মির জাফরের
তৃতীয় স্ত্রী মুন্নি বেগম পলাশি চক্রান্তের অন্যতম বর্ণিল এক চরিত্র। মুন্নি
প্রখ্যাত হয় তার নাম ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হেস্টিংসের ইম্পিচমেন্টের সঙ্গে
জড়িয়ে যাওয়ায়। মুন্নি
ছোটবেলাতেই নর্তকী বিশুর নাচ দলে ভারত ঘুরতে ঘুরতে বাংলা সুবার প্রধান শহর মুর্শিদাবাদে এসে
পৌঁছয়। সিরাজের পিসি ঘসেটি
বেগম আর নাওয়াজিশ মুহম্মদ খানের পুত্র ইক্রমুদ্দৌল্লার বিবাহে বিশুর নাচ দলের সঙ্গে মুর্শিদাবাদে
অনুষ্ঠান করে যথেষ্ট নাম অর্জন করে। দেখতে সুন্দর আর মুন্নি হয়ত শিখে নিয়েছিলেন রাজপুরুষদের বশ করার দেশি কৌশল। আলিবর্দী খাঁএর প্রধানতম সেনাপতি মির জাফরের
নজরে পড়ে। জাফরের অন্দরমলে ঠাঁই পায় সে। মির জাফরের অন্য দুই ডাকসাইটে বৌ শাহ্ খনম আর বাবু বেগমকে টপকে মির জাফরের নজর কেড়ে নেয় মুন্নি। ক্রমশঃ মুন্নি হয়ে ওঠে মিরজাফরের প্রধানা বেগম। মির জাফরের সিংহাসনে আরোহন এবং সব শেষে ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৭৬৫তে মির জাফরের মৃত্যু হলে স্বামীর বিশাল সম্পত্তির মালিক
হয়ে বসে মুন্নি বেগম।
ক্ষমতার অলিন্দ দখলে যথেষ্ট পরিপক্কতা দেখিয়ে পলাশির মূল ক্রীড়ানক ক্লাইভের
বন্ধুত্ব অর্জন করে নানান ছলে। ক্লাইভও তাকে আশ্বাসদেয় তিনি আর তার দলবল মুন্নিকে তাদের মাতৃস্থানীয়ারূপে
দেখবে। কোম্পানির সঙ্গে রফা হয় সিংহাসন নিয়ে। পুত্র
নাজমুদ্দৌল্লাকে মসনদে বসাতে ক্লাইভকে পাঁচলাখ টাকা ঘুষও দেয় সে। নবাবের
মাতারূপে তিনি অন্তঃপুরের প্রধানা হয়ে ওঠে। চাকরবাকরের দেখরেখ, বিভিন্ন ধর্মীয়-সামাজিক অনুষ্ঠানের খরচ, জেনানা মহলের দায় মেটাতে মাসিক ২৩
হাজার টাকা দায়ও তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেয় মুন্নি। ইতোমধ্যে রেজা খাঁ নবাবের প্রশাসনের নায়েব নাজিম হয়ে ওঠেন। রেজা খাঁর সঙ্গে নরমে গরমে সম্পর্ক স্থাপন করে মুন্নি। ১৭৬৬তে
নাজমুদ্দৌল্লা মারাগেলে সিংহাসনে আরোহন করে ভাই সইফুদ্দৌল্লা। ১৭৭০এর মার্চে
সইফুদ্দৌল্লার মৃত্যু ঘটলে বাবু বেগমের পুত্র মোবারকউদ্দৌল্লা বাংলার নবাবের পদে
আরোহন করে।
এরপর মুর্শিদাবাদে মুন্নির সমস্ত প্রতাপ নির্বাপিত হল।
কিন্তু উদ্যমী মুন্নি চুপ করে ছিলে না। সে সময় মুর্শিদাবাদের রাজ মহলের পর্দার আড়ালে বিভিন্ন
নল চালনায়ও মুন্নি মাহির হয়ে ওঠে। রেজা খাঁর বিরুদ্ধে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও ঘুষের আর দুর্ণীতির নানান অভিযোগ ওঠায় তদন্ত শুরু হল। নন্দকুমারের পুত্র
রাজা গুরুদাস মুন্নি বেগমের প্রধান সহচর নির্বাচিত হয়। বাংলার জমিদারদের ওপর
তার প্রতাপ এতই ছিল যে নাটোরের রানী ভবানী ত্রিশ বেহারাসহ একটি পাল্কি উপহার দেন
এবং বেহারাদের ভরনপোষণের জন্যও জমিও মুন্নিকে উপঢৌকন দেন। তত্কালীন এক
উচ্চপদস্থ কর্মচারী লর্ড ভ্যলেন্সিয়ার বয়ানে ৭০ বছর বয়সী মুন্নিকে প্রায়ই হুঁকো টানতে
দেখতেন। মুন্নি পরোপকারী ছিল। সহজে বন্ধুত্ব নষ্ট
করত না। মুন্নি ৯০ বছর বয়সে ১০ জানুয়ারি ১৮১৩তে মারা যায়
এবং মির জাফরের সমাধিতে তার দেহ সমাধিস্থ করা হয়।
No comments:
Post a Comment