সম্প্রতি রাজ্যে সংবাদপত্র দেখলে মনে হবে হয়ত হঠাতই হকার
সমাজ যেন খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা কতটা সত্যি তলিয়ে দেখা যাক। গৌতম
বুদ্ধের আগেও ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতি, অর্থনীতিতে হকারদের বিপুল ভূমিকা ছিল। বিশ্বায়নের প্রভাবে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসা চাষী,
হস্তশিল্পী, কারখানা বন্ধ হওয়া শ্রমিক, বেকার যুবক শহরের ফুটপাথে হকার হতে বাধ্য
হন। অনেকেই সম্প্রদায়গতভাবে ব্যবসায়ী। এই হকারেরা দেশিয় বাস্তবতায় নতুন এক মাটির অর্থনীতি বা
লো-সার্কিট ইকনমি তৈরি করেছেন, যে অর্থনীতিতে তাঁরা শুধু নিজেরাই রোজগার করে না,
স্থানীয় উৎপাদন দেশে বিদেশে বিক্রি করে স্থানীয় মানুষদের রোজগার দেন এবং স্থানীয়
সংস্কৃতি রক্ষা করেন। সারা বিশ্বে বড় পুঁজির আর্থনীতিতে ধ্বস নামলেও হকার অর্থনীতি এই বাজারের
বাইরে থাকায় ভারতে এর আঁচ পড়ে নি। শপিং মলে আশি কোটি চাষী, ছোট উৎপাদকের উৎপাদন
থাকুক চাই না থাকুক, ভারতের এই মানুষদের শহুরে বাজার তৈরি করে দেন চার কোটি হকার।
এর বিনিময়ে তাঁরা সরকারের কাছে চাকরি চাইতে যাননি, ব্যবসার পুঁজিও ধার হিসেবে
চাননি – যদিও সেটি তার সাংবিধানিক অধিকার ছিল। নিজেরা পুঁজি জড়ো করে শহরের নানান এলাকা সমৃদ্ধ করেছেন, ব্যবসা,
বসবাসের উপযোগী করেছেন। এর বদলে নয়ের দশকে তাদের কর্মস্থল থেকে, বাসস্থান থেকে
রাষ্ট্রের থেকে উচ্ছেদের হুমকির সামনে পড়তে হয়েছে। ১৯৯৬ সালের কলকাতায় আপারেশন
সানসাইনে(না সানসেট?) ১৮ জন হকার মারা যান। বিযয়টা হল বড়
পুঁজি দশ হাজার কোটি টাকার কলকাতার রাস্তার ব্যবসা দখল নিতে চাইছে। তারা সংগঠিত
ভাবে হকার বিরোধিতা চারিয়ে দিতে চাইছে জনগণের মধ্যে। কিন্তু রাস্তায় হকারদের ব্যবসা জনগণ-সমর্থন ছাড়া হয় না।
২০০০ সালে হকার সংগ্রাম কমিতির গ্রাহক সমীক্ষায় পরিষ্কার হকারদের থেকেও মানুষ যে
সেবা পান তা যে কোনও সংগঠিত সেবা ক্ষেত্র থেকে ২৫-৭৫ শতাংশ শস্তা, ভাল এবং হাতের
কাছে পাওয়া যায়। ২০০৪ সালে হকারদের
নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে কলকাতায় চারটি মডেল হকার জোন(পার্ক স্ট্রিট, রাসেল স্ট্রিট,
ক্যামাক স্ট্রিট, এলগিন রোড) তৈরি হলে হকারদের গ্রাহক বেড়েছে। ফুড হকারেরা কলকাতায় দিন আসা কয়েক কোটি মানুষের মুখে
অন্ন তুলেদেন। এঁদের সেবা দেওয়ার সামর্থ নেই সংগঠিত হোটেল রেস্তোরাঁর। ১৯৯৩ সালের অল
ইন্ডিয়া ইন্সটিউট অব হাইজিন এন্ড পাব্লিক হেলথের সমীক্ষা বলছে ফুটপাথে ৩০০ ধরণের গরম
এবং টাটকা খাবার পাওয়া যায়। তাই জীবানু বাসা বাঁধে না। হকারেরা বাসি খাবার
বিক্রি করেন না। শুধু ব্যবহারিক জলের
মান উন্নত করতে পারলে টুকরো সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনা যায়। সমাধানে সরকারের
অংশগ্রহণ জরুরী। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে বাংলায় সে উদ্যমের অভাব রয়েছে। ২০১৩, ৯ সেপ্টেম্বরে সালে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যগুলোর
সচিবদের নির্দেশ দিয়ে বলে চার মাসের মধ্যে পৌরসভাগুলোতে টাউন ভেন্ডিং কমিটি তৈরি
করে হকারদের রেজিস্ট্রেশন, হকিং জোন নন হকিং জোন তৈরি করতে হবে, তাদের পরিচয়পত্র
দিতে হবে। যতদিন না কমিটি হবে ততদিন কোনও হকার সরানো যাবে না। ভারতে ৮৫ শতাংশ কর্পোরেশন
সেটি করলেও বাংলায় আজও টাউন ভেন্ডিং কমিটি তৈরি হয় নি। ২০১৪ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি
সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে, ৪ মার্চ, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে গৃহীত হওয়া হকার সম্বন্ধীয়
আইনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হল। শহরে মানুষের চলাচল, যান চলাচল বাধাহীন হয়
এবং একি সঙ্গে হকারদের জীবন জীবিকার স্বার্থ সংরক্ষণ হল। আমরা মনে করি শহরে গতি আনতে হবে। তাই টাউন ভেন্ডিং কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক করবে
হকারেরা কোথায় বসবে আর কোথায় নয়। যদিও বলা হয় কলকাতায় মাত্র ১১ শতাংশ রাস্তা।
কিন্তু সেই ফাঁকা স্থান বজায় রেখে হকারদের মূলতঃ ফুটপাথে পুনর্বাসন সম্ভব। বাকিদের
কলকাতার পৌর বাজারগুলো বহুতল করে নিচের একটি তলা হকারদের জন্যও কর্তৃপক্ষ দিয়েও
দেন তাহলেও প্রচুর হকার বসতে পারেন। কোনও ডেভেলাপার যদি হকারদের ব্যবসার জন্য নিচে
তলাটি ছেড়ে দেন তাহলে তাঁকে একটা তলা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ছাড় দেওয়া যায়। ইচ্ছে থাকলে
উপায় হয়। আইন এবং কোর্টের রায় বলছে আগামী দিনের নতুন শহরে শহর পরিকল্পনায় আড়াই
শতাংশ স্থান হকারদের জন্য ছেড়ে দিলে বড় শহরের ওপর হকারদের চাপ কমে যাবে। আমরা মনে
করি আরবান রিনিউয়াল মিশনের দর্শনে যারা সব কিছু কিনে নিতে পারেন তাদের জন্য শুধু উন্নয়ন
নয়, ফ্লাইওভার, বড় বড় বাড়ি, শপিং মলও উন্নয়ন নয়। দরকার মানুষের উন্নয়ন। আরবান লাইভলিহুড মিশনের বিপুল
টাকার মধ্যে পাঁচ শতাংশ হকারদের সমীক্ষা, প্রশিক্ষণ, পারিবারিক সুরক্ষা আর
পুনর্বাসনের উন্নয়নের পরিকল্পনায় খরচ করতে পারবে রাজ্যগুলো। কোর্টের রায়
এবং কেন্দ্রীয় আইনে বলা হয়েছে শহরে টাউন ভেন্ডিং কমিটিতে স্থানীয় সরকার, পুলিশ,
হকার এবং অন্যান্যদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এরাই ঠিক করবেন আগামী দিনে শহরে কোথায়
হকার স্থায়ী ভাবে, আর কোথায় নিয়ন্ত্রিত ভাবে বসবেন। আগামী দিনে যখন শহরের
লোকসংখ্যা বাড়বে, তখন সেই বাড়তি জনসঙ্খ্যাকে সেবা দিতে হকারদের জন্যও যে আড়াই
শতাংশ জায়গা রাখা হয়েছে, সেখানে কোন নীতিতে হকারেরা বসবেন। আমি সংগঠন করতে গিয়ে মহাদেশগুলোর
চল্লিশটি দেশ ঘুরে দেখেছি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় থাইল্যান্ডের হকার পরিকল্পনা সব থেকে
ভাল। এদের সমাজ বাস্তবতা ভারতের মত। প্রচুর মানুষ, প্রচুর হকার। এঁরা নিজেদের মত
করে হকারদের সাজিয়ে নিয়েছেন। রাস্তার জায়গা নিয়ে দখলদারি নেই। কিন্তু খুব গুছোনো।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। শহরের হকার নেতাদের সেগুলো দেখালে তাদের চোখ ফুটবে। আমরা মনে
করি শহর জনগণের, হকারেরাও এই শহরের
গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি সুন্দর রাখা হকাদের
দায়িত্ব। এই শহরের যে হকার
পিচের রাস্তায়, গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের ৫০ ফুট, ফুট জুড়ে বসে তারা হকারদের বন্ধু নয়। এদের মদত দিচ্ছে প্রশাসন, পুলিশ আর তথাকথিত ইউনিয়নের
নামে তোলাবাজ। সারা দেশে এরা বিপুল অর্থ হকারদের থেকে তোলা তোলে। আমরা কলকাতা
পুরসভাকে বলেছি, সারা বছর হকারেরা ১০০ কোটি টাকা সরাসরি কর দেবেন। এই রাজ্য
হকারদের স্বার্থ দেখতে চাইলে ভেন্ডিং কমিটি তৈরি করেই এগোতে হবে। এই কমিটি ঠিক করবে কোনও হকার বিধি ভঙ্গ করলে তার কি
সাজা হবে। হকার ইস্যুতে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীও আশাকরি এই ভাবনাই ভাবছেন। নান্যঃপন্থা।
No comments:
Post a Comment