থেয়ন কন্যা মিসরীয় হাইপাশিয়ার হত্যা
খ্রিষ্ট নানান সাহিত্যে বিশেষ করে ওল্ড টেস্টামেন্ট বা এজিকিয়েলের বইতে যারা সূর্যের উপাদনা করবে তাদের ধ্বংস করার কথা বলা হল, Slay utterly old and young, both maids, and little children, and women
(Ezekiel 9:6)। প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিষ্ট ধর্মের বাইরে থাকা যে কোন জীবনচর্যা, জ্ঞানচর্চা ধ্বংসের যে ব্যাপক উদযাপন চলতে থাকে, যাতে চার্চ অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার সুযোগ পায়, তার ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যায় থেয়ন কন্যা হাইপাশিয়ার হত্যার ঘটনায়।
হাইপাশিয়া ছিলেন গ্রন্থাগারিক, অঙ্কবিদ, জ্যোতির্বিদ, এবং নব্যপ্লেটোনিয় দার্শনিক। সমস্ত কিছুতেই প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিষ্ট ধার্মিকদের প্রচণ্ড আপত্তি – হাইপাশিয়ার কাজে খ্রিষ্টধর্মের সমাজপতিরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে শুরু করেন, তারা তাকে শত্রু দেগে দেন। খ্রিষ্ট ধর্মতত্ত্বের বাইরে সমস্ত কিছুকে শয়তানি দর্শন বা বিদ্যা দেগে দেওয়া হল যাতে সেগুলি নির্বিবাদে ধ্বংস করে ফেলা যায়। তাদের চোখে অঙ্কবিদ আর জ্যোতির্বিদ মানে জাদুগর বিশেষ, আর খ্রিষ্ট ধর্মের বাইরে থাকা দার্শনিক বিপজ্জনক মানুষ এবং খ্রিষ্ট ধর্মের চরম শত্রু। হাইপাশিয়া সেসময়ের জনমান্য শিক্ষক, তার বক্তৃতার জন্য প্রখ্যাত ছিলেন। হাইপাশিয়ার ছাত্র ছিলেন সাইরিনের সাইনেসিয়াস। হাইপাশিয়াকে লেখা তাঁর কিছু চিঠির সূত্র ধরে আমরা জানতে পারি হাইপাশিয়া জল পরিশোধনের প্রযুক্তি, জলের উচ্চতা মাপার প্রইয়ুক্তি, তরলের ভূকর্ষ মাপার তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন।
৪১২ সালে সিরিল আলেকজান্দ্রিয়ায় সমাজপতি হলেন। তিনি প্রচার করা শুরু করলেন হাইপাশিয়ার সঙ্গে মিশরের পুরোহিতদের জ্ঞানীদের যে যোগ তা অনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। জনগণকে খেপিয়ে তুলে সিরিল গ্রন্থাগারে যাওয়ার পথে জনগণকে দিয়ে হাইপাশিয়াকে গ্রেপ্তার করালেন। থিওডোসিয়াস সম্রাট এবং বিশপদের বিশপ হয়ে ওঠার ছ বছরে কি ঘটেছিল তার ইতিহাস আসলে শুধু হাইপাশিয়ার মতকে ধ্বংস করা নয়, সামগ্রিকভাবে পাগান মতাবলম্বীদের মুছে ফেলার ইতিহাস। আদতে হাইপাশিয়ার মতবাদ এতই প্রভাবশালী হয়ে উঠতে শুরু করে যে প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিষ্টধর্ম তাকে সিঁদুরে মেঘ হিসেবে গণ্য করে। একদিন একটি খ্রিষ্ট জন মিছিল তাকে দখল এবং পিটিয়ে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে ফেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
সিরিলের নেতৃত্বে যে পাগান ধ্বংস কাজ শুরু হয়েছিল তা হাইপাশিয়ার হত্যার মধ্যে দিয়ে তুঙ্গে উঠতে শুরু করে। সিরিল এবারে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় হয়ে উঠলেন সন্ত সিরিল। এর পর যারা খ্রিষ্ট ভগবানের বিরুদ্ধাচরণ করেছে বা তাকে মান্য করে নি তাদের সরাসরি হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে তার নির্দেশে। অত্যাচার করে কনফেশান নেওয়ার পদ্ধতি বার করা হল নিত্যনৈমিত্তিকভাবে। বহু মানুষকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হল, কিছু মানুষকে বন্দী করা হল আর কিছু পালিয়ে গেলেন মিশর থেকে। অবিশ্বাসীদের ধর্মস্থান দখল করতে করতে চার্চ হয়ে উঠল ধনীতম ধর্মব্যবসায়ী। শার্লিম্যানের সময় একদিনে ৪৫০০ সাক্সনকে হত্যা করা হয়।
তো আমরা দেখলাম কন্সট্যান্টাইন বা তার পরের গ্রাসিয়ান, দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান, এবং প্রথম থিওডোসিয়াসএর সময় পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিষ্টধর্ম ক্ষমতায় থাকলেও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তাদের আনুপাত খুবই নগণ্য ছিল। যারা সে সময়ে খ্রিষ্ট ধর্মের বিরোধিতা করেছে, তাদের ‘সত্য ধর্মের শত্রু’ দাগিয়ে দিয়ে তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, যারা পূর্বের পাগান সম্রাটদের পক্ষ নিয়েছিলেন তাদের হত্যা করা হয়।
গিবন বলছেন, The edict of Milan, the great charter of toleration, had confirmed to each individual of the Roman world the privilege of choosing and professing his own religion. But this inestimable privilege was soon violated; with the knowledge of truth the emperor imbibed the maxims of persecution; and the sects which dissented from the Catholic Church wre afflicted and oppressed by the triumph of Christianity
মিলানের নির্দেশ(এডিক্ট অব মিলান) জারি করেন কন্সট্যান্টাইন এবং সম্রাট লিসিনিয়াস ৩১৩ সালে যা আদতে ইওরোপিয় সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিষ্টান ধর্মকে মানিয়ে নেওয়ার(টোলিওরেসন অব খ্রিস্টানিটি) পথ। কিন্তু যত প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিষ্ট ধর্মালবম্বীরা বাড়তে থাকে মানিয়ে নেওয়ার পথে থাকা তত্ত্বে আস্থাবান খ্রিষ্ট মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। প্রথম থিওডোডিয়াস খ্রিষ্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মরূপে ঘোষণা করলেন এবং পাগান আর খ্রিষ্ট ধর্ম বিশ্বাসের বাইরে থাকা মানুষদের বিরুদ্ধে ধ্বংস অভিযান তীব্র করলেন।
সে সময় রাষ্ট্রের সরাসরি অর্থ এবং ক্ষমতার আনুকূল্যে চার্চ হাজার হাজার বছরের নানান জ্ঞানচর্চা, নানান ধর্ম চর্চা, নানান অপ্রাতিষ্ঠানিক খ্রিষ্টিয় ধর্ম/জীবনচর্যা মুছে ফেলতে উদ্যমী হয়ে উঠল, যাতে ইওরোপে তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতে অখ্রিষ্টিয় মানুষদের ওপর খ্রিষ্টিয়দের পশুদের মত ব্যবহারের অভিযোগ ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিষ্ট ধর্মের বাইরে যত ধর্ম সব নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল, ধর্মীয় সমস্ত সম্পত্তি রোজগার কেড়ে নেওয়া হল, মহিলা ধর্মপ্রচারকদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল, মৃতদের কবরখানায় কবর দেওয়া নিষিদ্ধ করা হল, মন্দির, উপাসনাগৃহ ধ্বংস বা বন্ধ বা লুঠ করা হল বা সেগুলি চার্চে রূপান্তরিত করা হল। প্রাচীন ধর্মের, ধর্মবিশ্বাসীদের সমস্ত শেকড় ধ্বংস এবং উতপাটন করে নব্য প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিষ্ট ধর্মের একা থাকার জমি তৈরি করা হল।