চার চালা বিশিষ্ট, সে
দেশে ইহাকে চৌরী ঘর বলে। পূর্ব্ববঙ্গে এরূপ ছন জন্মে তাহাকে উলুছন
বলে। এই উলুছনের উল্লেখ পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকায়
অনেক-স্থলে পাওয়া যায়। সাধারন ছন হইতে এই উলুছন দীর্ঘ, সূক্ষ্ম ও
অনেককাল স্থায়ী। এই উলুছনকে খুব কায়দা করিয়া কুলিছন তৈরী করিতে হয়। মুঠির মধ্যে উলুছন
এক এক আঁটি ধরিয়া তাহা ছাঁটিতে হয়, কোন একটি খড় বড় বা ছোট না হয় এই ভাবে বাছাই হয়
এবং সমান করিয়া কাটিতে হয়। তত্পরে এই কুলি ছনের এক একটি আঁটি বিস্তৃত করিয়া
সাজানো হয়। চালের
উপর ছন খুব পুরু করিয়া প্রত্যেকটি স্তর নির্ম্মিত হয়, প্রত্যেক ছনের ছয় ইঞ্চি
ব্যাপক ছনের স্তরের উপর আঁঠন(বাঁশের চটা উহা খুব সরু করিয়া গোলাকৃতি করে তাহারই
নাম ছাওনা কাঠি) এইরূপ স্তরে স্তরে কুলিছন চালের সঙ্গে বাঁধিয়া ঢালা (উপরের দিক)
পর্য্যন্ত লইয়া যাওয়া হয়। উপরের দিকটা ঐ ছনই মোড় দিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া এমন
করিয়া বাঁধে যে তাহা দেখিতে খুব সুন্দর হয়। এই ঢালের নীচের দিকটা অতি সরু – কারুকার্যময় পাটী থাকে। এই পাটীকে
পূর্ব্ববঙ্গে শীতলপাটী বলে। ইহার দাম খুব বেশী। কখনও কখনও একখানির
দাম ৫০০ টাকাও হইয়া থাকে। শীতলপাটীতে আটকাইবার জন্য ছাটান(সূক্ষ্মভাবে
চাঁচা বাঁশের চটা) ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি প্রত্যেক চার আঙুল পরে পরে ছাটান ছাটান
থাকে, ছটানগুলির সঙ্গে ফুরোসা(ছাটান হইতে বড় অর্দ্ধ গোলাকৃতি চাঁচা বাঁশ) বক্র এবং
আড়িভাবে আবদ্ধ থাকে। এই ফুরোসার সহিত দড়ি(তাইতা) দিয়া চালের উপরকার আঁটন
আবদ্ধ থাকে। এই সমস্ত বাঁধনে কুলি ছন খুব শক্তভাবে আঁটা থাকে। ফুরোসার সঙ্গে সঙ্গে
ঘন ঘন পাকা বাঁশের নাতিস্থূল গোলাকৃতি রুয়ো আড়াআড়িভাবে বাঁধা হয়, ইহাতে চাল এতই শক্ত হয় যে কেহ চালের উপর তাণ্ডব
নৃত্য করিলেও তাহা হেলে না। রুয়োকে আটকাইবার জন্য বাঁশের চটা সর্বনিম্নে
আবদ্ধ হয়, এই প্রশস্ত চটাকে মুখজোত বলে। চালের একেবারে সম্মুখের সাজানো দিকটাকে মুখপাত
বলে। এখন ঘরের মধ্যে গিয়া উর্দ্ধে তাকাইলে যে দৃশ্য
দেখা যায় তাহা বর্ণনাতীত, যে সকল বাঁধ ও আঁটনের কথা বলা হইয়াছে, সেই সমস্তই নানান বর্ণের রঞ্জিত ও তাহার প্রত্যেকটিতে অসীম ধৈর্য্যের পরিচায়ক শিল্পকার্য্য আছে। বিচিত্র বর্ণের ফুল ও লতাতে উপরকার দৃশ্য অতি
মনোরম হয়। নানান কারুকার্য্য মণ্ডিত খুঁটির সঙ্গে কাঠের ডাফ
দিয়া চাল আঁটা হয়। এই ডাফগুলির কোনটি নরাকৃতি, কেনটি হাতীর শুঁড়ের
মত, কোনটীতে পরী ও অন্য কোন জীবজন্তুর মূর্ত্তি গড়া থাকে। যেখানে যেখানে বেতের গোরা,
সেইখানে সেইখানে বিচিত্রবর্ণ পশুপক্ষী ও ফুল পল্লবের কারিগরী। সুন্ধী বেত অতি
সূক্ষ্ণভাবে চাঁচিয়া তাহাতে নানান কায়দা করিয়া লতাপাতা বা ফুলের আকারের গেঁড়োগুলি
(গ্রন্থি) গড়া হয়। নিম্ন হইতে ঊর্দ্ধে তাকাইলে মাঝে মাঝে শীতলপাটী ও
বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত গেঁড়ো এবং ঠেকাগুলি অদ্ভুত অদ্ভুত মূর্তিতে এমন শোভাময় দেখায়
যে চক্ষু সেই চারু দৃশ্যে ভুলিয়া যায়। খাম্বা অথবা বাঁশের খুঁটিতে যে বাঁশ থাকে এবং
যাহার সঙ্গে চাল আঁটা থাকে তাহাকে পাড় বলে। আবার ঘরের ভিতর চালাকে শক্ত ও উঁচু করিয়া রাখিবার
জন্য ডাফের যে সরু বাঁশ দিয়া চালা বাঁধা থাকে তাহাকে রুয়ো আঠান বলে। এই শিল্প-শোভা
প্রতিপদে অজন্তার ছাতের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়।
No comments:
Post a Comment