পুতুল নাচের পরম্পরার ইতিহাসে শুধু ছায়া পুতুল ছাড়া চারটি পুতুল নাচের
ঐতিহ্য আজও জীবিত রয়েছে বাংলায়। ঐতিহ্যগত ছায়া পুতুল বাংলার পাশের রাজ্য ওড়িশায়
আজও দেখানো হয়। ডাং পুতুল, বেণী পুতুল, দস্তানা পুতুল এবং তার পুতুল নাচের বহু দল
বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। এই পুতুল নাচগুলি প্রচার প্রসারে
সরকার, স্বেচ্ছাব্রতী সংগঠন বেশ কিছু কাজও করেছেন। যদিও সেই কাজ প্রয়োজনের তুলনায়
অপ্রতুল। বিভিন্ন গবেষক, বিভিন্ন সবুজ পত্রিকা, পুতুল নাচ, জ্ঞান, প্রযুক্তি বিষয়ে
তাত্বিক, প্রায়োগিক নানান দিক বিচার করে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। সরকারি উদ্যোগে
বেশ কিছু বড় কর্মশালাও আয়জিত হয়েছে। পুতুল নাচের দলগুলোর টিকে থাকা, তাদের সমস্যা,
তাদের অনুষ্ঠান পাওয়ার সমস্যা, সব কটি পুতুল নাচের আঙ্গিকের, প্রায় সব কিছু বিষয়
নিয়েই নানান সরকারি, বেসরকারি সংগঠন আজও কাজ করে চলেছেন, তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী।
শহুরে, অনেকটা মিডিয়ার যথেষ্ট দাক্ষিণ্য পাওয়া ইয়োরোপীয় ধাচের পুতুল নাচের
আঙ্গিকের বাইরে আজও নানান সুবিধে অসুবিধে নিয়ে টিকে রয়েছেন কয়েক শ গ্রামীণ পুতুল
নাট্যের দল। একদা রঘুনাথ গোস্বামীমশাই তার নিজের শহুরে দল ‘দ্য পাপেটস’ নিয়ে বহু
পুরস্কার জয়ী অনুষ্ঠানের বাইরে, নিজে উদ্যোগী হয়ে গ্রামীণ পারম্পরিক দলগুলিকে ভারত
এবং ভারতের বাইরে বহু অনুষ্ঠান করিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, গ্রামীণ সংস্কৃতিতে পুতুল
নাচ আজও বাংলার অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিককর্ম। সেই বৈদিক আমল থেকে সন্ধিমের চামড়া
জুড়ে জুড়ে তৈরি করা ছায়া পুতুল, বা তার পুতুল নাচের অসম্ভব পুরনো গ্রামীণ ঐতিহ্য গ্রামের
পুতুল নাচের সংস্কৃতি কর্ম আজও বহন করে নিয়ে চলেছেন, নানান সরকারি, বেসরকারি
ঔদাসিন্য সত্বেও।
শিক্ষিত শহুরে
লোকসংস্কৃতিপ্রিয় ইংরেজি পদ্ধতিতে শিক্ষিত বাঙ্গালি, গ্রামীণ সংস্কৃতি বিষয়ে
আলোচনায় লুপ্তপ্রায় লব্জটি খুব বেশী যেন প্রয়োগ করতে ভালবাসে। শিল্পবিপ্লবের সময়
থেকেই শিক্ষিত বাঙালি শহরমুখীন, ইংরেজ সংস্কৃতির সরাসরি অনুগামী। ইংরেজদের সঙ্গে
মিলে, ইওরোপমুখ্য বাঙালি, চাকরি, ব্যবসা আর উমদোরির লোভে, কয়েক হাজার বছর ধরে তিল
তিল করে গড়ে তোলা গ্রামীণ উৎপাদন, ব্যবসা, শিক্ষা পরিকাঠামো ধংস করেছে। অষ্টাদশ
শতকের ভারতের ২৫ শতাংশ জিডিপি বিংশ শতকে এক শতাংশে নেমে যে এসেছিল, তার বড় কারণ
ব্রিটিশের সঙ্গে ভারত সম্পদ লুঠের অংশীদার হয়েছিল ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি। বাল্যকাল
থেকেই সে শিকড় উৎপাটিত। শেকড় বিহীন শহুরে আলালি সংস্কৃতির প্রতিভূ বাঙালি ইংরেজি
ভাষা শিখে, ইংরেজি আদবকায়দা শিখে, শিশুকাল থেকে মধুসুদনেরমত ইয়োরোপীয় সংস্কৃতির
মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে ভালবেসেছে। তার প্রিয় কবিতার স্তবকটি এদেশে জন্মে পদাঘাতই
শুধু পেলাম। ইয়োরোপের প্রাধান্য তার কাছে স্বতঃসিদ্ধ। যা কিছুই আমেরিকিয়, যা কিছুই
ইয়োরোপীয় সব কিছুই আন্তর্জাতিক, প্রগতিশীল, ধ্রুপদী। এই এলাকার বাইরে আর সব
স্থানীয়, ফোক, ট্রাইবাল – তার ফিল্ড। তাদেরকে খুব খেটেখুটে আন্তর্জাতিক মানের হয়ে
উঠতে হয় – বা তাদের আন্তর্জাতিক মানের কাছে মিউজিয়ামের দেখানোর মত করে আতুপুতু করে
দেখানো হয়। এবং সেই ঠেকা নিয়েছে শিক্ষিত বাঙালি। কেননা সেই ভারতে আন্তর্জাতিকতার,
প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী। সে জানে ফোক, আদিবাসীর মানে কি আর প্রগতিশীলতা উন্নয়ন
মানে কি!
No comments:
Post a Comment