(ঋণ স্বীকার – মুকুলরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়)
সম্ভবতঃ মাদুর কথাটির উত্পত্তি সংস্কৃত শব্দ মন্দুরা থেকে। মাদুরের মূল উপাদান এক ধরনের তৃণ – সাধারণতঃ যা মাদুরকাঠি নামে পরিচিত। মাদুরকাঠি সাধারণতঃ সরু, গোলাকার, দৈর্ঘে চার হাত বা একটু বড়, কোনো গাঁট থাকে না বা শাখা প্রশাখাও হয় না। তৃণ শীর্ষে চার পাঁচটি ধারালে পাতা থাকে।
মাদুর কাঠির চাষ হয় সাধারণতঃ পূর্ব আর পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ আর উত্তর ২৪ পরগণা, আর হাওড়া জেলায়। চাষের জন্য দোঁয়াশ মাটি সর্বশ্রষ্ঠ হলেও বালি ও এঁটেল মাটিতেও মাদুরকাঠি চাষ হয়ে থাকে। কাঠির রং হলুদ, চাঁপাফুলের রং বা সবুজ হয়ে থাকে। চাষের সময় চৈত্র বৈশাখ। ক্ষেত থেকে মাঘ মাসে তুলে আনা মূলগুলি রেখে ছায়ায় বা পুকুর ধারে জল ছিটিয়ে ঢাকা থাকে। চার পাঁচদিন পর অঙ্কুর দেখা যায়। জল জমে না এমন জমিতে লাঙল দিয়ে ও মাটি গুঁড়ো করে জিম প্রস্তুত করা হয়। ছয় ইঞ্চি করে সার কেটে দুটি মূল পরস্পরের এক ইঞ্চি দূরত্বে বসিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়। দিন দশেকের মধ্যে বৃষ্টি না হলে সেচ দিতে হয়। এক সপ্তাহের মধ্যেই গাছ থেকে মূল বেরিয়ে আসে। ছোট অবস্থায় একবার নিড়েন দিতে হয়।
আশ্বিন-কার্তিক মাসে কাঠি গোড়া থেকে কেটে নেওয়ার পর কাঠির মাথা সমান করে সাজিয়ে মাথা থেকে পাতা কেটে নেওয়া হয়। প্রতিটি কাঠি ২-৩-৪ ভাগে করে কেটে নিয়ে ২ দিন রোদে ফেলে বাঁধাই করে বেঁধে তোলা হয়।
বাংলার মাদুর সাধারণতঃ তিন ধরণের – একহারা, দোহারা আর মসলন্দ। কাঠি তৈরির জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন ছুরি। একে গেঁজে ছুরি বলে। এক হারা মাদুর বোনার জন্য প্রয়োজন, মাদুর কাঠি, সুতলি, টানা দেওয়ার জন্য ৪টে বাঁশের খুঁটি, টানা বাঁধার জন্য ২ খানা সোজা বাঁশ, দুটি মোটা দড়ি, শালকাঠের শানা (প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ১৪ থেকে ১৬টা ফুটো), একটা তক্তা, কাছি ভেজাবার জন্য পাত্র। দোহারা মাদুরের জন্য প্রয়োজন এ সবই কিন্তু শানার জন্য প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ৯ থেকে ১০টা। মসলন্দ মাদুরের জন্য আরও প্রয়োজন গোল বাঁশের চটা। শানায়ও তারতম্য হয় প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ২৮ থেকে ৪৮। মসলন্দ মাদুরের কাঠি থেকে মাঝখানের সাদা অংশটি ছেঁটে বাদ দিতে হয়।
মাদুরে রংএর ব্যবহার
মাদুরের নকশা অনুসারে যতটুকু অংশ রং করার দরকার হয়, সেই অংশ টুকুর দুধারে ভাল করে বাঁধেন কারিগরেরা, তার পর সেদ্ধ করে নিতে হয় কম করে আট ঘন্টা। রং পাকা করার সময় নুন আর তেল ব্যবহার করা হয়। মাদুরকাঠি রংএর জন্য ব্যবহার হয় সবং এলাকার একধরনের গাছের পাতা।
ভৌগোলিক এলাকা ভেদে একহারা আর দোহারা মাদুর বুননের তারতম্য
সাধারণতঃ ভারতের অন্যান্য লৌকিক শিল্পের মতই মাদুর শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন। তবে এলাকা তারতম্যে মাদুর বুননের পার্থক্য রয়েছে।
১. সবং – দশগ্রাম, সবং, তেমোহানি, কুচবসান, সারতা, খাজুরি, বালিচক প্রভৃতি অঞ্চলে যে একহারা মাদুর বোনা হয়, তাতে একটি মাত্র টানায় সামনাসামনি দুজন কারিগর বসেন প্রতি কাঠি বোনার পর শানা মারেন। কাঠি যে যার বাঁদিক থেকে বোনা আরম্ভ করেন। বোনার শেষে কাঠির ডগা টানার শেষে যে দড়ি থাকে সেই দড়িতে পেঁচিয়ে রেখে গিয়ে পরে শানা মারার সময় ডগা মুড়ে গাঁট দিয়ে যান। তাই বুননের সঙ্গে সঙ্গে বাঁধাও শেষ হয়। তাই মাদুর চিকন হয়, মসৃণ থাকে, আরক ধার সোজা বাঁধার ফলে দেখতেও সুন্দর হয়।
২. রামনগর – এখানে একজন শিল্পী ৩-৫-৭ করে কাঠি বুনে শানা মারেন। আর বোনার সময় বাঁধাও হয় না। সামনা সামনি বসে একজন বিজোড় কাঠি বোনেন এবং শানা মারেন। ফলে মাদুরের জমি প্রায়শঃই মসৃণ হয় না। ফলে মাদুরের ধার অসমান হওয়ার সুযোগ থেকে যায়।
৩. এগরা – এ অঞ্চলেও রামনগর অঞ্চলের একহারা বুননের রীতি অনুসরণ করা হয়। এখানে রঙিণ মাদুর কম হয়।
৪. উদয়নারায়ণপুর – উদায়নারায়ণপুর আর আমতা অঞ্চলে জোড়া মাদুর তৈরি হয়। মাদুর বোনার সময় দুটি মাদুরকাঠি নিয়ে একটি টানার অর্ধেক বোনার পর অপর কাঠি বুনে টানার শেষ পর্যন্ত নিতে হয়। প্রথম কাঠির ডগা ধার বাঁধার মত রেখে গোড়া যেখানে শেষ হয়, সেখানে টানার নিচে ঢুকিয়ে দিতে হয়। তাই মাঝখানে জোড়া মাদুরের আয়তন বেশ বড় হয়। সাধারনের চোখে বোঝা না গেলেও তবে নজর করে মাঝখানটা হাত দিলে একটু মোটাই লাগে।
৫. উত্তর ২৪ পরগণা – উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাত, বসিরহাট, দেগঙ্গা, বাদুড়িয়া, বনগ্রামে রামনগরের ধাঁচে একহারা বুনন পদ্ধতি অনুসৃত হয়। তবে এ অঞ্চলে পাতি বা হোগলা বেশি তৈরি হয়।
সবংএর দোহারা মাদুরের বুনন পদ্ধতি অন্যান্য অঞ্চলের মতই। সবংএর মোহাড়ে এক বিশেষ মাদুর তৈরি হয় – নাম চালা মাদুর যা দোহারা মাদুরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রথনে দুই তিন ইঞ্চি বোনার পর বোনা অংশের কাঠিগুলিকে নখ দিয়ে শিল্পীরা পেছনের দিকে চালিয়ে মাদুরকে যতসম্ভব খাপি করার চেষ্টা করেন। তাই জমিন ঘন হয়, বেশিদিনও ব্যবহার করা যায়।
রামনগর অঞ্চলে দোহারা মাদুর কম হয়, এগরায় বেশি হয়। তৈরি হয় মাদুর আর আসন। হাওড়ায়ও কম বোনা হয়। ২৪ পরগণায়ও পাতি আর হোগলা পাতির দোহারাই বেশি।
মসলন্দ মাদুর
সবং আর রামনগরে হয়। কাঠির মান অনুযায়ী মসলন্দ মাদুরের মসৃণতার হেরফের হয়। সবং অঞ্চলের শিল্পীরা এই মাদুর বোনার সময় কাঠি দাঁত দিয়ে চিরে নেন। আর মাদুর বোনার সময় ধার বেঁধেও যান। প্রকৃতিক রং ব্যবহারের জন্য রং পাকা হয়। সবং এলাকার কাঠি সবুজাভ তাই দেখতে অনেক সুন্দর। রামনগরের কাঠি অনেকটা হলদেটে – মাদুরের কাঠি থেক পিথি অংশটা বাদ দেওয়া হয় – তাই স্থায়িত্ব বেশি।