Tuesday, October 16, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২ ১৩০০ বছর বাংলায় ছোটলোক-ভদ্রলোক ইতিহাস ছোটলোকেদের প্রাধান্য ধ্বংস করতে তৈরি হল লুঠেরা উপনিবেশ

<নাহ এবারেও বেরোতে পারলাম না, যেতে পারলাম না বৌদ্ধ ভদ্রলোকিয় ছোটলোক বিরোধী পড়াশোনার জগতে। এখনও ছোটলোকামিতে আটকে রইলাম>

আমরা দেবীপ্রসাদের খুব বড় অনুগামী নই, কিন্তু ছোটলোক সমাজের কৈবর্ত বিপ্লবের আঙ্গটপাত হিসেবে তিনি যে সিদ্ধদের ভূমিকা আঁচ করেছিলেন, স্বাভাবিককারণেই সেই সিদ্ধান্তটি আমরা ফেলে দিতে পারি নি। বড়লোকের ছোটলোক ঘেন্নার ১৩০০ বছর বুঝতে আমরা যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করছি, সেই আলোচনা গত বারের কিস্তিতে শেষ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু মনে হল সিদ্ধ কৈবর্ত বিপ্লবেরে প্রভাব বুঝতে সিদ্ধগুরুদের প্রাথমিক চরিত্র পরিচিতি দেওয়া দরকার যে পরিচিতি অভদ্র অকেন্দ্রিভূত অপুঁজিবাদী অসুশাসনীয়, সাম্যলক্ষণযুক্ত, ক্ষমতার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটলোকিয় অরাজক সমাজ তৈরির ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা পাবে। এই প্রাথমিক ধারণাটুকু না থাকলে বোঝা যাবে না সিদ্ধগুরুরা কোন অবস্থায় দার্শনিকতত্ত্ব এবং সাহিত্য রচনা করতেন, কিভাবে কৈবর্তদের প্রভাবিত করেছেন। বর্তমানে ছোটলোক বা অভদ্রসমাজ আলোচনায় আমরা একটা গুণগত কাজ প্রথমেই করে থাকি সেটা হল, ভদ্র সমাজ যে সবগুণগুলি দোষের মনে করে সেগুলি আমরা যারা ভদ্রসমাজ সঞ্জাত ভদ্রসভ্য মানুষ, তারা সেগুলি বাদ দিয়ে ভদ্র চরিত্রলক্ষ্মণগুলি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া - মানুষগুলি দেখতে ছোটলোক, কিন্তু কাজে চরিত্রে ভদ্রলোক। সেই ধারণা থেকেও আমাদের বেরোতে হবে সিদ্ধ আলোচনায়।
সেই লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধদের নাম নিয়ে আলোচনা করা যাক। আজও ভদ্রসমাজে সন্তানের নামকরণে তৎসম শব্দের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। আমরা যদি সিদ্ধদের নামের তালিকা করি, তাহলে দেখতে পাব অধিকাংশের আজকের ভাষায় ভাল নামবা প্রমিত নামনেই প্রত্যেকের নামকরণ হয়েছে বৃত্তিগত বা পেশাগত সংযোগের কারণে (এই তথ্য থেকে আরও একটা বিষয় প্রমান হয়, ছোটলোকেদের সে সময় মোটামুটি স্থায়ী বৃত্তি ছিল) যেমন তান্তিপা - তাঁতি, চমরিপা - চামার, তেলিপা - তেলি, কুমোরিপা - কমোর, ধোম্বিপা - ধোবি, কংপারিপা - কামার, মেদিনীপা - চাষী।। এছাড়াও তাদের আচার আচরণের ভিত্তিতেও নামকরণের ঝোঁক ধরাপড়ে লূইপা যিনি মাছের পোঁটা খেতে ভালবাসতেন, বীণাপা বীণা বাজাতেন, থকণপা যিনি লোক ঠকাতেন বা মিথ্যা কথা বলতেন, শালিপা যিনি শেয়াল বা নেকড়ে ভয় পেতেন, এক গৃহস্থপুত্রের নাম নগুণি অর্থাত যার কোন গুণ নেই, কুক্কুরিপা যিনি কুকুর ভালবাসতেন, দিংকপা যিনি ঢেঁকিতে ধান কুটতেন, দারিকপা বেশ্যার দ্বাররক্ষী ইত্যাদি।
এই সিদ্ধগুরুরা সক্কলেই কিন্তু নিজের স্বভাবে, কাজকর্ম করে, সেই কাজেও সার্থক হয়ে সিদ্ধ হয়েছেন। এরা ভদ্র সমাজের সন্ন্যাসীদের মত কেউ নিজের পোষাক ছাড়েন নি, কেউ প্রবজ্যা নেন নি, কেউ বনবাসেও যান নি, প্রবজ্যা, উপসম্পদা গ্রহণ করে মঠে মন্দিরেও মানসিক শান্তি খোঁজেন নি। অথবা ভদ্র সমাজের লেখক কবিদের মত এঁরা কেউই শুধুই লেখক ছিলেন না - এঁরা সক্কলে ভীষণভাবে নিজের বৃত্তিতে জীবিকা নির্বাহ করতেন। যেমন শবরিপা ব্যাধ, মীনপাজেলে, গোরক্ষপা রাখাল, খড়্গপা চোর, নারোপা শুঁড়ি, ছত্রপা ভিক্ষুক, ভন্ধোপা চিত্রকর, অচিন্ত্যপা কাঠুরে, মেকোপা মুদি, কোটলিপা মাটিকোপানো ব্যক্তি, যোগিপা চণ্ডাল, গোরুরপা পাখিমারা, পচরিপা পিঠে বিক্রেতা, কন্তিলিপা দির্জি, সরহপা শর তৈরিতে দক্ষ ইত্যাদি। শুধু পেশাই নই ভদ্র সমাজে যে সব চরিত্রগুলি গুণনীয়ক হিসেবে পরিচিত সত্য কথা বলা, মানুষকে না ঠকানো ইত্যাদিতেও তারা ভদ্রসমাজের গুণতির বাইরে ছিলেন। ঠকণপা মানুষ ঠকাতেন বা মিথ্যে বলতেন ইত্যাদি।
ওপরের পেশাগুলি লক্ষ্য করে দেখুন সেদিনও এই পেশাগুলি ভদ্রসমাজের পেশা ছিল না, আজও এগুলি কোনওভাবেই ভদ্রসমাজের পেশা হিসেবেও চিহ্নিত নয়। চুরাশিজন সিদ্ধর মধ্যে কুড়ি জনই স্পষ্টতঃ শূদ্র বলা হয়েছে। একমাত্র বিরূপাকেই তাঁর জীবনের প্রথম পর্বে সংঘারামে, কিন্তু সেখানে মদ খাওয়ার দোষে তিনি বিতাড়িত হন, এবং তারপরে মদ খাওয়ার মাত্রা বেড়েই চললে। ভদ্র সমাজের সঙ্গী হতে যে সব গুণ অর্জন করা দরকার হয়, তারা সে সব গুণের বাইরে ছিলেন। এঁদের দুচারজন যে ভদ্রসমাজের ছিলেন না তা নয়, কিন্তু সিদ্ধ হতে গিয়ে এদের প্রথমেই জাতিচ্যুত হতে সয়েছে। দিংকপা প্রথম জীবনে ছিলেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, মন্ত্রী সিদ্ধি লাভের জন্যে মদ বিক্রি করতে হয়েছে, ধান কুটতে হয়েছে কেন না ব্রাহ্মণত্বের অর্থাৎ ভদ্রত্বের মুখোশ খুলে তার ব্রাহ্মণত্বের অহংকার চূর্ণ করতে এই কাজগুলি করা প্রাথমিক কর্তব্য ছিল। রাজা ইন্দ্রপাল সিদ্ধ হবার জন্যে বারনারীর দাসত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তিনি বেশ্যার পা ধুইয়েছেন, শরীর মালিশ করেছেন, তারপর সিদ্ধ পদবাচ্য হয়ে দারিকপা হয়ে তার দ্বাররক্ষা করেছেন।

অর্থাৎ ছোটলোকত্বের একটা ধারা ছিল সেই ১৩০০ বছর আগে। এবং সেই ধারা সে সময়েই খুব শক্তিশালীও ছিল বলে মনে হয়। অর্থাৎ এটি খুব পুরোনো ঐতিহ্যের ধাবাহিকতা - ১৩০০ বছরেরও পুরোনো। ছোটলোকত্ব এতই জোরদার ছিল যে ছোটলোকামি করতে তাঁদের ভদ্রবেশ, ভদ্রপন্থার চরিত্রকে নানান প্রক্রিয়ায় ধুয়ে ফেলতে হয়েছে। ভদ্রলোকামির চত্ত্বরের বাইরে ছোটলোকামি একটি নির্দিষ্ট যাপন, যা নিয়ে একবারও ভদ্রসমাজ আলোচনা করে নি বরং তাকে ঘৃণা করে এসেছে এবং ভদ্রসমাজের বাইরে রেখে দিয়েছে। এই জন্যেই বলি তাতে ছোটলোক সমাজের কিছুই যায় আসে নি। তারাও দ্বিধাহীনভাবে ছোটলোকত্বকে দৃঢ করার জন্যে কাজ কাজ করে গিয়েছে।  

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - ১৩০০ বছর বাংলায় ছোটলোক-ভদ্রলোক ইতিহাস - ছোটলোকেদের প্রাধান্য ধ্বংস করতে তৈরি হল লুঠেরা উপনিবেশ

ভূমিকা
বাংলায় ভদ্রলোক-ছোটলোক লড়াই এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ভদ্রলোক প্রাধান্য শুধু ঔপনিবেশিক সময়ে শুরু হয়েছে ভাবলে ভুল হবে। ভদ্ররা বহুকাল ধরেই ক্ষমতার কাছাকাছি, ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবে থেকেই ছোটলোকেরা সমস্ত গণ্ডগোলের মূলে, এই ধারণাটি প্রত্যক্ষ্যে লিখিতভাবে লালন করছিল - উদ্দেশ্য ছিল ছোটলোকেদের প্রাধান্য হ্রাস। তাদের সে সাধ পূর্ণ হয় ব্রিটিশ সময়ে। ভদ্রলোকেদের ছোটলোকেদের ওপর রাজত্ব করার সাধ পূরণ করতে এই বিপুল বিশাল দেশকে উপনিবেশে পরিণত করতে হয়েছে, দেশকে সার্বিকভাবে লুঠপাত্রে অর্পণ করতে হয়েছে, দেশকে উত্তমর্ণ থেকে অধমর্ণে পরিণত করতে হয়েছে, উদ্বৃত্ত অর্থনীতিকে ধারের অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে লুঠেরা কর্পোরেট বৈদেশিক শক্তির সাহায্য নিতে হয়েছে।
অন্তত ১৩০০ বছর এই অশ্রদ্ধার ভদ্রলোকিয় লিখিত ইতিহাস। ব্রিটিশপূর্ব সময়ে সামাজিকভাবে ছোটলোকেদের প্রাধান্য ছিল। সামাজিকভাবে কেন বলছি, উপনিবেশপূর্ব সময়ে রাষ্ট্র সরাসরি সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় খবরদারি করতে পারত না - ক্ষমতার কাছাকাছি না থেকেও, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ্য সাহায্য না নিয়ে ছোটলোকেরা গড়ে তুলেছিল ব্যপ্ত উৎপাদন ব্যবস্থা বিপুল বাণিজ্য চক্র অসাধারণ জ্ঞানচর্চার ধারা আর উদ্বৃত্ত অর্থনীতি। ভদ্ররা ক্ষমতায় বসে থেকেও রাষ্ট্রের বাইরে থাকা, রাষ্ট্রের ভর্তুকি না নেওয়া ছোটলোকেদের দেশের অর্থনীতিতে জ্ঞানচর্চায় প্রাধান্য দেখছে অসহায়ভাবে। রাগে গা কষকষ করছে। কিচ্ছু করা নেই। শশাঙ্ক থেকে নবাবি আমল পর্যন্ত রাষ্ট্রনায়কেরা কেউই ক্ষমতার কাছে থাকা ভদ্রলোকেদের ছোটলোক দলনের দাবি পাত্তা দ্যান নি। তাই ছোটলোকেদের ওপরে খুব বড় অত্যাচার নেমে আসে নি।
জানি, "অত্যাচার নেমে আসে নি" বাক্যবন্ধটা শুনে অভ্রান্তভাবে বলবেন পাল আমলে কৈবর্ত লড়াই। সে সময় রাষ্ট্রের ক্ষমতা যেহেতু সীমাবদ্ধ ছিল সামগ্রিক সমাজব্যবস্থায়, রাষ্ট্রপতিরা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে যতদূর সম্ভব বাঁচিয়ে রাখতে চাইতেন। আওরঙ্গজেবের সময় কৃতি আলোচনায় অড্রে ট্রুস্কে যেমন বলেছেন রাষ্ট্রের ক্ষমতার ওপর হাত পড়লে আওরঙ্গজেব যে কোন সমাজের ওপর আগ্রাসীরূপে খড়্গহস্ত হতেন, - তিনি গোলকুণ্ডা আর বিজাপুরকেও ছেড়ে কথা বলেন নি তেমনি পালেদের সিংহাসন চ্যুত করায় রামপাল কৈবর্তদের ওপরে আক্রমন নামিয়ে এনেছিল। তার বেশি কিছু নয়। সামাজিকভাবে ছোটলোকেরা সে সময় এতই প্রভাবশালী ছিল, সমাজের কর্তৃত্বে হাত দেওয়ার খুব বেশি অধিকার ছিল না রাষ্ট্রের। ছোটলোকেরা এতই ক্ষমতাশালী ছিল যে সামুহিক পাল রাজত্ব উচ্ছেদ করার অবস্থায় তারা পৌঁছে যায়। উৎপাদন এবং ব্যবসা বাণিজ্যের মূলগত অধিকার ছিল চাষী-বৈশ্য-শূদ্র-মুসলমান-আদিবাসী কারিগরদের। রাষ্ট্রও তাদের পোষণ করত।রাষ্ট্র কর্তারা জানত ছোটলোকেদের রাজস্ব তাদের খাওয়ার জোগায়। চরম ঔরঙ্গজেব বিরোধী যদুনাথ সরকার মুঘল এডমিনিস্ট্রেশনে এ কথা বলেছেন।
তাই ভদ্রলোকেরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে আক্রমন চালিয়েছেন ছোটলোকদের ওপরে তাত্ত্বিকভাবে - কখোনো রেগেমেগে গ্রাম ব্যবস্থাকেও। তাই কেন বলছি ভদ্রলোকদের ছোটলোক বিরোধিতার ইতিহাস ১৩০০ বছরের, সেটার ধাপগুলি কি কি ছিল তাও বুঝে নিতে চাই। প্রথমটি - সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত। দ্বিতীয়টি ভদ্রলোকনির্ভর বুদ্ধ জ্ঞানচর্চা। তৃতীয়টি শ্রীচৈতন্যের পরিকরদের লিখিত চৈতন্যভাষ্যে বলানো তাত্ত্বিকভাবে গ্রাম বিরোধিতা। সব শেষে ঔপনিবেশিক আমলে ভদ্রলোকেদের(শুধুই ব্রাহ্মণদের নয় - ব্রাহ্মণ্যবাদ নয় ভদ্রলোকবাদ) হাত দিয়ে কারিগর উতপাদন কাঠামো ধ্বংস এবং তাদের অধিকার হরণ; মার্ক্স আর তাঁর অনুগামীদের লেখনিতে গ্রামকে, গ্রাম্যতাকে উপহাস এবং দেশের সমস্ত অনাচারের কারণ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া - তার ফল স্বাক্ষরতা কর্মসূচী(অক্ষর জানাকেই শিক্ষার চরমধাপ দাগিয়ে দেওয়া - দেশের এত নিরক্ষর নিয়ে কি করে যে বিশ্বের[আদতে ইওরোপ আমেরিকার] কাছে মুখ দেখাব বুঝতে পারি না জাতীয় খেদ), ল্যাবটুফিল্ড কর্মসূচী(গ্রামীন উৎপাদন ব্যবস্থায় কর্পোরেট যান্ত্রীকরণের প্রকল্প), স্বাস্থ্যবিধান কর্মসূচী(গ্রামীন পরিবেশই অস্বাস্থ্যের মুল), নারী সশক্তিকরণ(গাঁইয়ারাই মহিলাদের দাবিয়ে রেখেছে, তাদের মধ্যবিত্তাকারে গড়ে তোলার প্রকল্প[আমরা ভুলে যাই ভদ্রদের সমাজে বিধবা বিবাহ দিতে আর বিধবা পোড়ানো রোধে বিপুল সংগ্রাম করতে হয়েছিল - আজও এই সমাজে অধিকাংশ নারী পরনির্ভর, বরং গ্রামীনে মহিলারা গায়েগতরে খাটেন]) ইত্যাদি।
Top of Form
উপমহাদেশের ইতিহাসে বাঙালি ভদ্রলোকেরা সরাসরি নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিল লিখিতভাবে পাল আমলে। সন্ধ্যাকর নন্দী কৈবর্ত বিজয় উপলক্ষ্যে লিখলেন রামচরিত। এই কাব্যে তিনি সরাসরি বলে দিলেন রাজারা এবং তাদের সঙ্গী ভদ্রলোকেরা ক্ষমতায় না থাকাতেই মাৎস্যন্যায় অবস্থা তৈরি হয়েছে। সামগ্রিক এই অবস্থাকে তিনি বলছেন অরাজক অবস্থা, ঠিক সেই শব্দগুলি ধ্বনিত হবে নন্দীগ্রাম আমলে ভদ্রলোক বামেদের আর্তিতে।
বিগ্রহপালের পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল অত্যাচারী শাসক ছিলেন। সে সময় বারেন্দ্রে প্রজা বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন কৈবর্তরাজ দিব্বোক। বাসিন্দা ছিলেন ধামর(ধামরাই) থানার মঙ্গলবাটির। দ্বিতীয় মহীপাল দিব্বোকের বোন চন্দ্রমতীকে হরণ করে নীতপুর প্রমোদ ভবনে নিয়ে যান। দিব্বোক ছিলেন নৌসেনাপতি। বরেন্দ্রর সামন্তরা প্রকাশ্যে দিব্বোকের পাশে দাঁড়িয়ে রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধে দ্বিতীয় মহীপাল নিহত হলেন। শুরু হল ক্ষণস্থায়ী কৈবর্ত রাজ। দিব্বোকের নেতৃত্বে যে স্থানে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল কৈবর্ত বিপ্লবীরা সেটি এখন বাংলা দেশের নওগাঁ জেলার দিবর বা ধীবর গ্রামের সোনাডাঙ্গা মাঠ। দিবর দীঘি আজও আছে। দীনেশ চন্দ্র সেন বৃহতৎ বঙ্গতে লিখেছেন – “কৈবর্তরাজ ভীমের খুল্ল পিতামহ দিব্বোক দ্বিতীয় মহিপাল কে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করিয়া বিজয়োল্লাসে যে স্তম্ভ উথ্থাপিত করিয়াছিলেন তাহা এখনও রাজশাহী জেলার এক দীঘির উপরে মস্তক উত্তোলন করিয়া বিদ্যমানতার মৃতুর পর ভাই রুদ্রোক রাজা হন। রুদ্রোকের পর ভীম সিংহাসনে বসেন। দিনাজপুরের আশেপাশে ভীমের জাঙ্গাল, ভীম সাগর, ভীমের পাণ্ঠী ইত্যাদি ভীমের স্মৃতি আজও বহন করছে। সারা বাংলায় ভীমের পুজো করেন কৈবর্তরা আজও।
সন্ধ্যাকরনন্দী নিজে দ্বিতীয় মহীপালের উচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন এবং এই বিপ্লব নিজের চোখে দেখেছেন এবং লিখেছেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থ্যায় মাৎস্যন্যায় এবং অরাজক তত্ত্বের স্রষ্টা। বাঙালি (ইংরেজি)শিক্ষিত ইওরোপধন্য ভদ্রমধ্যবিত্তের ভাষায় অরাজক বলতে বোঝায় শশাঙ্ক পরবর্তী এবং পাল রাজাদের সিংহাসনে ওঠার মাঝখানের মাৎস্যন্যায় অবস্থা। মাৎস্যন্যায় শব্দটির যে অর্থ সন্ধ্যাকর নন্দীর লেখায় পাই সেটি হল, বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে গিলে খায়। এটি তিনি অক্লেশে রামচরিতএ ব্যবহার করেছেন। বৌদ্ধ আমলের খালিমপুর তাম্র শাসনেও এই শব্দটি একই অবস্থা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।ঐতিহাসিকেরা বলছেন ২৫ বঙ্গপূর্বাব্দে (ঔপনিবেশিকদের লব্জে ৬২৫ খৃ) শশাঙ্কের মৃত্যুর পর আর পালেদের রাজত্বের আগে, বাংলায় কেন্দ্রিয় ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। তারানাথও বহু পরে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে সে সময়ের বাংলা নিয়ে একই মন্তব্য করেছেন।
শশাঙ্কের পরে প্রায় দেড়শ বছর বাংলায় ভদ্রলোকের শাসন ছিল না - তাই আতঙ্কিত ভদ্রলোকেরা একে মাতস্যন্যায় আখ্যা দিচ্ছে - কারণ তার টিকে থাকার দণ্ড সরকারেরই অস্তিত্ব নেই। ছোটলোকেদের সে সমস্যা নেই। তার সমাজ আছে। তার উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যবসা বাণিজ্য সবই চলেছে রাষ্ট্র ছাড়াই। এবং সে সময়েও বাংলা উদ্বৃত্ত অর্থনীতি ছিল। তাকে ঠেকনা হিসেবে ভদ্রবিত্তের মত রাষ্ট্রকে পাশে রাখতে হয় নি।
অলকা চট্টোপাধ্যায়ের চুরাশি সিদ্ধর কাহিনী নামক বইএর ভূমিকা লিখতে গিয়ে ছোটলোকেদের সিদ্ধ আন্দোলন এবং কৈবর্ত বিদ্রোহের সঙ্গে যে সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিলেন অলকার অর্ধাঙ্গ দেবীপ্রসাদ তাকে ফুতকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন দুই বাম ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা এবং নীহাররঞ্জন রায়। এ প্রসঙ্গে আমাদের এক যুবা প্রাজ্ঞ বন্ধু বলেছিলেন দেবীপ্রসাদ মূলত দার্শনিক, তিনি এই দুজনের কাজে তার ধারনার প্রতিষ্ঠা নিতে গিয়ে ভুল করেছিলেন। আমরা ছোটলোকেরা বিশ্বাস করি দেবীপ্রসাদ তার সিদ্ধান্তে সঠিক ছিলেন।

কেন সেটা বলব পরের অংশে। এবং সেখান থেকে ভদ্রলোকনির্ভর বুদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় যাব। পাল সরকার পোষিত ভদ্রবিত্তের বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চায় প্রবেশ করার আগে আরেকটু ছোটলোক কৈবর্ত আন্দোলন নিয়ে বাগবিস্তার করা যাক।
ভদ্রবিত্তের সরকার পোষিত ভদ্রবিত্তের বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চায় প্রবেশ করার আগে আরেকটু ছোটলোক কৈবর্ত আন্দোলন নিয়ে বাগবিস্তার করা যাক।
সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিতে স্পষ্ট দেখিয়েছেন কিভাবে উতকোচ দিয়ে নানান সামন্তকে হাত করে কৈবর্ত সরকারকে উচ্ছেদ করল পাল রাজত্ব। অতীত উপমহাদেশে অধিকাংশই শূদ্র রাজা ছিলেন এবং তাদের বংশপরম্পরাও তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শূদ্ররা সামুহিকভাবে লড়াই করে সাম্রাজ্য দখলে নিচ্ছে এ ইতিহাস খুব বেশি নেই। সেই অর্থে কৈবর্ত রাজত্ব সকলের থেকে আলাদা চরিত্রের। ঠিক, সেনাপতি হরির বিশ্বাসঘাতকতায় রাজ্য হারাতে হয় শূদ্রদের, কিন্তু কৈবর্ত রাজত্ব উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ায় গোটা কৈবর্ত সমাজ উচ্ছেদ হয়ে যায় নি। সারা বাংলা জুড়ে আজও দিব্যোক, ভীমেদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কৈবর্ত লড়াই ঔপনিবেশিক পাঠ্য পুস্তকে হয়ত হালে ঠাঁই হয়েছে, কিন্তু তাতে তার কিস্যু যায় আসে না। তারা রয়েছেন জনগণের স্মৃতিতে।
কৈবর্ত রাজত্বের ভিত্তিভূমি ছিল সিদ্ধ আন্দোলন। অলকা চট্টোপাধ্যায়ের চুরাশি সিদ্ধর কাহিনী বইটিতে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কৈবর্ত বিদ্রোহের সঙ্গে সিদ্ধ আন্দোলনের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন একটি সংযোজিত প্রবন্ধে। নিচের লেখাটি সেই প্রবন্ধ ভিত্তি করে তৈরি।
দেশের যে অঞ্চলে - বিশেষ করে উত্তরবাংলায়, যে যুগে সিদ্ধ আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করেছিল, মোটের ওপর সেই অঞ্চলেই স্বল্প ব্যবধানে ঘটেছিল কৈবর্ত বিপ্লব - এ তথ্য আজ পরিষ্কার। শুধু এইটুক নজির থেকে সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া বৃথা কি না এই প্রশ্ন তুলে দেবীপ্রসাদ বলছেন একটা বিরাট গণভ্যুত্থানের জন্যে মতাদর্শগত জমি তৈরি করাটাও জরুরি কাজ ছিল। সিদ্ধ আন্দোলন পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে কৈবর্ত বিপ্লবের জমি দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুত করে তুলছিল কি না এই নিয়ে দেবীপ্রসাদ ভেবেছেন। তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুলছেন, "সে জিজ্ঞাসাটা পেশ করা কি খুবই অবান্তর হবে?"
কয়েক মাস আগে আমরা এই ফেবুতে কৈবর্ত বিপ্লব বিষয়ে একটি ভূমিকা লিখেছিলাম - ফলে কৈবর্তি বিপ্লব কী এবং তার পটভূমি এবং ভীম দিব্যোক ইত্যাদি আর আজও দিনাজপুরে শুধু নয় বাংলা জুড়ে তাদের নানান স্মৃতি নানা ভাবে ছড়িয়ে আছে বলেছিলেন বন্ধু Md Makim Makim এবং যদি স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে, তাহলে সুব্রত ঘোষও। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত আবিষ্কার করার পর ঐতিহাসিক মহলে টনক নড়েছিল। উত্তরবঙ্গে কৈবর্তদের নেতৃত্বে প্রকৃতিপুঞ্জ একটি বিশাল ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। ভারতজয়ী মহীপালের বিশাল ব্যাপক সেনা বাহিনী বিশাল প্রজাপুঞ্জের তীর-বল্লম-ধনুকের খোঁচায় ছত্রভঙ্গ হল। মহীপাল প্রজাপুঞ্জের হাতে নিহত হলেন। হঠকারী মহীপালের পর রামপাল নানান রাজা সামন্তদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে এই বিপ্লব দমন করেন।
সঙ্গত কারণেই দেবপ্রসাদ কৈবর্তদের নেতৃত্বে ছোটলোকেদের রাজ ক্ষমতা দখলকে বলছেন গণবিপ্লব। তার নিশ্ছিদ্র অনুমান এই গণবিপ্লবের ভিত তৈরি করেন সিদ্ধ বিপ্লবীরা। সেই মতের প্রতিষেধক তৈরি করেন রাজারা দেশজুড়ে পাইকারি হারে বিশাল বিপুল বৌদ্ধ মঠ, বিহার, মন্দির স্থাপন করে। ধর্ম প্রচারকদের জন্য তারা দেদার খরচ করেছেন রাজকোষ থেকে। পাল রাজারা যে বিশুদ্ধ মহাযান পন্থী(উতপন্নক্রম সম্পন্নক্রম প্রভৃতি কর্মফলবাদী আলোচনায় ঋদ্ধ) ছিলেন তাই নয় তারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের যাগযজ্ঞের ব্যাপারেও খুব বেশি উদাসীন ছিলেন না। বিক্রমশীল বিহারে তারানাথের বলি, আচার্য বা হোম আচার্যের বিপুল রাজকীয় বর্ণনা শেষে বলছেন রাজত্বের পরমায়ু যাতে সুদীর্ঘ হয় তার জন্য বিপুল রাজকীয় যজ্ঞ করেছিলেন যার জন্য ন লক্ষ দুহাজার রৌপ্যমুদ্রা খরচ করেন।
পাল আমলের শেষাশেষি অবস্থা সামাল দিতে রাজ শক্তির পক্ষে অবলোকিতেশ্বরের মৈত্রী, করুণা, বোধিচিত্ত উতপাদনী মহাযানী জীবনাদর্শ প্রচারে বিশাল ব্যাপক আয়োজনের সাক্ষী হচ্ছে বিশাল ব্যাপক লক্ষ লক্ষ শ্রমণওয়ালা মঠ, বিহার মহাবিহার।
ঠিক উল্টো দিকে বিপুল গণ অভ্যুত্থান যার চোটে প্রথমে রাজশক্তি মারখেলো এবং তাকে দমন করার জন্য পালরাজাদের নিজস্ব বাহিনীর শক্তিতে কুলোলো না আশেপাশের শাসক শক্তির দ্বারস্থ হতে হল।
ফলে বোঝা যাচ্ছে সে যুগে ছোটলোক কারিগরেরা শুধুই জোড় হাতে অনন্ত করুনার আধার অবলকিতেশ্বরের পায়ে মাথা কোটে নি, তীর ধনুক বল্লমের দিকে হাত বাড়িয়েছিল - সন্ধ্যাকর নন্দীর কথায় মোষের পিঠে চেপে অস্ত্র হাতে রাজ সেনা আর সুশিক্ষিত যুদ্ধ কুশল হাতি-ঘোড়ার পালকেও উৎখাত করে ছেড়েছিল।
এই উৎখাতটা সম্ভব হত না যদি না মতাদর্শের জোরটা কৈবর্তদের নেতৃত্বে ছোটলোকেদের থাকত। রামশরণ শর্মা স্পষ্ট দেবপ্রসাদকে বলেছিলেন সরাসরি সম্পর্কের কোন নজির না-দেখানো পর্যন্ত আপনার বক্তব্যে ঐতিহাসিক সাড়া পাবেন না।
কিন্তু কোথায় নিদর্শন? একমাত্র রামচরিত, যেটাকে দেবীপ্রসাদ বলছেন চাটু-পটু লেখা, রামপালকে স্বয়ং রামের সঙ্গে তুলনা করছেন সন্ধ্যাকর, এবং রামের রাজত্ব উদ্ধারের গল্পর ছায়ায় লিখছেন রামপালের পিতৃ রাজত্ব উদ্ধারের কাহিনী। কবির প্রধান উদ্দেশ্য রামপালের কৈবর্ত বিপ্লব দমনের গান গাওয়া। সেখানে কৈবর্তদের পক্ষে কোন তুচ্ছ সাফাই গাওয়ার সুযোগও ছিল না।
অথচ নীহাররঞ্জন সিদ্ধ আন্দোলন আর কৈবর্ত বিপ্লবের মধ্যে সান্নিধ্য সম্পর্কে দেবীপ্রসাদকে প্রশ্রয়ের সুরে বলছেন জিজ্ঞাসা যখন জেগেইছে, তখন একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টায় বাধা কী? কিন্তু রামশরণ শর্মা বলছেন না সে কথা, তিনি পাথুরে প্রমান চাইছেন। সে বাধা দূর হল তার স্ত্রী বিদূষী অলকা চুরাশীতি-সিদ্ধ-প্রবৃত্তি মূল তিব্বতী থেকে বাংলায় অনুবাদ করায়।
তিনি বলছেন সমাজের ওপরের উপরতলার শাসক সম্প্রদায়, যার মধ্যে ভদ্রলোকেরাও পড়ে, ছোটলোকেদের যে-সব জীবিকা-উপায়কে হেয় ও হীন বলে প্রচার করত যেই বৃত্তিগুলোকে প্রকৃত মর্যাদা দেওয়ার প্রয়াস চুরাশি সিদ্ধ। দেবীপ্রসাদ বলছেন, তাঁতি-জোলা-জেলে-চাষ-কুমোর-কামার সকলেই আত্মবিস্বাস ও বৃত্তিগত প্রত্যয় সৃষ্টির প্রয়াস এই চুরাশি সিদ্ধর দর্শন(আমরা সামান্য ভিন্নমত প্রয়াসী - পেশা নিয়ে প্রত্যয় ছোটলোকেদের সেদিনিও ছিল, আজও আছে - ভদ্রবিত্তের মত পেশার গ্ল্যামার যোগ করার প্রয়োজন হয় না তাদের। সিদ্ধরা তাদের আন্দোলনের খুঁটির কাজ করেছিলেন)। যদিও এই তত্ত্বের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ছকে বাঁধা মহাযানমতের জোলো সংস্করণ - কিন্তু সহজ সাধারণ জীবনে প্রত্যয় তৈরি করতে পারলে কি যে ঘটনা ঘটে তা দেখেছিল পাল সাম্রাজ্য।
মুল ঘটনার বহু পরে লিখিত চম্পারণের জনৈক অভয়দত্তশ্রী বর্ণনা করেছিলেন চুরাশি সিদ্ধদের নাম। ফলে ছোটলোক সিদ্ধদের বা তাদের চর্যার নাম পাল্টানোর সুযোগ ছিল না - কিন্তু তিনি বলছেন আধা-তান্ত্রিক, আধা-মহাজনী মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল... চুরাশীতি... কি তারই নমুনা? প্রশ্ন করছেন দেবপ্রসাদ। একটা গণঅভ্যুত্থানের মতাদর্শগত প্রস্তুতি কী ভাবে ধামাচাপা পড়তে পারে তারই নমুনা বলে সন্দেহ হয় না?
এই বিতর্কটা বন্ধুদের সামনে পেশ করলাম।

দেবীপ্রসাদের এই সূত্র ধরে আগামী কিস্তিতে বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চায় ঢুকব।