(From http://chorchapod.blogspot.com)
পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে লেটো গানের প্রচলন হয়েছিল মূলত মুসলিম সমাজে। বিনোদনের জন্যেই শ্রমজীবী কৃষিজীবী মুসলমানরা লেটো গানের প্রবর্তন করেছেলেন। লেটো গানের আগে এবং লেটো গানের সমকালেও অন্য যে-সব লোকগান প্রচলিত ছিল সেগুলো হল- সত্যপীরের গান, ফকিরী গান, বেহুলার গান, জারি, মরমিয়া, মানিক পীরের গান, ইমামযাত্রা, কবি ও তরজা প্রভৃতি গান। কাজী নজরুল ইসলাম ওরফে দুখু মিয়া ক্রমে এসব গানের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, পাড়ায় বা মাজারের পাশে যখন ফকিরী গান বা সত্যপীরের গানের আসর বসতো তখন দুখু ময়িা উপভোগ ছাড়াও নিজেও সুর করে পুথি পাঠে অংশ নিতেন। মনোরঞ্জন করতেন দর্শকদের সংসারে ছিল অভাব-অনটন। আর এজন্যে মক্তব পাঠ শেষে তাকে পাড়ার মসজিদে ইমামতি করতে হতো। খাদেমগিরি করতে হতো হাজী পাহলোয়ানের মাজারে। শুধু তাই নয়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিলাদ পাঠ করেও অর্থ উপার্জন করতে হতো। অর্থ উপার্জনের বিশেষ অবলম্বন বাদ দেয়ার পর একই সমাজে, একই সময়ে প্রচলিত অন্যান্য গানে আগ্রহী না হয়ে দুখু ময়িা কেনো লেটোদলে যোগ দিয়েছিলেন, প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ‘নাচ-গান-নাট’-কে প্রাচীনকালে বলা হতো নাটগীত। খারাপ ও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে ‘নাটগীত’ বলা হত। নাটগীত ও নট থেকে যে, লেটো গানের উৎপত্তি তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন দুখু মিয়ার লেটো গানের সংকলক ও সম্পাদক, মুহম্মদ আয়ুব হোসেন। তাঁর বর্ণনা তুলে ধরছি, গ্রাম্যজনের মুখে, গ্রাম্য ছড়ায়, প্রবাদ-প্রবচন ও গ্রাম্য মেয়েলী গীতে ‘নট’ ‘নেটে’ ‘নটী’ ও ‘নাটুয়া’ ইত্যাদির উল্লেখ আছে। পুরাতন আঙ্গিকে নতুন ধারায় এই গান শুরুর সময় এর নির্দিষ্ট কোন নাম ছিল না। যারা এই শ্রেণীর নাচ-গান নাটক করতো, তাদের বলা হতো ‘নট’ ‘নাটুয়া’ ইত্যাদি। এই শ্রেণীর গানকে গ্রাম্যলোকে বলতো ‘নাটুয়াদের গান’। পরে ‘নাটুয়াগান’। আরও পরে নাটয়া গান> নেটুয়া গান> নেটু গান> নেট গান> নেটো গান> লেটো গান এইভাবে এর নাম হয়ে গেল নেটো বা লেটো গান।” লেটো গানের কলাকৌশল পুরাতন কিন্তু ধারাটি তখন নতুন আর এই নতুন ধারার গানের জনক কে বা প্রথম কার চিন্তা-ভাবনায় এসেছিল বিষয়টি- তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রথমে অ-সংগঠিতভাবে চলছিল লেটো গান। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যে দু’জন লেটোগানকে অসংগঠিত পর্যায় থেকে অনুশীলনের পর্যায়ে এনে সুশৃঙ্খলরূপে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম কাজী পরিবারের একজন। তিনি দুখু মিয়ার বাবা কাজী ফকির আহমদের আপন চাচাতো ভাই কাজী বজলে করীম। তিনি শিক্ষিতও ছিলেন। তিনটি ভাষা আরবি, ফারসি ও বাংলায় তার দক্ষতা ছিল। তিনি নিজেই লেটো গান রচনা করতেন। অর্থাৎ গান- সং, পালা তিনিই রচনা করতেন। তাছাড়া দলের কবি গান তিনি নিজেই গাইতেন। তাকে দলের গোদা কবিও বলা হতো। দলের মূল কবিই মূলত গোদা কবি।
চুরুলিয়া নিমশা-ফকির বৈদ্যনাথপুরের লেটো গানের অনুকরণীয় মানুষ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
দুখু মিয়া তাঁর চাচা কাজী বজলে করীমের সহযোগিতায় লেটোর দলে যোগ দিয়েছিলেন।
আরও একটি বিশেষ কারণ ছিল, আর সে কারণই প্রধান। লেটোর দলের অধিকাংশ শিল্পীরা ছিল মূলত কিশোর। বয়স্কদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো নয়। লেটো গানের দলে কিশোরদের অংশগ্রহণ থাকতে হতো আর যে সব কিশোর লেটোর গানে অংশ নিতো তারা ব্যাঙাচি’ নামে পরিচিত হতো।
লেটোর দলে কিশোরদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত ছিল বলেই দুখু মিয়া অন্যান্য গানের দলের প্রতি আগ্রহী না হয়ে লেটো দলে যোগ দেন। অবশ্যই অর্থ উপার্জন ছিল মুখ্য বিষয়।
লেটো গানের পরিবেশনায় ছিল- ‘ছোট ছোট’ প্রেমগীত, ডুয়েট, ইলামী গান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান, চাপান- উতোর সং এবং বিভিন্ন ধরনের পালা।
নিমশা গ্রামে লেটো গানের দলটির পরিচালক, গোদা কবি ও ওস্তাদ ছিলেন কাজী বজলে করীম। তার সহযোগিতা-প্রশিক্ষণ পেয়ে দুখু মিয়া নাচ-গান-অভিনয়ে এবং বাদ্যযন্ত্রেও দক্ষ হয়ে ওঠেন। জানা যায়, বজলে করীম গানে সুরারোপ, সং ও পালা পরিচালনা এবং অভিনয় পদ্ধতি দেখিয়ে দিতেন। বজলে করীম হয়ে ওঠেন দুখু মিয়ার লেটো গানের গুরু।
লেটো গানে কিশোররা মেয়ে সেজে নাচ করে। তাদের বলা হয় বাই, ছোকরা ও রাঢ়। রাজকন্যা বা রাণী সাজে যারা তাদের বলা হয় রাণী। পাঠক বলা হয় যারা রাজা, মন্ত্রী, রাজপুত্র ও সেনাপতি সাজে। আর যারা নাচ, গান, অভিনয় ও সংলাপ ইত্যাদির দ্বারা দর্শক-শ্রোতাদের হাসায় তাদের বলা হয় সংদার বা সঁংগাল।
দুখু মিয়া ছোকরা সেজে গানে অংশ নিতেন কিনা এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। তবে সং সেজে যে নাচ-গান অভিনয় করে মানুষ হাসাতেন তার তথ্য রয়েছে।
কবি স্বভাব তার কৈশোরেই উন্মোচিত হতে দেখা যায় লেটো গানে। বেঙাচি হিসেবে দলে আবির্ভাব ঘটলেও দুখু যখন পাল্লাপাল্লি লেটোর গানের আসরে বিপক্ষের গোদা কবিকে হারিয়ে দিতেন, তা দেখে তাঁর চাচা লেটো গুরু বজলে করীম বলতেন, দুখু ‘বেঙাচি নয় গোখরো’, কিছুদিনের মধ্যেই গুরুর উৎসাহে ও দলের প্রয়োজনে দুখু রচনা করেন বিভিন্ন পালা, রচনা করেন, ‘প্রেম গান, ইসলামী গান, ডুয়েট গান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান। হাসির গান ও অন্যান্য গান, হাস্যরসাত্মক সং।’ শুধু তাই নয়, “তাঁর অন্য আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তা হলো সং ও পালার সঠিক স্থানে। সঠিক রসের গানের সংযোজন। এসব গান তিনি নিজেই রচনা করতেন। যার জন্য সং ও পালাগুলো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো। লেটোর আসরে হাস্যরসাত্মক নাট্যশ্রিত গান এবং এক মুখো কমিকের প্রচলন তিনি করে গিয়েছিলেন।”
বয়সের ভারে বজলে করীম দল ছাড়ার আগে দুখু-কে লেটো দলের ওস্তাদ পদে নিযুক্ত করেন। ওস্তাদ হবার পর তাঁর লেটো দলে আসে নতুন করে গতি।
এ ব্যাপারে সমালোচক যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘ওস্তাদের পদ গ্রহণ করে তাঁর পরিচালিত লেটো দলকে ঢেলে সাজালের তিনি। নানা ঢঙের লেটো গান, নানা রসের সং, হাস্যরসাত্মক- করুনরসাত্মক একমুখো কমিক এবং নানা স্বাদের পালা রচনা করে, পুরাতন-নতুন লেটো শিল্পীদের নিয়ে অনুশীলন শুরু করলেন তিনি।ঃ সুর যোজনা, অভিনয়, পরিচালনা ও বাজনার ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে, তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায়, লেটো গান সু-সংবাদ, সু-সমৃদ্ধ হল ও পূর্ণতা লাভ করলো।” লেটো দলের নবাগত শিল্পী হিসেবে বেঙাচি’ হয়ে অংশ গ্রহণ ছিল দুখুর। ওস্তাদ হয়ে দল পরিচালনার পর তাকে ক্ষুদে ওস্তাদ’ উপাধি দেওয়া হয়। জানা যায়, ‘এ উপাধি তিনি পেয়েছিলেন, বীরভূম জেলার দুবরাজপুরে, গ্রাম্য মেলার এক লেটো গানের আসরে।’
তারপর তিনি লেটো গানের জন্যে উপাধি পান ‘ভ্রমর কবি বা ভোমর কবি’ হিসেবে। মুহম্মদ আয়ুব হোসেন এ ব্যাপারে জানিয়েছে লেটো দলে ওস্তাদ রূপে বরিত হয়ে, লেটো শিল্পীদের দ্বারা এই উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। দুখু মিয়ার সমসাময়িক লেটো শিল্প শেখ আব্দুল ওয়াজেদ মাস্টার, শেখ আব্দুল লথিব, শেখ মুবাই সংদার ও এদের পরবর্তী আলী আহমদ দফাদার ইত্যাদি আমাকে এই নামকরণ ও তার দুইটি ব্যাখ্যার কথা শুনিয়েছেন। প্রথমত ভ্রমর ফুল হতে মধু আহরণ করে তা জমা করে মৌচাকে। আমরা সেই মিষ্টি মধু পান করি।
ভ্রমর কবির রচিত গান-সং পালাগুলো মধুর মতই মিষ্টি, সেগুলো জমা হয় লেটো গানের দলে, আর মানুষ গীত অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তা আস্বাদন করে। দ্বিতীয়ত ভ্রমরের হুল খুব সূক্ষ্ম আর তার জ্বালা বৃশ্চিক ইত্যাদির মত নয়। লেটো গানের আসরে বিপক্ষ দলের প্রতি যে চাপান গান ও সং গীত-অভিনীত হত তা মিষ্টি। অর্থাৎ তার চাপান গান ও সং মিষ্টি মাখা হুল।’
দুখু তার অল্প বয়সের ‘ভ্রমর কবি’ উপাধিকে গ্রহণ করেছিলেন ভিতর থেকেই। গৌরববোধও করতেন তার উপাধি নিয়ে। আর সে কারণেই হয়তো তার একটি গানে ভ্রমর কবি ভানতা যুক্ত পঙক্তি পাওয়া যায়। যদিও নজরুল তার বিখ্যাত একটি গানের শেষে ভ্রমর’-এর স্থলে গাঁথিস’ শব্দটি ব্যবস্থার করেছেন। গানটির প্রথম কলি “চেয়োনা সুনয়না আর চেয়োনা এনয়ন পানে।” মুহম্মদ আয়ুব হোসেন তার গ্রন্থে তথ্যসহ দেখিয়েছেন দুখু মিয়া গানটি লেটোর গানে পরিবেশনের জন্যে লিখেছিলেন। গানটির প্রথম ও শেষে দুই পঙক্তি করে চারপঙক্তি উল্লেখ করা হলো:
চেয়োনা সুনয়না আর চেয়োনা, এনয়ন পানে।
জানিতে নাইকো বাকি সই ও আঁখি কি জাদু জানে ।।
মিছে তুই কথার কাঁটায় সুর বিঁধে হায় রে ভ্রমর কবি।
বিকিয়ে জায়রে মালা, আয় নিরালা আঁখির দোকানে।।
বর্তমানে গানটির ‘ভ্রমর’ শব্দের স্থলে ‘গাঁথিস’ ব্যবহৃত। গানটি যে লেটোর গানের জন্যেই রচিত এ ব্যাপারেও মুহম্মদ আয়ুব হোসেনের দেয়া তথ্য এরকম ‘এই গানটি আছে, কবির লেটো জীবনের বন্ধু, চুরুলিয়া নিকটবর্তী কোলজোড়ার শেখ ফকির মন্ডলের লেটো গানের খাতায়।’ দুখু-র গানগুলো তখন দুখু মিয়ার গান ও দুখুর গান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। এখনও সে হিসেবেই পরিচিত। শিয়ারসোলের স্কুলে ভর্তি হয়ে রাণীগঞ্জ মুসলিম হোস্টেলে চলে গেলে লেটো গানের দল ছেড়ে দেন দুখু মিয়া। তবে শিয়ারসোল-রাণীগঞ্জের ছাত্র জীবনেও দুখু মিয়া অনেক লেটো গান, সং ও পালা রচনা করেছিলেন। লেটোর গানকে নতুন করে জনপ্রিয় করে তুলবার ক্ষেত্রে এবং কৃষিজীবী শ্রমজীবী মুসলমান সমাজের চিত্তবিনোদনের জন্যে দুখু মিয়ার অবদান বাংলা লোক সাহিত্যে অনন্য সংযোজন।
Lokfolk লোকফোক forum of folk লোক tribal আদিবাসী culture সংস্কৃতি of West Bengal পশ্চিমবঙ্গ, বাংলা. LOKFOLK is Bengal বাংলা India's ভারতের traditional পারম্পরিক knowledge system জ্ঞানভাণ্ডার, history ইতিহাস, Indigenous technology প্রযুক্তি. We have two mass bodies গনসংগঠন Bongiyo Paromporik Kaaru O ও Bastro Shilpi Sangho; Bongiyo Paromporik Aavikaar Shilpi Sangho. Journal পত্রিকা, PARAM, পরম. Picture - KaaliKaach কালিকাচ, Dinajpur দিনাজপুর, Madhumangal মধুমঙ্গল Malakar মালাকার
Monday, October 25, 2010
লেটো কবি দুখু মিঞা
লেবেলসমূহ:
Bengal,
Dukhu Miyan,
leto,
দুখু মিয়া,
লেটো
Sunday, October 24, 2010
প্রয়াত পুতুল শিল্পী পাঁচুগোপাল দাস
(সঞ্জয় ঘোষ, জয়নগর মজিলপুর, ৩০ জানুয়ারি)
বেলুচিস্তানের মেহেরগড় পর্যন্ত অজানা প্রাচীনতম টেরাকোটা অর্থাৎ পোড়ামাটির শিল্প নিদর্শন আবিষ্কার হওয়ার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে এই শিল্পের বয়স প্রায় ৭০০০ বলে অনুমান করা হচ্ছে। বাংলাদেশে পান্ডু রাজার ঢিবি, মঙ্গলকোটের প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন ও পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক ও উত্তর চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়ের সাথে এই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার হরিনারায়ানপুর প্রভৃতি স্থান থেকে পোড়ামাটির লোকশিল্পের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তা হয়ত ২০০০ বা তারও অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে ওই শিল্প প্রচলনের ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে পোড়ামাটির পুতুল শিল্পের যে কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে মুর্শিদাবাদের কাঁটালিয়া ও বীরভূমের রাজনগরের কেন্দ্রগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল শিল্পের কোনরকমে টিকে থাকা অবশিষ্ট কেন্দ্রগুলির মধ্যে বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া বাদে আর মাত্র দুটির একটি মেদিনীপুরের নাড়াজোল ও অপরটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার (জয়নগর) মজিলপুর। গত ২৩ জানুয়ারি ২০১০ মজিলপুর ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী পাঁচুগোপাল দাস ৮২ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
পাঁচুগোপাল দাসের কাছে শোনা তাঁদের বংশ ইতিহাস অনুযায়ী আনুমানিক ২০০-২৫০ বছর আগে তাঁদের পূর্বপুরুষ কালিচরণ পেয়াদা জশোর থেকে মজিলপুরে চলে আসেন। পরবর্তী কোনও সময় এঁরা দাস পদবি গ্রহণ করেন। কালিচরণের দুই পুত্র, জানকী দাস ও রাম দাস। রাম কুমোরটুলির প্রতিমার ডাকের সাজের কাজে যুক্ত হন এবং জানকীকে পুতুল গড়তে অনুপ্রাণিত করেন। জানকী কুমোরটুলি দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর পুত্র হরিনাথ মজিলপুরের তথা সুন্দরবনের পরিবেশ থেকে রসদ সংগ্রহ করে পুতুল গড়তে থাকায় মজিলপুরের ঘরানার উদ্গাতা বলা যায় তাঁকে। কিন্তু এই দাস বংশের মধ্যে সুন্দরবনের লৌকিক দেবদেবী সহ লৌকিক ধারার পুতুল গড়ে সবার চেয়ে বিখ্যাত হন হরিনাথের পুত্র গোপালের বড়ো নাতি মন্মথনাথ দাস (২৮ এপ্রিল ১৯০৫ -- ১০ জানুয়ারি ১৯৮৬)। মন্মথনাথের সময় থেকেই তাঁর হাতে গড়া সুন্দরবনের লৌকিক দেবদেবী বেশি প্রচার পায়।
জানকীর অধস্তন ষষ্ঠ উত্তরপুরুষ পাঁচুগোপাল দাসের জন্ম ১৯২৭ সালে। তাঁর পিতা জিতেন্দ্রনাথ দাসের কাকা মন্মথনাথের কেবল একটি কন্যা ছিল। কোনও পুত্র না থাকায় তিনি মাত্র দেড় বছর বয়স থেকে পাঁচুগোপালকেই পুত্রের মতো মানূষ করেন ও পুতুল তৈরির শিক্ষা দেন। পাঁচুগোপাল ৫-৬ ক্লাসের বেশি স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি। ক্রমে পুতুল তৈরি তাঁর নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় বোস পাড়ায় যেখানে তাঁদের বাস, সে পাড়ার এক প্রবীণ মানুষ অজিত বোস (৭৪ বছর) জানালেন --- উনিশশ' চল্লিশের সেই উত্তাল দশকে স্বদেশি বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণায় ও গোপন পরিচালনায় তাঁদের বাড়ির সামনেই গড়ে ওঠা জয়নগর মজিলপুর ব্যায়াম সমিতিতে পাঁচুগোপাল তাঁর মতো ৭-৮ বছরের বালকদের জিমন্যাস্টিক, জাগলারি ইত্যাদি ট্রেনিং দিতেন। জানিনা সেই মূল্যবোধের থেকেই তিনি পূর্বপুরুষের অনুসৃত লৌকিক এই পুতুল তৈরির ধারাটিকে নিষ্ঠার সাথে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কিনা। যদিও এই শিল্প তাঁকে উপযুক্ত অর্থ বা যশ কিছু দিতে পারেনি, অভাব অনটনেই দিন কেটেছে, সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনও উল্লেখযোগ্য আর্থিক সাহায্য বা সম্মান তিনি পাননি। অথচ মন্মথনাথের মতো তাঁর পুতুলও ভারতবর্ষের বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানে জায়গা পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নতত্ত্ব লোকসংস্কৃতির জগতে বহু পদস্থ কর্মকর্তা, গবেষক তাঁর বাড়িতে এসেছেন। তাঁদের পরিবারের বিষয় নিয়ে দুটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম বুলেটিন (ভারতীয় সংগ্রহশালা পত্রিকায়) বিশেষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২০২-২০৪ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোক ও আদিবাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পত্রিকায় (জুন ২০০০, ১৬ সংখ্যা) তাঁদের বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতায় বহুবার এবং বোম্বে ও মাদ্রাজের প্রদর্শনীতে তাঁদের পুতুল বিক্রি হয়েছে ও প্রশংসা পেয়েছে। প্রয়াণের কিছুদিন আগে নিত্য অভ্যাস মতো প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে জয়নগরের যোগী মিত্র শ্মশান ঘাটের কালি মন্দিরে প্রণাম করার সময় ভক্তদের জেলে রাখা মোমবাতি ধুপ ইত্যাদি থেকে অসাবধানতাবশত চাদরে আগুন ধরে গেলে দেহের পেছন দিক পুড়ে যায়। ভালো চিকিৎসার আশায় তাঁকে কসবার ব্যয়বহুল রুবি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করা সত্ত্বেও অমানবিক ও অর্থলোলুপ এই বেসরকারি নার্সিং হোম তাঁর চিকিৎসা ঠিকমত করেনি। সেই কারণে শেষ দিকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলেও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তাঁর স্ত্রী ও তিন পুত্র বর্তমান। আপশোসের বিষয় এই গুণী শিল্পীর হাতে তৈরি দক্ষিণ রায়, বনবিবি, আসানবিবি সহ নয় বিবি, গাজীবাবা, পির গোরাচাঁদ, বসন্ত রায়, শীতলা, মনসা, হাড়ি ঝি, চণ্ডী সহ সুন্দরবনের ২৬টি লোক দেবতার পুতুল আহ্লাদি পুতুল, গণেশ, চিরকালীন ধারার হাতে টেপা মা পুতুল, তাঁদের পরিবারে বৈশিষ্ট্যসূচক জগন্নাথ আর দেখতে পাওয়া যাবে না। যদিও আশার কথা যে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শম্ভু (২৫) তাঁর পুতুল তৈরির ধারাটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে নানা অসুবিধার মধ্যেও। তবে আজ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকেই ভাবতে হবে উপযুক্ত আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে মজিলপুর ঘরানার এই শেষ প্রদীপটিকে বিশ্বায়ন ও প্লাস্টিক পুতুলের ঝড়ের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখার বিষয়টি। তা না হলে লুপ্তপ্রায় বাংলার ঐতিহ্যশালী পোড়ামাটির পুতুল শিল্পের আরেকটি কেন্দ্রও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন কিন্তু আপশোসোর সীমা থাকবে না।
(তথ্য সূত্র - http://sites.google.com/site/songbadmanthan/1february2010thirteen)
কলাবতী মুদ্রার সংযোজন -
সম্প্রতি কলাবতী মুদ্রার ব্যস্থাপনায গড়েওঠা একটি দুর্গাপুজোয় বাংলার পুতুল সহ নানান লৌকিক শিল্প স্থান পায়। সেই উত্সবে পাঁচুগোপাল দাসের পুত্র চারটি পুতুল পাঠান। সেগুলি সেখানে প্রদর্শিত হয়।
বেলুচিস্তানের মেহেরগড় পর্যন্ত অজানা প্রাচীনতম টেরাকোটা অর্থাৎ পোড়ামাটির শিল্প নিদর্শন আবিষ্কার হওয়ার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে এই শিল্পের বয়স প্রায় ৭০০০ বলে অনুমান করা হচ্ছে। বাংলাদেশে পান্ডু রাজার ঢিবি, মঙ্গলকোটের প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন ও পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক ও উত্তর চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়ের সাথে এই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার হরিনারায়ানপুর প্রভৃতি স্থান থেকে পোড়ামাটির লোকশিল্পের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তা হয়ত ২০০০ বা তারও অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে ওই শিল্প প্রচলনের ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে পোড়ামাটির পুতুল শিল্পের যে কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে মুর্শিদাবাদের কাঁটালিয়া ও বীরভূমের রাজনগরের কেন্দ্রগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল শিল্পের কোনরকমে টিকে থাকা অবশিষ্ট কেন্দ্রগুলির মধ্যে বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া বাদে আর মাত্র দুটির একটি মেদিনীপুরের নাড়াজোল ও অপরটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার (জয়নগর) মজিলপুর। গত ২৩ জানুয়ারি ২০১০ মজিলপুর ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী পাঁচুগোপাল দাস ৮২ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
পাঁচুগোপাল দাসের কাছে শোনা তাঁদের বংশ ইতিহাস অনুযায়ী আনুমানিক ২০০-২৫০ বছর আগে তাঁদের পূর্বপুরুষ কালিচরণ পেয়াদা জশোর থেকে মজিলপুরে চলে আসেন। পরবর্তী কোনও সময় এঁরা দাস পদবি গ্রহণ করেন। কালিচরণের দুই পুত্র, জানকী দাস ও রাম দাস। রাম কুমোরটুলির প্রতিমার ডাকের সাজের কাজে যুক্ত হন এবং জানকীকে পুতুল গড়তে অনুপ্রাণিত করেন। জানকী কুমোরটুলি দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর পুত্র হরিনাথ মজিলপুরের তথা সুন্দরবনের পরিবেশ থেকে রসদ সংগ্রহ করে পুতুল গড়তে থাকায় মজিলপুরের ঘরানার উদ্গাতা বলা যায় তাঁকে। কিন্তু এই দাস বংশের মধ্যে সুন্দরবনের লৌকিক দেবদেবী সহ লৌকিক ধারার পুতুল গড়ে সবার চেয়ে বিখ্যাত হন হরিনাথের পুত্র গোপালের বড়ো নাতি মন্মথনাথ দাস (২৮ এপ্রিল ১৯০৫ -- ১০ জানুয়ারি ১৯৮৬)। মন্মথনাথের সময় থেকেই তাঁর হাতে গড়া সুন্দরবনের লৌকিক দেবদেবী বেশি প্রচার পায়।
জানকীর অধস্তন ষষ্ঠ উত্তরপুরুষ পাঁচুগোপাল দাসের জন্ম ১৯২৭ সালে। তাঁর পিতা জিতেন্দ্রনাথ দাসের কাকা মন্মথনাথের কেবল একটি কন্যা ছিল। কোনও পুত্র না থাকায় তিনি মাত্র দেড় বছর বয়স থেকে পাঁচুগোপালকেই পুত্রের মতো মানূষ করেন ও পুতুল তৈরির শিক্ষা দেন। পাঁচুগোপাল ৫-৬ ক্লাসের বেশি স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি। ক্রমে পুতুল তৈরি তাঁর নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় বোস পাড়ায় যেখানে তাঁদের বাস, সে পাড়ার এক প্রবীণ মানুষ অজিত বোস (৭৪ বছর) জানালেন --- উনিশশ' চল্লিশের সেই উত্তাল দশকে স্বদেশি বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণায় ও গোপন পরিচালনায় তাঁদের বাড়ির সামনেই গড়ে ওঠা জয়নগর মজিলপুর ব্যায়াম সমিতিতে পাঁচুগোপাল তাঁর মতো ৭-৮ বছরের বালকদের জিমন্যাস্টিক, জাগলারি ইত্যাদি ট্রেনিং দিতেন। জানিনা সেই মূল্যবোধের থেকেই তিনি পূর্বপুরুষের অনুসৃত লৌকিক এই পুতুল তৈরির ধারাটিকে নিষ্ঠার সাথে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কিনা। যদিও এই শিল্প তাঁকে উপযুক্ত অর্থ বা যশ কিছু দিতে পারেনি, অভাব অনটনেই দিন কেটেছে, সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনও উল্লেখযোগ্য আর্থিক সাহায্য বা সম্মান তিনি পাননি। অথচ মন্মথনাথের মতো তাঁর পুতুলও ভারতবর্ষের বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানে জায়গা পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নতত্ত্ব লোকসংস্কৃতির জগতে বহু পদস্থ কর্মকর্তা, গবেষক তাঁর বাড়িতে এসেছেন। তাঁদের পরিবারের বিষয় নিয়ে দুটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম বুলেটিন (ভারতীয় সংগ্রহশালা পত্রিকায়) বিশেষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২০২-২০৪ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোক ও আদিবাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পত্রিকায় (জুন ২০০০, ১৬ সংখ্যা) তাঁদের বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতায় বহুবার এবং বোম্বে ও মাদ্রাজের প্রদর্শনীতে তাঁদের পুতুল বিক্রি হয়েছে ও প্রশংসা পেয়েছে। প্রয়াণের কিছুদিন আগে নিত্য অভ্যাস মতো প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে জয়নগরের যোগী মিত্র শ্মশান ঘাটের কালি মন্দিরে প্রণাম করার সময় ভক্তদের জেলে রাখা মোমবাতি ধুপ ইত্যাদি থেকে অসাবধানতাবশত চাদরে আগুন ধরে গেলে দেহের পেছন দিক পুড়ে যায়। ভালো চিকিৎসার আশায় তাঁকে কসবার ব্যয়বহুল রুবি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করা সত্ত্বেও অমানবিক ও অর্থলোলুপ এই বেসরকারি নার্সিং হোম তাঁর চিকিৎসা ঠিকমত করেনি। সেই কারণে শেষ দিকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলেও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তাঁর স্ত্রী ও তিন পুত্র বর্তমান। আপশোসের বিষয় এই গুণী শিল্পীর হাতে তৈরি দক্ষিণ রায়, বনবিবি, আসানবিবি সহ নয় বিবি, গাজীবাবা, পির গোরাচাঁদ, বসন্ত রায়, শীতলা, মনসা, হাড়ি ঝি, চণ্ডী সহ সুন্দরবনের ২৬টি লোক দেবতার পুতুল আহ্লাদি পুতুল, গণেশ, চিরকালীন ধারার হাতে টেপা মা পুতুল, তাঁদের পরিবারে বৈশিষ্ট্যসূচক জগন্নাথ আর দেখতে পাওয়া যাবে না। যদিও আশার কথা যে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শম্ভু (২৫) তাঁর পুতুল তৈরির ধারাটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে নানা অসুবিধার মধ্যেও। তবে আজ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকেই ভাবতে হবে উপযুক্ত আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে মজিলপুর ঘরানার এই শেষ প্রদীপটিকে বিশ্বায়ন ও প্লাস্টিক পুতুলের ঝড়ের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখার বিষয়টি। তা না হলে লুপ্তপ্রায় বাংলার ঐতিহ্যশালী পোড়ামাটির পুতুল শিল্পের আরেকটি কেন্দ্রও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন কিন্তু আপশোসোর সীমা থাকবে না।
(তথ্য সূত্র - http://sites.google.com/site/songbadmanthan/1february2010thirteen)
কলাবতী মুদ্রার সংযোজন -
সম্প্রতি কলাবতী মুদ্রার ব্যস্থাপনায গড়েওঠা একটি দুর্গাপুজোয় বাংলার পুতুল সহ নানান লৌকিক শিল্প স্থান পায়। সেই উত্সবে পাঁচুগোপাল দাসের পুত্র চারটি পুতুল পাঠান। সেগুলি সেখানে প্রদর্শিত হয়।
লেবেলসমূহ:
Dolls of Bengal,
FolkCommunity,
FolkCraft,
Jaynagar,
Mazilpur,
Panchugopal Das,
Sambhu Das,
Terracotta
Sunday, October 17, 2010
পট
লোকচিত্রকলার এক বিশিষ্ট অঙ্গ পট চিত্র। পট চিত্রের উৎস ও সংরক্ষন গ্রাম জনপদের মানুষ। কবে থেকে এই পট চিত্রের সূচনা হয়েছিল সঠিক ভাবে বলা যায় না। আনুমানিক আড়াই হাজার বছর আগে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পট চিত্র ও পটুয়াদের সন্ধান পাওয়া যায়। ঐ সময় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের যাজকেরা জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে পট এঁকে গ্রামে গ্রামে ধর্ম প্রচার করত কিছু দিন আগেও বাংলাদেশে অনেক ধরনের পট পাওয়া যেত। যা এখন নেই বললেই চলে। এ পটের ভিতর চক্ষুদান পট, গাজীর পট ও জড়ানো পট বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য।
পটগানের প্রথমেই চলে আসে 'পট' শব্দটি। এই পট শব্দটি কোথা থেকে এসেছে তা নিয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষকদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন 'পট্ট' শব্দ থেকে 'পট' শব্দটি এসেছে। তবে বেশী সংখ্যক গবেষকদের মতামত সংস্কৃত শব্দ 'পট' শব্দ থেকে এই শব্দের উৎপত্তি। পট শব্দের অর্থ ছবি আঁকার কাপড়। যেটা এখন ক্যানভাস নামে পরিচিত। পটের পরেই আসে পটচিত্র। সহজ কথায় পটচিত্র বলতে আমরা পটের উপর অংকিত কোন ছবিকে বুঝি। অবশ্য পরবর্তীতে কাগজ কিংবা মাটির তৈরী বড় থালার উপর চিত্র তৈরী হলে তাকেও পটচিত্র বলা হয়েছে। কারণ পূর্বের ঐ নামকরণ থেকেই পবর্তীতে নামকরণ হয়েছে।
পটগানের ইতিহাস অথবা এর প্রাচীনত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলা যায়- মানুষের ভাষার প্রথম প্রকাশ ঘটে চিত্রের মাধ্যমে। ধারণা করা হচ্ছে সপ্তম ও অষ্টম শতকে পটচিত্র প্রথম তৈরী হয়। সপ্তম শতকের প্রথম দিকে রচিত বাণভট্টের 'হর্ষচরিত' -এ যমপট ব্যবসায়ীদের উল্লেখ আছে রাজা হর্ষবর্ধণ নিজে একজন পটুয়াকে কতকগুলো ছেলেদের মাঝে বসে পট বোঝাতে দেখেছিলেন। রবীন্দ্র মজুমদার লিখেছেন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বুদ্ধ জীবনী ও জাতকের কাহিনী পট চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হত। আট শতকের রচিত বিশাখাদত্তের মুদ্রারাস নাটকে এটি উল্লেখ আছে। এছাড়া কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্' ও মালবিকাগি্নমিত্র' নাটক, ভবভূতির উত্তররাম রচিত এবং ভট্ট রচিত হরিভক্তি বিলাস' নামক গ্রন্থে পটচিত্রের বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা আছে।
প্রায় সকল লোকসংস্কৃতি গবেষকের লেখায় এটাই স্পষ্ট যে, প্রধানত ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটানোর জন্যই পটচিত্রের উদ্ভাবন। অবশ্য পরবর্তীতে অর্থ উাপার্জনের জন্যও এটি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর পটচিত্রকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য ছড়ার মতো করে সুর ও তাল সম্বলিত কিছু কথা সাজিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। সেটাই হচ্ছে এখনকার পটগান। ধর্মপ্রচারে জন্য এই পটগান ব্যাহারের কারণ পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে তখনকার সময় বিভিন্ন ভাষাভাষী ও নিরর মানুষের জন্য ছবির ভাষা বেশী গ্রহণযোগ্য ছিল।
অনেকে মনে করেন বাংলার পট শিল্পীরা বৌদ্ধযুগের চিত্রকরদের উত্তরসাধক। এ সম্পর্কে ড. দিনেশ চন্দ্র সেনের মন্তব্য পটুয়াদের পূর্ব পুরুষ মাস্করী উপাধিধারী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বুদ্ধের সময় হতে পটচিত্র এঁকে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতো। বাংলার মাস্করীদের নাম পটীদার। ব্রাহ্মণদের দ্বারা অত্যাচারিত পটুয়ারা অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের পূর্ব পুরুষের বৃত্তি আঁকড়ে ধরেছিলেন।
এক সময় ভারতবর্ষের প্রায় সব এলাকাতেই পটচিত্রের প্রচলন ছিল। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র কাব্যাদিতে পটের অনেক প্রমান আছে। অবশ্য গুজরাটে এখনও 'চিত্রকর্থীর' অস্তিত্ব আছে। এই চিত্রকর্থী হচ্ছে পটগানের গুজরাটীয় ভাষা এবং সেখানকার পটুয়ারা বাংলার পটুয়াদের মতো ঘুরে ঘুরে পট দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে। বাংলাতেও কোন এক সময় পটুয়ারা পট দেখিয়ে ও গান শুনিয়ে যেমনি অর্থ উপার্জন করতো তেমনি সমাজের দরিদ্র মানুষদের লোকশিা দিতো। তবে সেই পটগানের কাহিনী ছিল পৌরনিক অথবা অলৌকিক। শুধু বৌদ্ধ কিংবা হিন্দু কাহিনী নিয়েই পট গান তৈরী হয়নি, মুসলিম কাহিনী নিয়েও পটগান তৈরী হয়েছে যেমন গাজী কালুর পটগান। গাজীপীরকে মনে করা হতো বাঘের দেবতা। পূর্ববঙ্গে বেশী প্রচলন ছিলো এই গাজী কালুর পট। এক গবেষক পূর্ববঙ্গের গাজীর পট নাচানোর বর্ননায় এক স্থানে একটি চিত্রের উল্লেখ করেছেন, গাজী সাহেব ব্যাঘ্রের উপর সমাসী ও চারিদিকে ঊর্দ্ধপুচ্ছ ব্যাঘ্রাদির পালায়ন। ড. সুকুমার সেন তাঁর 'ইসলামিক বাংলা ' সাহিত্য গ্রন্থে গাজীর 'পট' পাদনামে একটি আলোকচিত্র দিয়েছেন, তাতে শ্মশ্রুধারী বাঘের ঊপর গাজীর মনুষ্যমূর্তি অঙ্কিত দেখা যায়। এছাড়াও গাজী-কালু-চম্পাবতীর জীবনকে কল্পনা করে তাদের জীবনের ধারাবাহিকতার উপর বিভিন্ন পটগান তৈরী হয়েছে।
অবশ্য প্রাচীন পটের প্রত্য নিদর্শন নেই বললেই চলে। তবে বিদেশের অনেক মিউজিয়ামে প্রাচীন পট সংরক্ষিত আছে। যার মধ্যে অক্সফোর্ডে All Souls College ম্যানচেস্টার, John Rylands Library এবং আয়ারল্যান্ডের Chestor Batty Library - তে রাখা ৭ থেকে ৮টি আকর্ষণীয় পটচিত্র আছে। এগুলোর মধ্যে আবার Chestor Batty Library- তে রাখা পটটি সবচেয়ে বেশী প্রাচীন। ভগবত ও পূরাণের গল্পে অঙ্কিত এই পটটি পনেরো শতকের। মসলিন কাপড়ের তৈরী ও দেশীয় রঙ ব্যবহৃত এই পটটির দৈর্ঘ্য ১৭০ ফুট এবং প্রস্থ মাত্র ২ ইঞ্চি। ধারণা করা হয় গাজীর পট চিত্রগুলো ষোল শতকের। কারণ ইসমাইল গাজীর অবির্ভাবের কাল পনের শতকের শেষের দিকে বলে ধরা হয়। অবশ্য ষোল শতকের কবি মুকুন্দরামের চন্ডিমঙ্গল কাব্যে পট চিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। অক্সফোর্ডের All Souls College রতি পটটি সতের শতকে অঙ্কিত এবং ম্যানচেস্টার John Rylands Library -তে সংরতি পটটি ১৭৮০ সালে অঙ্কিত।
পটগানের প্রথমেই চলে আসে 'পট' শব্দটি। এই পট শব্দটি কোথা থেকে এসেছে তা নিয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষকদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন 'পট্ট' শব্দ থেকে 'পট' শব্দটি এসেছে। তবে বেশী সংখ্যক গবেষকদের মতামত সংস্কৃত শব্দ 'পট' শব্দ থেকে এই শব্দের উৎপত্তি। পট শব্দের অর্থ ছবি আঁকার কাপড়। যেটা এখন ক্যানভাস নামে পরিচিত। পটের পরেই আসে পটচিত্র। সহজ কথায় পটচিত্র বলতে আমরা পটের উপর অংকিত কোন ছবিকে বুঝি। অবশ্য পরবর্তীতে কাগজ কিংবা মাটির তৈরী বড় থালার উপর চিত্র তৈরী হলে তাকেও পটচিত্র বলা হয়েছে। কারণ পূর্বের ঐ নামকরণ থেকেই পবর্তীতে নামকরণ হয়েছে।
পটগানের ইতিহাস অথবা এর প্রাচীনত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলা যায়- মানুষের ভাষার প্রথম প্রকাশ ঘটে চিত্রের মাধ্যমে। ধারণা করা হচ্ছে সপ্তম ও অষ্টম শতকে পটচিত্র প্রথম তৈরী হয়। সপ্তম শতকের প্রথম দিকে রচিত বাণভট্টের 'হর্ষচরিত' -এ যমপট ব্যবসায়ীদের উল্লেখ আছে রাজা হর্ষবর্ধণ নিজে একজন পটুয়াকে কতকগুলো ছেলেদের মাঝে বসে পট বোঝাতে দেখেছিলেন। রবীন্দ্র মজুমদার লিখেছেন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বুদ্ধ জীবনী ও জাতকের কাহিনী পট চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হত। আট শতকের রচিত বিশাখাদত্তের মুদ্রারাস নাটকে এটি উল্লেখ আছে। এছাড়া কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্' ও মালবিকাগি্নমিত্র' নাটক, ভবভূতির উত্তররাম রচিত এবং ভট্ট রচিত হরিভক্তি বিলাস' নামক গ্রন্থে পটচিত্রের বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা আছে।
প্রায় সকল লোকসংস্কৃতি গবেষকের লেখায় এটাই স্পষ্ট যে, প্রধানত ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটানোর জন্যই পটচিত্রের উদ্ভাবন। অবশ্য পরবর্তীতে অর্থ উাপার্জনের জন্যও এটি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর পটচিত্রকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য ছড়ার মতো করে সুর ও তাল সম্বলিত কিছু কথা সাজিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। সেটাই হচ্ছে এখনকার পটগান। ধর্মপ্রচারে জন্য এই পটগান ব্যাহারের কারণ পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে তখনকার সময় বিভিন্ন ভাষাভাষী ও নিরর মানুষের জন্য ছবির ভাষা বেশী গ্রহণযোগ্য ছিল।
অনেকে মনে করেন বাংলার পট শিল্পীরা বৌদ্ধযুগের চিত্রকরদের উত্তরসাধক। এ সম্পর্কে ড. দিনেশ চন্দ্র সেনের মন্তব্য পটুয়াদের পূর্ব পুরুষ মাস্করী উপাধিধারী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বুদ্ধের সময় হতে পটচিত্র এঁকে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতো। বাংলার মাস্করীদের নাম পটীদার। ব্রাহ্মণদের দ্বারা অত্যাচারিত পটুয়ারা অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের পূর্ব পুরুষের বৃত্তি আঁকড়ে ধরেছিলেন।
এক সময় ভারতবর্ষের প্রায় সব এলাকাতেই পটচিত্রের প্রচলন ছিল। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র কাব্যাদিতে পটের অনেক প্রমান আছে। অবশ্য গুজরাটে এখনও 'চিত্রকর্থীর' অস্তিত্ব আছে। এই চিত্রকর্থী হচ্ছে পটগানের গুজরাটীয় ভাষা এবং সেখানকার পটুয়ারা বাংলার পটুয়াদের মতো ঘুরে ঘুরে পট দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে। বাংলাতেও কোন এক সময় পটুয়ারা পট দেখিয়ে ও গান শুনিয়ে যেমনি অর্থ উপার্জন করতো তেমনি সমাজের দরিদ্র মানুষদের লোকশিা দিতো। তবে সেই পটগানের কাহিনী ছিল পৌরনিক অথবা অলৌকিক। শুধু বৌদ্ধ কিংবা হিন্দু কাহিনী নিয়েই পট গান তৈরী হয়নি, মুসলিম কাহিনী নিয়েও পটগান তৈরী হয়েছে যেমন গাজী কালুর পটগান। গাজীপীরকে মনে করা হতো বাঘের দেবতা। পূর্ববঙ্গে বেশী প্রচলন ছিলো এই গাজী কালুর পট। এক গবেষক পূর্ববঙ্গের গাজীর পট নাচানোর বর্ননায় এক স্থানে একটি চিত্রের উল্লেখ করেছেন, গাজী সাহেব ব্যাঘ্রের উপর সমাসী ও চারিদিকে ঊর্দ্ধপুচ্ছ ব্যাঘ্রাদির পালায়ন। ড. সুকুমার সেন তাঁর 'ইসলামিক বাংলা ' সাহিত্য গ্রন্থে গাজীর 'পট' পাদনামে একটি আলোকচিত্র দিয়েছেন, তাতে শ্মশ্রুধারী বাঘের ঊপর গাজীর মনুষ্যমূর্তি অঙ্কিত দেখা যায়। এছাড়াও গাজী-কালু-চম্পাবতীর জীবনকে কল্পনা করে তাদের জীবনের ধারাবাহিকতার উপর বিভিন্ন পটগান তৈরী হয়েছে।
অবশ্য প্রাচীন পটের প্রত্য নিদর্শন নেই বললেই চলে। তবে বিদেশের অনেক মিউজিয়ামে প্রাচীন পট সংরক্ষিত আছে। যার মধ্যে অক্সফোর্ডে All Souls College ম্যানচেস্টার, John Rylands Library এবং আয়ারল্যান্ডের Chestor Batty Library - তে রাখা ৭ থেকে ৮টি আকর্ষণীয় পটচিত্র আছে। এগুলোর মধ্যে আবার Chestor Batty Library- তে রাখা পটটি সবচেয়ে বেশী প্রাচীন। ভগবত ও পূরাণের গল্পে অঙ্কিত এই পটটি পনেরো শতকের। মসলিন কাপড়ের তৈরী ও দেশীয় রঙ ব্যবহৃত এই পটটির দৈর্ঘ্য ১৭০ ফুট এবং প্রস্থ মাত্র ২ ইঞ্চি। ধারণা করা হয় গাজীর পট চিত্রগুলো ষোল শতকের। কারণ ইসমাইল গাজীর অবির্ভাবের কাল পনের শতকের শেষের দিকে বলে ধরা হয়। অবশ্য ষোল শতকের কবি মুকুন্দরামের চন্ডিমঙ্গল কাব্যে পট চিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। অক্সফোর্ডের All Souls College রতি পটটি সতের শতকে অঙ্কিত এবং ম্যানচেস্টার John Rylands Library -তে সংরতি পটটি ১৭৮০ সালে অঙ্কিত।
পনের শতকে এসে পট চিত্রের বিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই সময় পৌরাণিক আখ্যানগুলো সংস্কৃত থেকে বাংলায় বিবৃত করার রীতি শুরু হয়। কৃষ্ণের পুতনা বধ, গোষ্ঠ লীলা, রাস লীলা, নৌকা বিলাস, রামের বনবাস, লক্ষণের শক্তিসেল বিদ্ধ হওয়া, রাবণের মৃত্যু, সিতার পাতাল প্রবেশ, বেহুলা-লখিন্দরের প্রেম কাহিনী প্রভৃতি আখ্যান নিয়ে বহু পট আঁকা হয়। ধারণা করা হয় এই সময় পটুয়ারা পট রচনা করে সেগুলো নগরের বাসিন্দাদের সুরের মাধ্যমে বর্ণনা করতেন। পনের শতক হতে বাংলায় হিন্দু পৌরাণিক আখ্যানগুলো সাধারণ মানুষের নিকট বর্ণনা করা শুরু হয়। তবে এই বর্ণনাত্ম রীতির প্রচলন আরো পূর্বে। যাতকের গল্পে পটুয়াদের পরিচয় লিপিবদ্ধ হতে দেখে এই উৎসকাল আরো পূর্বে বলে অনুমান করা আরো সহজ। বুদ্ধ দেব-এর জন্ম কাহিনী এবং তাঁর পূর্ব জন্ম সম্পর্কিত কাহিনী পটুয়ারা অঙ্কন করতেন। সেগুলো ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যেএক দল গায়ক জন সাধারণের মধ্যে প্রচলন করতেন। এই গায়ক বাদক দলের মধ্যে ‘মস্করী’ ভিক্ষু নামে একটি শ্রেণি ছিল যাদের উদ্দেশ্যেই ছিল পট চিত্রের মাধ্যমে বুদ্ধের বাণী প্রচার। বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্যের সঙ্গে পটচিত্রের সংযোগ লক্ষ করা যায়। কথিত আছে বুদ্ধদেব স্বয়ং পটচিত্রের প্রশংসা করতেন। বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘আর্যমঞ্জশ্রীকল্প’ নামক গ্রন্থে পটচিত্র অঙ্কন শিক্ষার রীতি বর্ণনা করা আছে। এই গ্রন্থ চীন এবং তিব্বতি ভাষায় অনুদিত হয় এবং সমগ্র বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের মধ্যে প্রচারিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে পটচিত্র অঙ্কনের ধারাও প্রসারিত হয়। এই সময় ‘চরণচিত্র’ নামে এক প্রকার পটচিত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই রীতি ছিলো কাহিনী নির্ভর এবং উপর হতে নিচের দিকে ধারাক্রমভাবে কাহিনীকে আশ্রয় করে এই চিত্র আঁকা হতো। বর্তমানে এই ধরণের পটের প্রচলন দেখতে পাওয়া যায় না। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর বর্ণনাতে এদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে পটচিত্র পরিবেশিত হওয়ার কথা জানা যায়।
অষ্টম-নবম শতাব্দীতে বাঙালির ধর্মীয় জীবনে ইসলামী প্রভাব পড়তে থাকে। এই সময় ও তার পরে অসংখ্য সুফিমতবাদী ধর্ম প্রচারক মধ্য ইরান-আরব এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে। এঁদের প্রভাবে এদেশের মানুষ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারে। ইসলামের প্রভাবে এদেশের মানুষের ধর্মীয় জীবন হতে সামাজিক জীবনে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে দেশীয় সংস্কৃতির সকল আঙ্গিকে ইসলামী প্রভাব পড়তে থাকে। সেই প্রভাব পটচিত্রকলায়ও দেখা যায়। ইসলামী প্রভাবে এখানকার পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে ইসলামী আখ্যান যুক্ত হয়। পাল্টে যায় দেব-দেবীর বেশভূষা চালচিত্র। তারা এক একজন বিভিন্ন নতুন আসনে অভিষিক্ত হতে থাকেন। যেমন, বন দুর্গা হয়ে ওঠেন বনবিবি, শিতলা লাভ করেন বনবিবির রূপ, দক্ষিণ রায়ে স'লে অভিষিক্ত হন গাজী কালু, সত্যনারায়ণের স্খলে সত্যপীর ইত্যাদি। এ কারণে এই সকল পীর ফকিরসহ ইসলামী দেব-দেবী বাঙালি জীবনের নতুন অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এই অনুষঙ্গ নির্ভরতায় পটচিত্রের আখ্যান আর চরিত্রে রদবদল ঘটে। তাই কালিয়া দমন আর গোষ্ঠ লীলার পাশাপাশি দেখা যায় গাজীর পট। যা সুস্পষ্ট রূপে বাঙালি জীবনে ইসলামী সংস্কৃতির মিশ্রণের পরিচয় বহন করে।
বাংলায় বৈষ্ণবীয় ধারায় পটচিত্র অঙ্কন করার রীতিও যথেষ্ট। নিমাইয়ের সন্ন্যাস গ্রহণ থেকে শুরু করে নগর কীর্তনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে পট আঁকা হয়েছে । এই সকল পটচিত্র আবার কাহিনী আকারে মানুষের মধ্যে পরিবেশিত হওয়ার কথাও জানা যায়। বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের পরবর্তীতে বৈষ্ণবীয় ধারার পটের প্রসার ঘটে বেশি। নগর কীর্তনের মতো পটের গানও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারে যথেষ্ট প্রভাব রাখে।
বাংলার পৌরাণিক আখ্যানগুলো কোনো অতিলৌকিক জীবনের প্রশ্রয় পায়নি। সাধারণ গৃহী জীবনের কথাই সেখানে বিবৃত হয়েছে। যেমন শিব দেবতার অনেক কাহিনী পটের গানে আশ্রয় পেয়েছে। শিব এখানে কোনো অতিলৌকিক জগতের দেবতা নন। তিনি একজন সাধারণ গৃহস্থ। যখন তিনি.ক্ষেতে চাষ করতে গেছেন তখন তার স্ত্রী দুর্গা তাঁর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছেন। তিনি তাঁকে দেখার জন্য অসি'র চিত্ত নিয়ে নারদের নিকট তাঁর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছেন। এই চিত্রে নিত্য জীবনের প্রতিচ্ছবি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবিই পটের চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই সেখানে মাহেশ্বরও একজন সাধারণ কৃষকের চরিত্রে অঙ্কিত। শিবের কাহিনী নির্ভর একটি পটের গান এমন-
ব্যাঘ্রের আসনে বসিলেন যুগপতি
নারদে ডাকিয়া দুর্গা বলিছে বচন ॥
অন্য লোকে চাষ করে ঘুরে আসে ঘর
চাষ করতে গেছে আমার ভোলা মহেশ্বর ॥
উপায় বল মোরে বাছা বুদ্ধি বলো মোরে
তোমার মামা ঘরকে আসে কেমন প্রকারে ॥
নারদ বলে যদি মামী ঘরতে পারো বাগ্দিনী বরণ
রূপেগুণে মামার সঙ্গে হবে দরশন ॥
নারদের কথাটি দুর্গার মনেতে লাগিল
স্বর্গে ছিলেন কামিলা সেদিন মর্ত্তে আসিল ॥
হেদে বলি কামিলা বাটার তাম্বুল খাবি
শীঘ্র করে জাল দড়ি নির্মাণ করিবি ॥
এক ছিলেন কামিলা ঠাকুর দ্বিজ আজ্ঞ পেল
আড়াই দিবসের মধ্যে জাল নির্মাণ হইল ॥
ঘন ঘন পাশ ফেলাই পাশ ফেলাই গিয়ে লেখা নাই
জালিখানটি নির্মান করিলেন কামিলা গোঁসাই ॥
জাল-দড়ি নির্মাণ করে দুর্গার আগে দিল
জাল-দড়ি দেখে দুর্গা হাস্য-বদন হল।
যাও বাছা কামিলা তোমারে দিলাম বর
মৃত্তিকাতে দেউল দালান দেবতা লোকের ঘর ॥
... ... ...
বাংলার পটচিত্র রীতির দুইটি আকৃতি লক্ষ করা যায়। একটি হলো জড়ানো এবং অন্যটি চৌকো। জড়ানো পট ১২ থেকে ২৫ ফুট লম্বা এবং ১ থেকে ৩ ফুট চওড়া হতে পারে। সকল জড়ানো পটই কাহিনী নির্ভর। এক একটি ছবি দেখানো হতো এবং সমবেতভাবে গীত-বদ্য-নৃত্যের মধ্য দিয়ে তা পরিবেশিত হতো। আর চৌকো পটের সার্থক রূপায়ণ লক্ষ করা যায় কলকাতার কলীঘাটে। এই তীর্থকে কেন্দ্র করে পটুয়ারা নান আঙ্গিকে পট অঙ্কন করেছেন। বিভিন্ন উৎসবের সময় বাঙালিরা তীর্থ ভ্রমণ করতে এসে এই পটচিত্র নিয়ে ঘরে ফিরতেন। তবে এই পটচিত্রকে অবলম্বন করে কোনো গীত-বাদ্যের প্রচলন লক্ষ করা যায় না। বিশেষ করে পটের গান জড়ানো পটকে কেন্দ্র করে বিবর্তিত হয়েছে।
পট অঙ্কনের কয়েকটি রীতি দেখা যায়। বিশেষ করে পটের গানের জন্য যে পট ব্যবহৃত হতো সেগুলো প্রধানত কাপড়ে আঁকা হতো। কখনো কখনো কাপড়ের উপর কাগজও লাগানো থাকতো। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাপড়ের পটই ব্যবহৃত হতো। কাপড়ের উপর লাল মাটির প্রলেপ বা গোবর মিশ্রিত মাটির প্রলেপ দেওয়া হতো। মাটির প্রলেপের পর তেঁতুল বিচি জ্বাল দিয়ে এক প্রকার আঠা তৈরী করে তার উপর লাগানো হতো। তেঁতুল বিচির আঠা লাগিয়ে পট তৈরীর উপযুক্ত জমিন তৈরী করে নেওয়া হতো। পটুয়ারা নিজস্ব পদ্ধতিতে গাছের পাতা, বাঁকল, ইত্যাদির রস-আঠা ব্যবহার করে রঙ তৈরী করতেন। এর সঙ্গে মেশানো হতো তেঁতুল বিচির তৈরী আঠা। বিভিন্ন আখ্যান অনুযায়ী এক একটি পট অঙ্কন করতে এক একজন পটুয়ার এক থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময় অতিবাহিত হতো।
অষ্টম-নবম শতাব্দীতে বাঙালির ধর্মীয় জীবনে ইসলামী প্রভাব পড়তে থাকে। এই সময় ও তার পরে অসংখ্য সুফিমতবাদী ধর্ম প্রচারক মধ্য ইরান-আরব এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে। এঁদের প্রভাবে এদেশের মানুষ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারে। ইসলামের প্রভাবে এদেশের মানুষের ধর্মীয় জীবন হতে সামাজিক জীবনে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে দেশীয় সংস্কৃতির সকল আঙ্গিকে ইসলামী প্রভাব পড়তে থাকে। সেই প্রভাব পটচিত্রকলায়ও দেখা যায়। ইসলামী প্রভাবে এখানকার পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে ইসলামী আখ্যান যুক্ত হয়। পাল্টে যায় দেব-দেবীর বেশভূষা চালচিত্র। তারা এক একজন বিভিন্ন নতুন আসনে অভিষিক্ত হতে থাকেন। যেমন, বন দুর্গা হয়ে ওঠেন বনবিবি, শিতলা লাভ করেন বনবিবির রূপ, দক্ষিণ রায়ে স'লে অভিষিক্ত হন গাজী কালু, সত্যনারায়ণের স্খলে সত্যপীর ইত্যাদি। এ কারণে এই সকল পীর ফকিরসহ ইসলামী দেব-দেবী বাঙালি জীবনের নতুন অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এই অনুষঙ্গ নির্ভরতায় পটচিত্রের আখ্যান আর চরিত্রে রদবদল ঘটে। তাই কালিয়া দমন আর গোষ্ঠ লীলার পাশাপাশি দেখা যায় গাজীর পট। যা সুস্পষ্ট রূপে বাঙালি জীবনে ইসলামী সংস্কৃতির মিশ্রণের পরিচয় বহন করে।
বাংলায় বৈষ্ণবীয় ধারায় পটচিত্র অঙ্কন করার রীতিও যথেষ্ট। নিমাইয়ের সন্ন্যাস গ্রহণ থেকে শুরু করে নগর কীর্তনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে পট আঁকা হয়েছে । এই সকল পটচিত্র আবার কাহিনী আকারে মানুষের মধ্যে পরিবেশিত হওয়ার কথাও জানা যায়। বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের পরবর্তীতে বৈষ্ণবীয় ধারার পটের প্রসার ঘটে বেশি। নগর কীর্তনের মতো পটের গানও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারে যথেষ্ট প্রভাব রাখে।
বাংলার পৌরাণিক আখ্যানগুলো কোনো অতিলৌকিক জীবনের প্রশ্রয় পায়নি। সাধারণ গৃহী জীবনের কথাই সেখানে বিবৃত হয়েছে। যেমন শিব দেবতার অনেক কাহিনী পটের গানে আশ্রয় পেয়েছে। শিব এখানে কোনো অতিলৌকিক জগতের দেবতা নন। তিনি একজন সাধারণ গৃহস্থ। যখন তিনি.ক্ষেতে চাষ করতে গেছেন তখন তার স্ত্রী দুর্গা তাঁর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছেন। তিনি তাঁকে দেখার জন্য অসি'র চিত্ত নিয়ে নারদের নিকট তাঁর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছেন। এই চিত্রে নিত্য জীবনের প্রতিচ্ছবি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবিই পটের চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই সেখানে মাহেশ্বরও একজন সাধারণ কৃষকের চরিত্রে অঙ্কিত। শিবের কাহিনী নির্ভর একটি পটের গান এমন-
ব্যাঘ্রের আসনে বসিলেন যুগপতি
নারদে ডাকিয়া দুর্গা বলিছে বচন ॥
অন্য লোকে চাষ করে ঘুরে আসে ঘর
চাষ করতে গেছে আমার ভোলা মহেশ্বর ॥
উপায় বল মোরে বাছা বুদ্ধি বলো মোরে
তোমার মামা ঘরকে আসে কেমন প্রকারে ॥
নারদ বলে যদি মামী ঘরতে পারো বাগ্দিনী বরণ
রূপেগুণে মামার সঙ্গে হবে দরশন ॥
নারদের কথাটি দুর্গার মনেতে লাগিল
স্বর্গে ছিলেন কামিলা সেদিন মর্ত্তে আসিল ॥
হেদে বলি কামিলা বাটার তাম্বুল খাবি
শীঘ্র করে জাল দড়ি নির্মাণ করিবি ॥
এক ছিলেন কামিলা ঠাকুর দ্বিজ আজ্ঞ পেল
আড়াই দিবসের মধ্যে জাল নির্মাণ হইল ॥
ঘন ঘন পাশ ফেলাই পাশ ফেলাই গিয়ে লেখা নাই
জালিখানটি নির্মান করিলেন কামিলা গোঁসাই ॥
জাল-দড়ি নির্মাণ করে দুর্গার আগে দিল
জাল-দড়ি দেখে দুর্গা হাস্য-বদন হল।
যাও বাছা কামিলা তোমারে দিলাম বর
মৃত্তিকাতে দেউল দালান দেবতা লোকের ঘর ॥
... ... ...
বাংলার পটচিত্র রীতির দুইটি আকৃতি লক্ষ করা যায়। একটি হলো জড়ানো এবং অন্যটি চৌকো। জড়ানো পট ১২ থেকে ২৫ ফুট লম্বা এবং ১ থেকে ৩ ফুট চওড়া হতে পারে। সকল জড়ানো পটই কাহিনী নির্ভর। এক একটি ছবি দেখানো হতো এবং সমবেতভাবে গীত-বদ্য-নৃত্যের মধ্য দিয়ে তা পরিবেশিত হতো। আর চৌকো পটের সার্থক রূপায়ণ লক্ষ করা যায় কলকাতার কলীঘাটে। এই তীর্থকে কেন্দ্র করে পটুয়ারা নান আঙ্গিকে পট অঙ্কন করেছেন। বিভিন্ন উৎসবের সময় বাঙালিরা তীর্থ ভ্রমণ করতে এসে এই পটচিত্র নিয়ে ঘরে ফিরতেন। তবে এই পটচিত্রকে অবলম্বন করে কোনো গীত-বাদ্যের প্রচলন লক্ষ করা যায় না। বিশেষ করে পটের গান জড়ানো পটকে কেন্দ্র করে বিবর্তিত হয়েছে।
পট অঙ্কনের কয়েকটি রীতি দেখা যায়। বিশেষ করে পটের গানের জন্য যে পট ব্যবহৃত হতো সেগুলো প্রধানত কাপড়ে আঁকা হতো। কখনো কখনো কাপড়ের উপর কাগজও লাগানো থাকতো। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাপড়ের পটই ব্যবহৃত হতো। কাপড়ের উপর লাল মাটির প্রলেপ বা গোবর মিশ্রিত মাটির প্রলেপ দেওয়া হতো। মাটির প্রলেপের পর তেঁতুল বিচি জ্বাল দিয়ে এক প্রকার আঠা তৈরী করে তার উপর লাগানো হতো। তেঁতুল বিচির আঠা লাগিয়ে পট তৈরীর উপযুক্ত জমিন তৈরী করে নেওয়া হতো। পটুয়ারা নিজস্ব পদ্ধতিতে গাছের পাতা, বাঁকল, ইত্যাদির রস-আঠা ব্যবহার করে রঙ তৈরী করতেন। এর সঙ্গে মেশানো হতো তেঁতুল বিচির তৈরী আঠা। বিভিন্ন আখ্যান অনুযায়ী এক একটি পট অঙ্কন করতে এক একজন পটুয়ার এক থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময় অতিবাহিত হতো।
গাজী পীরের উপাখ্যানের বিভিন্ন দৃশ্য সম্বলিত চিত্রকলা গাজীর পট৷ বাংলার এক সময়ের অত্যনত্ম জনপ্রিয় এ লোকচিত্রকলা পটুয়ারা সঙ্গীতযোগে পরিবেশন করত৷ গাজীর পট সাধারণত গ্রামে-গঞ্জে বাড়ির উঠোনে প্রদর্শিত হত৷ কুশলীলবরা জুড়ি, ঢোল, চটি প্রভৃতি বাজিয়ে গান গায় আর পট প্রদর্শন করে৷ এ সময় পটে অঙ্কিত চিত্রসমূহ একটি লাঠির সাহায্যে নির্দেশ করে তা সুর, তাল ও কথার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়৷ নির্দিষ্ট কোন কাহিনীর পরিবর্তে গাজীর পটের বর্ণনাংশে তিনটি বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটে গাজী পীরের মাহাত্ম্য ও অলৌকিক ৰমতা, কৌতুক মিশ্রিত হিতোপদেশ এবং মৃতু্য তথা যমরাজের ভয়৷
পটের চিত্রসমূহ সাধারণত মোটা কাপড়ে অঙ্কিত হয়৷ সমগ্র পটটি মোট পঁচিশটি প্যানেলে বিভক্ত৷ তন্মধ্যে কেন্দ্রীয় প্যানেলটি বৃহত্৷ এর ওপরে চার ও নিচে তিন সারি প্যানেল থাকে৷ সর্বনিম্ন সারিটি বাদে অন্যসব সারিতেই তিনটি করে প্যানেল থাকে৷ কেন্দ্রীয় প্যানেলে অঙ্কিত হয় বাঘের পিঠে উপবিষ্ট গাজী এবং তার দু’পাশে থাকে মানিক পীর ও কালু পীর৷ ওপর থেকে দ্বিতীয় সারির মাঝে থাকে নাকাড়া বাদনরত ছাওয়াল ফকির এবং তৃতীয় সারির মাঝের প্যানেলে থাকে কেরামতি শিমুল গাছ ও তার ডানে আসাহাতে গাজীর গুণকীর্তনরত দুই মহিলা৷ কেন্দ্রীয় প্যানেলের নিচের সারির মাঝে অঙ্কিত হয় গাজী পীরের ভগ্নী লক্ষ্মী ও তার বাহন পেঁচা৷ দ্বিতীয় সারির ডানদিকের প্যানেলে থাকে মকর মাছের পিঠে উপবিষ্ট গঙ্গা দেবী এবং সর্বনিম্ন সারির বামে থাকে যমদূত, ডানে কালদূত ও মাঝে মানুষের মাথা রন্ধনরত যমরাজের মা৷ প্রতিটি ফ্রেমের চারপাশে সাদার ওপর খয়েরি রঙের শিকল নকশাকৃত বর্ডার থাকে৷
গাজীর পট জড়ানো প্রকৃতির এবং তা সাধারণত মোটা কাপড়ে অঙ্কন করা হয়৷ অঙ্কনের আগে তেঁতুল বিচি বা বেলের আঠা দিয়ে পটের জমিন তৈরি করা হয়; তার ওপর চক পাউডার, তেঁতুল বিচির আঠা ও ইটের গুঁড়ার মিশ্রণের প্রলেপ দেয়া হয়৷ এটি ভালভাবে রোদে শুকানোর পর সমগ্র পটটি নির্দিষ্ট প্যানেলে ভাগ করে শিল্পী বিভিন্ন প্রতিকৃতি অঙ্কন করেন৷
চিত্রাঙ্কনের জন্য প্রয়োজনীয় রঙ নানা ধরনের উদ্ভিদ ও খনিজ পদার্থ থেকে সংগৃহীত হয়, যেমন- মশালের ওপর উপুড় করা মাটির সরার কালি থেকে কালো, শঙ্খগুঁড়া থেকে সাদা, সিঁদুর থেকে লাল, হলুদ গুঁড়া থেকে হলুদ, গোপীমাটি থেকে মেটে হলুদ এবং নীল গাছ থেকে নীল রঙ সংগ্রহ করা হয়৷ ছাগল বা ভেড়ার লোম দিয়ে শিল্পী নিজেই তুলি তৈরি করেন৷ বর্তমানে অবশ্য বাজারে প্রাপ্ত রাসায়নিক রঙ এবং বিভিন্ন ধরনের তুলিও শিল্পীরা ব্যবহার করেন৷
বাংলাদেশের এই পটশিল্পের শুরম্ন খৃস্টীয় সপ্তম শতকে বলে মনে করা হয়৷ গাজীর পটে যমদূত ও তার মায়ের চিত্র থেকে অনুমিত হয় যে, এর উত্স প্রাচীন যমপট, যেখানে ধর্মরাজ যমের মূর্তি এবং যমালয়ের ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য অঙ্কিত হত৷ বাংলাদেশের পট চিত্রকলা ভারতীয় উপমহাদেশের বৌদ্ধ পূর্ব ও অজনত্মাপূর্ব যুগের চিত্রকলা এবং পরবর্তীকালে তিব্বত, নেপাল, চীন ও জাপানের ঐতিহ্যবাহী পট চিত্রের সাথে সম্পৃক্ত বলে মনে করা হয়৷ প্রাচীন বাংলায় যখন কোন দরবারি শিল্পের ধারা গড়ে ওঠেনি তখন পট চিত্রই ছিল বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক৷ পট চিত্রের শিল্পীদের পটুয়া বলা হয়৷ গাজীর এ পট চিত্রে গাজীকে কখনও দেখা যায় সুন্দরবনের রাজার সঙ্গে লড়াই করতে; কখনও ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে সমাসীন, কখনও মাথায় টুপি অথবা রাজমুকুট, পরনে রঙিন পাজামা কিংবা ধুতি, এক হাতে চামর বা ত্রিকোণ পতাকা এবং অপর হাতে তলোয়ার কিংবা মুষ্টিঘেরা জ্যোতি৷ এখানে মানিক পীর, মাদার পীর, সত্য পীর, কালু ফকির, বনবিবি প্রভৃতি সম্পর্কে নানা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের ছবিও প্রদর্শিত হয়৷ এরূপ ধর্র্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি নানা কৌতুক, রঙ্গারস সম্বলিত কাহিনী, ব্যঙ্গচিত্র এবং সামাজিক দুরবস্থার চিত্রও অঙ্কিত হয়৷ কখনও কখনও পেঁচা, বানর, গরম্ন, বাঘ, সাপ, কুমির ও গাছপালাও স্থান পায়৷ লোক ধর্মে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ অনেক সময় পটুয়া বা পটচিত্রকে ঝাড়ফুঁকের ৰেত্রে ব্যবহার করে৷ অনেক গৃহে পটচিত্র সংরৰণ করাকে কল্যাণ ও দৈব-দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বলেও মনে করে৷
চক্ষুদান পট
যখনই কোনও সাঁওতাল পুরুষ, নারী অথবা শিশু মারা যায়, তখনই মৃতের কল্পিত ছবি এঁকে জাদু-পটুয়া চলে যান শোকের সেই বাড়িতে। সে ছবিতে ব্যক্তির ছাপ নেই। শুধু লিঙ্গ আর বয়স ভেদের ছাপ। রং-রেখায় ছবিটি পুরোপুরি তৈরি হলেও চক্ষুদানটুকু কেবল বাকি থাকে। চোখ-না-ফোটা সেই ছবিটি দেখিয়ে পটুয়া মৃতের স্বজনদের বলেন, চোখ-না-থাকা অবস্থায় পরলোকে মানুষটি ঘুরে ঘুরে কষ্ট পাচ্ছেন, স্বজনদের কাছ থেকে ‘ভুজ্জি’ পেয়ে পটুয়া চিত্রে চক্ষুদান করলেই ম্যাজিকের মতো তাঁর পরিত্রাণ। সে জন্যই এ পটুয়ার নাম জাদু-পটুয়া আর পটের এই বিশেষ ধারার নাম চক্ষুদান পট। গুরুসদয় দত্তের বর্ণনায় এমনই ধারণা মেলে সাঁওতালি পটের এই বিশেষ ধারা সম্পর্কে। মৃত্যুর পাশাপাশি সাঁওতালি পটে থাকে জন্মও। অনেক সাঁওতালি পটেই ছবির বিষয় সাঁওতাল উপজাতিটির জন্মকথা। ‘যমপট’ আবার সমতল বাংলার ঘরে ঘরে প্রচলিত ছিল। সেখানে ধর্মরাজের বিচারে দণ্ডিত মানুষের নরকভোগ আর পুরস্কৃত মানুষের স্বর্গসুখের ছবি।
পটুয়া ও রবীন্দ্রনাথ
সে মনে ভাবে, ‘ধনী ছিলেম, ধন গিয়েছে, হয়েছে ভালো। দিনরাত দেবতার রূপ ভাবি, দেবতার প্রসাদে খাই, আর ঘরে ঘরে দেবতার প্রতিষ্ঠা করি। আমার এই মান কে কাড়তে পারে।’
এমনমসয় দেশের রাজমন্ত্রী মারা গেল। বিদেশ থেকে নতুন এক মন্ত্রীকে রাজা আদর করে আনলে। সেদিন তাই নিয়ে শহরে খুব ধুম।
কেবল অভিরামের তুলি সেদিন চলল না।
নতুন রাজমন্ত্রী, এই তো সেই কুড়িয়ে-পাওয়া ছেলে, যাকে অভিরামের বাপ মানুষ করে নিজের ছেলের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিল। সেই বিশ্বাস হল সিঁধকাঠি, তাই দিয়ে বুড়োর সর্বস্ব সে হরণ করলে। সেই এল দেশের রাজমন্ত্রী হয়ে।
যে ঘরে অভিরাম পট আঁকে সেই তার ঠাকুরঘর; সেখানে গিয়ে হাত জোড় করে বললে, ‘এইজন্যেই কি এতকাল রেখায় রেখায় রঙে রঙে তোমাকে স্মরণ করে এলেম। এত দিনে বর দিলে কি এই অপমান।’
২
এমনসময় রথের মেলা বসল।সেদিন নানা দেশের নানা লোক তার পট কিনতে এল, সেই ভিড়ের মধ্যে এল একটি ছেলে, তার আগে পিছে লোক-লশকর।
সে একটি পট বেছে নিয়ে বললে, ‘আমি কিনব।’
অভিরাম তার নফরকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘ছেলেটি কে।’
সে বললে, ‘আমাদের রাজমন্ত্রীর একমাত্র ছেলে।’
অভিরাম তার পটের উপর কাপড় চাপা দিয়ে বললে, ‘বেচব না।’
শুনে ছেলের আবদার আরও বেড়ে উঠল। বাড়িতে এসে সে খায় না, মুখ ভার করে থাকে।
অভিরামকে মন্ত্রী থলিভরা মোহর পাঠিয়ে দিলে; মোহরভরা থলি মন্ত্রীর কাছে ফিরে এল।
মন্ত্রী মনে মনে বললে, ‘এত বড় স্পর্ধা!’
অভিরামের উপর যতই উৎপাত হতে লাগল ততই সে মনে মনে বললে, ‘এই আমার জিত।’
৩
প্রতিদিন প্রথম সকালেই অভিরাম তার ইষ্টদেবতার একখানি করে ছবি আঁকে। এই তার পূজা, আর কোনো পূজা সে জানে না।একদিন দেখলে, ছবি তার মনের মতো হয় না। কী যেন বদল হয়ে গেছে। কিছুতে তার ভালো লাগে না। তাকে যেন মনে মনে মারে।
দিনে দিনে সেই সূক্ষ্ণ বদল স্থূল হয়ে উঠতে লাগল। একদিন হঠাৎ চমকে উঠে বললে, ‘বুঝতে পেরেছি।’
আজ সে স্পষ্ট দেখলে, দিনে দিনে তার দেবতার মুখ মন্ত্রীর মুখের মতো হয়ে উঠছে।
তুলি মাটিতে ফেলে দিয়ে বললে, ‘মন্ত্রীরই জিত হল।’
সেইদিনই পট নিয়ে গিয়ে মন্ত্রীকে অভিরাম বললে, ‘এই নাও সেই পট, তোমার ছেলেকে দিয়ো।’
মন্ত্রী বললে, ‘কত দাম।’
অভিরাম বললে, ‘আমার দেবতার ধ্যান তুমি কেড়ে নিয়েছিলে, এই পট দিয়ে সেই ধ্যান ফিরে নেব।’
মন্ত্রী কিছুই বুঝতে পারলে না।
লেবেলসমূহ:
Bengal,
clay pottery,
Medinipur,
গাজীপট,
চক্ষুদান পট,
পট,
বাংলা,
সাঁওতাল
Subscribe to:
Posts (Atom)