Friday, November 26, 2010

Ivory Carving in Bengal


Ivory carving is one of the oldest crafts in India. Finely carved Ivory pieces recovered from Lothal-Swaraswati Civilization testify to the high degree of perfection achieved by Indian artisans. There are numerous instances in history to show that ivory had been included amongst the legendary merchandise that had made fabulous in the eyes of the old world.

As far as Bengal is concerned the art of ivory carving thrived under the patronage of the  Nawabs of Murshidabad. Archeologycal finds in Pandu Rajar Dhipi includes ivory comb and in the Chandra Ketu Garh a host of ivory bangles, rods and sticks, discs, fragment of ivory cascades  was found. In the Pala period the art of ivory carving reached its peak. Sir George Watt in his "Indian Art at Delhi - 1903" records that Tippera had enjoyed the reputation of being one of the ancient seats of Bengal for the art of ivory carving at the Chittagong Hill Tracts. But the town of Murshidabad emerged as the principal seat of ivory carving in Bengal during the reign of Nawabs.
Khagra & Jiagunj in Murshidabad are the presets of ivory carving of Bengal. The tool used by the artisans are not much changed since the Saraswati Period. These includes files, chisels of various sizes & shapes, wooden mallets and hammers compasses etc. For each work a specific tool has been used and it is only through training and experience that a craftpersons learns to handle these tools with skill and dexterity for producing objects of superb beauty and intricate craftpersonship.
Models of Birds, Beasts, Mayurpankhi Boats, richly decorated mounted elephants(Ambari Elephants), mythological figures, beautiful rural scenes are only a few of wonderful variety of artistic products.
The Sutradhars and Bhaskars are the folk community who are now translated themselves into other carving like shola peath or wood to survive as the ivory trade is banned now.

Thursday, November 25, 2010

বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাসের উদ্ভবএর ইতিহাস -অন্য নজরদারি

(এই লেখাটি তৈরি হয়েছে বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের এক অংশের লেখা আর বর্তমানে দশাবতার শিল্পী পরিবার ফৌজদার পরিবারের শেষ প্রতিনিধি শীতল ফৌজদারের সঙ্গে আলোচনাক্রমে)
সাধারণ প্রচলিত ভারতীয় ইতিহাস বলছে পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতে তাস খেলার উদ্ভব কিন্তু বিষ্ণুপুরের ইতিহাস বলছে মল্লরাজাদের সমৃদ্ধিকালে দশাবতার তাস আর তাস খেলার প্রবর্তন হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই ১৮৯৫ সালের এসিয়াটিক সোসাইটির জার্নালের এক ছোট্ট নোটে বলছেন ...I fully believe that the game was invented about eleven or twelve hundred years before the present date. শাস্ত্রী মশাই-এর হিসেব অনুযায়ী এই খেলার উদ্ভব সপ্তম-অষ্টম শতক। প্রথম কারণ সাধারণতঃ প্রচলিত দশাবতার বিশ্বাসে জগন্নাথ বা বুদ্ধের স্থান নবম - কল্কীর(স্মরণ করুন কবি কোকিল জয়দেবের দশাবতার শ্লোকাবলী - প্রলয় প্রলয়ধি জলে-র বুদ্ধসংক্রান্ত শ্লোকটি) আগে। কিন্তু দশাবতার তাস অনুযায়ী জগন্নাথ বা বুদ্ধদেবের স্থান পঞ্চম। শাস্ত্রীমশাইএর যুক্তি ধরে বলাযায়, বাংলায় এমন এক সময়ে দশাবতার তাসের খেলার প্রবর্তণ হয়েছিল, যখন বুদ্ধদেব পঞ্চম অবতার রূপে গণ্য তাসে বুদ্ধমুর্তি আদতে জগন্নাথ মূর্তি, - কেবল মাথা ও হাতসহ দেহকাণ্ডের মূর্তি। সুতরাং জীবের ক্রমবিকাশেরস্তরে নৃসিংহ(অর্ধ নর অর্ধ পশু) এবং বামনের (পূর্ণ নর) মধ্যবর্তী স্থান পেয়েছেন তিনি - অর্থাত্ নিম্নতম জীব মত্স্য থেকে পূর্ণ মানব পর্যন্ত বিকাশের ইতিহাসের একদম মাঝখানটি অধিকার করে আছেন তিনি - তাই বিনয় ঘোষবাবু এটিকে বলছেন ...খুব যুক্তিসংগত স্থান। আর ভারতীয় চিহ্ণতত্বের বিকাশের দৃয্টিভঙ্গী হিসেবে যদি দেখা যায়, দশাবতার তাসে বুদ্ধের প্রতীক পদ্ম। অর্থাত্ এই তাসটি এমন সময় প্রতিভাত হয় যখন বুদ্ধ পদ্মপাণিরূপে পরিচরত ছিলেন - অর্থাত্ পদ্মই ছিল তাঁর পুজোর প্রতীক - যে সময়ের বাংলার কথা আমরা আলোচনা করছি সেটি হল মহাযানী বাংলার কাল। ৮০০ থেকে ১০০০ খ্রীষ্টাব্দের সময় - পাল রাজত্বে বা তার কিছু আগেও হতে পারে। জয়দেব বা ক্ষেমেন্দ্রর কালে প্রচলিত ধারার উত্পত্তি হলেও পাল রাজাদের আগেও এই দশাবতার তাস খেলার প্রচলন ছিল
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাইএর বোদ্ধিক কাজের প্রায় প্রতিটি অংশে বৌদ্ধবাইএর ছোঁয়া ছিল এ মিথ কিন্তু মিথ্যা নয় - বলেছেন অনেকভাবুকই - বিশেষ করে বিনয় ঘোষমশাই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রকাশণ বিভাগ, পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ শাস্ত্রীমশাইএর যে রচনাবলী প্রকাশ করেছেন তার ছত্রেছত্রে এই তত্বের প্রকাশ এবং তাঁর এই অন্তর্দর্শণ অসম্ভব সত্য। দশাবতার তাস খেলা, অঙ্কণরীতি, মুদ্রা, রংকরার পদ্ধতি দেখলে পাল যগেরই কথা সর্বাগ্রে মনে আসে। এদের ঐতিহ্য আজ বহন করছেন শীতল ফৌজদার। 

Wednesday, November 24, 2010

টেরাকোটা মন্দির১

ইতালিয় শব্দ টেরাকোটা অর্থ পোড়ামাটি। এঁটেল মাটির সঙ্গে বালি, খড়কুটো, তুষ, ভূষিসহ নানান স্থানীয় দ্রব্য মিশিয়ে মাটি তৈরি করেন কারিগরেরা। ছাঁচে বা হাতের চাপে এই মাটিতে উপযুক্ত শিল্প গড়ার পর তা রোদের আঁচে বসিয়ে শক্ত হলে পোড়ান হয়। এর পর ভাটি। পোড়ানোর পর কখোনো রং করা হয়, কখোনো বা এগুলোকে পোড়ার মাটির স্বাভাবিক রংএও রাখা হয়। পোড়ানোর সময় ভাটির ধোঁয়া বেরোতে দিলে সামগ্রীগুলো স্বভাবিকভাবেই পোড়ামাটির রংএ রাঙানো হয় আর মুখ চাপা থাকলে সেগুলোর রং পুরো কালো হয়
সারা পৃথিবীর সঙ্গে প্রায় দশ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী লোথাল-সরস্বতী(সাধারণ লব্জে হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়ো) সভ্যতায়ও এ ধরণের পোড়ামাটির নানান পুতুল পাওয়া গিয়েছে। তক্ষশিলা, মথুরা, ভিটা, বাক্সার, পাটনা বা বাংলার নানান উত্খননেও নানান ধরনের টেরাকোটা মুর্তির হদিশ মিলেছে। চন্দ্রকেতুগড়ে পোড়ামাটির নলবিশিষ্ট পয়ঃপ্রণালী, নাগদেবী, নানান তৈজসপত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। পাল আমলেরও নানান পোড়ামাটির দ্রব্য, অলঙ্কৃত মন্দির, বৌদ্ধবিহার আবিষ্কার হয়েছে বাংলার নানান স্থানে। অলঙ্করণে রয়েছে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যসহ নানান ধর্মের দেবদেবী মূর্তি, বিদ্যাধর, গন্ধর্ব, নাগ, মানুষ, পশুপাখি, জলচর জীব, ফল, বৃক্ষ, শঙ্খ, চক্র, পুঁথি, জলপাত্র প্রভৃতি। এই লোকশিল্পের শিল্পীরা ছিলেন গ্রাম জীবনে সংপৃক্তথাকা লৌকিক মানুষজন, যাঁরা দেশজ শিল্প আর প্রযুক্তির আসল ধারক-বাহক। শহুরে এই কর্মকাণ্ডে সাধারণ লোক জীবনের নানান দৃশ্যাবলীর অলঙ্করণে প্রমাণিত হয়, বৃটিশ কথিত সামাজিক বিধিনিষেধ এবং খাড়াখাড়িভাবে সামাজিক বিভাজনের যে তত্ব চারিয়ে গিয়েছিল বাংলার শহুরে পাণ্ডিতি ধারার মধ্যে এবং বাংলার জ্ঞাণীগুনীরা যে ধারা আজও বহন করে নিয়ে চলেছেন, সেই ধারাকে নতুন করে প্রশ্নের সময় এসে গিয়েছে
মনেআছে বাংলার পোড়ামাটির কাজ শয়ে শয়ে বছর ধরে রোদজলশীত সহ্যকরে টিকে রয়েছে আথচ এ যুগের সিমেন্টএর কাজ দুদশকেই মাটি ধরে এই প্রশ্নের উত্তরে বাঁকুড়ার ছাঁদারের(শহুরে লব্জে ছান্দার) পথভাঙা সংস্থা অভিব্যক্তি প্রধান উত্পল চক্রবর্তী কলাবতী মুদ্রার এক প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছিলেন, পোড়ানোর আগে এগুলোকে প্রথমে মধু আর তার পর কোনো স্নেহদ্রব্যে(যতদৃর সম্ভব বলেছিলেন ঘি-তে) ডুবিয়ে রাখা হত
খ্রীস্টিয় ষোড়শ শতকে শুরু হওয়া বাংলার মন্দির গাত্রে পোড়ামাটির ইটের ওপর বিষ্ময়কর টেরাকোটার কাজ দেখা যায়। এসব মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন মাপের ছাঁচে গড়া টেরাকোটা টালি পলেস্তেরা দিয়ে ইটের গায়ে সেঁটে দেওয়া হত। মন্দিরের নানান অংশে টেরাকোটা কাজ দেখা যেত। কয়েকটি টালির সংযোগে ধারাবাহিক ভাবে দৃশ্যরচনার উত্কর্ষ দেখা যায়। নানান পৌরানিক কাহিনী ছাড়াও নৃত্যগীতরত নরনারী, নৌকা বিহার, জলকেলি, পালকি, বিবাহের শোভাযাত্রা, সমুদ্রগামী জাহাজসহ হাজারো শহুরে ভা লৌকিক জীবনের প্রতিচ্ছবি আজও দেখি

Tuesday, November 23, 2010

The LEK Initiative Presents


An Exhibition on Traditional Folk and Innovative Crafts


You are cordially invited on behalf of the traditional folk and tribal artists and artisans to participate and encourage a unique exhibition on Traditional Folk Crafts and Innovative crafts like Dolls of Bengal, Aduri Sora, Sherpai, Pot, Antic Banam of Santhals, Masks of Rajbanshis etc at Dolly’s Collection, 18J, Park Street, Kolkata – 71, Besides Peter Cat.
The exhibition started at November 21, 2010, Sunday to November 28th 2010, Sunday, 12 to 7 PM.
Thanking You,
Yours truly,
Joya Mitra, Loknodi Trust     Bikram Mitra, Arth Craft       Biswendu Nanda, Kalaboti Mudra Trust



সুধি,
কলাবতীমুদ্রাট্রাস্ট, লোকনদীট্রাস্ট আর আর্থক্রাফ্ট-এর সংযোগে তৈরি লোআক আশা আয়োজিত লৌকিক বাংলার অলৌকিক শিল্প-সম্ভারের প্রদর্শনীতে আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ প্রদর্শণীতে থাকবে গালাসহ বাংলার নানান পুতুল, সরা, শেরপাই, পট, শোলা আর কাঠের শিল্প, হতে তৈরি নানান দ্রব্য, কচুরিপানার আর গামছা দিয়ে তৈরি দ্রব্য আর উত্তর বাংলার নানান লৌকিক দ্রব্য- বিশেষ করে বেশ পুরেনো কয়েকটি সাঁওতাল বানাম আর রাজবংশী মুখা(মুখোশ) প্রদর্শণীটি চলছে ২১ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর, ২০১০, ডলিজ কালেকশন. পিটার ক্যাটের পাশেই, দুপুর বারোটা থেকে সাতটা পর্যন্ত
সব্বাইর আমন্ত্রণে,
জয়া মিত্র, লোকনদী ট্রাস্ট       বিক্রম মিত্র, আর্থ ক্রাফ্ট         বিশ্বেম্দু নন্দ, কলাবতী মুদ্রা


 

Friday, November 12, 2010

সরা


গোল পোড়ামাটির উত্তল মাটির থালায় আঁকা রীতিকেই সরা বলে মনেকরা হয়, পঞ্চকল্যাণী পটের বংশাবলীর মধ্য থেকে উঠে এসেছে লক্ষ্মীসরা এ অঙ্কণরীতিও বেশ উপজীব্য লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে ধানের শিষ, কলমী, পদ্ম, প্যঁচাসহ লক্ষ্মী আঁকা হলেও কৃষ্ণরাধা বা দুর্গামূর্তি আঁকা সরা বাজারে আজও পাওয়া যায় সরার প্রান্তে এক আঙুলপরিমাণ এক রংএর, বিশেষ করে লাল রংএর পাড় এঁকে মূল দেবচিত্রের সঙ্গে নানবিধ নকশার প্রতিমা আর কয়েকজন সহচরীরও মূর্তিও আঁকার প্রবণতা রযেছে এলাকা অনুযায়ী তিন-পাঁচ-সাত পুতলি প্রভৃতি মোটিফের পুতলির সংখ্যা বাড়ে বা কমে নদিয়া জেলার তাহেরপুর, নবদ্বীপে এখন উত্তর ২৪ পরগণার দত্তফুলিয়া অঞ্চলে লক্ষ্মীসরা তৈরি আর আঁকা হয়
সরা শিল্পীরা প্রথমে মাটি ছেনে মাটির তালকে হাতের দুতালুর চাপে রুটির মত গোল আকৃতি দেন এর নাম চরা কাটা এবার ঐ সরা আকৃতির তালকে কেনো পকা সরার ওপরে রেখে জলমাটির(ঘোলা) তরল মিশ্রণে ভেজানো পাতলা ন্যাকড়ার সাহায্যে মসৃণ করা হয় এবারে কিছুক্ষণ ছায়ায় রেখে সেটিকে শোকানো হয় এরপর ভাটিতে পোড়ানোর জন্য যায় এই সরা লক্ষ্মী সরার ওপর যেসব চিত্র আঁকা হয় নবদুর্গা, পাঁচপুতুল রাধাকৃষ্ণ, দুইপুতুল লক্ষ্মীনারায়ণ, এক লক্ষ্মী, তিন লক্ষ্মী, পাঁচ পুতুল ময়ূর প্রভৃতি
বাংলাদেশের ঢাকাই সরা বা ফরিদপুরের সরার নিজস্ব আঁকার পদ্ধতি রয়েছে ঢাকাই সরার দেবদেবী আঁকার নিচের দিকে থাকে একটি নাওএর প্রতিমা আর ফরিদপুরের সরাতে দেবদেবীরা সাধারণতঃ একটি চৌখুপির মধ্যে থাকেন ফরিদপুরের সুরেশ্বরী সরার উপরিঅংশে সপরিবারে মহিসাসুরমর্দিনীর ছবি আঁকা হয়, আর নিচে সবাহন লক্ষ্মীমূর্তি থাকেন

বিষ্ণুপুরের দশাবতার আর নক্সা তাস


গুণীব্যাক্তিরা বলেন ভারতে তাস খেলার প্রচলন হয়েছে ওলান্দাজদের এ দেশে আসার পর সারা দেশেই দিশেষ করে রাজবাড়িগুলোতেই এই ধরনের তাসের খেলার প্রচলন ঘটে খ্রিষ্টিয় দ্বাদশ দশকে সারা ভারতের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবাড়িতেও এ খেলার বিশেষ প্রচলন ছিল এখানে দুধরণেক তাস খেলার প্রচলন ছিল দশাবতার তাস আর নক্সা তাস
দশাবতার তাসের মোট সংখ্যা ১২০টি মত্স, কুর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, জগন্নাথ আর কল্কি এই দশ অবতার ঘিরে তৈরি হয় তাসের প্রবাহ প্রতি অবতারেরর খণ্ডে থাকে ১২টি তাস রাজা, উজির, এক্কা, দোক্কা, তিক্কি, চৌকা, পাঞ্জা, ছক্কা, সাত্তা, আটা, নক্কা আর দশ তাসগুলি গোল আর ব্যসে হয় চার বা সাড়ে চার ইঞ্চির রাজা ও উজির এই দুশ্রেণীর তাসে দশাবতার মূর্তিগুলি সরাসরি অঙ্কিত হয় অন্য তাসগুলিতে অবতার অনুযায়ী আয়ুধগুলি অঙ্কিত মাছ, শঙ্খ, চক্র, কমণ্ডল, কুঠার, তীর, গদা, পদ্ম, খড়্গ পদ্ম প্রতীক ব বুদ্ধদেবের এ তাসে জগন্নাথ আর বুদ্ধ অভিন্ন
প্রতি তাসের খণ্ডের রংএর ব্যবহারেও বৈচিত্র রয়েছে মত্সাবতার আঁকা হয় কালো রংএ মত্স ছাবি ছাড়া কুর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম,  বলরাম, জগন্নাথ আর কল্কি আঁকায় যথাক্রমে খয়েরি, সবুজ, ধূসর, নীল, সাদা, লাল, ফ্যারকা, হলুদ, সিঁদুরে লাল রং ব্যবহার হয় দেশি রংএ ছাগললোমের তুলি আজও ব্যবহার করেন আজও বিষ্ণুপুরের শাঁখারিপাড়ার শীতল ফৌজদার ৫০ বছর আগেও অনেক শিল্পী ছিলেন, কিন্তু আজ শুধু কালের হস্তাবলেপনে টিকে আছেন শুধু শীতলএর পরিবার আজ আর এই তাস খেলার প্রচলন নেই শুধুই ব্যক্তিগত বা যাদুঘরগুলোর প্রয়োজনে এই তাস বিক্রি হয়
আর এক ধরনের তাস যার নাম নক্সা তাস, দশাবতারের সঙ্গে তৈরি হয় এতে থাকে ১২টি খণ্ডে ৪৮টি তাস সাহেব, গজপতি, বিবি(অশ্বপতি), ফুল, পতাসহ ফুল, তলোয়ার, চৌকো ফুল, ফুল, শংখ, পত্র, পালোয়ান আর পরী প্রতি খণ্ডে চারটে করে তাস পরীর এক ফোঁটা তলোয়ার সাত ফোঁটা সাহেব ১২ ফোঁটা কয়েক খণ্ড আলাদা আলাদা নামে ফুল হিসেবে চিহ্নত হলেও প্রত্যকটির গড়ন আর রং আলাদা মানুষ আঁকা তাসগুলি মূল তাস বাকি সব ফোঁটা মোট সতের ফোঁটার খেলা যে খেলোয়াড় আগে ১৭ ফোঁটা পাবে তার জিত
শোনাযায় এই অঞ্চলে অষ্টমল্ল নামে এক ধরনের তাস খেলা চালু ছিল ৩২ বা ৬৪টি তাসের খেলা আজ আর দেখা যায় না

Wednesday, November 10, 2010

খড়ুইএর গালার পুতুল

অতীতে বাংলার বেশ কয়েকটি এলাকায় গালার নানান পুতুল তৈরি হলেও এখন এগরার কাছে পটাশপুরের পশ্চিমসাঁই আর প্রতাপদিঘি আর এগরার পাঁচরোলে টিমটিম করে টিকে আছে গালার পুতুল আজ এই প্রবন্ধে শুধু খড়ুইএর গালার পুতুল নিয়েই আলোচনা করব 
গ্রামে ২৮টি শঙ্খবণিক পরিবার শাঁখার কাজে নিযুক্ত থাকলেও মাত্র চারটি পরিবার গালার পুতুলের কাজে যুক্ত এর আগে আরও বেশি সংখ্যায় কারিগর যুক্ত থাকলেও লৌকিক শিল্পের ভাঁটার টানে অনেকেই বৃত্তিচ্যুত হয়েছেন আজকের আলোচ্য খড়ুইএর শ্রীবাস চন্দ, গদাধর চন্দ, বৃন্দাবন চন্দ আর কানাই নন্দী এই কাজে যুক্ত আজ শ্রীবাস প্রায় দৃষ্টিহীন কাজ আর করতে পারেন না বললেই চলে এদের অনেকেই শাঁখা শিল্পের সঙ্গে এক সময় যুক্ত ছিলেন
প্রাথমিকভবে এই কাজ করতে উইএর ঢিবি থেকে মাটি সংগ্রহ করতে হয় এই মাটিতে কোনো কাঁকর থাকে না আর মাটি মসৃণ আর আঠালো হয় - চিট ধরে তাই মাটির পুতুল তৈরি করে পোড়ানোর পর মসৃণতার ধর্মের জন্য যদৃচ্ছভাবে গালা লাগানো চলে প্রায় সারা বছর এই মাটি সংগ্রহ করা গেলেও বছরের বর্ষার সময় এই মাটি অধিক পরিমানে সংগ্রহ করা যায় বড় পাত্রে এই মাটি নিয়ে জল মিশিয়ে দু-তিনদিন মাটিকে রেখে তা তৈরি করতে হয় একপর কাঠের পাটাতনে রেখে মাটিকে ডলে ডলে মিহি করা হয় এর পর হাত দিয়ে টিপে গণেশ, লক্ষ্মী, ত্রিনাথ, নানান ধরনের পশু, কচ্ছপ, ডাইনোসর, পাখি, গলার হারের লকেটসহ নানান ধরনের পুতুল তৈরি করা হয় নানান পুতুলের বর্ধিত অংশে সরু লোহার তার ঢোকানো হয় আর দিন-তিনেক ছায়ায় রেখে দেওয়ার পর আরও দুতিন দিন রোদ খাওয়ানো চলে -এই কাজ চলে মোট সাতদিন। এরপর পুতুলের ভাটিতে দেওয়ার কাজ ভাটি হয় আড়াই ফুট থেকে তিন ফুট উঁচু ভাটির নিচের থেকে কিছু ওপরে লোহার রড দিয়ে ঘুঁটে সাজানোর পর আনুভূমিকস্তরে কিছু পুতুল রেখে আবার ঘুঁটে সাজানো হয়, এপর স্তরে স্তরে ১৫০টি পুতুল-ঘুঁটে সজ্জার পর আগুণ দেওয়া হয় যতক্ষননা ওপরের স্তরের ঘুঁটে পুড়ে না যাচ্ছে, ততক্ষণ পোড়ানো চলে সাধারণতঃ সকালে আগুণ লাগালে বিকেলে  পুতুল বার করা হয়
শিরিষ আর কুসুম গাছের বর্জ থেকে গালা পাওয়া যায় কিন্তু আজকাল শিল্পীরা বাজার থেকেই গালা কেনেন পুতুল তৈরির মতই গালার সুতো আর খড়ি তৈরির পদ্ধতিও বেশ সময়সাধ্য প্রক্রিয়া বাঁশের দুটো কঞ্চির দণ্ড নিয়ে সেটিকে গরম করে দুটি দণ্ডের মুণ্ড দিয়ে চটকে চটকে সুতো তৈরি হয় অলঙ্করণের জন্য আর খড়ি তারি হয় সাধারণ রং করার জন্য এই রংএ হলুদ হরিতাল সর্বঘাটে কাঁঠালি কলা
পুতুলে রং করার জন্য প্রথমে একটি পাত্রে(আমি দেখেছিলাম আর্ধেক কলসি কেটে তার মুখ মাটিতে আটকে মুখটি মেঝের দিকে করে রাখা) কাঠকয়লা ধিকিধিকি করে জ্বেলে দুটি একটি পুতুল গরম করে রাখা হয়, এরপর পুতুলের নিচের দিকে লোহার দণ্ড আটকে সেটিকে ধরে ধরে প্রয়োজনীয় রং করা হয়

বাংলার মাদুর শিল্প

(ঋণ স্বীকার মুকুলরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়)
সম্ভবতঃ মাদুর কথাটির উত্পত্তি সংস্কৃত শব্দ মন্দুরা থেকে মাদুরের মূল উপাদান এক ধরনের তৃণ সাধারণতঃ যা মাদুরকাঠি নামে পরিচিত মাদুরকাঠি সাধারণতঃ সরু, গোলাকার, দৈর্ঘে চার হাত বা একটু বড়, কোনো গাঁট থাকে না বা শাখা প্রশাখাও হয় না তৃণ শীর্ষে চার পাঁচটি ধারালে পাতা থাকে
মাদুর কাঠির চাষ হয় সাধারণতঃ পূর্ব আর পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ আর উত্তর ২৪ পরগণা, আর হাওড়া জেলায় চাষের জন্য দোঁয়াশ মাটি সর্বশ্রষ্ঠ হলেও বালি ও এঁটেল মাটিতেও মাদুরকাঠি চাষ হয়ে থাকে কাঠির রং হলুদ, চাঁপাফুলের রং বা সবুজ হয়ে থাকে চাষের সময় চৈত্র বৈশাখ ক্ষেত থেকে মাঘ মাসে তুলে আনা মূলগুলি রেখে ছায়ায় বা পুকুর ধারে জল ছিটিয়ে ঢাকা থাকে চার পাঁচদিন পর অঙ্কুর দেখা যায় জল জমে না এমন জমিতে লাঙল দিয়ে ও মাটি গুঁড়ো করে জিম প্রস্তুত করা হয় ছয় ইঞ্চি করে সার কেটে দুটি মূল পরস্পরের এক ইঞ্চি দূরত্বে বসিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হয় দিন দশেকের মধ্যে বৃষ্টি না হলে সেচ দিতে হয় এক সপ্তাহের মধ্যেই গাছ থেকে মূল বেরিয়ে আসে ছোট অবস্থায় একবার নিড়েন দিতে হয়
আশ্বিন-কার্তিক মাসে কাঠি গোড়া থেকে কেটে নেওয়ার পর কাঠির মাথা সমান করে সাজিয়ে মাথা থেকে পাতা কেটে নেওয়া হয় প্রতিটি কাঠি ২-৩-৪ ভাগে করে কেটে নিয়ে ২ দিন রোদে ফেলে বাঁধাই করে বেঁধে তোলা হয়
বাংলার মাদুর সাধারণতঃ তিন ধরণের একহারা, দোহারা আর মসলন্দ কাঠি তৈরির জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন ছুরি একে গেঁজে ছুরি বলে এক হারা মাদুর বোনার জন্য প্রয়োজন, মাদুর কাঠি, সুতলি, টানা দেওয়ার জন্য ৪টে বাঁশের খুঁটি, টানা বাঁধার জন্য ২ খানা সোজা বাঁশ, দুটি মোটা দড়ি, শালকাঠের শানা (প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ১৪ থেকে ১৬টা ফুটো), একটা তক্তা, কাছি ভেজাবার জন্য পাত্র দোহারা মাদুরের জন্য প্রয়োজন এ সবই কিন্তু শানার জন্য প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ৯ থেকে ১০টা মসলন্দ মাদুরের জন্য আরও প্রয়োজন গোল বাঁশের চটা শানায়ও তারতম্য হয় প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ২৮ থেকে ৪৮ মসলন্দ মাদুরের কাঠি থেকে মাঝখানের সাদা অংশটি ছেঁটে বাদ দিতে হয়
মাদুরে রংএর ব্যবহার
মাদুরের নকশা অনুসারে যতটুকু অংশ রং করার দরকার হয়, সেই অংশ টুকুর দুধারে ভাল করে বাঁধেন কারিগরেরা, তার পর সেদ্ধ করে নিতে হয় কম করে আট ঘন্টা রং পাকা করার সময় নুন আর তেল ব্যবহার করা হয় মাদুরকাঠি রংএর জন্য ব্যবহার হয় সবং এলাকার একধরনের গাছের পাতা
ভৌগোলিক এলাকা ভেদে একহারা আর দোহারা মাদুর বুননের তারতম্য
সাধারণতঃ ভারতের অন্যান্য লৌকিক শিল্পের মতই মাদুর শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন তবে এলাকা তারতম্যে মাদুর বুননের পার্থক্য রয়েছে
১. সবং দশগ্রাম, সবং, তেমোহানি, কুচবসান, সারতা, খাজুরি, বালিচক প্রভৃতি অঞ্চলে যে একহারা মাদুর বোনা হয়, তাতে একটি মাত্র টানায় সামনাসামনি দুজন কারিগর বসেন প্রতি কাঠি বোনার পর শানা মারেন। কাঠি যে যার বাঁদিক থেকে বোনা আরম্ভ করেন বোনার শেষে কাঠির ডগা টানার শেষে যে দড়ি থাকে সেই দড়িতে পেঁচিয়ে রেখে গিয়ে পরে শানা মারার সময় ডগা মুড়ে গাঁট দিয়ে যান তাই বুননের সঙ্গে সঙ্গে বাঁধাও শেষ হয় তাই মাদুর চিকন হয়, মসৃণ থাকে, আরক ধার সোজা বাঁধার ফলে দেখতেও সুন্দর হয়
২. রামনগর এখানে একজন শিল্পী ৩-৫-৭ করে কাঠি বুনে শানা মারেন আর বোনার সময় বাঁধাও হয় না সামনা সামনি বসে একজন বিজোড় কাঠি বোনেন এবং শানা মারেন ফলে মাদুরের জমি প্রায়শঃই মসৃণ হয় না ফলে মাদুরের ধার অসমান হওয়ার সুযোগ থেকে যায়
৩. এগরা এ অঞ্চলেও রামনগর অঞ্চলের একহারা বুননের রীতি অনুসরণ করা হয় এখানে রঙিণ মাদুর কম হয়
৪. উদয়নারায়ণপুর উদায়নারায়ণপুর আর আমতা অঞ্চলে জোড়া মাদুর তৈরি হয় মাদুর বোনার সময় দুটি মাদুরকাঠি নিয়ে একটি টানার অর্ধেক বোনার পর অপর কাঠি বুনে টানার শেষ পর্যন্ত নিতে হয় প্রথম কাঠির ডগা ধার বাঁধার মত রেখে গোড়া যেখানে শেষ হয়, সেখানে টানার নিচে ঢুকিয়ে দিতে হয় তাই মাঝখানে জোড়া মাদুরের আয়তন বেশ বড় হয় সাধারনের চোখে বোঝা না গেলেও তবে নজর করে মাঝখানটা হাত দিলে একটু মোটাই লাগে
৫. উত্তর ২৪ পরগণা উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাত, বসিরহাট, দেগঙ্গা, বাদুড়িয়া, বনগ্রামে রামনগরের ধাঁচে একহারা বুনন পদ্ধতি অনুসৃত হয় তবে এ অঞ্চলে পাতি বা হোগলা বেশি তৈরি হয়
সবংএর দোহারা মাদুরের বুনন পদ্ধতি অন্যান্য অঞ্চলের মতই সবংএর মোহাড়ে এক বিশেষ মাদুর তৈরি হয় – নাম চালা মাদুর যা দোহারা মাদুরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রথনে দুই তিন ইঞ্চি বোনার পর বোনা অংশের কাঠিগুলিকে নখ দিয়ে শিল্পীরা পেছনের দিকে চালিয়ে মাদুরকে যতসম্ভব খাপি করার চেষ্টা করেন তাই জমিন ঘন হয়, বেশিদিনও ব্যবহার করা যায়
রামনগর অঞ্চলে দোহারা মাদুর কম হয়, এগরায় বেশি হয় তৈরি হয় মাদুর আর আসন হাওড়ায়ও কম বোনা হয় ২৪ পরগণায়ও পাতি আর হোগলা পাতির দোহারাই বেশি
মসলন্দ মাদুর
সবং আর রামনগরে হয় কাঠির মান অনুযায়ী মসলন্দ মাদুরের মসৃণতার হেরফের হয় সবং অঞ্চলের শিল্পীরা এই মাদুর বোনার সময় কাঠি দাঁত দিয়ে চিরে নেন আর মাদুর বোনার সময় ধার বেঁধেও যান প্রকৃতিক রং ব্যবহারের জন্য রং পাকা হয় সবং এলাকার কাঠি সবুজাভ তাই দেখতে অনেক সুন্দর রামনগরের কাঠি অনেকটা হলদেটে মাদুরের কাঠি থেক পিথি অংশটা বাদ দেওয়া হয় তাই স্থায়িত্ব বেশি

উত্তরবঙ্গের ধোকড়া শিল্প


(ঋণ স্বীকার - ধনঞ্জয় রায়)
উত্তরবঙ্গের লৌকিক মানুষজনের শিল্পকৃতির অন্যতম প্রধান বাহন ধোকড়া বয়ন শিল্প বা মোটা কাপড় এর একটি সংস্কৃত প্রতিশব্দ রয়েছে - ধোতকট কবিকঙ্কনে দেখি সদাগর আচ্ছাদন না ছাড়ে ধোকড়ি এক সময়ে বাংলার জনসমষ্টি অঙ্গে দুফালি বস্ত্র পরার যে আচার ছিল হাজার হাজার বছর ধরে, সেই আচার এখোনো ধরে রেখেছেন রাজবংশী জনসাধারণ অসাধারণ শিল্পসুষমায় ঢোকড়া শিল্পের মাধ্যমে  
উত্তরবঙ্গে রাজবংশী সমাজে ধোকড়া শব্দটি বিকল্প বস্তু হিসেবে পরিচিত যেমন ধোকড় বাপ বিকল্প বাপ দিনাজপুরের লোক কথায় চাল-চিঁড়ে-চট-গুড় এই নিয়ে দিনাজপুর- এখানে চট অর্থে ধোকড়া সাধারণ বাড়িতে এই ধোকড়া বিছিয়েই যেমন অতিথিদের বসতে দেওয়া হয় তেমনি এতে করে ফসল রোদে শুকোতে দেওয়া হয়
প্রায় দুশতক পূর্বে দিনাজপুরের সুজানগর আর মাহীনগর পরগণায় তাঁত শিল্পীদের বসবাল ছিল এছাড়াও মথুরাপুর, দেলওয়ারপুর, বাজিতপুর, রাধাবল্লভপুর, কান্তনগর, রাজানগর পরগণার অধীনে বালুরঘাট, কুমারগঞ্জ, তপন, গঙ্গারামপুর, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, বংশীহারি, হেমতাবাদ, ইটাহার, কুশমন্ডি এলাকায়ও তাঁতিরা শিল্পকর্ম করতেন বাংলার অন্যান্য তাঁতিদের সঙ্গে এই অঞ্চলের তাঁতিদের বিদ্রোহ ইতিহাসের অমর গাথা রচনা করেছে
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় ছিলেন রাজবংশী জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে প্রচুর কার্পাসগাছ জন্মাত যার নাম বাঙ্গার এই বাঙ্গারের চাষ করতেন রাজবংশীরাই যুগে যুগে
রাজবংশীদের পাট থেকে সুতো তৈরির করে বয়ন করার এই পদ্ধতি সারা বিশ্বের হস্ত তাঁত শিল্পের এক প্রাচীণ বয়ণ পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত এই বয়ন পদ্ধতিতে খুব বেশি স্থান প্রয়োজন হয় না শুধু প্রয়োজন দুটি খুঁটি যা অক্ষদণ্ড রূপে ব্যবহৃত রাজবংশী ভাষায় তাঁতপোই কোচবিহার, পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, মালদহের গাজোল থানায় ধোকড়া শিল্পে নিযুক্ত রয়েছেন বর্মণ, রায়, দেবশর্মা উপাধিধারী মহিলারা জনশ্রুতি এই সমাজে পুরুষের তাঁত বোনা নিষিদ্ধ ছিল পুরুষেরা তাঁত বুনলে তাঁদের পুরুষত্বে হানি হয় অর্থাত্ মহিলা শাসিত সমাজের যে বিধিনিষেধ তাও আজও সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে এক্কেবারে মিলিয়ে যায়নি আজও এ অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক হাটে ধোকড়া বিক্রি করেন মেয়েরাই আর সুন্দর মননশীল ধোকড়া বোনার ওপর নির্ভর করে এই সমাজে মেয়েদের বিয়ের সিদ্ধান্ত
উত্তরবঙ্গে অন্যান্য এলাকার তুলনায় পশ্চিম দিনাজপুরে এই কাজের প্রবণতা আর উতপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি আজ এই এলাকায় ৩৩ হাজার শিল্পীর নাম সরকারি তালিকাভূক্ত তবে স্থানীয় শিল্পীদের-মানুষের বিশ্বাস এই ভৌগোলিক এলাকায় অন্ততঃ এক লক্ষ মানুষ এই বয়নশিল্পকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করেন
প্রযুক্তি
জলে ভেজা পাট থেকে ছাল ছাড়িয়ে তাঁশ বা খোয়াগুলোকে চিরে লাছি তৈরি হয় লাছি নাচো(টাকু)র সাহায্যে পাকিয়ে সুতো তৈরি হয় পাটের গোড়া অংশ ফোতা আর মাথার অংশটি পাইন নামে পরিচিত ফোতা হয় মোটা আর পাইন হয় সরু একটি তাঁতপোইতে দেড় হাত চওড়া আর পাঁচহাত লম্বা একটি ফাটি তৈরি হয় এরকম তিনটি ফাটি জোড়া দিলে তৈরি হয় একটি ধোকড়া
তাঁতপোই
তাঁতপোইএর প্রত্যেক অংশ টুকরো টুকরো তাঁতপোইএর জন্য দুটি বাঁশেক খুঁটি দুহাত দুরত্বে মাটিতে পোঁতা থাকে দুটি খুঁটির সঙ্গে সমাম্তরাল বাঁধাথাকে দুটি বাঁশ - তাছলা তাছলার ওপরে একটি কাঠি এবং নিচে একটি বাঁশের কাঠি বাঁধা থাকে এটি নাম দণ্ডর নিচের দিকে আরও যে কয়েকটি কাঠি পরপর সাজানো থাকে তাকে বলে জালো কাঠি, পিঁপড়ি কাঠি, কোপনি কাঠি বোলার সময় প্রথম টান পড়বে কোপনি কাঠির কোপনি কাঠিটি টানা থাকে দুটি ছোট খোঁটার সাহায্যে একে বলে টাকুর সঙ্গে সুতো যখন মাকুতে যায় তখন তাকে বলে কান্তা এবারে তৈরি হয় এক একটি ফাটি যে ফাটি চওড়া হয় তাকে বলে পেটোয়ান তখনই ধোকড়ার ওপর নকশার কাজ শুরু হয় মোটা সুতো গাঁথার জন্য অর্ধচন্দ্রকার মোটা ও চওড়া লাঠি বেওন দরকার সরু সুতোর কাঠিকে বলে আলনি রাজবংশী বয়নী মজবুত ও ঘন জালের একটি অংশ কোমরে পেছনে বেঁধে বোনার কাজ শুরু করেন এর নাম নেত্তুরং ফাটি জোড়া দেওয়ার জন্য এমন সুতো তৈরি করেন যেন মনে হয় যন্ত্রে বোনা
সম্পূর্ণ পশ্চিমি যন্ত্র ব্যতীত হাতে তৈরি ধোকড়া শিল্পের রংও পুরোপুরি ঐতিহ্যশালী পদ্ধতিতে করা হয়। ঝিমুল, জিগা, ভেরেণ্ডা, আমের কুষি, বসনবৈর প্রভৃতি গাছের পাতা, ফল, ছালের রসে সোড়া, লবন জলে মিশিয়ে সিদ্ধ করে কালো, খয়েরি, লাল রং করা বের করা হয়। 
ধোকড়ার হাট বসে পশ্চিম দিনাজপুরের বংশীহারি থানার সরাই, ইটাহারের পাতিরাজ, কালিয়াগঞ্জ থানার ধনকৈল আর কুনোর, করণদিঘির রসখোয়া, দার্জিলিংএর নকশালবাড়ি, মাটিগড়া প্রতি বছর ধোকড়ার বাজার হল ২ কোটি ৮৫ লক্ষ ১২ হাজার টাকা

Sunday, November 7, 2010

বাংলার ভুলে যাওয়া ইতিহাস – পোখন্না গ্রাম


উত্তর বাঁকুড়ার দামোদর সংলগ্ন এক গ্রাম পোখন্না এক সময়ের বিশিষ্ট জনপদ পুষ্করণা বা পোখন্না অনেক প্রাচীণ জনপদেরমতই আজ তার অতীত গৌরব হারিয়েছে শেকড়ে ফিরে যাওয়ার ব্রত নেওয়া স্থানীয় কিছু মানুষ আর কিছু উত্সর্গীকৃত মানুষ বা সংস্থা ছাড়া এ নিয়ে মাথাব্যাথা নেই প্রায় কারোরই ৬৫-৬৬তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগের খননকার্যে এই এলাকার গিধুনিয়া, বাঁকাজোড়, ভরতপুর, বাঘডিহা, রামনাথপুর, শুশুনিয়া, কুশবন্যা, শিউলিবনা, শুয়াবসা, পারুল্যা, পাহাড়ঘাটা, ধানকেড়া, করকাটা, বাবলাডাঙা, নেটেল্যা, শিমুলবেড়া, হাপানিয়া, চাঁদড়া, বিন্দিসাসহ বেশকিছু গ্রামঘিরে বেশ পুরোনো মানব বসবাসের চিহ্ন পাওয়া যায় এই সব গ্রমে বর্ষাফলক, হাতকুঠার, নানান হাতিয়ার, মসৃণ কুঠার, ছিদ্রযুক্ত ক্ষুদ্রকাকার চক্র পাওযাওয়ায় বাংলার ইতিহাসকে নতুনকরে লিখতে হয় শুশুনিয়া সংলগ্ন প্রায় ৬০ বর্গমাইল এলাকায় নানান বহুবিচিত্র অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যাওয়া মানিকলাল সিংহ বা পরেশ দাশগুপ্ত মশাইএর অনুসারে আদি প্রত্নশ্মর আমলের ছোট বসতি শুরু হয়, তিন-চার লক্ষ বছর থেকে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া, দ্বারকেশ্বর ও কুমারী নদীর এলাকায় তা বাড়তে শুরু করে মানব সমাজের পরিপূর্ণ বসতিতে রূপান্তরিত হয়
প্রাগৈতিহিসিক শুশুনিয়ার প্রমাণ পাহাড়ের উত্তরদিকের গুহায় লিপিবদ্ধ শিলালিপি
পুষ্করণাধিপতে মহারাজ শ্রীসিঙ্ঘবর্মণঃ পুত্রস্য
মহারাজশ্রীচন্দ্রবর্ণণঃ কৃতিঃ
চক্রস্বামিণঃ দোসগ্রেণতিসৃষ্টঃ
এই দুই লিপির কাল খ্রীষ্টীয় চতুর্থ দশক গুপ্তযুগ প্রায় দেড় হাজার বছর আগের লিপির হরফ ব্রাহ্মী কিন্তু ভাষা সংস্কৃত এর সঙ্গে পাওয়া গিয়েছে একটি বিষ্ণুচক্রও
আমাদের আলোচ্য পোখন্না শুশুনিয়ার প্রায় ৪০ কিমি দূরে অবস্থিত এই গ্রামের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে আমরা দ্বারস্থ হই রাখালদা, বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গদেশে বাঁকুড়া জেলার শুশুলিয়ার পর্বতগাত্রে চন্দ্রবর্মার যে শিলালিপি আছে, তাহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তাঁহার পিতার নাম সিংহবর্মা এবং তিনি চক্রস্বামী বা বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন... মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মালবদেশে প্রাচীণ দশপুরের(বর্তমান মন্দশোর) ধ্বংসাহশেষের মধ্যে একটি শিলালিপি আবিষ্কার করিয়াছেন তাহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, চন্দ্রবর্মার ভ্রাতার নাম নরবর্মা এবং তিনি ৪৬১ বিক্রমাব্দে(৪০৪-০৫ খ্রী.) জীবিত ছিলেন এই সকন প্রণমানের এপর নির্ভর করিয়া শাস্ত্রী মহাশয় নির্ণয় করিয়াছেন যে, শুশুনিয়া পর্বতলিপির চন্দ্রবর্মা ও দিল্লির লৌহস্তম্ভ লিপির  চন্দ্র একই ব্যক্তি, এবং দশপুর বা মন্দশোরের শিলালিপির নরবর্মা তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা চন্দ্রবর্মা সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয় যাত্রা অব্যবহিত পূর্বে বঙ্গদেশ হইতে বহ্লীকদেশ পর্যন্ত সমগ্র আর্যাবর্ত জয় করিয়াছিলেন এলাহাবাদের দুর্গমধ্যে অশোকের শিলাস্তম্ভে সমুদ্রগুপ্তের যে প্রশস্তি উত্কীর্ণ আছে, তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায় যে, সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রবর্মা নামে জনৈক আর্যাবর্তরাজকে বিনষ্ট করিয়াছিলেন সমুদ্রগুপ্তের প্রশস্তি ও শুশুনিয়া শিলীলিপির চন্দ্রবর্মা এবং দিল্লির স্তম্ভলিপির চন্দ্র যে অভিন্ন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই

শুশুনিয়ার পাথর শিল্প


বাঁকুড়ার ছাতনা থানার এক গ্রাম শুশুনিয়া এখানেই রয়েছে ৪৪০ মিটার উঁচু শুশুনিয়া পাহাড় এটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা ১৯৬৫-৬৬তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ খননকার্য করে এই এলাকার গিধুনিয়া, বাঁকাজোড়, ভরতপুর, বাঘডিহা, রামনাথপুর, শুশুনিয়া, কুশবন্যা, শিউলিবনা, শুয়াবসা, পারুল্যা, পাহাড়ঘাটা, ধানকেড়া, করকাটা, বাবলাডাঙা, নেটেল্যা, শিমুলবেড়া, হাপানিয়া, চাঁদড়া, বিন্দিসাসহ বেশকিছু গ্রামে এই সব গ্রমে বর্ষাফলক, হাতকুঠার, নানান হাতিয়ার, মসৃণ কুঠার, ছিদ্রযুক্ত ক্ষুদ্রকাকার চক্র পাওয়া যায় শুশুনিয়া সংলগ্ন প্রায় ৬০ বর্গমাইল এলাকায় নানান বহুবিচিত্র অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যাওয়া মানিকলাল সিংহ বা পরেশ দাশগুপ্ত মশাইএর অনুসারে আদি প্রত্নশ্মর আমলের ছোট বসতি শুরু হয়, তিন-চার লক্ষ বছর থেকে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া, দ্বারকেশ্বর ও কুমারী নদীর এলাকায় তা বাড়তে শুরু করে মানব সমাজের পরিপূর্ণ বসতিতে রূপান্তরিত হয়
প্রাগৈতিহীসিক শুশুনিয়ার প্রমাণ পাহাড়ের উত্তরদিকের গুহায় লিপিবদ্ধ শিলালিপি
পুষ্করণাধিপতে মহারাজ শ্রীসিঙ্ঘবর্মণঃ পুত্রস্য
মহারাজশ্রীচন্দ্রবর্ণণঃ কৃতিঃ
চক্রস্বামিণঃ দোসগ্রেণতিসৃষ্টঃ
এই দুই লিপির কাল খ্রীষ্টীয় চতুর্থ দশক গুপ্তযুগ প্রায় দেড় হাজার বছর আগের লিপির হরফ ব্রাহ্মী কিন্তু ভাষা সংস্কৃত এর সঙ্গে পাওয়া গিয়েছে একটি বিষ্ণুচক্রও পুষ্করণা বা আজকের পোখন্না নিয়ে বারান্তরের কোনও প্রবন্ধে আলোচনা করব এটি কোনওভাবেই এই প্রবন্ধের আলোচ্য অংশ হতে পারে না
কবেকার শুশুনিয়ার আজকের খ্যাতি পাথর শিল্পে শুশুনিয়া, নামো শুশুনিয়া, ছাতাতলা, কামারপাড়া গ্রামগুলির প্রায় শতাধিক পরিবার এই ঐতিহ্যশালী পাথরের শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন এই শুশুনিয়ারই নরম সাদা পাথরে ছেনি, বাটালি, হাতুড়ি, উকো দিয়ে খোদাই করে তৈরি করেন নানান মায়াময় পাথুরে শিল্প
আমরা অনেকেই হয়ত জানি অতীতে গ্রামীণ বাজারের ওপর ভর দিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে টিকেছিল বাংলার লৌকিক শিল্প তার নিজস্ব গতিতেই পুরোনো প্রজন্মের মানুষের মুখে শোনা, সে সময় তৈরি হত থালা, বাটি, জল খাওয়ার তৈজস(গ্লাস), প্রদীপ, চন্দনপিঁড়ি, রুটির চাকি, শিবলিঙ্গ তালিকা থেকে পরিষ্কার এই কাজের শিল্পীদের প্রধান বাজার ছিল গ্রামের জীবনযাত্রা নির্বাহ করা মানুষজন আজ অন্তঃত বিগত ৪০-৫০ বছরে বাজার পাল্টেছে, গ্রামের মানুষদের চাহিদা পাল্টেছে, জীবনযাত্রায় এসেছে শহুরে টান তাই টান পড়েছে লৌকিক শিল্প ঘিরে বেঁচে থাকা মানুষজনের তাঁরা হাজার হাজার বছর ধরে নানান রাষ্ট্রবিপ্লব দেখেছেন, দেছেছেন সহ্যকরেছেন নানান সামাজির-রাষ্ট্রীয় ঝড়ঝঞ্ঝা তবুও শিল্পীর অদ্যম্য বিশ্বাস আর নিজের বাপ-দাদার শিল্পের প্রতি ভালবাসায় পড়ে থেকেছেন আরও নিবীড় শিল্পচর্চায়, আরও নতুন নতুন দ্রব্য উত্পাদনের লক্ষ্যে
অদ্যম্য এই শিল্পীরা তাই চিরাচরিত বাজার হারানোর আশংকা থেকে বেরিয়ে আসতে তৈকর করছেন নতুন শহুরে বাজারের উপযোগী নানান শিল্পদ্রব্য নানান দেবদেবীর মূর্তি, পশুপাখি, ফুল, ধূপদানি, নানান খ্যাতকীর্তির মূর্তি ও আরও হাজারো দ্রব্য ভারতের বিভিন্ন মন্দিরের নানান শিল্পকীর্তিরও অসম্ভব নকলও তাঁরা তৈরি করছেন অসাধাণ শৈল্পিক দক্ষতায় এশিয় এবং ভারতীয় শিল্পকৃতির ধারা পালন করে কোনও তৈরি ব্লু-প্রিন্ট আর প্রায় বিদ্যুত্ ছাড়াই কর্মকার, সিংহ, দত্ত পদবীযুক্ত শিল্পীরা যে শিল্প দ্রব্য তৈরি করেন তা এককথায় আসামান্য