Monday, March 25, 2019

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১ - পলাশীপূর্ব রাজস্ব ব্যবস্থা - জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা

(এর আগে বাংলার জমিদারির আদায় নিয়ে আলোচনা করেছি আমার পলাশীর পূর্বে বাংলার ৫০ বছর বইতে। বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের ভাবনা ভাবছি। জমি আর রাজস্ব ব্যবস্থা প্রথন খণ্ডে আলোচিত হয় নি। তাই এখানে ছুঁয়ে যাচ্ছি জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা। কয়েক কিস্তিতে আলোচনা করব জাফরখানি ব্যবস্থা কেন আলাদা ছিল মুঘল শাসন থেকে। এটি মূলত নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল আর রমেশ দত্তর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া আরও বেশ কিছু বইএর অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। এখানে বিশদে লেখার সুযোগ নেই - তাই পটভূমি আলোচনা। বিশদে থাকবে বইতে - বিশ্বেন্দু}



বাদশা আওরঙ্গজেবের আমলে মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনুযায়ী সুবা বাংলাতে দিল্লি থেকে একজন নাজিম আরেকজন দেওয়ান আলাদা আলাদা করে নিযুক্ত হতেন। দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশনে যদুনাথ সরকার বলছেন বাদশারা চেকস এন্ড ব্যালেন্সের জন্যে পরস্পর প্রতিযোগী দুই উচ্চপদস্থ কর্মচারী পাঠাতেন যাতে দুজনের দপ্তর দুজনের দপ্তরের কাজের ওপর কড়া নজর রাখতে পারে। মুঘল শাসন ঐতিহ্য মেনে নিজামতের দায়িত্ব ছিল মনসবদারদের অধীনে থাকা অশ্বারোহী বাহিনীর তদারকি এবং অন্যান্য শাসন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে যত কছু করণীয় আছে সব করা। দেওয়ানির কাজ ছিল মূলত রাজস্ব সংগ্রহ। শাসনকাজে মূলত অমুসলমান কর্মচারী দিয়ে জমিদারদের থেকে খাজনা আদায় এবং জমি রাজস্ব ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়িক একক যেমন হাট, বাজার, গঞ্জ, বন্দর, চৌকি ইত্যাদি থেকে সায়ের অর্থাৎ অকৃষিজ ব্যবসায়িক শুল্ক আদায় করতেন। নবাব নাজিমের কাজ ছিল রাজস্ব আদায়ে দেওয়ানকে সাহায্য করা। রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে কোথাও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে, এ কাজ সুসম্পন্ন করার জন্যে দেওয়ানির কর্মচারী/আমলাদের সহায়তা করা। এছাড়া বিশাল আয়ের দপ্তর দেওয়ানিতে কারচুপি তছরূপ আটকাতে আর জমিদার রায়তের ভূমিত্বের দলিল রাখার জন্যে একজন স্বাধীন বঙ্গাধিকারী কানুনগো নিযুক্ত হতেন – স্বাধীন বলা হচ্ছে কারণ তারা হিসেব মনোমত না হলে নবাবের মুখের ওপর জবাব দিয়ে দিতেন, কারণ তারা স্বাক্ষর না করলে কেন্দ্রিয় দেওয়ানি এই হিসেব স্বীকার করত না - মুর্শিদকুলি খাঁর সময় এরকম একটি ঘটনা ঘটে – রসুম বাবদ ৩ লক্ষ টাকা না পেলে কাননুগো দর্পনারায়ণ হিসেবে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। তাঁর অধীনে বিভিন্ন পরগণা পরগণায় কানুনগোরা এবং মৌজায় মৌজায় পাটোয়ারিরা দলিল আর হিসেব রাখতেন। কতগুলি মৌজা/গ্রাম নিয়ে পরগণা এবং অনেকগুলি পরগণা নিয়ে সরকার তৈরি হত। প্রত্যেক সরকারে নিজামতের এক ফৌজদার এবং দেওয়ানির এক আমিল শান্তিরক্ষা আর রাজস্ব/সায়ের আদায়ে নিযুক্ত থাকতেন। ফৌজদার হতে নির্দিষ্ট পদ আর সওয়ারের মনসবদার হতে হত। অনেক সময় প্রতিপত্তির জোরে ফৌজদার মাঝখানের জমিদার সরিয়ে আমিলের নেতৃতে বিশাল আমলা বাহিনী দিয়ে খাজনা আদায় করতেন। জমিদারি ছিল মূলত বংশানুক্রমিক। পরগণায় নির্দিষ্ট সংখ্যায় নির্দিষ্ট পরিমান পাইক রেখে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। এই কাজের জন্যে মালজমি আর সায়েরের খাজনার দশভাগ অর্জন করতেন। বিদ্রোহ না করলে বা রাজস্ব দেওয়ার কাজে গাফিলতি না করলে এদের বংশানুক্রমিক অধিকার খারিজ হত না। নিজামত আর দেওয়ানির আমলাদের মত জমিদার বা চৌধুরীরা সরকারি কর্মচারী ছিলেন না। এদের সাহায্যে জমির খাজনার একাংশ যেত কেন্দ্রিয় তহবিলে আরেক অংশ পেতেন মনসবদারেরা, নির্দিষ্ট সঙ্খ্যক সওয়ার আর জাট রাখার জন্যে জায়গীর হিসেবে। নিজামত বা দেওয়ানির প্রধান বহু সময় খালিসা থেকে নগদে বেতন পেতেন না হলে জায়গীরের আয় থেকে। এছাড়া ছিল বেশ কিছু নিষ্কর জমি যা নবাব সরকার বা জমিদারেরা মদদইমাশ, লাখেরাজ, খয়রাত, আয়মা, পীরোত্তর, দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, মহাত্রাণ, চাকরাণ, পাইকান ইত্যাদি নানান নামে নানান কাজে বিতরণ করতেন।

No comments: