খুব সম্প্রতি সরকার নির্ভর পুঁজিবাদ নিয়ে খুব তর্ক বিতর্ক উঠছে।
ব্রিটিশ উপনিবেশে পলাশীর কুশিলবেরা কর্নওয়ালিসের পরিকল্পনায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণে বড় মানুষ হয়ে উঠছেন - কোম্পানির রাজত্বের কর্ণধারদের সঙ্গে ওঠা বসার সুযোগে ধনবান হয়ে উঠছেন দ্বারকানাথ-রামমোহন জুটি - এমনকি বিদ্যাসাগর মশাইও ব্যবসায়ে সরকার নির্ভরতার পথ ধরতে কুণ্ঠা বোধ করেন নি।
অথচ তারানাথ বাচস্পতি সংস্কৃত কলেজে পড়েও তাঁর সহধ্যায়ীদের মত চাকুরিজীবিও হননি, আবার সরকারি সুযোগ সুবিধে নিয়েও ধনী হননি। চিরাচরিত ব্যবসায়ী বাংলার অতীত ঐতিহ্য মেনে কলকাতার বাইরে চালিয়েছেন বিশাল কর্মযজ্ঞ।
সেই মানুষটির প্রতি ছোট ব্যবসায়ীদের উইভার্স, পার্ফরমিং আর্টিজান, ট্রাডিশনাল পার্ফরমিং আর্টিস্টস গিল্ডএর শ্রদ্ধার্ঘ-
---
কালিদাস সার্বভৌমের পুত্র তারানাথ তর্কবাচস্পতি ১৮১২ খৃষ্টাব্দে কালনায় জন্মগ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগরের চেয়ে তারানাথ প্রায় আট নয় বছরের বড় ছিলেন। সংস্কৃত কলেজের ততকালীন অধ্যক্ষ, বেঙ্গল ব্যাঙ্কের দেওয়ান রামকমল সেন মশায়ের সঙ্গে কালনার 'বাঙাল ভট্টাচার্য' পরিবারের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল।
রামকমল প্রায়ই কালনায় যেতেন। তিনিই তারানাথ ও তাঁর জৈষ্ঠতাতপুত্র তারাকান্তকে কলকাতায় নিয়ে এসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দেন। তারানাথ প্রথমে অলংকার শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক নিমচাঁদ শিরোমণির কাছে ন্যায়শাস্ত্র আধ্যয়ন করেন। যখন তিনি ন্যায়শাস্ত্রের ছাত্র, তখন বিদ্যাসাগর আলঙ্কার শ্রেণীর ছাত্র। প্রতিদিন বিকেলবেলা ছুটির পর বিদ্যাসাগর, তারানাথের ঠনঠনিয়ার বাসায় যেতেন। তখনকার কলকাতার বড় বড় পণ্ডিতসভায় তারানাথ বিচারের জন্য আমন্ত্রিত হতেন এবং বালক ছাত্র বিদ্যাসাগরকে সঙ্গে করে নিয়ে তিনি যেতেন সভায়। বিদ্যাসাগরকে দিয়েই তিনি সবায় প্রায়ই 'পূর্বপক্ষ' করাতেন। পনের বছরের বালক বিদ্যাসাগরের 'পূর্বপক্ষ' করা দেখে সকলে বিস্মিত হতেন। পরে তারানাথ উঠে সভাস্থ পণ্ডিতদের বিচারে পরাস্ত করতেন।
কলেজের পাঠ শেষ হওয়ার পর বাচস্পতি মশায় বর্ধমানের সদর আমিন পদের নিয়োগপত্র প্রত্যাখ্যান করেন। বৃত্তিভোগ করা বা চাকুরী করার মতন মনোভাব তাঁর কোনকালেই ছিল না, স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে উন্নতি করাই বাচস্পতি মশায়ের কাম্য ছিল। ...কালনায় নিজ বাড়িতে টোল ...খুললেন ...এবং কাপড়ের দোকান খুললেন বাজারে। তখন বিলেতী কাপড়ের আমদানি পূর্ণোদ্যমে শুরু হয় নি। বিলেতী সুতো কিনে আম্বিকা-কালনায় প্রায় বারোশ তন্তুবায়কে দিয়ে তিনি কাপড় বুনিয়ে ব্যবসা করতেন এবং বাইরেতেও কাপড় চালান দিতেন। কিছুদিন পরে তারানাথ মেদিনীপুর জেলার রাধানগর গ্রামে কাপড়ের কুঠি প্রতিষ্ঠা করেন। কাশী, মির্জাপুর, কানপুর, মথুরা, গোয়ালিয়র প্রভৃতি অঞ্চলে তিনি কাপড় পাঠাতেন। তখনও কিন্তু রেলপথ সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গরুর গাড়িতে আথবা মুটের মাথায় পণ্ডিত মশায় লক্ষ লক্ষ টাকার কাপড় চালান দিতেন। কলকাতার বড়বাজারেও তাঁর কাপড়ের দোকান ছিল। কাশী-আমৃতশহর থেকে তখন প্রায় ছয় লক্ষ টাকার শাল বাংলাদেশে আমদানি হত। তাঁর মধ্যে প্রায় এক লক্ষ টাকার শাল বাচস্পতি মশায় নিজে আমদানি করতেন। এ-ছাড়া হীরা-জহরত, সোনা-রূপার আলঙ্গারেরও তাঁর ব্যবসা ছিল। বীরভূমের দশ হাজার বিঘে জঙ্গল কিনে তিনি চাষ আরম্ভ করেন এবং পাঁচশ গরু কেনেন দুধ-ঘিয়ের ব্যবসার জন্য। মুটের মাথায় করে কলকাতায় ঘি এনে তিনি বিক্রী করতেন। কালনাতে তিনি নেপালে ও তরাই অঞ্চল থেকে কাঠ আমদানি শুরু করেন এবং কাঠের ব্যবসাতেই কয়েক লক্ষ টাকা উপার্জন করেন। এই সময় কালনাতে তিনি প্রাসাদের মত বিরাট অট্টালিকা তৈরি করেন বসবাসের জন্য। কাপড় কাঠ ছাড়া চালের ব্যবসা করতেও বাচস্পতি মশায় ছাড়েননি। কালনায় কয়েক শত ঢেঁকি বসিয়ে তিনি ধান ভানতে আরম্ভ করেন, কারণ চালের কল তখনও তেমন আমদানি হয় নি। ঢেঁকির শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে কালনাবাসী যখন অভিযোগ করেন, তখন তিনি তাঁর ঢেঁকিশাল বা ঢেঁকির কারখানা দূরের গাঁয়ে সরিয়ে নিয়ে যান।
বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি্র থেকে(বই কৃতজ্ঞতাঃ সৌমেন নাথ)