অবাধ রপ্তানির ফলে দামও অবাধে বেড়েচলে। তার ওপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। টাকার দাম কমিয়ে দেওয়া হোল(অবমূল্যায়ন)। ব্রিটিশদের ভারতীয় শস্য কেনা আরও সস্তা হয়ে গেল। আরও
পরিহাসের কথা, যে রেলপথটি তৈরিই হয়েছিল মন্বন্তর রোখার জন্য সেতো মন্বন্তর রুখলই
না, বরং যে স্টেশনের নামে রেলপথ, সেই নাগপুরেই ১৮৯৬-৯৭র মাঝামাঝি নাগাদ খাদ্যশস্যর
জন্য দাঙ্গা হল। পাশের রাজ্য ডুঙগারগঢ়ে শাস্তির হুমকি আর সেনা নামিয়ে অবস্থা সামাল
দেওয়া হয়। এই রেলপথেরই পাশে সাগর জেলায় ঊল্টো পুরাণ- ১৮৬৫-৯৫ পর্যন্ত জনসংখ্যা
বাড়ল ১৮ শতাংশ, চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ল ৪৮ শতাংশ, রেলযোগে গম রপ্তানির পরিমাণ,
১৮৮৭-৯৭, এই এক দশকে, ৪০,০০০ মণ থেকে ৭,৫৮,০০০ মণে গিয়ে পৌঁছল।
মন্বন্তর ফান্ডের সুযোগ পাওয়া অন্য রেলপথটি কী করল দেখা যাক। ইন্ডিয়ান মিডলাণ্ড রেলওয়ে কোম্পানির ঘাড়ে চেপে
বোম্বাইয়ের গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে(জিআইপিআর) নিজেদের রেলপথ এলাকা আরও
বিস্তারলাভ করাবার সুযোগ পেল। দুটি রেল
কোম্পানির পরিচালন ব্যব্যস্থা প্রায় সমান সমান। ফলে জিআইপিআর, মিডলাণ্ডকে দখলে
নিল। ভারতে রেল ব্যবসার জিআইপিআরএর প্রধান প্রতিযোগী ইস্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে।
কোম্পানিটি বেসরকারি কিন্তু সরকারি মদত পুষ্ট। সরকারের গ্যারান্টি তার রয়েছে।
১৮৭০এ রেলের জাতীয়করণ হাওয়ার সময় ইণ্ডিয়া অফিস জিআইপিআরএর শেয়ার কেনেনি। ফলে পরের
২৫ বছর রেলপথটির রোজগার, ভারত সরকারের সামনে, উপভোগ করেছে জিআইপিআরএর অংশিদারেরা। ফেমিন কমিশনের সামনে সাক্ষীরা বলেছেন, মন্বন্তরের সময় জিআইপিআর অতিরিক্ত
শুল্ক ধার্য করেছে। তার জন্য কমিশন জিআইপিআরকে সমালোচনাও করেছে। এতদিন যে জিআইপিআরএর
ডাইরেকটরেরা ৫ শতাংশ গ্যারান্টি ভোগ করে এসেছে, তারাই, মিডলাণ্ড কোম্পানির ঘাড়ে
চেপে ফেমিণ ফাণ্ডএর সুযোগ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল।
অন্যদিকে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের জাতীয়করণএর গুনাগার দিল ভারতীয়
করদাতারা। ইআইআরএর অংশীদারদের সরকারকে দিতে হল মূলের ওপর ৩০ শতাংশ বেশী এছাড়াও
বছরে বছরে লভ্যাংশএর অংশীদারি। ১৮৮০র
ফেমীন কমিশনের প্রধান স্যর রিচার্ড স্ট্রাচি, রেল কোম্পানিটির প্রধান মনোনীত হয়ে
বছরে বছরে বিশাল অংশ এন্যুইটি, বার্ষিক রোজগার অর্জন করেন। আমলা হিসেবে চাকরি করে
যে পেনসনের খুদকুঁড়ো অর্জন করেছেন, তার তুলনায় এই এন্যুইটির পরিমান প্রায় পাহাড়
প্রমাণ। স্ট্রাচির ইআইআরএর দায়িত্ব ছিল খাদ্যশস্য বিতরণের। বেঙ্গল নাগপুর রেলপথের
সঙ্গে মিলে তারা খাদ্যশস্যএর সঙ্গে কয়লার ব্যবসা শুরু করে। তবে স্ট্রাচি বলেন, তার
কোম্পানি, লন্ডনের ফেমিন রিলিফ চ্যারিটিতে বিন্দুমাত্র অংশগ্রহণ করে নি।
রেল কোম্পানিতে অপরিকল্পিত বিনিয়োগও হয়েছে। আসামের বেশ কিছু অলাভজনক বেসরকারি
রেল প্রকল্পে সরকারি গ্যারান্টি যোগাড় করেন স্ট্রাচি। আসাম বাঙলা রেলওয়ে তৈরি হয়
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যাবহার, আসামে খাদ্য বিতরণ আর বার্মায় সেনা পাঠানোর জন্য। রমেশ
দত্ত একে সব থেকে খারাপ পুঁজিবাদী পরিকল্পনাগুলির মধ্যে সর্বাগ্রে রাখার কথা বলেন।
কার্জন একে মন্বন্তর, সামরিক পরিকল্পনা ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনার সুচতুর ককটেল
হিসেবে মন্তব্য করেন। এই প্রকল্পটিতে ভারতের করদাতাদের ৯ মিলিয়ন(তৈরির খরচ ৫
মিলিয়ন) ডলার খরচ হয়। এই রেলপথ তৈরিতে সবথেকে বেশি লাভ করেছেন ব্রিটেনের কারখানা
মালিক আর ভারতের ফড়েরা। তিনি বলছেন ব্রিটেন থেকে যত পরিমাণ রেল যন্ত্রাংশ এসেছে,
তার তুলনায় সেচের সরঞ্জাম এসেছে বিন্দুবৎ। এছাড়াও সাম্রাজ্যের পরিচালকরাও সেচ
ব্যবস্থায় বিনিয়োগের বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। ভারত সচিব, পরে প্রধানমন্ত্রী, সলিসবেরি
ব্রাডফোর্ডে ১৮৭৬-৭৮এর মন্বন্তরের সময়, এক সভায় বলেন, ভারতে সেচ ব্যবস্থা বিনিয়োগ
করার অর্থ গরীব অর্থ করদাতাদের ওপর আরও বেশী কর আর খরচের বোঝা চাপানো। ফলে দারিদ্র
আরও বৃদ্ধি পাবে। উল্টোদিকে তিনি এত কঠিন কথা রেল বাজেট তৈরির সময় বলেন নি। বরং
তিনি ভারতের কৃষকদের উপদেশ দিয়ে বলেছেন, তারা বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদন না করে খাদ্য
শস্য উৎপাদন করুক যাতে কৃষক মহাজনের শোষণের হাত থেকে মুক্তি পায়। এবং তিনি বলেন
কৃষকের কাছে এটি একটি বীমাও বটে। অথচ মন্বন্তর রোখার নামে ভারতীয় রেল তৈরি করেছে
ফড়ে, মহাজন, বাণিজ্য চাষ এবং শস্য বণিকদের। এমনকি ম্যানচেস্টারের মিলমালিক এবং
কোয়েকার দর্শনে বিশ্বাসী জন ব্রাইট ১৮৭৭এ বলছেন মাত্র ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ
করলেই, মন্বন্তরে ভোগা লাখো লাখো কৃষক উপকৃত হতে পারত। ঠিক এর আগের বছরে ব্রিটিশ
উপনিবেশ রেলে ১৬০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেও সেচে বিনিয়োগ হয়েছে ২০ মিলিয়ন ডলার।
রেলে বিনিয়োগ এই ধারণা থেকে করা হয়েছে যে, ভারতের মন্বন্তর খাদ্যশস্যের
অপ্রতুলতার দরুন হয় নি, হয়েছে এলাকায় খাদ্য শস্য না পাওয়া যাওয়ার জন্য। ফলে ভারতে
খাদ্যশস্যের চলাচল হওয়া ভীষণ জরুরী। তার জন্য রেল। ভারতীয় রেলের এক প্রাক্তন
পরামর্শদাতা, হোরেশ বেল এই সাম্রাজ্য তত্ত্ব খারিজের জন্য কোমর বাঁধেন। তিনি
১৮৯৮এর ফেমিন কমিশনের তথ্য তুলে বলছেন, সাম্রাজ্যে ১৮৯৬-৯৭তে ১৮-১৯ মিলিয়ন টনের
মতো খাদ্য শস্যের অভাব রয়েছে। মন দিয়ে খুঁজলে ১৮৯৮-১৯০০র মন্বন্তরে হয়ত আরও বেশী
ঘাটতির খবর পাওয়া যেতেপারে।
মন্বন্তর রুখতে সরকারের প্রয়োজন ছিল আরও বেশী খাদ্য শস্য আমদানি করা। শুধু
রেল তৈরি করে অথবা দাম নিয়ন্ত্রণ করে মন্বন্তর রোখা সম্ভব নয়। আর মন্বন্তরে দান
শস্যর দাম বেশী হলেও স্থানীয় শস্য ব্যাবসায়ীরা এই শস্য নিয়ে ব্যবসা করতে পারেন নি,
কেনোনা, প্রায় সবই বিদেশে চড়া দামে রপ্তানি হয়ে যাচ্ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে
একমাত্র বার্মাতেই মন্বন্তরে ভর্তুকির দামে খাবার দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু খাদ্যশস্যের দাম আর পরিবহন
খরচের দরুন সেটা হয়ে ওঠে নি। বার্মার রেলে আকাশ ছোঁয়া ভর্তুকি দিয়েও খাদ্য
দ্রব্যের দাম কমিয়ে রাখা যায় নি। অন্যভাবে বললে, মন্বন্তরে লাভ করে, ফুলে ফেঁপে
উঠেছে রেল কোম্পানিগুলো। ১৮৯৬-৯৭ সালের মন্বন্তরে মেইকটিলা-মিনগিয়ান রেলপথ, বর্মার
মন্বন্তর বরাদ্দের ৯৫ শতাংশ খাদ্যসশ্য রপ্তানি করে। বার্মার প্রশাসকেরা এই
রেলজালের মাধ্যমে ইউরোপে আরও বেশি দামে গম পাঠাতে সুরু করেন। বার্মা রেলওয়ে
কম্পানির জন্য সস্তার শ্রমিক, আরও লাভের গ্যারান্টি আর মন্বন্তর ভর্তুকি দিয়েও
কোম্পানির লাভ বাড়লেও জনগণের মন্বন্তরের কবলে পড়ে।
সরকারি মদতে, করদাতাদের অর্থে তৈরি হয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা এই রেল কোম্পানিগুলো,
মন্বন্তরের সময়, মন্বন্তর এলাকাগুলোয় সস্তার খাদ্যশস্য সরবরাহ করতে ব্যার্থ হয়েছে।
গম পরিবহনএর শুল্ক বেশ চড়া ছিল, বিশেষ করে আমেরিকারমত যেসব দেশে গম রপ্তানি হয়েছে,
তার তুলনায়। রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কমিশন সস্তায়, প্রতি মাইলে ২৫ পেনি শুল্কে গম
পরিবহনের জন্য আমেরিকার চেষ্টাকে সাধুবাদ জানায়। ভারতের শুল্ক এর তুলনায় অনেক বেশি
ছিল, বিশেষ করে জিআইপিআর অথবা ইআইআর রেলপথে। সরকারি প্রচেষ্টায় পরিবহন শুল্ক কমলেও
তাও আমেরিকার তুলনায় অনেক বেশি। আর এই পরিবহন ব্যাবস্থায় মধ্যসত্ত্বভোগীদের সংখ্যা
বাড়ায় খরচও বেড়ে চলে।
১৮৭৫-১৯১৪ সময়ে ১ কোটি ৬০ লক্ষ
ভারতীয় মন্বন্তরের কবলে পড়ে মারা যান। অন্যভাবে বললে তাদের খুন করা হয়, এটি আসলে
গণহত্যাই। মন্বন্তর বলা আসলে ভাবের ঘরে চুরি। ব্রিটিশ অর্থ ব্যবস্থাকে মন্বন্তরের
ছোঁয়ার বাইরে রাখার চেষ্টা হয়েছিল ইন্ডিয়া অফিস মারফৎ, যাতে তৃতীয় দুনিয়ার এসব
খারাপ সারাপ ব্যাপারে তাদের নাম উঠে না আসে। ১৮৯৬-৯৭ এবং ১৮৯৯-১৯০০ অর্থবর্ষে
ব্রিটেন, ইন্ডিয়া অফিসকে মন্বন্তরের জন্য দান দিতে চাইলেও ভারত সরকার সেই দান নিতে
অস্বীকার করে। বিদেশী বা ভারতের কোনও মন্বন্তর সাহায্য নেওয়া হয় নি। অথচ, মন্বন্তর
রোখার অর্থ বিনিয়োগ করে ভারত জুড়ে রেল সংযোগ বেড়ে চললেও, সেই কোম্পানিগুলো
মন্বন্তর রোখার কাজে বিন্দুমাত্র সাহায্য করে নি, বরং প্রকোপ বাড়াবার কাজ করেছে।
দ্বিতীয়বারের জন্য রেল কোম্পানিগুলোকে অর্থ সাহায্য করার সময়, ভারত সরকার রেল
আমলাদের মন্বন্তর তৈরির জন্য বিন্দুমাত্র দায়ি করে নি, এবং যে তিনটি ফামিন কমিশন
তৈরি হয়, তারাও রেল আমলাদের প্রশ্ন করে নি।
সাম্রাজ্য মনে করত ভারতএর জনগন নিজেদের দোষেই মারাযাচ্ছে। এই ঘটনায়
ব্রিটেনএর বিন্দুমাত্র হাত নেই। ভারতের জনঘনত্ব এই মন্বন্তরগুলোর জন্য দায়ি, এরকম
এক ধারনা ইউরোপ ছড়িয়ে ছিল। যেমন, ম্যালথাসবাদী ভাইসরয় লিটন। তিনি মনে করতেন ভারতই
তার দুর্দশার জন্য দায়ি, The population of this country is still almost
wholly dependent upon agriculture. It is a population which, in some parts of
India, under the security for life which are the general consequence of British
rule, has a tendency to increase more rapidly than the food it raises from the
soil.
ভারতের বিশিল্পায়নের
অন্যতম কারবারি, উপনিবেশিক রেল ভারতের জনগণকে আরও বেশি জমির ওপর নির্ভরশীল করে
তোলে। ১৮৯৮-১৯০০র পরে অনেক বেশি বিনিয়োগ সেচ ব্যাবস্থায় বরাদ্দ হয়। কিন্তু রেল
কোম্পানিগুলোকে আরও সাহায্যের নীতি আরও বেশি আঁকড়ে ধরছিল, যার লাভ সুদে আসলে উসুল
করেছে কোম্পানিগুলোর লন্ডনের বোর্ড সদস্য আর অংশিদারেরা। এ ছাড়াও লাভ করেছেন শস্য
ব্যাবসায়ী, মজুতদার, মহাজনেরমত মধ্যসত্তভোগীরা।