মশালার কথা। তারাও খুব উতসাহী সে ব্যাপারে। বললেন কুড়ি তিরিশ বছর আগে তাদের গ্রামে বাড়ি বাড়ি চাষ হত সাদা কাপাস তুলো – সেই তুলো দিয়ে তারা তাদের কাপড় বুনতেন অন্তত বিশ বছর আগেও প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে ছিল তাঁত – সেই তাঁতে কাপড় বুনতেন গাঁয়ের মেয়েরা – যে কাজে তাদের একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। কথা বলতে বলতেই এসে হাজির এক বয়স্কা মহিলা তকলি দিয়ে সুতো কাটতে কাটতে – সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য তিনি সগৌরবে জানালেন পাঁচশ মেচ বসতির গ্রামে আজও কয়েকশ মহিলা সুতো কাটতে পারেন তুলো থেকে, নিজের হাতে
স্বাভাবিকভাবেই সমাজের মানুষদের সঙ্গে কর্মশালার বাইরে বসে প্রস্তাব দেওয়া হল, তারা কি তুলো চাষে ইচ্ছুক? তুলো কাটতে ইচ্ছুক? এক স্বরে স্থানীয় যুবারা বলে উঠল ব্যবস্থা করেন আমরা আছি। কর্মশালা চলা কালীন ঠিক হয়ে গেল পরের মাসে ঠিক এই তারিখের কাছাকাছি তুলো বীজ নিয়ে আর তুলো চাষের উদ্গাতা সৌমিক মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আমরা মেচ গ্রামে আসছি। মেচ সংগঠনের যুবা নেতা রাজীব ঠাকুর নিজে পাঁচ বিঘেতে তুলো চাষ করতে বড়ই ইচ্ছুক। সংঘ তাঁদের একটি সংগঠন তৈরি করিয়ে দিচ্ছে, যে সংগঠনের মাধ্যমে তারা সংঘের বা ওয়াটাগের যৌথ উদ্যোগে বা শুধু নিজেরাও তুলো চাষ, সুতো কাটা, সুতো রঙ করা এবং কাপড় তৈরি এবং ব্যবসা করতে পারবেন সরাসরি বাজারের হাতে নিয়ন্ত্রিত না হয়েও।ইতিমধ্যে কথা হয়েছে, সৌমিকবাবু কিছু তুলো পরীক্ষামূলকভাবে মধ্যনারারথলীতে পাঠাবেন সুতো তৈরির জন্য।
তো ইতিমধ্যে বাঁশের যে কর্মশালা চলছিল তাও দারুণ রূপ পেতে থাকল – যা আপনারা এই ছবিগুলিতে দেখতে পাচ্ছেন।