বাংলার লৌকিক আচার অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক ঐতিহ্যণ্ডিত লোককলার এক বিশিষ্ট নিদর্শণ পোড়ামাটির তুলসিমঞ্চ । প্রায় প্রত্যেক গ্রামীণ গৃহস্থের বাড়িতে পবিত্র ও পুজনীয় তুলসীগাছ যে বাঁধানোবেদীতে রোপন করা হত, সেই বাঁধানো বেদীই হল তুলসিমঞ্চ । বাঁধনো বেদিটি পোড়ামাটির হত বলে একে গর্বকরে পোড়ামাটির তুলসিমঞ্চ আখ্যাদেওয়া হয় । শুধুই গ্রামীণ বাংলাই নয়, শহরেও প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই এ ধরণের বাঁধানো তুলসি মঞ্চে বিবাহিত মহিলাদের নিত্য প্রদীপজ্বালিয়ে সন্ধ্যাপুজো(আরতি) দিতে দেখা যেত কয়েক বছর আগেও - বিশেষ করে বৈষ্ণব ধর্মালম্বী গৃহস্থের ভদ্রাসনে । তবে গরীব গৃহস্থেরা সাধারণ দেউলাকৃতি মাটির ঢিবি বা বেদি তৈরি করে সেখানে অসীম শ্রদ্ধায় মমতায় তুলসিগাছ রোপণ করতেন । একটু ঢণাঢ্যদের দাবি অনুযায়ী কর্মীরা তুলসিমঞ্চে আবার বিশেষ কারুকাজ করতেন, কোথাও ক্ষুদ্র চারচালার মন্দির, কোথাও দেউলাকৃতির মঞ্চ কোথাও আবার মঞ্চের গায়ে নানান কারুকাজের পাশাপাশি লিপি খোদাই করার রেওয়াজ ছিল । কোথাও কোথাও শায়িত পশুর নানান
ভঙ্গিমার ওপরও তুলসি মঞ্চও স্থাপন করতেন । আর হরিমন্দির তৈরির রীতি মেনে নানান গৃহস্থ মাঝখানে একটি আর তার চারপাশে চারটি তুলসিমঞ্চ স্থাপন করতেন । মাঝখানেরটিতে রোপণকরা হত তুলসিচারা । এ ছাড়াও অনেকসময় তুলসিমঞ্চ স্থাপনকর্মের সময় সেই মঞ্চে মুদ্রা উত্সর্গ করার রীতি প্রচলন ছিল । বাঁকুড়ার যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবন সংগ্রহশালায় এধরনের কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে ।
যদিও অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন এ ধরনের তুলসি মঞ্চ মেদিনীপুর বা বাঁকুড়ার নানান গ্রামে দেখাযেত - এই প্রতিবেদকের অভিজ্ঞতা বলছে এর বাইরেও নানান জেলায় বিশেষ করে ২৪ পরগণা, নদিয়ার নানান গ্রাম-শহরেও দেখা যেত ।
মেদিনীপুর জেলা জুড়েই বিশেষকরে পাঁশকুড়া, সুতাহাটা, খড়্গপুর, মেদিনীপুর সদর, রামনগর বা কাঁথি মহকুমায় ফাঁপা চার ছয় বা আট কোণা নানান ধরনের তুলসিমঞ্চ দেখা যায় । আবার কোথাও কোথাও গোলাকার দেউলাকৃতিরও মঞ্চও স্থাপনা হয় । এই মঞ্চ প্রস্তুতি-স্থাপনার কাজ করেন জেলার কুম্ভকার সমাজ ।
তুলসিমঞ্চের ওপরের ছাদের অংশটি সাধারণতঃ স্তুপাকৃতি হয় । ছাদে মধ্যস্থলে স্থাপনাকরাহয় কলসির উপরিভাগের কানা(তুলনীয় - মেরেছ কলসির কানা তাই বলেকী প্রেম দেবনা) - কোথাও কোথাও মোকা নামেও পরিচিত - যা আদতে কলসির সর্বোচ্চ ভাগ মুখের বেড় অংশ । এই অংশটি কলসির সবথেকে অভঙ্গুর । তুলসি মঞ্চের নিচেরভাগটি হয় বেশ ফাঁপা - সেখানে মাটিদিয়ে ভরাট করা হয় যাতে রোপিত তুলসিগাছটি তার শেকড় আরও ভালকরে মাটিতে চালনা করতে পারে ।
এই নানান কোণাকৃতি মঞ্চের গায় শুধুই লিপি খোদিত থাকে তাই নয়, সেখানে অলংকরণ হিসেবে নানান রিসিফের কাজ থাকে দেবদেবীর মূর্তি বা রাধাকৃষ্ণ কোথাও জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা, কোথাও নক্ষ্মীনারায়ণ বা রামসীতা - সবথেকে বেশি দেখাযায় গৌরনিতাই । দেওয়ালে চারপাশে থাকে লতাপাতাফুলের সজ্জা । কোথাও কোথাও থাকে সখীদের সারিবদ্ধ মূর্তি – যা আদতে আদি রাসমণ্ডলের মোটিফ । কোথাও খোদিতথাকে শাস্ত্রবাক্য, কেথাও কৃষ্ণনাম, কোথাও শিল্পীর নামও ।
No comments:
Post a Comment