মধ্যরাতে ছৌ-নাচ, মানুষের
ভগ্ন দেহে দেবতার মুখোশ পেখম
কাড়া-নাকড়ার শব্দে কেঁপে ওঠে দশদিক, চতুর্থ প্রহর
মন্দিরে মন্ত্রের মতো ধ্বনি জাগে, যাগযজ্ঞে আছি মনে হয়
ঝর্ণা নামে রক্তস্রোতে, অব্যক্ত ও অব্যাহতিহীন কলরোল শুধু কলরোল।
- পুর্ণেন্দু পত্রী
কাড়া-নাকড়ার শব্দে কেঁপে ওঠে দশদিক, চতুর্থ প্রহর
মন্দিরে মন্ত্রের মতো ধ্বনি জাগে, যাগযজ্ঞে আছি মনে হয়
ঝর্ণা নামে রক্তস্রোতে, অব্যক্ত ও অব্যাহতিহীন কলরোল শুধু কলরোল।
- পুর্ণেন্দু পত্রী
অসামান্য সচেতন
নাকউঁচু কবি পুর্ণেন্দু পত্রীও কবিতায় ছৌ শব্দটি যে কেন ব্যবহার করলেন। শব্দটি কিন্তু ছো। মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলে আজও দৈনন্দিনের নানান অনুষঙ্গে
ছো শব্দটি অবলীলায় ব্যবহার করেন অসামান্য গ্রামীণেরা। যে গ্রামটি জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে
যাওয়া শব্দকে জুড়েদেন নিজেদের সাংস্কৃতিক ক্ষুত পিপাসা প্রদর্শণের আঙ্গিকের সঙ্গে,
সেই গ্রামটার নাম বাঙলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে অক্ষয় হয়ে রয়েছে তীর্থক্ষেত্রের গরীমাময়
মর্যাদায়। স্থানীয় ভাষায় চোড়দা, শহুরে পালিশকরা
ভাযায় চড়িদা, জেলা পুরুলিয়া। পারম্পরিক
সংস্কৃতিময় বাঙলায় ছো মুখোশ নৃত্যের সঙ্গে চড়িদা শব্দটি একই নিশ্বাসে উচ্চারিত হয়
আজও। এই গ্রামেই সুত্রধর সম্প্রদায়ের মানুষ অদম্য উত্সাহে ছোএর মুখোশ তৈরি করেন। আসামান্য তার কারিগরী দক্ষতা।
অসাধারণ তার শিল্পমূল্য। বলেরাখি বাঙলার
পারম্পরিক শিল্পকলার প্রযুক্তি নথিকরণ করতে থাকার সংগঠণ, কলাবতী মুদ্রা, শেষতম
দুর্গা উত্সবটিতে চোড়দা গ্রাম থেকেই অসামান্য কিছু ছোএর মুখোশ পাঠাতে পেরেছিল
মুম্বাইএর এক দুর্গাপুজোয় মন্ডপ সাজানোর কাজে। শিল্পীরা দাম পেয়েছিলেন ভালই। চোড়দা এমন একটি গ্রাম যেখানে বাঙলার
অন্যতম নৃত্য আঙ্গিক, ছো নাচে পারম্পরিক পদসঞ্চার আর লালিত্যের মিশেল ঘটেছে
অসামান্য গ্রামীণ শিল্প প্রজ্ঞায়। বাঙলার হাজার হাজার গ্রামের মধ্যে চড়িদা সাধারণ কোনো
একটি গ্রামের নাম নয়, শুধু একটি প্রশাসনিক পঞ্চায়েতও নয়, প্রত্যন্ত বাঙলার সংস্কৃতিময়
জঙ্গল মহলে শুধুমাত্র একটি নাচগানের টোলাও নয়, চোড়দা এমন এক গরিমাপূর্ণ গ্রাম, যে
গ্রামের অসামান্য মানুষজন অসম্ভব অহংপূর্ণ দায়িত্বে, বাঙলার হাজার হাজার বছরের
শিল্প নৈপুণ্য আর সেই সংক্রান্ত প্রযুক্তিকে বুকে ধরে অটল প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে
রয়েছেন নিজস্ব গরিমায়। চড়িদা ভ্রমণ তাই শুধুমাত্র হপ্তাশেষের আপিসবাবুর পকেট
বাঁচিয়ে পরিবারের মন ভোলানো ডিজনিল্যান্ড ভ্রমণ নয়, শস্তাতম ছো দেখানো গাইড বই
হাতে করে চোখে ঠুলি বেঁধে কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে ধরতক্তামারপেরেকগোছের যেমন তেমন পুরুলিয়ার
পানে বেরিয়ে পড়া নয়, বল কলম হাতে যেনতেনপ্রকারেন ভ্রমণ কথা লেখা নয়, চড়িদাগ্রাম আম
বাঙালি ভ্রমণার্থীদের সাংস্কৃতিক তীর্থ, যে তীর্থে মাঝেমধ্যেই তাকে মাথা ঠেকাতে
যেতে হয়।
হাওড়ার ট্রেনে
বরাভূম স্টেশন অথবা হাওড়া থেকে পুরুলিয়া। বাঙলার যে কোনও শহর থেকে পুরুলিয়া এসে বাগমুন্ডি পাহাড়গামী শকটে সত্তর
কিলোমিটারের কাছাকাছি অযোধ্যা মোড়ে নামা। নিজস্ব গাড়ি না থাকলে পুরুলিয়া শহর থেকে আড়াই ঘন্টারমত।
গ্রামে আসতে আসতে
চোখ চলে যায় দু’পাশের শূন্য প্রান্তরের অসামান্য বন্য
সৌন্দর্যের
দিকে। গ্রামে ঢোকার
পথে অযোধ্যার মোড়ে ছোট একটা বসতি। দু’পা দূরেই
চড়িদা গ্রাম। কলাবতী মুদ্রারই
পারম্পরিক শিল্পীদের সংগঠণ বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘর অন্যতম
সম্পাদক, জাতীয় শিল্পীর পুরস্কার বিজয়ী মুখোশ শিল্পী, গায়ক, নর্তক নেপাল সূত্রধরের
বাড়ি চড়িদায়। তিনিসহ তিন প্রজন্ম অত্যন্ত
সুমধুরভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এই কলায়। চড়িদায় খুব কম ঘরই আছে যেখান
থেকে এক জনও ছো শিল্পী ইউরোপ-আমেরিকায় অনুষ্ঠান করতে যাননি। নেপাল বহুবার বিদেশে গিয়েছেন মূর্তি তৈরি করতে, কর্মশালা পরিচালন করতে। শুধু মুখোশ নয়, মূর্তি তৈরি করতেও তার বহু নাম, বিশ্বে বহু প্রান্তের
জাদুঘরে তাঁর তৈরি মূর্তি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
প্রায় ৮০টি পরিবার নিয়ে এই
গ্রাম। নেপালেরমতই প্রতি
বাড়িতে প্রায় একই দৃশ্য। বাড়ির দালানে বসে পরিবারের বড় থেকে ছোট, প্রায়
সব সদস্যই ছো নাচের মুখোশ তৈরিতে ব্যস্ত। ব্যস্ততার মধ্যেও
ঘুরতে আসা ভ্রমণার্থীর নানান চালাকিময় প্রশ্নের
উত্তর দেন ধৈর্য ধরে হাসিমুখে। শিল্পীর অহংপূর্ণ হাসিটা ধরাথাকে ঠোঁটে। শিল্পীর অহং কিন্তু আহংকার নয়। অসামান্য গ্রামীণ সলজ্জতা আর বিনম্রতা তাঁদের কথায়।
ঘরের ভিতর উঁকি মারলেই দুর্গা, গণেশ,
শিব, অসুরের মুখোশ দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে অসামান্য উজ্জ্বলতায়। আকারও
বিভিন্ন ধরনের। কিনতে চাইলে কিনেও ফেলা
যায়। ছো নাচ দেখতে চাইলে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হয়। পদ্মশ্রী খেতাব পাওয়া ছো শিল্পী গম্ভীর সিংহ মুড়ার নাম জুড়ে
আছে চড়িদার সঙ্গে, নেপালও গম্ভীর সিংএর দলের শিল্পী
ছিলেন। যে গুরুর হাত ধরে ছো
নাচ এ গ্রামকে বিদেশে নিয়ে গিয়েছে, কথায় কথায়
সেই পূর্বজর প্রতি প্রণাম জানান নেপাল। শিল্পীদের মহড়া দেওয়ার জন্য
গ্রামের মাঝখানে একটি ছোটখাটো হল আর গ্রামে ঢোকার মুখেই আছে গম্ভীর সিংহের মূর্তি।
বরাভূম স্টেশনে নেমে চড়িদা আসার পুরো
রাস্তা জুড়ে প্রচুর খেজুর গাছ। শীতের সকালে মন খেজুর রসের বায়না করলে এই মুখোশময়
চড়িদাতেও তা মিলবে। শীত থাকলে আলি ভাইএর ঘরেই
বসে দেখা যাবে খেজুর গুড় বানানোর বিরল দৃশ্য। চাইলে নলেন গুড় কেনা যাবে। রাঢ় বাঙলা আর জঙ্গল মহলের গুড়ের
স্বাদই আলাদা। চড়িদার
পিছনে পাহাড়ের পাদদেশে জঙ্গলের মধ্যে হদহদি ঝরনা।
শীতকালে জল না থাকলেও বর্ষায় রূপ দেখার মতো। শাল, বয়রা,
আমলকীর
ঘন জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে এই ঝরনার
জায়গাটি বেশ মনোরম। হদহদিতে গিয়ে জল দেখতে না পেলেও চুপ করে বসে থাকলেও নানা পাখির ডাক মন
ভরিয়ে দেবে। কখনও দেখা যায় দল বেঁধে গ্রামের মেয়ে-বৌরা কাঠ কাটতে, পাতা
কুড়োতে জঙ্গলে যাচ্ছেন। অসম্ভব সুরেলা সবার গলা।
সমতল থেকে ৭০০ মিটার উচ্চতায়
অযোধ্যা পাহাড়ে জঙ্গলের রাস্তা বেয়ে থুর্গা লেক। বৃষ্টির জলই এই লেকটিকে
বাঁচিয়ে রেখেছে। বর্ষায় এর রূপ
অনন্য। এই লেক থেকে কিছু দূরে বাঘমুন্ডি গ্রাম। অযোধ্যা ও
বাঘমুন্ডির
জলের একমাত্র উৎস থুর্গা লেক। বিশাল লেকের ঠান্ডা হাওয়া মন জুড়িয়ে দেয়। থুর্গা
যাওয়ার পথে রাস্তায় পড়বে মানভূম ট্যুরিস্ট
লজ। একদম নির্জন প্রকৃতির মধ্যে যাঁরা থাকতে
চান, তাঁদের জন্য মানভূম ট্যুরিস্ট লজ আদর্শ। এখানকার কেয়ারটেকারকে বললে খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই বাঙলার
এ ধরণের পারম্পরিক শিল্পী সমৃদ্ধ গ্রামে লৌকিক ভ্রমণের ব্যতিক্রমী পরিকল্পনা করছে
কলাবতী মুদ্রা। আশা আগামী দিনে বাঙলার ভ্রমণপ্রেমী আর সংস্কৃতি উত্সাহী মানুষ তাঁদের
উত্সাহের হাত বাড়িয়ে দেবেন এই উদ্যমে। বাঙলার
নানান পারম্পরিক উদ্যমের গ্রামগুলিকে নিয়ে তাঁরা এক লৌকিক ভ্রমণের শৃঙ্খলের
পরিকল্পনা করছেন। সংগঠণ সম্পাদক নেপাল সূত্রধরও চাইছেন
তাঁর একফালি জমিতে মাটির বাড়ি বানিয়ে ভ্রমণার্থীদের থাকর ব্যবস্থা করা। কলাবতী মুদ্রা সেই পরিকল্পনার ভাগিদার। স্থানীয় প্রতিনিধি কে পি সিং দেও
উত্সাহ দেখিয়েছেন। শিল্প গ্রামে মাটিরবাড়িতে থেকে সেই শিল্প প্রত্যক্ষ্য করা এবং যতদূরসম্ভব
তা শিখে নেওয়া যায়। আশাকরি অনেকেই এই পরিকল্পনায় শামিল
হবেন। চড়িদার স্থান হোক বাঙলার হৃদিকমলে।
চড়িদা ইকো ইন্ডেক্স
গ্রামঃ চড়িদা, পুরুলিয়া
শিল্পঃ ছো নাচ, ছো মুখোশ
আলাপ করবেন যে জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী শিল্পীর
সঙ্গেঃ নেপাল সূত্রধর
রাতে থাকার স্থানঃ ভাবিষ্যতে গ্রমেই থাকার ব্যবস্থার পরিকল্পনা রয়েছে, বর্তমানে দুধের স্বাদ
ঘোলে মেটামোরজন্য দু কিমি দূরে লজে অথবা পুরুলিয়ায় ফিরে আসা
রাস্তাঃ পাকা, গাড়ি যাবে বর্ষায়ও
কাছের রেলস্টেশন আর পরিযানঃ বরাভূম(থেকে ট্রেকারে), পুরুলিয়া(থেকে ভাড়া গাড়ি অথবা বাসে)
গ্রামে সম্ভাব্য মাথাপিছু খরচঃ দৈনিক ৫০০ টাকা(শুধু বাগমুন্ডিতে থাকা আর তিনবেলা খাওয়া)
আবহাওয়াঃ গরমে অসম্ভব গরম আর শীতে বেশ শীত, তবে শীত আর বর্ষাকালের মজাই আলাদা
নিরাপত্তাঃ অসম্ভব ভাল
গ্রামের জনসুবিধাঃ তিন তারা(রাতে গ্রামে থাকার ব্যবস্থা হলে জয়গুরু রাঙ্কিং অর্জন
করবে)
(এক তারাঃ চলনসই, দুই তারাঃ ভাল, তিন
তারাঃ বেড়ে, চার তারাঃ চমতকার, পাঁচ তারাঃ জয়গুরু)