জোনসের উদ্যমে ভদ্রবিত্তরা পুনর্বাসিত হয়ে মুক্তির স্বাদ অর্জন করেছে এবং কার্যত বিইস্লামিকিকরণের উদ্যম নেওয়া শুরু করেছে - যে রাজত্বে তারা মন্ত্রীও হয়েছিল। অথচ উপনিবেশিক সরকারে তাদের মন্ত্রী হতে আরও দেড়শ বছর অপেক্ষা করতে হবে - বহু কষ্টে ভদ্রলোকেরা উঠতে পারত হল শুধুই ডেপুটি পদ পর্যন্ত - কিন্তু তাতেই কি দাসত্ব উতসাহ। ১৮২০/২৫ থেকেই বঙ্গীয় নবজাগরণের আড়ালে হিন্দুত্বের জিগির উঠতে আরম্ভ করেছে, সেইরকম ভাষা লব্জ তৈরি হচ্ছে একেরপর এক।শুধু ইসলাম নয় গ্রামীনের খিস্তি করাটাও নবজাগরণীয় সাহিত্যের ফ্যাশানে রূপান্তরিত হচ্ছে ভদ্রলোকিয় লন্ডনীদের দেখাদেখি।
প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে গিলক্রিস্টিয় নব্য বাংলা ভাষার হায়ারার্কি তৈরি করছে - সাহেব চাকুরেদের কি নামে ডাকা হবে, অভদ্রলোকেরা কিভাবে তাদের সামনে সম্মান দেখাবে সেই সব নির্দেশাবলী লেখা হচ্ছে। এটা সামগ্রিকভাবে একটা ভদ্রলোকিয় প্রকল্প।
পরে এটা গতি পাবে বিদ্যাসাগরের হাতে যখন তিনি সেখানে যাবেন। তিনি এবং তাঁর সহকারী সমবিব্যহারে শুরু হবে সাহিত্যে, কথ্য ভাষায় যবনী মিশেল বাদ দেওয়ার উদ্যোগ। সাধু নামক একটা বাংলা ভাষা পরিকল্পিত হবে। একই সঙ্গে প্রমিত হিন্দি তৈরি হবে সঙ্গে কেটেকুটে - যা আজ ভাজপার মুখের ভাষা। এই হিন্দুয়ানির জোয়ারে মুসলমান সমাজ ভদ্রবিত্ত 'হিন্দু' সমাজ থেকে বর্জিত হল, সঙ্গে বর্জিত হল অভদ্ররাও, কিভাবে পরের স্তবকে আলোচনা করছি। বিদ্যাসাগর মিলের ভারত ইতিহাস অনুবাদ করলেন। মিল কোন দৃষ্টিতে ভারত ইতিহাস লিখেছিলেন আমরা জানি। প্রাচ্যবাদের ঘুর্ণিপাকে ঢুকে পড়ে মুসলমান বিরোধী হিন্দুবাদী নবজাগরনীয় বাঙ্গালিত্ব নির্মান ঘটল। আজ বাঙ্গালির খাওয়া, সাজ, পোষাক, জীবনধারণ, কথাবার্তা, সম্পর্ক, কৃষ্টি ইত্যাদি বলতে যা বুঝি সে সবের নির্মানপর্ব চলছিল হিন্দুত্ববাদী নবজাগরণের প্রথমপর্বে।
মুসলমানত্বকে বাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীনদের পিছিয়েপড়া দাগিয়ে দেওয়া শুরু হল - নাহলে লুঠেরা নবজাগরণ যে প্রগতিশীল কাজ সেটা বোঝানো যায় না। ১৭৬৩ থেকে ফকির-সন্ন্যাসী লড়াই শুরু হয়েছে, গ্রাম বাংলা তেতে আছে ছোটলোকেদের লড়ায়ে - সেনা লেলিয়ে দিয়েছে গণহত্যা ঘটাচ্ছে সাম্রাজ্য। ইংরেজদের সঙ্গে খুন অত্যাচার আর লুঠকর্মে নিযুক্ত শহুরে নবজাগরিত ভদ্রবিত্ত গ্রামে লড়াইরত গ্রামীনদের সরকার বিরোধী ছোটলোকামিতে ক্ষুব্ধ। কোম্পানির হাতে পরিকল্পিত হিন্দুত্ববাদী নবজাগরণ প্রকল্প ততদিনে কলকাতায় শেকড় গেড়েছে। ঔপনিবেশিক রাজত্বে লুঠের ছোটতরফ ভদ্রলোকেদের দাসত্বমূলক সুখাহারের প্রসাদ গ্রহণে ব্যাঘাত ঘটছিল গ্রামীনদের লড়াই। ভদ্রলোকেদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে বলেই গাঁইয়া ছোটলোকেদের গালাগালি দেওয়াটা জায়েজ হয়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকেদের - পরে দিকে মার্ক্সবাদীরা আরও বড়ভাবে দেবে।তাই ঔপনিবেশিক হিন্দুত্ববাদী নকুলে ভদ্র সাহিত্যে চাঁড়াল, চাষা, কুসংস্কারচ্ছন্ন, অশিক্ষিত, মুচি ক্যাওট, অসভ্য, ইতর, সাঁওতাল ইত্যাদি নির্বিচারে গালাগাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের মুচিরাম গুড় হল ছোটলোককে কিভাবে দেখা হবে তার বয়ান আর আনন্দমঠে ফকিরদের বর্জন করে লড়ায়ের ইতিহাস কিভাবে লেখা হবে তার বয়ান তৈরি করে গেলেন।
আজকের ভদ্রলোকেদের ভাষা এবং ভদ্রবিত্তীয় হিন্দুত্ববাদীদের ভিত সেই তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে গড়ে উঠেছে। এবং খুব গুরুত্বপুর্ণ হল ভদ্রলোক হিন্দুত্ববাদীরা গত ৮০-৯০ বছর ধরে তাদের উচ্চবর্ণিক হিন্দুত্ববাদ বাংলার বিশাল পরিমানে তথাকথিত অভদ্রলোকেদের খাওয়াতে পেরেছে। ফেসবুকে এই প্রবণতা স্পষ্ট। একটু খেয়াল করে যদি দেখেন অধিকাংশ ভাজপা বা সঙ্ঘী ট্রোল অভদ্রলোকিয় উপাধিধারীরা।
২০১৯এর নির্বাচন এই তাত্ত্বিক অবস্থানকে পাকা করল এবং আগামী দিনে হিন্দুত্ববাদের শেকড় আরও গভীরে যাবে তার ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি হল। এটা স্পষ্ট যতদিন যাবে এই বিভাজন আরও বাড়বে।