বাঙ্গালা দেশে
যে এইরূপ ঘর অনেক ছিল, তাহার প্রমাণ শুধু পল্লী-গীতিকায় নহে – আইন-ই-আকবরিতেও আছে। আবুল ফজল লিখিয়াছেন, বাঙ্গালীদের ঘরগুলি প্রধাণতঃ বাঁশ দ্বারাই নির্ম্মিত
হইয়া থাকে। ইহাদের
কতগুলি ৫০০০টাকা বিংবা ততোধিক অর্থ ব্যয়িত হয় – এই ঘরগুলি খুব
দীর্ঘস্থায়ী হয়। একখানি
ঘর প্রস্তুত করিতে ৫০০০ এবং ততোধিক টাকা সে সময়ে ব্যয় হইত, এখনকার দিনে ঐ টাকার
মূল্য অনেক অধিক।
ভেলুয়া নামক
গীতিকায় সদাগরের বাড়ী ও জাহাজগুলির যে বর্ণনা পাওয়া গিয়াছে, ভাবিয়াছিলাম উহা নিছক
কল্পনা, কিন্তু এখন মনে হইতেছে ঐ বর্ণনায় অতিরঞ্জন থাকিলেও তাহা সত্যের ভিত্তির
উপর প্রতিষ্ঠিত।
ছাওয়ার জান
মিঞার বাড়ীর মত সাবেকী ধরনের ঘর এখনও বঙ্গদেশের নানান স্থানে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায়
নিগৃহীত হইয়া পড়িয়া আছে। দৃষ্টান্তস্থলে
আমরা বীরভূমের অন্তর্গত সীমাত্ গ্রামের একজন ব্রাহ্মণের বাড়ীর ঘরের আলাদা উল্লেখ
করিতে পারি।
গ্রামখানি বোলপুর হইতে ১৫ মাইল দূরে অবস্থিত। ঘরের মধ্যে
নানান কারুকার্য, তাহা বেতের বাঁধনে ময়ূর, ফুল ও নানানরূপ মূর্ত্তি তুলিয়া
সম্পাদিত হইয়াছে। কাঠের কাড়ার মধ্যে নানানরূপ মূর্ত্তি খোদাই করা। ঐ ঘরখানি ২০০
বত্সর পূর্ব্বে তৈয়ারী হইয়াছিল। ত্রিপুরা এস্টেটের রাজধানী আগরতলায় কর্ণেল মহিমচন্দ্র ঠাকুরের ঐরূপ একখানি
ঘর ছিল, তাহার ভগ্নাবশেষ এখনও বিদ্যমান। খুলনা জেলার আসাসনি গ্রামের নিকট কোনও এক পল্লীতে প্রতাপাদিত্যের সময়কার
কাঠের একখানি ঘর ছিল, তাহাতে কাষ্ঠনির্ম্মিত নানান দেবদেবী ও মানুষ এবং পশুপক্ষীর
মূর্ত্তি গৃহের খুঁটি ও প্রাচীরের শোভা বর্ধন করিত, তাহার কিছু কিছু উপাদান আমার
কাছে আছে।
বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়রের গ্রামে ডাক্তার দেবেন্দ্রনাথ হাজরা, এম এ ও তাঁহার জ্ঞাতিবর্গের
বাড়ীতে সারওয়ার জান মিঞার ঘরেরমত এখনও একখানি প্রাচীন ঘর বিদ্যমান। যিনি আমাকে এই
সংবাদ দিয়াছেন, তিনি বললিলেন – এই ঘরখানির
শিল্প-কার্য্য অদ্ভুত – বেতের বাঁধনে
ও কাঠের কাজের মনুষ্য ও পশুপক্ষীর মুখ অতি উত্কৃষ্টভাবে নির্ম্মিত হিয়াছে।
বর্মবৈচিত্র্যে, সূক্ষ্ম কারুকীর্য্যসম্পদে, ও অভ্রখচিত নানারূপ মনোহর চারুকলায়
প্রাচীন ঘরখানি এখনও দর্শনীয় হইয়া আছে। এই একখানি খড়ো ঘর নির্ম্মাণ করিতে যে অর্থ ব্যয় হইয়াছে তাহাতে অনায়াসে
একখানি দ্বিতল বাড়ী নির্ম্মিত হইতে পারিত।
কবিবর
নবীনচন্দ্র সেন, আমার জীবন পুস্তকের ৪র্থ খণ্ডে(৬ পৃষ্ঠা) ৬০ বত্সর পূর্ব্বে
নির্ম্মিত এইরূপ কতগুলি ঘরের উল্লেখ আছে। তিনি লিখিযাছেন, রাজার ঝি দীঘির পাড়ে(নোযাখালি, ফেণী মহকুমায়) এই গৃহগুলি
দেশায় ঘরামীরা ১৮৭৪ খৃঃ অব্দে নির্ন্মাণ করিয়াছিল। প্রত্যেক ঘরের
স্বতন্ত্র আকৃতি, প্রত্যেক ঘরের পনের কি বিশ চাল, নানারূপ কোন চক্রে প্রত্যেক ঘরের
স্ব৬তন্ত্র শোভা। এ
অঞ্চলে কি কোন অঞ্চনে এমন কবিত্বপূর্ণ বাঁশের ঘর কেহ কখনও দেখে নাই। বাঁশের কুটীর
যে এমন সুন্দর হইতে পারে, এ ধারণাও কাহারও ছিল না। এ অঞ্চলে এ সকল
ঘর লইয়া মহা হুলুস্থুল পড়িয়া গেল। বহুদূর হইতে দলে দলে লোক এই সকল গৃহ দেখিতে আসিতে লাগিল।
...এই সকল
শিল্পীদের আমরা কেনও উত্সাহই দিই নাই। তাহারা শুকাইয়া মরিতে বসিয়াছে। আমরা কারিন্থিয়ান ও গথিক স্থাপত্যের আলোচনায় ততক্ষণ প্রাজ্ঞ হইয়া ডাক্তার
উপাধির জন্য বিলাত পর্যন্ত ঘুরিয়া আসিয়ায়াছি। শিল্প-লক্ষ্মীর
যে বাড়ির এত কাছে, তাহার সন্ধান লই নাই।