Tuesday, August 14, 2012

দিনাজপুরের পরম্পরায় ডুবে থাকা এক শিল্পী

উত্তররঙ্গ ১২য় শান্তি বৈশ্য
একসময় লৌকিক দক্ষিণ বাঙলায় প্রবাদ ছিল চাষ করতে আর তাঁত চালাতে না পারলে বাঙালির মেয়ের বিয়ে হয় না মালদার গঙ্গা পেরিয়ে দিনাজপুরে, এই বাক্যটাই ঈষদ পাল্টে বলা হয়, ধোকড়া বোনা, চাষের কাজ আর বাঁশের শিল্পকর্ম না জানলে গ্রামীণ মেয়ের বিয়ে হওয়া মুশকিল বাঙলার পারম্পরিক বাঁশের কাজের শিল্পী শান্তি বৈশ্য নিজের জীবন সংগ্রামে শুধু এই প্রাচীণ বাঙালি প্রবাদটি সত্যি প্রমাণ করেন নি, বাঁশের কাজ করে আজও নিজের সংসার প্রতিপালন করেন অপরিসীম প্রাত্যহিকতায় 
বিবাহসূত্রে স্বামী সেল্টু বৈশ্য থাকতেন শ্বশুর বাড়িতে, স্ত্রী শান্তির ভিটেতেই বিশ্বায়ণ আর শহুরে রাজনীতির প্রভাব যখন মহামারীরমত ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম সমাজে, তখন দুই দিনাজপুরে এই ভঙ্গুর সময়েও বাঙলার সাম্যবাদী তন্ত্র সভ্যতার নানান রেশ জড়িয়ে রয়েছে সমাজের স্তরেস্তরে ঘরজামাই কথাটির চল থাকলেও, কথাটিতে শহুরে পুরুষতান্ত্রিকতার মরণ কামড় নেই শান্তির স্বামী সেই এলাকায় দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ব্যবহার হওয়া নানান ধরণের বাঁশের দ্রব্য তৈরি করতেন বাল্যাবস্থা থেকেই শান্তি বাঁশের কাজ করতেন দুজনে মিলে তৈরি করতেন বিয়ের ডালা, বিয়ের ফুল রাখার রঙিন বরণ ডালা, সাদা ও রঙিন কুলো, মুড়ি ভাজার চালন, ভাত গড়ানো আর তরকারি রাখা ঝুড়িরমত বাঙলার নিজস্ব গড়নশৈলীওয়ালা অসংখ্য দ্রব্যাদি
স্বামী মারা যান ২১ বছর আগে কিন্তু শান্তি অকুল পাথারে পড়েন নি, তিনি নিজে বাঁশের কাজ জানেন, যে কাজের চাহিদা রয়েছে নিজ এলাকাতেই এবং এই জ্ঞাণের সঙ্গে নিজের পরিবারের জীবনযাত্রা নির্বাহ করারমত সঙ্গতিও তৈরি হয়েছে তাঁর দিনাজপুরের পারম্পরিক হস্তশিল্প, বাঁশের কাজ সম্বল করে তিনি আজও নিজের পরিবারের প্রতিপালন করে চলেন অনপনেয় প্রাত্যহিকতায়
স্বামী মারা যাওয়ার বছর পাঁচেক পর তিনি পাশের অঞ্চলে, পরেশ সরকার এবং শিল্পী মধুমঙ্গল মালাকারের উদ্যমে তৈরি হওয়া খুনিয়াডাঙির বাঁশ-কাঠের সমবায়ে নতুন ধরণের বাঁশের শিল্পদ্রব্যের প্রশিক্ষণ নিয়ে শহুরে বাজারের উপযোগী, স্থানীয় ভাষায় চিকন কাজএর নানান ধরণের দ্রব্য বানাতে শিখলেন দুই মেয়ে, অপর্ণা, ছায়ার বিয়ে দিয়েছেন হস্তশিল্প অবলম্বন করে কলকাতা, মালদহ, শিলিগুড়িরমত কারু মেলায় অংশগ্রহণ করে বছরে রোজগার করেন আধলাখ টাকার কাছাকাছি, যে শিল্পজাত অর্থ দিয়ে তিনি অক্লেশে প্রতিপালন করেন নিজের সংসারবিশ্ব
শান্তির জীবন চমক বিহীন শহুরে জীবনযাত্রার পক্ষে বড্ড বেশি নিস্তরঙ্গ শান্তির জীবনযাত্রা শান্তি তাঁরর শিল্পদ্রব্য জেলা অথবা রাজ্য অথবা জাতীয় স্তরে প্রতিযোগিতার জন্য পাঠান নি শান্তির খেদ নেই শান্তি নিভৃতে পুজোরমত আজও বয়ে নিয়ে চলেন বাঙলার পারম্পরিক শিল্প সম্ভার, নিজেরমতকরে পারম্পরিক শিল্পীদের বিনম্রতায়, মাথা নিচু করে কাজ করে চলেন শ্রীতমী নদীর ধারে ফতেপুর-কালিয়াগঞ্জ রাস্তার ধারেই ঊষাহরণে, নিজের ভিটায়
শান্তিরা আজও নিজের শিল্পীত জীবনে ব্যক্তি-শিল্পস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বয়ে নিয়ে চলেন লৌকিক দিনাজপুরের কৌম শিল্প পরম্পরা শিল্পসম্ভারে দেখনদারি নেই, জীবনযাত্রায় নেই শহুরে শিল্পীদেরমত চাকচিক্যের বাহার, তবুও বাঙলা জুড়ে শান্তি বৈশ্যের মত হাজারো পারম্পরিক শিল্পী অলক্ষ্যে অলঙ্কার এবং অহঙ্কারহীনভাবে শিল্পদেবতা আর বাঙলার ঐতিহ্যের সেবা করে চলেছেন নিরন্তর শান্তিরমত শিল্পীদের অসম্ভব একাগ্রতা আর নিঃস্বার্থ নিবেদনে আবহমান কাল জুড়ে টিকে রয়েছে বাঙলার পারম্পরিক শিল্পের প্রবাহমানতা
জয়তু বাঙলার পরম্পরা, জয়তু শান্তি

No comments:

Post a Comment