Sunday, February 26, 2017

দেশজ কৃষ্টিচর্চা - হাপু গান


বাঁকুড়া-বর্ধমান-বীরভূম জেলার হাপুগান করেন বাজিকর, মাল, বাইতি, কাকমারা, বেদে, পটুয়া সম্প্রদায়। এ ধরনের প্রায় প্রত্যক সমাজ মূলতঃ ভ্রাম্যমান জীবনযাপন করতেন। রোগএর নানান দেশজ ওষুধের –স্থানীয় ভাষায় টোটকা(আজকের নিন্দিত অর্থে নয়) – খনি ছিলেন এঁরাই। কবরেজির বাইরেও গ্রাম্য চিকিৎসা ব্যবস্থার ধারক-বাহক ছিলেন এঁরাই। এরাই রোগ থেকে বাঁচবার নানান টোটকাও বলতেন নিজেদের গানে।
এ দেশের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যখন শুধুই এ্যালোপাথি চিকিৎসা ব্যবস্থাএ একচোখামি জাঁকিয়ে বসেনি, যখন দৈত্যসম ওষুধ/প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর স্বার্থ রোগীর স্বার্থের ওপরে ওঠেনি, ডাক্তারেরা লক্ষ লক্ষ কাঞ্চনমুদ্রা ব্যয় করে ডাক্তারি পড়ে রুগিমার ডক্তার হয়ে বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার অদৃশ্য ক্যানভাসারের কাজে দামি গাড়ি বাড়ি হাঁকিয়ে বড়লোক হবার দায় নিজের কাঁধে তুলে নেননি, তখন থেকেই কয়েক হাজার বছরের দেশজ জ্ঞানচর্চার বাহক হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা দিতেন এই বাজিগরেরা – এই কাজে সেই সমাজের মেয়েদের ভূমিকা ছিল অগ্রণীর।
হাপু গানের সঙ্গে নাচ দেখিয়ে তাঁরা ঢুকে যেতেন অন্তরপুরে তাঁদের ওষুধের সামগ্রী নিয়ে। ওষুধের সঙ্গে থাকত নানান ধরনের বিক্রির জিনিসপত্র। যে নৌকো করে এঁরা দেশে দেশান্তরে ঘুরতেন তাকে বলাহত বেদে নৌকো।
বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গে নামক পুস্তকে বেদে/হাপু গানের নানান উদাহরণ পাওয়া যাবে। এই গানে তাল রাখতে ঘুঙুর, খঞ্জনি আর ডাবকি ব্যবহৃত হত। দ্রুত উচ্চারনের জন্য(যাকে আজকের ভাষায় র‍্যাপ বলে) গানের আগে মুখে এক ধরনের শ্বাস নেওয়ার ধরণটাই হাপু গানের নিজস্ব ধারা। মহিলা আর ছোটছোট ছেলেমেয়েরা বগল বাজিয়ে, হাত দিয়ে শরীরের নানান অঙ্গে আঘাত করে বিচিত্র শব্দ তুলে, নানান অঙ্গভঙ্গীকরে গান পরিবেশন করেন ।
চিরকালেরমতই মধ্যবিত্ত বিশেষজ্ঞরা হাপুকে মোটাদাগের, অশ্লীল বা অশ্রাব্যসহ নানান ধরণের উচ্চসাংস্কৃতিক অভিধা দিয়েছেন। তবুও বলা যায় হাপুর তুলনা হাপুই – তথাকথিত অশিক্ষিত-অমার্জিত জনগণই দেশের সংস্কৃতির হকদার, রক্ষাকর্তা। যে সব মানুষ এধরনের সংস্কৃতিকে মোটাদাগের, অশ্লীল বা অশ্রাব্যবলে গালি পাড়ছেন, তারাই নিজের দেশের সম্পদের প্রতি অশ্রদ্ধাজ্ঞাপণ করছেন – এ কথা বলার আজ সময় হয়ে এসছে, একথা আজ কম্বুকণ্ঠে বলতে হবে।
কয়েকটা হাপুগানের নমুনা
হাপু আতা পাতা লো,
হাপু সর্ষে পাতা লো,
হাপু আম খাবি জাম খাবি,
তেঁতুল খাবি লো,
তেঁতুল খেলে প্যাট গুলোবে ছেলে হবে না,
হাপু কাকে খেলে লো,
হাপু ক্যা ঝাড়ুনি লো,
হাপু বেদের মাকে লো
ই ডাঙাড়ে ঐ ডাঙাড়ে শালিক বস্যেছেঁ
বেদের মাকে বিয়া করতে পাল্কী আস্যেছেঁ
হা ফুঃ কদম ফুঃ
বুঢ়াতে বুঢ়ীতে লড়াই লাগ্যেঁছে
বুড়া কপালে বুঢ়ী পাদ্যেঁ দিয়েঁছে
হা ফুঃ কদম ফুঃ – ইত্যাদি
অথবা
হাই লো বামুন দিদি
বাগদি ঠাকুরঝি
আমি কেলে গয়লার বেটার
ঠিয়ে কখন হাঁস্যেছি-
হাঁস্যেছি বেশ করেছি
তর বাপের কী
যখন ছিলাম ছ বছরের
তখন উঠে নাই গা
এখন আমি বছর তেরো
হব ছেলের মা
মাছ ধরতে গিলাম আমি
কুঁয়ে লুদির কুলে
দেখি এ্যাক মিনসে
রসির লাগর
ডাঁড়া ফেলছে চারে
জলে নেমে জাল ছাঁকি
আর মিনসে থাকে চেঁয়ে
ভাল্ কেনা তুই ঢ্যামনা মিনসে
থানা কেনা চেয়ে
তাকে দেখে উচএ যাব
নইক তেমন মেয়ে
মাছ ধরছি চিংড়ি চাঁদা
গচি মাগুর গাগর
কার্তিক মাসে মাছের রসে
বলবো কি বুন্ বলবো কিলো
আমার প্যাট হয়েঁছে ডাগর
খোসার দুম খোলাক দুম
কাঁথা চাপা দিঁয়ে মারব ঘুম – ইত্যাদি
বছর পনের আগে বীরভূমের নলহাটিতে শুনেছিলাম, পুরোনো খাতা থেকে এঁরা প্রকাশ পেল। এঁদের গানে আর চমত্কৃত হওয়ার উপাদান রয়েছে।

Saturday, February 25, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২২ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় এই ওষুধগুলি বিক্রি করতে চিকিৎসক এবং অচিকিতসকেদের নিয়োগের পরিকল্পনা হল। জেলার মেডিক্যাল অফিসার এবং তার অধস্তন আর জমিদারদের জুড়ে এই কাজটা সম্পাদন করার পরিকল্পনা করল সরকার। ত্রাণের বা অন্যান্য কাজে কিন্তু বাংলার কবিরাজদের যুক্ত করেন নি লেফটানেন্ট জেনারেল। দেশজ ওষুধ ব্যবহার ছাড়া দেশজ চিকিৎসকের সাহায্য নিতে এবং তাদের সাহায্য করতে অস্বীকার করেন তিনি।

ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল বেছে নেওয়া হল এই প্রকল্পের মুখড়া হিসেবে ১৮৬৯এর শেষের দিকে। সেখানে সিভিল সার্জেন এবং আরেকজন যোগ্য সহকারী সিভিল সার্জেন, এনাটমি, সার্জারি, মেটিরিয়া মেডিকা এবং ছোটখাট শল্য চিকিৎসা নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন। তিন বছরের শিক্ষানবিশী কাল শেষে উত্তীর্ন ছাত্রদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, হয় তারা কম্পাউণ্ডার বা নিচুস্তরের দেশিয় চিকিৎসক হিসেবে সরকারি চাকরি করতে পারে অথব গ্রামে ফিরে গিয়ে চিকিৎসা করতে পারবে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু গ্রামীন দেশিয় রোগ্রাক্রান্তদের সাহায্য করার জন্য তাই ভারতের ব্রিটিশ জনগনকে সাহায্য করতে স্নাতকদের গ্রামে যেতেই উতসাহ দেওয়া হল। আর মহামারীর প্রকোপ হলে এই চিকিৎসকেরা সরকারের হয়ে কাজ করতেন।

১৮৭৩ সালে গ্রামের কবিরাজ, কম্পাউন্ডারদের সরকারি ডিসেপেনসারিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানোর নতুন এক পরিকল্পনা পেশ করেন বর্ধমানের জেলা শাসক মেটকাফ। তার উদ্দেশ্য ছিল জ্বরাক্রান্ত বর্ধমানের জেলাগুলিতে তাদের ব্যবহার করা। প্রশাসনের দুটিস্তরের মতভেদে এই প্রস্তাবটাও চাপা পড়ে যায় – প্রথম দপ্তরটি আইন সংক্রান্ত, যেখানে মেটকাফ নিজেই চাকরি করতেন এবং আরেকটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যেখানে বাংলার হাসপাতালগুলির ডেপুটি ইনপেক্টর জেনারেল ড জি স্যান্ডার্স কাজ করতেন। স্যান্ডার্স, মেটকাফের প্রস্তাবের পাল্টা দিয়ে বললেন কবিরাজদের বাংলার প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন প্রান্ত থেকের জোগাড় করে তাদের বর্ধমানের সিভিল সার্জেনের তত্ত্বাবধানে জ্বর, পেটখারাপ, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি রোগের নিশ্চিত এবং যথেষ্ট পরিমান ওষুধ বর্ধমানে তৈরি করিয়ে চিকিৎসা করতে সাহায্য করতে হবে। প্রত্যেক প্যাকেটের গুলি, গুঁড়ো এবং মিকচারের গায়ে কম্পাউন্ডারের নির্দেশে দেশিয় ভাষায় ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া থাকবে। তবে তিনি স্পষ্ট বলেন চিকিতসায় কম্পাউন্ডারের জ্ঞানের ওপর নির্ভর করা চলবে না৮৯।

এই নীতিই দুটি প্রকল্পের মধ্যে পার্থক্য ঘটিয়ে দিয়েছিল। বোস এবং স্মিথ একদিকে যেমন দেশিয় চিকিতসকেদের পশ্চিমি ঔষধে শিক্ষিত করিয়ে কাজে লাগাবার কথা ভাবছিলেন অন্যদিকে সান্ডার্সের প্রকল্পে দেশিয় চিকিৎসকেরা কম্পাউন্ডার, সহায়ক, সাহায্যকারী মাত্র। আগের প্রকল্পে পশ্চিমি দৃষ্টিভঙ্গীতে দেশজ চিকিতসার গুনাগুন চিহ্নিত করে সেই জ্ঞানকে ব্যবহার আর দ্বিতীয় প্রকল্পে তাদের জ্ঞানকে ব্যবহার করে তাদের সাহায্যকারী হিসেবে রেখে দেওয়া।

তার পরের কয়েকটি প্রস্তাবে দেশিয় চিকিতসকেদের ব্যবহারের কথা উঠেছিল। ১৯০৭ সালে দিল্লিতে এক বৈঠকে স্থানীয় প্রশাসনে য়ুনানির হেকিম এবং আয়ুর্বেদিয় বৈদ্যদের কাজে লাগানোর নতুন করে প্রস্তাব ওঠে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল জি বমফোর্ড লেফটানেন্ট গভর্নরের প্রস্তাব গ্রহন করে বৈদ্য আর হেকিমদের কাজে লাগানোর শর্ত কমিশনারদের হাতে ছেড়ে দিলেন। এবং পুরসভা আর পঞ্চায়েতে তাদের কাজের মাসিক বেতন ১৫টাকা থেকে বেড়ে হল ২২টাকা।

উনবিংশ শতের শেষের দিকে এবং বিংশ শতকের প্রথম দিকে তিন ধরণের চিকিৎসক ব্রিটিশ বাংলায় দেখা যেত, প্রথম দলের মানুষ হলেন নিজের শেকড়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেশিয় চিকিৎসার গোঁড়া সমর্থন, যারা শেষ দিন পর্যন্ত নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যবসা করে গেছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষেরা হলেন পশ্চিমি চিকিতসাব্যবস্থায় চিকিৎসা করা ইওরোপিয় আর দেশিয় চিকিৎসকবৃন্দ। আর্নল্ডের ভাষায় তারা নিজেদের ব্যবস্থার বাইরে সব কিছুকে ফেলনা দাবি করেন। আর তৃতীয় শ্রেণীর দেশিয় চিকিৎসকেরা পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যার দৃষ্টিতে নিজেদের চিকিতসাবিদ্যার গবেষণা এবং প্রচার প্রসার ঘটানো। এই কাজে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশজ চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে গবেষণা আর জ্ঞানচর্চা ছিল তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের কাজের বিকাশের মৌল ভিত্তি। তারা ১৯১৭-১৮ সালে একটি পৃথক আয়ুর্বেদিক বোর্ড তৈরি করার দাবি জানান তাহলেই তাদের মনে হয় আয়ুর্বেদ বিষয়ে নির্দিষ্ট ধরণের গবেষণার পদক্ষেপ গ্রহন করা যাবে। তাদের বিশ্বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে যদি এই ধরণের গবেষণা করা যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত উপাধি পাওয়া সহজ হবে। এই ধরণের কাজ কবিরাজ যামিনীভূষণ রায় বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। ১৯১৬-১৭ সালে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদিয় কলেজের স্থাপনা করে পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা পড়াবার মত করে পাঠ্যক্রম তৈরি করেন তিনি। এর কুড়ি বছর পরে দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠায় ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যায় স্টেট মেডিক্যাল ফেসিলিটিগুলি গড়ে ওঠে।

সারাংশ
দেশিয় এবং পশ্চিমি, এই দুই ধরণের চিকিৎসাবিদ্যা শুধু যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষনায় বেড়ে উঠেছিল তা যেমন ঠিক, তেমনি দুটি চিকিৎসা, নিদান দেওয়ার তাত্ত্বিক অবস্থানের মিলের জন্যও এই বিকাশ হয়েছিল এটাও বলা দরকার। ঠিক সেই জন্য প্রথম দিকে একটি অন্যটির প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে নি। এর ফলে দেশজ ওষুধ বিষয়ে গবেষণা বৃদ্ধি পায় এবং দেশজ চিকিতসকেদের চাকরি হয়।

কিন্তু বিদেশিয় ভাষায় বিদ্যাদান দেশিয় চিকিৎসা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা খাড়া করে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রের অনুমোদনক্রমে ইংরেজি মাধ্যমে দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা পড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। দুই চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে বিপুল ফারাক তৈরি করার পিছনে যেমন সাম্রাজ্যবাদী তাত্ত্বিকদের বড় অবদান ছিল, তার সঙ্গে জুড়েছিল বাড়তে থাকা বড় পুঁজির বিনিয়োগে রসায়ন এবং ওষুধ শিল্পের দ্রুত কেন্দ্রিভবন ঘটতে থাকা আর ব্রিটেনে চিকিতসাবিদিদেরন বাড়তে থাকা পেশাদারিত্বও। একবিংশ শতের দ্বিতীয় শতে ভারতীয়রাও ভাবতে শুরু করে যে এই পার্থক্যটা হয়ত আর ঘোচানো সম্ভব নয়। এই পার্থ্যক্যটা কিভাবে বিভিন্ন স্তরীয় পেশাদারিত্বের জন্য ঘটল সেটা আমরা পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব।
(চলবে)

Friday, February 24, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২১ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

হয়ত কয়েকটি মহামারী আর মন্বন্তরের পর বাংলার গ্রামীনদের স্বাস্থ্যের অবস্থা অবনতি ঘটে এবংসে সময় গ্রামীন এলাকায় নানান রোগের প্রকোপে তাদের জীবনের আশংকা বেড়ে চলছিল। স্থানীয় চিকিতসকেদের নিয়ে একটি দল তৈরি করে প্রত্যন্ত গ্রামে গরীব মানুষদের সফলভাবে চিকিৎসা সেবার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিল। কিন্তু কিভাবে এই বিষয়টি বাস্তিবায়িত কতা হয়েছিল, তা আজানাই থেকে গিয়েছে।

১৮৬৯ সালে বাংলার এক সিভিল সার্জেন ভোলানাথ বোস পিড়ীত রোগীদের দাবি পূরণ করতে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। তিনি প্রত্যেক জেলায় একটি অস্থায়ী চিকিৎসবিদ্যা শিক্ষার বিদ্যালয় এবং তার সঙ্গে জুড়ে একটি হাসপাতাল খোলার প্রস্তাব দেন। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দেবেন সাব-এসিস্ট্যান্ট সারজেন এবং তার সহকারী থাকবেন একজন দেশিয় চিকিৎসক, এছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মীও থাকবেন। শিক্ষার্থীদের উতসাহ দিতে জলপানি এবং বিনামূল্যে বই দেওয়া হবে। এই প্রকল্পে সারা বছর ধরে প্রশিক্ষণ এবং হাতে কলমে কাজের সুযোগও ছিল। তার পরে সফল শিক্ষার্থীদের পঞ্জীকরণ করে গ্রামে চিকতসা করার অনুমতি দেওয়া হবে।

বাংলার তৎকালীন স্যানিটারি কমিশনার ড ডি বি স্মিথ ভোলানাথ বোসের এই প্রকল্প রূপায়িত করতে অস্বীকার করেন। তার মতে সাব-এসিস্ট্যান্ট সার্জেন আর দেশিয় চিকিৎসকের থেকে শিক্ষা নিয়ে কোন যুবক শিক্ষার্থীর এক বছরের দেশজ চিকিৎসক হয়ে ওঠার পরিকল্পনা অবাস্তব। তার ভয় হল, সেই সময়ের বাংলার গ্রাম জুড়ে জর, পেটখারাপ, কলেরার মত জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব হচ্ছিল, সেসব রোগ সারানো সেই শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব হত না। আর অত কম সময়ে শিক্ষা নিয়ে চিকিৎসক হয়ে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করার পরিকল্পনা স্মিথের পছন্দ হয় নি।

বোস শিক্ষার্থীদের ভাউন্ত, ইন্দ্রজবের মত পেটখারাপ, কলেরা ইত্যাদি সারানোর জন্য প্রয়োগের উদ্দেশ্য জানা ভেষজ সম্বন্ধে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। প্রত্যেক জেলায় এই একটা বিদ্যালয় চালানোর খরচ ধরা হয়েছিল মাসে ১০০০টাকা। এই টাকা যদিও প্রাথমিকভাবে সরকারের খাজাঞ্চিখানা দিলেও পরে স্থানীয় জমিদার এবং অন্যান্য স্বচ্ছল শ্রেণীর ওপর ছোট আকারের সেস বসিয়ে সে খরচ তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এছাড়াও প্রত্যেক প্রশিক্ষিত চিকিতসকেদের থেকে পঞ্জীকরণ শুল্কও নেওয়ার প্রস্তাব ছিল। প্রাথমিকভাবে তারা পাউন্ড কিপার(পশু রক্ষক/চিকিৎসক), টিকাকার এবং স্থানীয় স্যানিটারি অফিসার হিসেবে কাজ করবে এবং পরে তাদের গ্রামে তারা চিকিৎসা করার অনুমতি পাবে। পাঠ্য হিসেবে বিভিন্ন ধরণের বই দেশজ ভাষায় অনুবাদের পরিকল্পনা করলেন বসু।
স্মিথের সমস্যা ছিল যে ভোলানাথ বোস চিকিৎসার জন্য সম্পূর্ণভাবে দেশজ ভেষজ আর ওষুধের ওপর নির্ভর করেছিলেন। স্মিথ বিশ্বাস করতেন সরকারের উচিত দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরের অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং যেসব উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমান রয়েছে সেগুলির উন্নতির চেষ্টা করা। তার মতে এই পরিকল্পনা যদি সফল হয় তাহলে সরকার নিয়ন্ত্রিত ও পোষিত যে শিক্ষা ব্যবস্থা এদেশে চালু আছে তার প্রতি মানুষের অনাস্থা দেখানো হবে৮৫।
স্মিথের মনে হয়েছিল ভোলানাথ বোসের পরিকল্পনার সব থেকে বড় ঘাটিতি ছিল প্রশিক্ষিত চিকিতসকেদের পাউন্ড কিপার(পশু রক্ষক/চিকিৎসক), টিকাকার এবং স্থানীয় স্যানিটারি অফিসারের মত নিম্নশ্রেণীর পদে কাজ করানোর পরিকল্পনা। যুবা সরকার পোষিত চিকিৎসকদের শুধু সরকারের কর আর শুল্ক আদায়কারিতে রূপান্তরিত করা ঠিক হবে না। সামগ্রিকভাবে স্মিথ মনে করলেন ভোলানাথ বোসের এই পরিকল্পনাটা অকার্যকর হবে।

তবে স্মিথের মনে হয়েছিল, দেশজ ভেষজ খুবই গুরুইত্বপূর্ণ বিষয়, এগুলি কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরে চিকিতসা কাজে নিযুক্ত থাকা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কবিরাজদের প্রয়োগ করলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে। তিনি মনে করতেন হাতে গোণা দেশিয় চিকিতসকেদের জেলার সরকারি ছোট হাসপাতালগুলিতে রোগীদের চিকিৎসা করার সুযোগ দিলে জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থ্যা উন্নত হবে। এই সুযোগে তারা তাদের জ্ঞানভাণ্ডার উন্মুক্ত করতে পারবেন। ব্রিটিশ চিকিৎসকেরা তাদের থেকে দেশজ ভেষজ বিষয়ে যথোপযুক্ত জ্ঞানও আহরণ করতে পারবেন। এছাড়াও ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে যদি শিক্ষার্থীদের তাদের জ্ঞান উজাড় করে দিতে পারেন, তাহলে সেটাও ভাল কাজ হতে পারে। জেলায় জেলায় উচ্চশিক্ষার(কলেজ) কেন্দ্রগুলিতে জেলা মেডিক্যাল স্কুল খোলার প্রস্তাব দিলেন তিনি, যাতে ব্রিটিশ প্রমিত ওষুধগুলি নির্দিষ্ট হারে জেলায় জেলায় পৌঁছে যেতে পারে।
মার্সার, বোস বা স্মিথ, কারোর কোন প্রস্তাবই বাংলার লেফটানেন্ট জেনারেলের অনুমোদন মিলল না। প্রত্যেকটার পিছিনে থাকা নীতিগুলির গুরুত্ব অস্বীকার না করেই তার মাথায় এল যে জেলায় জেলায় সিভিল সার্জেনের তত্বাবধানে প্রত্যেক জেলায় ৫ জন শিক্ষার্থীকে পাঠিয়ে সাধারণ ওষুধ এবং চিকিৎসার মূল সূত্র সম্বন্ধে যদি জানানো যায়। কোন সরকারি চিকিৎসালয়ে তাদের বছরে বছরে বেড়ে চলা অঙ্কের জলপানি নির্ভর করে তিন বছর ধরে পড়ানো হবে, সেই সময় তারা সেখানে বা সিভিল এবং জেল হাসপাতাল এবং ডিস্পেনসারিতে ড্রেসার, হাসপাতাল শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করবে। তৃতীয় বছরের শেষে তারা তাদের গ্রামে চিকিৎসা করার অনুমতি পাবে। পড়ানোর সময়ের অবধির পার্থক্য ছাড়া বোসের পরিকল্পনার সঙ্গে লেফটানেন্ট পরিকল্পনার মিল অদ্ভুত। এছাড়াও লেফটানেন্ট গভর্নর স্মিথের প্রস্তাবের একাংশ অনুমোদন করে, জেলায় জেলায় পশ্চিমি ওষুধ যেমন কুইনাইন, জেমস পাউডার, ডোভার্স পাউডার ইত্যাদি দামে দামে পাঠাবার অনুমতি দিলেন।
(চলবে)

উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা - বাঙলায় স্ত্রীশিক্ষা

সূত্রঃ বৃহতবঙ্গ, দীনেশ চন্দ্র সেন

বহু রূপকথা ও গীতিকথায় দৃষ্ট হয় স্ত্রীলোক ও পুরুষ এক গুরুর নিকট এক পাঠশালায় বসিয়া পড়িতেন। সখীসেনার গল্পে রাজকন্যা ও কোটালের পুত্র একত্র এক পাঠশালায় পড়িতেন – সেই সূত্রে একটা প্রতিশ্রুতির ফলে উভয়ে পলায়ন করিয়া স্বামী-স্ত্রীর মত জীবন যাপন করিয়াছিলেন। ...এতগুলি রূপকথায় আমরা রমণী ও পুরুষের একত্র পড়াশোনার কথা পইতেছি, যাহাতে মনে হয়, ইহা দেশব্যাপী একটা প্রাচীণ রীতির প্রতি অঙ্গুলিসঙ্কেত করিতেছে। কিন্তু পাঠশালায় একত্র পড়াশোনা না করিলেও স্ত্রীলোকের পড়াশোনা যে এদেশে মুসলমান সময়েও প্রচলিত ছিল, তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। আমরা গার্গী, মৈত্রেয়ী, খনা অরুন্ধতী প্রভৃতি বিশ্বশ্রুতা ইতিহাস-পূর্ব্ব যুগের পণ্ডিতাদিগকে লইয়া টানাটানি করিব না। কালিদাস তাঁহার স্ত্রী ভোজরাজের কন্যার নিকট স্বীয় মুর্খতার জন্য বিড়ম্বিত হইয়াছিলেন, কিংবা বিদ্যার ন্যায় রাজকুমারীরা পণ করিয়া বসিতেন যে, যে তাঁহাদিগকে বিচারে পরাস্ত করিতে পারিবে, তাঁহাকেই বিবাহ করিবেন – এই সকল গল্পকেও ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান দিব না। কিন্তু মধ্য যুগে আমরা চণ্ডীদাসের প্রণয়িনী রামী, শিখা মাইতীর ভগিনী মাধবী এবং চন্দ্রাবতী প্রভৃতি কবিদিগের লেখার সহিত পরিচিত হইয়াছি। চণ্ডাকাব্যে দেখা যাইতেছে যে বণিকের বধুরাও লিখিতে পড়িতে জানিতেন, পল্লীগীতিকার জেলে-কৈবর্ত কন্যা মলুয়া ও খুল্লনা পত্রাদি লিখিতে পারিতেন – এরূপ উল্লিখিত আছে। ইহার সকলগুলিই গল্প কি না, কিংবা ইহাদের কোন কোন কাহিনী সত্যমূলক তাহা নির্নয় করিবার অবসর আমাদের নাই। যাহারা শিল্পবিদ্যায় – সঙ্গীতে এবং অপরাপর কলাবিদ্যায় এতটা পারদর্শী ছিলেন, তাঁহারা লেখাপড়া জানিতেন না এমন মনে হয় না। আমরা গত একশত-দেড়শত বত্সর পূর্ব্বের অনেক শিক্ষিতা মহিলার কথা জানি – তাঁহারা শুধু লেখাপড়া জানিতেন না – কিন্তু অসাধারণ পণ্ডিত বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন।

ফরিদপুর যপসা-গ্রাম নিবাসী লালা রামগতি সেনের কন্যা বিদুষী আনন্দময়ী দেবীর নাম সুপরিচিত। ইনি পলাশী যুদ্ধের সময় জীবিত ছিলেন। ইনি অথর্ব্ব বেদ হইতে যজ্ঞকুণ্ডের আকৃতি আঁকিয়া রাজা রাজবল্লভকে তাঁহার যজ্ঞের জন্য দিয়াছিলেন। বেদ নির্দ্দিষ্ট সেই যজ্ঞ কুণ্ডের খসড়া পণ্ডিতমণ্ডলীকর্ত্তৃক গৃহীত হইয়াছিল। তাহার খুল্লতাত জয়নারায়ণ সেন যে হরিলীলা নামক কাব্য রচনা করেন, তাহাতে ইঁহার অনেক পদ আছে, তাহাতে সংস্কৃতে তাঁহার অসামান্য অধিকার প্রমাণ করে। যোড়শ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি চন্দ্রাবতীর নাম এখন সুপরিচিত। ইনি সংস্কৃতে ব্যুতপন্না ছিলেন, এবং মলুয়া, কেনারাম প্রভৃতি অনেক অপূর্ব্ব গীতিকা রচনা করিয়াছিলেন, এবং পিতার আদেশে রমায়নের পদ্যানুবাদও করিয়াছিলেন। ...বঙ্গদেশের পল্লীসাহিত্য খুঁজিলে আমরা বহু রমনী-কবির রচনা পাইতে পারি। কিন্তু সংস্কৃতে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ১০০ বছরের পূর্ব্বেও কোন কোন বঙ্গ মহিলার আয়ত্ত ছিল, তাহারও কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। শুধু চন্দ্রাবতী এবং আনন্দময়ী নহেন, বঙ্গদেশে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালেও এমন সকল পণ্ডিত রমণী ছিলেন, যাঁহারা বিদ্বত্সমাজে বিশিষ্ট স্থান পাইবার যোগ্য। ১৮৫১ খৃঃ অব্দের ১৯এপ্রিল তারিখের সম্বাদ-ভাস্কর নামক পত্রিকায় দ্রবময়ী দেবীর সবিস্তার উল্লেখ আছে। ইহার কাহিনী আমার ছাত্র শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সম্বাদ-ভাস্করের প্রাচীন স্তুপ হইতে আবিস্কার করেন এবং তাহার সহায়তায় শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ প্রবাসীতে (১৩৩৮, ফাল্গুন) প্রকাশিত করিয়াছেন। দ্রবময়ী দেবী ১৮৫১ খৃষ্টাব্দে মাত্র চতুর্দ্দশ বত্সর বয়স্কা ছিলেন। সম্বাদ-ভাস্করে তাঁহার সেই সময়ের কথাই লিখিত হইয়াছিল। এই অদ্ভুত প্রতিভাশালিনী বালিকা কৈবর্ত্তের ব্রাহ্মণ চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের কন্যা। ইনি ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দে খানাকুল কৃষ্ণনগরের সন্নিহিত বেড়াবেড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর আমরা সম্বাদ-ভাস্কর হইতে উদ্ধৃতি করিতেছিঃ- দ্রবময়ী বালিকাকালে বিধবা হইয়া পিতা চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের টোলে পড়িতে আরম্ভ করিলেন, তাহাতে সংক্ষিপ্তসার ব্যকরণ ও মূল সাতখানি টীকা এবং অভিধান-পাঠ সমাপ্ত হইলে চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কার স্বকন্যার ব্যুত্পত্তি দেখিয়া কাব্যলঙ্কার পড়াইলেন এবং ন্যায়শাস্ত্রেরও কিয়দংশ শিক্ষা দিলেন, পরে দ্রবময়ী গৃহে আসিয়া পুরাণ মহাভারতাদি দেখিয়া হিন্দুজাতির প্রায় সর্ব্বশাস্ত্রে সুশিক্ষিতা হইলেন, এইক্ষণ দ্রবময়ীর বয়ঃক্রম চৌদ্দবত্সর। পুরুষেরা বিংশতি বত্সর শিক্ষা করিয়া যাহা শিক্ষা করিতে পারেন না, দ্রবময়ী চতুর্দ্দশ বত্সরের মধ্যে ততোধিক শিক্ষা করিয়াছেন। এই ক্ষণে তাঁহার পিতা চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কার বৃদ্ধ হইয়াছেন, সকলদিন ছাত্রগণকে পড়াইতে পারেন না, তাঁহার টোলে ১৫।১৬ জন ছাত্র আছেন, দ্রবময়ী কিঞ্চিত শাস্ত্র পড়াইতেছেন, তাঁহার বিদ্যার বিবরণ শ্রবণ করিয়া নিকটস্থ অধ্যাপকেরা অনেকে বিচার করিতে আসিয়াছিলেন, সকলে পরাজয় মানিয়া গিয়াছেন। দ্রবময়ী কর্ণাটরাজের মহিষীর ন্যায় যবনিকান্তরিতা হিয়া বিচার করেন না। আপনি এক আসনে বৈসেন, সম্মুখে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণকে বসিতে আসন দেন, তাঁহার মস্তক ও মুখ নিরাভরণ থাকে, তিনি চর্ব্বাঙ্গী যুবতী হইয়াও পুরুষদিগের সাক্ষাতে বসিয়া বিচার করিতে শঙ্কা করেন না, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা তাঁহার তুল্য সংস্কৃত ভাষা বলিতে পারেন না, গৌড়িয় ভাষার বিচারেও পরাস্ত হন। দ্রবময়ীর ভাব দেখিতে বোধ হয় লক্ষ্মী কিংবা সরস্বতী হবেন, তাঁহাকে দর্শন করিলে ভক্তি প্রকাশ পায়, এ স্ত্রীলোক দেখিবার জন্য কাহার উত্সাহ না হয়। বেড়াবাড়ী গ্রামে যাইয়া দ্রবময়ীকে দেখুন, তাঁহার সহিত বিচার করুন, আমরা দ্রবময়ীর বিদ্যা-শিক্ষার বিষয় যাহা লিখিলাম যদি ইহার একবর্ণও মিথ্যা হয়, তবে আমাদেগকে মিথ্যাজল্পক বলিবেন, এরূপ সতী বিদ্যাবতী স্ত্রীলোক কেহ লীলাবতীর পরে এদেশে জন্মগ্রহণ করেন নাই।

১২৩১ বাং সনে কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ক নামক পুস্তক হইতে হটী বিদ্যালঙ্কার নাম্নী অপর এক মহিলার বৃত্তান্ত উদ্ধৃত করিতেছি – রাঢীয় ব্রাহ্মণ কন্যা হটী বিদ্যালঙ্কার নামে একজন ছিলেন, তিনি বাল্যকালে আপন আপন গৃহকার্যের অবকাশে পড়াশুনা করিয়া ক্রমে ক্রমে এমন পণ্ডিতা হইলেন, যে সকল শাস্ত্রের পাঠ দিতেন। পরে তিনি কাশীতে বাস করিয়া গৌড় দেশের ও সে দেশের অনেককে পড়াইতে পড়াইতে তাঁহার সুখ্যাতি অতিশয় বাড়িলে সেখানকার সকল লোকে তাঁহাকে অধ্যাপকের ন্যায় নিমন্ত্রণ করিতেন। এবং তিনি সভায় আসিয়া সকল লোকের সঙ্গে বিচার করিতেন। এই পুস্তকে আরও লিখিত আছে, ফরিদপুরের কোটালী পাড়া গ্রামের শ্যামাসুন্দরী নামে এক বৈদিক ব্রাহ্মণের স্ত্রী ব্যাকরণাদি পাঠ সমাপ্ত করিয়া ন্যায় দর্শণের শেষ পর্য্যন্ত পড়িয়াছিলেন, ইহা অনেকেই প্রত্যক্ষ দেখিয়াছেন। আর উলা গ্রামের শরণ সিদ্ধান্ত ভট্টাচার্যের দুই কন্যা বার্ত্তা-বিদ্যা ও ক্ষেত্র-বিদ্যা শিখিয়া পরে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ পাঠ করিয়া পণ্ডিতা হিয়াছিলেন, ইহা সকলেই জানেন।

আমরা আনন্দময়ী দেবীর কথা উল্লেখ করিয়াছি, ইঁহার আত্মীয়া গঙ্গামণি দেবীর রচিত অনেক গান বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রচলিত আছে। ইনি হরিলীলা কাব্য নকল করিয়াছিলেন, ইহার হস্তাক্ষর বড় সুন্দর ছিল। পার্ব্বতী দাসী নাম্নী আর এক জন মহিলার হস্তাক্ষরের নমুনাও আমরা বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে উদ্ধৃত করিয়া দিয়াছি। ইনি একখানি বৈষ্ণব পুঁথি নকল করিয়াছ্লেন, হস্তাক্ষরও মুক্তার ন্যায় সুন্দর ছিল।
ফরিদপুর জেলায় সুন্দরী দেবী নাম্নী এক ব্রাহ্মণ-রমণী এক শতাব্দী পূর্ব্বের ন্যায় শাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্য লাভ করিয়াছিলেন। লঙ সাহেবের ক্যাটালগে ইহার উল্লেখ দৃষ্ট হয়। বৈদ্যবংশীয়া অনেক রমণী গৃহে বসিয়া চিকিত্সা করিতেন, আমরা জানিতে পারিয়াছি। তাঁহারা আয়ুর্ব্বেদ পাঠ করিয়া কৃতি হইতেন, কিন্তু গাছছাড়া ও অমোঘ মুষ্টিযোগ সাহায্যে দুঃসাধ্য ব্যধি আরাম করিতে বেশী পটু ছিলেন। তাহাদের খ্যাতি বহুদূর ব্যাপী হইত এবং তাঁহাদের গৃহদ্বারে প্রত্যহ বহু রোগীর – বিশেষতঃ মহিলা-রোগীর ভিড় হইত।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২০ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

নিম, চিরতা এবং অনন্তমূলের মত দেশজ ভেষজ ওষুধ বিভিন্ন মেডিক্যাল মেন মেডিক্যাল কলেজে বিক্রি করত, এগুলি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রকাশিত তালিকা থেকেই নির্বাচিত করা হয়েছিল। গভর্নর কাউন্সিলের সূত্রে জানা যাচ্ছে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রখ্যাত পশ্চিমি চিকিৎসকেরা বিংশ শতের প্রথম দশকে মকরধ্বজ দিয়ে টাইফয়েড এবং অন্যান্য রোগের চিকিৎসা করেছেন৬৫, এছাড়াও বিভিন্ন স্থানীয় কমিটি ম্যালেরিয়া এবং পেটখারাপ নিয়ন্ত্রনে দেশিয় ওষুধের তালিকা চেয়ে পাঠাত। এর ফলে ইওরোপিয় ওষুধ কেনা বন্ধ হয়ে যায়৬৮। ঘোষ এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলছেন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের জন্য পশ্চিমি ওষুধ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই দেশি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময় স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে নিদান দেওয়ার সাঙ্ঘাতিক চেষ্টা করেছিল সরকার।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংলিশম্যান পত্রিকা বলছে যুদ্ধের জন্য মধ্য ইওরোপ সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় ভারতে বিভিন্ন ধরণের ভেষজ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ভারতে ভেষজ চাষে উতসাহ দেওয়া হতে থাকে। ইংলন্ডের চিকিতসাবিদ্যার স্নাতক এবং বম্বের গভর্মেন্ট মেডিক্যাল স্টোর্স ডিপার্টমেন্টের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট ছিলেন ঘোষ। তিনি কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সঙ্গে একটা বাগান করে ভেষজ চাষের গবেষণার প্রস্তাব দেন।
১৯৩০ সালে সরকার আরও একটা কমিটি তৈরি করে ভারতের বাজারে দেশিয় চিকিৎসকেরা যে ধরণের ওষুধ বিক্রি করেন তার কার্যকারিতা এবং বিশুদ্ধতা নির্ণয় করার সমীক্ষা করতে বলে। সরকারের এই উদ্দেশ্য ভারতীয়রা খুব ভালভাবে নেয় নি। দেশে যখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন অনেকেরই মনে হতে থাকে কংগ্রেস যেহেতু ব্রিটিশ ওষুধ বর্জনের ডাক দিয়েছে তার প্রতিষেধক হিসেবে এই কমিটিটি সরকার তৈরি করেছে।

এই কমিটির সরকারি নাম হল ড্রাগ এনকোয়ারি কমিটির। যেহেতু কমিটিকে সরকার শর্ত বেঁধে দিল, দেশজ ঔষধগুলি কতটা অশুদ্ধ ভাবে এবং প্রয়োগের সিঠিক কার্যকারিতা না নিয়েই ব্রিটিশ ভারতে বিক্রি হচ্ছে তা নির্নয় ও সমীক্ষা করা, তাই জাতীয়তাবাদীদের মনে প্রথমেই সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ উঁকি মারতে শুরু করে। ততদিনে ইওরোপিয় ওষুধ ভারতের বাজারের পকড় পেয়ে গিয়েছে এবং আন্দোলনকারীদের অভিযোগ সরকার উদ্দেশ্যপূর্ণ ভাবে দেশজ ওষুধ তৈরি ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিতে চাইছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটেনে দেশিয় ওষুধ শিল্পের বিকাশ একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়াল, যেহেতু ওষুধের জন্য ব্রিটেন সরাসরি নির্ভর করত জার্মানির ওপরে। সে সময় জার্মানি বিশ্ব ওষুধ শিল্পের অঘোষিত নেতা। কিন্তু যুদ্ধ এসে যাওয়ায় জার্মান ওষুধ কোম্পানিগুলি ঠিকমত প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না করতে পারায় যুদ্ধের প্রয়োজনে ওষুধ সংক্রান্ত গবেষনার কাজ জোর কদমে শুরু হয়ে গেল। একই ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬এর সময়টিতে, ব্রিটিশ ওষুধের বিক্রি তিনগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ মিলিয়ন পাউণ্ডে। যুদ্ধের পরিবর্তী পর্যায়ে একাডেমিক গবেষণা সংস্থাগুলি বিভিন্ন থেরাপিটিগ যৌগ আবিষ্কার করে, এবং সওদাগরি সঙ্গঠনগুলি সেগুলিকে ওষুধে রূপান্তরিত করে বাজারে নিয়ে আসার উদ্যম নেয়। এর পর থেকে গবেষকেরা মূল মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে বেরিয়ে গিয়ে সওদাগরি সঙ্গঠনের গবেষণাগারে যোগ দিতে শুরু করে।

ব্রিটিশ বাংলার দেশজ ওষুধ বিষয়ে সরকারি নীতির পরিবর্তনকে তিনিটি পর্বে ভাগ করতে পারি, প্রথম পর্যায়ে উনবিংশ শতের শুরুতে যখন সরকার দেশিয় ওষুধের গবেষণা এবং চিকিতসায় উতসাহ দিতে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায় হল শতাব্দ যত এগোতে থাকল দেশিয় ফার্মাকোপিয়ার ক্লিনিক্যাল গবেষণা তিন ধরণের রাস্তায় গেল, প্রথম, পশ্চিমি ওষুধের দৃষ্টিতে পরীক্ষা করা, দ্বিতীয়ত, মেডিক্যাল স্কুল, কলেজ এবং ডিসপেনসারিতে সেগুলি পৌঁছে দেওয়া, এবং দেশজ ওষুধের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইওরোপিয় ওষুধের আমদানি কমিয়ে দেওয়া।
তৃতীয় ও শেষ পর্যায়ে পশ্চিমি ফার্মাকোপিয়ায় বিশ্বাসযোগ্য(প্লসিবল) গুরুত্বপূর্ণ দেশজ ওষুধের প্রবেশ ঘটল। এর সঙ্গে সঙ্গে দেশজ ঔষধের বাজার ধ্বসে গেল এবং বিংশ শতকের তৃতীয় শতাব্দে ইওরোপিয় ওষুধ ভারতের বাজার দখল করে নিল।

দেশজ চিকিৎসক
উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় দেশজ চিকিতসকেদের নিয়োগের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর্নল্ড ১৮৩০ সালে ১০-১৫ জন, ১৮৪৪এ ৩০ এবং ১৮৫০এ ৬৮ জন টিকাদারের নাম তালিকাভুক্ত করছেন। বৈদ্যরা পশ্চিমি ওষুধ প্রাচারে কাজ করেছেন।

১৬৮০ সালে দেশজ চিকিতসকেদের চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করতে বিভিন্ন প্রকল্প প্রস্তাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সিলেটে যেহেতু প্রথাগত চিকিৎসার সুযোগ খুব সীমিত, তাই জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট প্রস্তাব দিলেন সেখানে অঞ্চলে অঞ্চলে হাসপাতাল বা ক্লিনিক চালু না করে দেশজ চিকিৎসক যাদের নাম কবিরাজ তাদের উন্নয়ন ঘটালে কাজ হতে পারে। এই চিকিৎসকেরা নতুন শিক্ষা বা চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি করে পশ্চিমি চিকিতসকেদের থেকে নতুন শিক্ষা গ্রহন করতে পারে। শিক্ষার্থীদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ওষুধ দেওয়া ছাড়াও তাদের শল্য চিকিতসায় হাত পাকাবার জন্য কিছু যন্ত্রও দেওয়া যেতে পারে। এই ধরণের কেন্দ্রে মানুষেরা পশ্চিমি চিকিৎসা পেলে তার ওপরে জনগণের আস্থা আসতে পারে। ভারত সরকারের সচিব এইচ বেল অফিসিয়েটিং কমিশনারকে লেখা এক চিঠিতে লেখেন, দেশিয় কবিরাজদের ব্যবহারে যদি সাফল্য আসে, তাহলে তারা পশ্চিমি চিকিৎসার জ্ঞান প্রচারে সাহায্য করতে পারে। সরকারের উদ্দেশ্য দেশজ ওষুধ এবং দেশজ চিকিৎসক ব্যবহার করে পশ্চিমি চিকিৎসার প্রচার ও প্রসার। এই প্রস্তাব সরকারের অনুমোদন পায়। ধনবান ভারতীয় এবং ইওরোপিয়রা যৌথভাবে এই ধরণের ডিসপেনসারি তৈরিতে অর্থ বরাদ্দ করবে এবং সরকার বাহাদুর কর্মী, যন্ত্রপাতি এবং ওষুধ দেবে। দেশজ চিকিতসকেদের মাসিক মাইনে স্থির হল ৪০ টাকা এছাড়া ঠিক হল ওষুধ এবং অন্যান্য খরচ ডিস্পেন্সারি কমিটি বহন করবে। এই প্রস্তাব সরকারের অনুমোদন লাভ করেছিল এই তথ্যটুকু ছাড়া আদৌ বাস্তবায়িত হয়েছিল কি না তা জানি না।

পশ্চিমি চিকিৎসার সঙ্গে জুড়ে দেশজ চিকিৎসার প্রসারে ১৮৬১ সালে উর্দুতে রোগের পরিভাষা এবং বর্গীকরণ প্রকাশিত হয়। সরকারি নির্দেশে এই বইগুলি জেল এনগ ডিস্পেনসারি, ব্রিটিশ এবং দেশিয় সেনাদের মধ্যে বিতরিত হয়৮০।
ভারতের অন্যনায় অঞ্চলে দেশজ চিকিতসকেদের ব্যবহার সফলভাবে কার্যরী হয়। যেমন মেজর মার্সার পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে একটা প্রকল্প চালু করেন, প্রত্যেক জেলায় প্রধান হেকিমের তত্ত্বাবধানে নির্বাচিত সহকারী হেকিম দিয়ে গ্রামচিকিতসালয়(ডিসপেনসারি) চালান। নদিয়া জেলার কমিশনার সরকারকে এই ধরণের প্রকল্প রূপায়নে প্রস্তাব দেয়। একই প্রসাতব কিন্তু বাংলার লেফটানেন্ট গভর্নর অনুমোদন করেন নি।
(চলবে)

Wednesday, February 22, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৯ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল(জিএমসি) ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়াকে আইনি মর্যাদা দেওয়ায় ভারতে তৈরি ওষুধগুলি একটা মান্যতা পেল। দেশিয় সাধারণ ওষুধ(ক্রুড ড্রাগ)এর প্রমিতিকরণের সে ঐতিহাসিক সমীক্ষা চলছিল তাতে দেখা গেল, এই ভেষজ এবং ওষুধগুলির উপাদানগুলির জ্ঞান যত বাড়ল, সেগুলির বিভিন্ন পরিমানে চরিত্র, ধর্ম ইত্যাদি জ্ঞান ব্যবহার করে তার নানান গুণও নির্ণয় করা গেল। ১৮৬৪ থেকে ১৯৩২এর মধ্যে ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার বিভিন্ন সংস্করণ প্রমান করে ওষুধগুলির চরিত্র নির্ধারণের আনুবিক্ষণিক সমীক্ষায় দেশজ ওষুধকে আরও বিশুদ্ধ করা যাচ্ছিল। পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যায় এই ফার্মাকোপিয়াক গবেষণা ব্রিটেনের বাজারে চলা ওষুধের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করেছে৩৯।
পশ্চিমি ওষুধের প্রমিতিকরণের ফলে ভারতের পশ্চিমি চিকিৎসকেরা ভারতীয় ওষুধের প্রমিতিকরণের অভাবের বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। তারা বিশুদ্ধ পশ্চিমি ওষুধ ব্যবহার করতে চাইছিলেন, কিন্তু সরকার খরচের দিকে তাকিয়ে প্রয়োজনীয় স্থানীয় ওষুধের দিকে জোর দেওয়ার চেষ্টা করছিল। পশ্চিমি চিকিৎসক এবং সরকারের মধ্যে এ বিষয়ে বিবাদ চলছিলই। ডাক্তারদের অভিযোগ, কলকাতার মেডিক্যাল স্টোর ডিপার্টমেন্ট তাদের হয় ইওরোপিয় ওষুধ দিতে দেরি করছে, না হয় তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমানে সেই ধরণের ওষুধ জমা থাকে না। কিন্তু ব্রিটিশ বাজার থেকে উচ্চদামের ইওরোপিয় ওষুধ কিনে সেগুলি বাংলা প্রেসিডেন্সির বাজারে ছাড়া সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল৪০।

ইংলন্ডের থেকে পশ্চিমি ওষুধ আনানোর তুলনায় দেশিয় শুকনো ওষুধের উপাদানগুলি ভারতের বাজারগুলি থেকে শস্তায় কিনলে ওষুধের দাম কম পড়ে। মেডিক্যাল ডিপার্টমেনন্ট বলল, নানান ভারতীয় অষুধ, পশ্চিমি ডাক্তারদের ভাষায় যেগুলি অপরিশোধিত এবং বিকৃত দেখতে, সেগুলিকে ব্যবহার করার আগে তারা ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে বিশুদ্ধ করে দেবে। মনে হয় সরকারের উদ্দেশ্য মেডিক্যাল স্টোর দপ্তরের মাধ্যমে অথবা কমিশনারিয়েট দপ্তরের মাধ্যমে কার্যকরী ওষুধগুলি সব দপ্তর এবং ডিসপেনসারি থেকে সরবরাহ করা। ঠীক হল, জেল এন্ড ডিসপেনসারির দপ্তরের খরচের রসিদ দেখালে, ওষুধ সরবরাহকারীদের, কমিশনারিয়েটের দপ্তর অনুমোদনক্রমে সিভিল গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলি থেকে পাওনা মিটিয়ে দেবে।

এর পরে সময় না নিয়েই অনতিবিলম্বে বিভিন্ন ভারতীয় চিকিৎসক এবং সিভিল মেডিক্যাল অফিসার দেশজ ওষুধের গুণগত ফার্মাকোপিয়া প্রকাশ করলেন।
কমিশনারি জেনারেলকেও বলা হল, বিদেশ থেকে দামি ওষুধ না আমদানি করে, ভারত জুড়ে ভেষজ কেনার শস্তা এবং উন্নত মানের বাজার খুঁজে বার করতে। রাষ্ট্র, আডমিনিস্ট্রেটিভ মেডিক্যাল অফিসারদের নির্দেশ দেয় দেশিয় ওষুধের বাজার বাড়িয়ে বিদেশি ওষুধের আমদানির ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে৪৪।এ পি হাওয়েল চিকিৎসা দপ্তরকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, দেশিয় যে সব ওষুধের বিকল্প পাওয়া যাবে না, একমাত্র সেই সব বিদেশি ওষুধ আমদানি করতে হবে তবেই সরকার সেই সব ওষুধের দাম মেটাবে। আর যদি দেখা যায় স্থানীয় ওষুধ থাকাতেও যদি সেই ধরণের প্রতিস্থাপনকারী ওষুধ আমদানি করা হয়েছে, তাহলে দেশিয় ওষুধের দামেই আমদানি করা ওষুধের দাম মেটানো হবে।

পশ্চিমি চিকিৎসক আর ঔপনিবেশিক সরকারের মধ্যে ওষুধ বিষয়ে বিবাদে এবং বিদেশি দামি ওষুধের বিকল্প হিসেবে তৈরি করতে ভারতীয় ওষুধের প্রনালীবদ্ধ এবং যত্নশীল পরীক্ষা আর উচ্চতর গুণমানের জন্য দেশিয় ওষুধগুলির শোধন করা হতে থাকল। এই পরিকল্পনা প্রয়োগ করার দায় পেল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে বিভিন্ন ভেষজের মূল্য এবং গুণাগুনের গবেষণা ও পরীক্ষা চলতে থাকে। ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ফার্মাকোপিয়া অব ইন্ডিয়া প্রকাশ করে। যদিও এটির ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার মত আইনি ভিত্তি ছিল না। চোপড়া৪৮ আর আর্নল্ড৪৯ বলছেন, এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় ভেষজএর ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ায় প্রবেশলাভমাত্র।

ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ এবং প্রেসিডেন্সির মেডিক্যাল স্কুলগুলিতে ব্যাপক পরিমানে দেশজ ওষুধের ব্যাপক ব্যবহার বাড়ল। এগুলির কিছু নমুনা ভারতের অন্যান্য প্রান্তের চিকিৎসা বিদ্যালয়গুলিতেও পাঠানো হল যাতে ছাত্ররা এগুলি ব্যবহার, চরিত্র সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে।

ভারতীয় ওষুধের ওপর গবেষণা এবং পরিশোধন খুব ঢিমে লয়ে চললেও, এটি অর্থনৈতিকভাবে আকর্ষনীয় হওয়ায়, সরকারি চাপে পড়ে এটিকে বাতিল করা সম্ভব হয় নি। ফলে মাঝে মাঝেই এই ওষুধগুলির প্রমিতিকরণ এবং পরিশোধন চলতে লাগল।

ক্রমশ স্থানীয় কমিটিগুলি সরকারের নীতির সমর্থনে ফার্মাকোপিয়া অব ইন্ডিয়া প্রকাশের প্রস্তাব দেয়। ১৮৯৫ সালে শল্য চিকিৎসক জি কিং এবং ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের মেটিরিয়া মেডিকা দপ্তরের অধ্যাপক জে এফ পি ম্যাকোনেলকে নিয়ে ১৮৯৫ সালে একটি কমিটি তৈরি করা হল। ১৮৯৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কংগ্রেসএর পরামর্শ অনুযায়ী দেশজ ওষুধের ব্যাপ্ত ব্যবহার কিভাবে করা যায় তার পদ্ধতি খুঁজে বার করার নীতি প্রণয়ণের দায় পড়ল এই কমিটির ওপর। অনেকগুলির মধ্যে নিচে উল্লিখিত মূল শর্ত তুলে দেওয়া হল-
১। দেশজ ভেষজের পদ্ধতিগত চাষের উতসাহ দেওয়ার পথ বার করা;
২। বাংলার বিভিন্ন মেডিক্যাল ডিপোয় নির্দিষ্ট গুণমানের ওষুধ ব্যবহারে উতসাহ দেওয়া;
৩। এই ডিপোতে স্থায়ীভাবে ওষুধগুলি তৈরির অনুমতি দেওয়া।

উনবিংশ শতকের শেষের দিকে পশ্চিমি ওষুধের চরিত্র দেশজ ওষুধের পথ থেকে সরে গিয়েছে। তার পেশাদারিকরণের পরে সে আর দেশিয় ওষুধের রসতাত্ত্বিকতার চিকিৎসাকে বাতিল করে অন্য পথে চলে গিয়েছে। ইতোমধ্যে ইওরোপের ওষুধ শিল্পে অগ্রনী দেশ জার্মানির ওষুধ শিল্পের প্রভাবে ব্রিটেনে বিপুল বিনিয়োগের ওষুধ গড়ে ওঠায় পরিকাঠামো তৈরি হয়ে গিয়েছে এই মানসিকতায়। ফলে পশ্চিমি চিকিৎসকেরা দেশজ ওষুধকে নিম্নমানের ভাবতে শুরু করে।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৮ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

পূর্বের দেশ সমূহে পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা শেখানোর লক্ষ্যে এই শিক্ষাকেন্দ্রটি প্রণালীবদ্ধ পাঠ্যক্রম পরিচালনায় পুরোধা রূপে কাজ করবে আগামী দিনে। এই শিক্ষাকেন্দ্র বিষয়ে আমরা পরের অধ্যায়ে বিশদে আলোচনা করব। এটির পরিচালনভার দেওয়া হল এডুকেশন কমিটির ওপর এবং বেন্টিঙ্কের নির্দেশনামায় বলা হল এই শিক্ষাকেন্দ্রে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে যে কেউ ভর্তি হতে পারবে। আপাতত ছাত্ররা সরকারের থেকে সাত টাকা জলপানি পাবে এবং সেই অঙ্কটি পরের দিকে বাড়তে পারে। এই নির্দেশে বলে দেওয়া হল সে সময়ের সরকারি ভাষা ইংরেজিতেই পড়াতে হবে। দেশের শিক্ষা চর্চায় ভাষা পছন্দ পালটে যাওয়ার পিছনে মেকলের বড় হাত রয়েছে, কেননা তিনি প্রতিনিয়ত ভিত্তিহীনভাবে সংস্কৃত সাহিত্যের ওপর আক্রমন শানিয়ে চলতেন, এবং বললেন উচ্চ শিক্ষা হবে পশ্চিমি পাঠ্যসূচী এবং শিক্ষার বাহনই হবে একমাত্র ইংরেজি২৬।

ভারতে চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষার ইতিহাসের ক্ষেত্রে এগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ স্তর, কেননা এই প্রথম পশ্চিমি চিকিতসাবিদতা আর দেশিয় চিকিতসাবিদ্যার যৌথ পাঠ্যক্রমে বিভেদ এনে দিল। এই ঘটনাটি বহুকাল পরে সংশ্লিষ্ট এবং জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যার জন্য আন্দোলনে নামবে।
১৮২২ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এনএমআই ১৬৬ জন দেশিয় চিকিৎসককে দেশিয় এবং পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষা দান করেছে। ১৯৩৯ সালে সরকার বাংলা প্রেসিডেন্সিতে ৩০৫ জন দেশিয় চিকিতসককে নিযুক্ত করে, তার মধ্যে ১২৪ জনই বিলুপ্ত এনএমআইএর ছাত্র। অন্যান্য ছাত্র গান ক্যারেজ এজেন্সিতে কাজ পেল। চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব এর পর থেকে কিভাবে সরকারের শিক্ষা দান নীতি ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ কেন্দ্রিক হয়ে উঠল।

দেশিয় ওষুধ
১৮৩৫ সালে দেশিয় এবং পশ্চিমি চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার রাস্তা আলাদা হয়ে গেলেও দেশিয় ওষুধ যেহেতু শস্তা এবং সহজেই পাওয়া যায়, তাই সেটি তৈরিতে ব্রিটিশদের উতসাহ কমল না। এর ফলে ড ও’শাউঘনেসির বেঙ্গল ফার্মাকোপিয়া তৈরি হল। এই বইটি ১৮৩৭ সালে প্রকাশিত হয়, এতে বাংলায় যে সব ভেষজ ব্যবহার হয় সেগুলির বিশদ বর্ননা রয়েছে। এ বছরেই বাংলার গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিলএর নির্দেশে কলকাতায়, দেশজ ওষুধ তৈরির জন্য একটি রসায়নাগার স্থাপন করা হল এবং সিদ্ধান্ত হল ড ও’শাউঘনেসির মত অনুসারে দেশজ ফার্মাকোপিয়া নির্ভর করে কোন ওষুধের কি কি গুণাগুণ তা জানার। বলা হল এই শস্তা এবং কার্যকর ওষুধগুলি শুধু সাধারণ মানুষেরই উপকারে লাগবে না, মিলিটারি এবং সাধারণ হাসপাতালগুলির ওষুধ দোকানেও মিলবে।

রাষ্ট্রীয় নীতিতে দেশিয় ফার্মাকোপিয়ায় উল্লিখিত ওষুধের গুনাগুণ নির্ধারণের জন্য চিকিৎসক(মেডিক্যাল মেন) নিয়োগ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কলকাতার ডিসপেনসারি কমিটিতে দেশিয় ওষুধের বিষয়ে জ্ঞান সম্পন্ন সম্ভব হলে একজন দেশিয় ওষুধ তৈরির নির্দেশক(এপোথেকারি জেনারেল), বোটানিক্যাল গার্ডেনের নির্দেশককে প্রবেশাধিকার দেওয়া হল। রোগ নির্নয়ে বাংলার প্রায় প্রত্যেকটি দাতব্য চিকিতসাখানায় ভারতীয় কম্পাউণ্ডার নিযুক্ত হল। ড ও’শাউঘনেসি সরকারকে বললেন, দেশিয় মেটিরিয়া মেডিকা তৈরিতে বর্তমানে কর্মক্ষম দেশজ চিকিতসকেদের নির্দেশে দেশজ রোগের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধের যথেষ্ট পরিমান তৈরি করে হাসপাতালে প্রয়োগ এবং সেগুলির প্রভাব নিরীক্ষণ করতে। ড ও’শাউঘনেসিরর নির্দেশে এই গবেষণায় ক্যানাবিস ইন্ডিকা ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ায় প্রবেশ করল ১৮৩৯ সালে। এই ওষুধটি আরক এবং নির্যাস তৈরি হল।
চিকিৎসকেরা একদিকে যেমন ওষুধের ওপর গবেষনা করছিলেন, অন্যদিকে মেডিক্যাল বোর্ড এবং গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে যুক্ত শল্য চিকিৎসকেরা ওষুধগুলির প্রয়োগের প্রভাব নির্ণয় করে মেডিক্যাল বোর্ডকে তাদের সমীক্ষা দিচ্ছিলেন। সরকারি খরচেই ফার্মাকোপিয়া ছাপা হল৩৩।

১৮৪১ সালে পশ্চিমি চিকিতসকেরা বাংলার একটি চিকিৎসালয়ে (ডিসপেনসারি)৩৪ দেশিয় ওষুধ প্রয়োগ করলেন৩৫। কালা দানা এবং কুট কেলিজার মত দেশিয় ওষুধ ব্যবহার করা হল সেখানে। পারদ এবং আফিম নির্ভর বহু ওষুধ প্রয়োগ করা হল ১৮৩৯-৪০এর বাংলা প্রেসিডেন্সির ব্যাপক কলেরা মহামারীতে৩৭। এইগুলি এবং অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ওষুধ সফলভাবে চট্টগ্রাম চিকিৎসালয় থেকে প্রাথমিকভাবে প্রয়োগ করা হল এবং সেগুলি যে খুব ভাল কাজ করছে সে তথ্য সমীক্ষাতেও পাওয়া গেল। চট্টগ্রাম চিকিতসালয়ের অর্ধবার্ষিকী সমীক্ষায় এই তথ্য স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে।
১৮৫০এর দিকে পরের স্তরে গবেষণায় দেশিয় ফার্মাকোপিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ব্রিটেনের ফার্মাকোপিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আসে। মেডিক্যাল এক্ট ১৮৫৮র আইনে সরকারিভাবে যে সব ওষুধ উল্লিখিত হল সেগুলি জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিলে প্রতিপালিত হয়ে ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া নামে চিহ্নিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ এবং কম্পাউণ্ডের তালিকা, সেগুলি তৈরির প্রক্রিয়া, এবং কোন অনুপানে এবং ওজনে সেগুলি তৈরি করতে মিশ্রিত করতে হবে তার বিশদ বিবরণ। প্রথম সংস্করনটি প্রকাশনার খুব তাড়াতাড়ি ১৮৬৪ সালের দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ শেষ হল, ততদিনে পশ্চিমি চিকিৎসকেরা দেশজ ফার্মাকোপিয়া নিয়ে বিশদে কাজ করেছেন এবং তার সমীক্ষা প্রকাশও পেয়েছে।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৭ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

চিকিৎসা শিক্ষাবিষয়ক সমীক্ষা – এনএমআইএর বিলুপ্তি
এনএমআইএর কাজকর্ম নিয়ে কোর্ট অব ডায়রেক্টর্স ১৮২৮সালে প্রথম সমীক্ষা করে১৭। সমীক্ষায় চিকিৎসা শিক্ষার সন্তোষজনক অগ্রগতির শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল শিক্ষা কেন্দ্রটিকে। কিন্তু ১৮৩২ আর ১৮৩৩এর সমীক্ষায় এনএমআইএর শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

এনএমআইএর শিক্ষা পদ্ধতির সমীক্ষার প্রস্তাব প্রথম দেয় কোর্ট অব ডায়রেক্টরদের কলমের খোঁচায় নিয়োজিত পলিটিক্যাল এন্ড মিলিটারি কমিটি। তাদের সংশ্লিষ্ট সমীক্ষা পত্র জমা দিতে বলা হল গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিলকে। এই কমিটিকে ছাত্রদের ভর্তি, চিকিৎসা শিক্ষা, পরীক্ষা, এবং নিয়োগ ইত্যাদি এবং এর সঙ্গে সংগঠনের সংবিধান উন্নত করারও সিদ্ধান্ত গ্রহন করার অধিকার দেওয়া হয়। এনএমআই যে সব বই ব্যবহার করবে, কমিটি সেগুলি এবং মানব দেহের আলাদা আলাদা হাড় এবং কিছু মোমের মডেল কেনার অনুমতি দেয়। এনএমআই দেশিয় চিকিৎসক তৈরিতে পশ্চিমি এবং দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা পড়ানোর যে উদ্যোগ নিয়েছিল, কমিটি তাদের সেই উদ্যোগকে সরকার সমর্থন করল না। সমালোচকেদের মনে হল এনএমআইতে চিকিৎসা শিক্ষা অধপতিত হচ্ছে এবং কোথাও যেন বদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই মতের সমর্থকেদের মধ্যে ছিলেন তখনকার সরকার প্রধান উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক। এনএমআইএর সমর্থকেরা তার এই মতের বিরুদ্ধে আপত্তি প্রকাশ করেন। সেসময়ে প্রাচ্য-প্রাতিচ্য বিতর্কে এই ঘটনার ছাপ পাওয়া যায়(এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে)।

এনএমআইতে ১৮৩৩ সালে সংস্কারের নির্দেশ দিলেন বেন্টিঙ্ক। তিনি পাবলিক ইন্সট্রাকশন কমিটিকে নির্দেশ দিলেন শুরু সময় থেকে এনএমআইএর শিক্ষা ব্যবস্থার সমীক্ষা করে তার অগ্রগতির খতিয়ান ব্যক্ত করা এবং সেই সমীক্ষার আলোকে দেশিয়দের ইওরোপিয় শিল্প এবং বিজ্ঞান পড়ানোর পদ্ধতি কিভাবে নির্নয় করা যায় তা স্থির করা। ১৮৩৪ সালের ২০ নভেম্বর কমিটি সমীক্ষাপত্র প্রকাশ করল। এনএমআইএর জোরের জায়গা নির্দেশ করে ঘাটতিগুলো বিশেদে ব্যাখ্যা করল কমিটি। কমিটি বলল এনএমআই ঠিকভাবে গঠিত এবং পরিকল্পিত হয় নি। তাদের মতে এনএমআইএর শিক্ষাদান, প্রশিক্ষণ দেওয়া আর পরীক্ষা নেওয়ার সময় যথেষ্ট নয় এবং এখানে আনাটমি নিয়ে কোন হাতে কলমে কাজের সুযোগ নেই। শিক্ষালয়ের প্রায়োগিক শ্রেণী কক্ষে নিয়মশৃঙ্খলাহীবভাবে ছাত্রদের শিক্ষা নেওয়ার উপস্থিতি এবং পরীক্ষা উত্তোরণের সঠিক মানদণ্ড না থাকা এনএমআইএর দুর্বলতা রূপে চিহ্নিত হল।

১৮৩৫ সালে কমিটির সদস্যরা শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজি না দেশিয় ভাষায় হবে, এই মতবাদে দুভাগ হয়ে গেলেন। যারা দেশিয় ভাষায় শিক্ষা চাইলেন তাদের নাম হল ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবাদী এবং যারা ইংরেজিতে চাইলেন তাদের নাম হল এংলিসিস্ট বা ইংরেজিবাদী। ওরিয়েন্টালিস্টদের মধ্যে অন্যতমরা ছিলেন জন টিটলার, রাম কমল সেন, এইচ এইচ উইলসন, বিপক্ষে রইলেন বেন্টিঙ্ক, মেকলে, শল্য চিকিৎসক জন গ্রান্ট(কোম্পানির ওষুধখানার নির্দেশক)। বিতর্কে জয়ী হলেন এংলিসিস্টরা, বললেন, ইংরেজি ভাষার জ্ঞান প্রাথমিক শর্ত, কেননা এই ভাষার জোরে শিক্ষার্থী নিজেকে বিজ্ঞান এবং অগণিত ছাপার বইতে লেখা এবং ছবি দেখে শেখার সুযোগ পাবে যা প্রাচ্য ভাষা শিক্ষায় সম্ভব নয়, কেননা, সেখানে খুবই অপরিণত বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের নামে অযৌক্তিক বিষয় রয়েছে২২।

এর পাশাপাশি ইংরেজিবাদীরা বললেন পাঠয় হিসেবে শুধুই ইওরোপিয় বিজ্ঞান পড়ানো হবে। ১৮৩৫ সালে প্রাচ্যবাদীদের ওপরে ইংরেজিবাদিদের বিজয় ঘটল, বেন্টিঙ্ক এনএমআইএর বিলয়ের নির্দেশনামা স্বাক্ষর করলেন। ১৮৩৫ সালের ২৮ সংখ্যক নির্দেশনামায় ২৮ জানুয়ারি এনএমআইএর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হল। এই পরোয়ানা সূত্রের গৃহীত প্রস্তাবক্রমে বলা হল, পয়লা তারিখ(ফার্স্ট প্রক্সিমো) থেকেই সংস্কৃত কলেজের চিকিৎসা শিক্ষা, মাদ্রাসার চিকিৎসা শিক্ষা এবং এনএমআইকে বন্ধ করতে হবে, এনএমআইএর যে সব শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য তৈরি তারা দেশিয় ডাক্তার হিসেবে চাকরি পাবে, এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীরা বর্তমান বেতন কাঠামোয় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হবে যদি তারা সঠিক গুণমানের চিকিতসকেদের নিয়ে তৈরি কমিটির অনুমোদন পায়, এবং তারা যদি দুবছরের মধ্যে সফল হতে না পারে তাহলে তাদের ছাঁটাই করা হবে।

এই সিদ্ধান্ত ক্রমে এনএমআই তুলে দেওয়া হল, সংস্কৃত এবং মাদ্রাসা কলেজের চিকিৎসা শ্রেণী বন্ধ করে দেওয়া হল, এবং নতুন একটি চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্র ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হল। এনএমআই বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ নয় যে ভারতীয় ভাষায় চিকিৎসা শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেল। দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা বাদ দিয়ে দেশিয় প্রথমে উর্দু এবং পরে বাংলায় ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যার পঠনপাঠন শুরু হল ১৮৩৯ সালে। এনএমআইএর মাত্র একজন সদস্য পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসক মধুসূদন গুপ্তই নতুন চিকিতসাপাঠদানকেন্দ্রে স্থান পেলেন২৫।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - বাংলা বানান সংস্কার


Dipankarদা বাংলা বানান সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। জরুরি প্রস্তাব।

এ প্রসঙ্গে আমাদের কথা...
বানানের শুদ্ধতার দাবি ঔপনিবেশিক ভদ্রলোকামি-অভিজাতমির নামান্তর। প্রমিত বাংলা নামে যাকে ডাকা হয়, সেটি ঔপনিবেশিক কাঠামোয় তৈরি করা - ভিত্তি ইংরেজি আর সংস্কৃত - যার সঙ্গে বাংলার মাটির হাজারো কথ্যরীতি্র যোগ নেই।
ইংরেজি-হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে বাংলাভাষা রক্ষার আন্দোলনের নেতৃত্বের কাছে প্রশ্ন, তারা ঢাকা-কলকাতার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী বাংলা উচ্চারণ এবং লেখ্য রীতি বাংলার অন্যান্য প্রকাশরীতিকে ঢেকে ফেলার পক্ষে না বিপক্ষে।
ভদ্রলোক মধ্যবিত্ত নির্ভর এই আন্দোলনে সাধারণত এই প্রশ্ন গুলি ওঠে না। গ্রামীন উতপাদক-বিতরকদের পক্ষ থেকে দীপঙ্করদার এই লেখার সূত্র ধরে এই বিষয়টা নিয়ে চর্চা হোক এই দাবি জানিয়ে রাখলাম।

Tuesday, February 21, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৬ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

১৮২৭ থেকে টেটলর পশ্চিমি রীতি অনুসারে সংস্কৃত কলেজ এবং কলকাতা মাদ্রাসায় অঙ্ক আর শারীরবিদ্যা নিয়ে ধারাবাহিক বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন। সংখ্যা না জানাগেলেও এনএমআইর শারীরবিদ্যা বিষয়ে কিছু দক্ষ ছাত্র হাসপাতালগুলিতে বা সিভিল সার্জনদের অধীনে কাজ শুরু করে। ১৮৩২ সালের ২৫ মে, সংস্কৃত কলেজ সঙ্গে জুড়ে ছোট একটি হাসপাতাল তৈরি করা হল১০। ১৮৩৩ সালে সংস্কৃত কলেজের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এবং লেকচারার ড জে গ্রান্ট হাসপাতালের প্রথম বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলেন। সেখানে বলা হল হাসপাতালে স্থায়ী রোগীর ৩০টি শয্যা রয়েছে, ১৮৩২ সালের শেষ আট মাসে ১৫৮ জন অস্থায়ী রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে। ভারতীয় ভাষায় ইংরেজি থেকে বিভিন্ন পুস্তক অনুবাদ করা হয়, এই অনুদিত বইগুলির পাশাপাশি দেশিয় চিকিৎসা বিষয়ক পাঠাদান চলতে থাকে। সংস্কৃততে চরক, সুশ্রুত আর ভগভট্ট প্রণোদিত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পাঠদান করার জন্য আরও শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। মাদ্রাসায় য়ুনানি এবং আরবি চিকিতসদকেদের জ্ঞান প্রদান করা হত, তবে শুরুহ আসবাব, আকসুরেস, সুদিদি বা আনিসুল মুশারাহিন ছাড়া আর কি কি পুঁথি পড়ানো হত তা আর জানা যায় না।

ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ কর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন টেটলর যাতে বহু মানুষ তা পড়তে পারেন। তিনি মনে করতেন, যদি সম্ভব নয়, ভারতীয়দের শিক্ষা দিতে হবে ভারতীয় ভাষায়। সংস্কৃতের মত ইংরেজি মাধ্যমে পাড়ানোয় কাজের কাজ হবে না১২।

দেখলাম পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার সঙ্গে দেশজ ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার সমান্তরাল ব্যবস্থা চলতে লাগল। তবে এই শ্রেণিগুলিতে শব্যবচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হয় নি১৩। ১৮৩৫ সালে শব ব্যবচ্ছেদ ডাক্তারি শিক্ষার অঙ্গাঙ্গী নীতি হিসেবে গৃহীত হলে এনএমআইএর বিলয় সুনিশ্চিত হয়। সেই ঘটনা পরের অধ্যায়ে বিশদে আলোচনা করা যাবে।

পাঠ্য পুস্তক সরকারি উদ্যোগে ছাপা হতে শুরু করল। হুপারের এনাটমিস্টস ভেদে-মেকাম অনুবাদের জন্য পণ্ডিত মুধুসুদন গুপ্তকে ১০০০ টাকা সাম্মানিক দেওয়া হয়েছিল১৪। সরকারি উদ্যোগে যেগুলি অনুদিত এবং লিখোগ্রাফি হয় সেগুলির তালিকা দেওয়া গেল-
১। হুপারের এনাটমিস্টস ভেদে-মেকাম
২। ফিজিসিয়ানস ভেদে-মেকাম
৩। সার্জেনস ভেদে-মেকাম
৪। থমসনস কনস্পেকটাস অব দ্য ফার্মাকোপিয়া
৫। ফিফে’র ম্যানুয়াল অব কেমিস্ট্রি এবং কঙ্কুয়েস্টের আউটলাইন অব মিডওয়াইফারি
৬। টুইনিং এবং স্মিথের ট্রপিক্যাল ডিজিজেস
৭। ড থমাসের প্লেগ
৮। টিকাকরণ নিয়ে বই
এনএমআইতে পাঠ্যক্রমে পড়ানো হত এই বইগুলি।

চিকিৎসা পাঠ্যক্রমের অবধি ছিল তিন বছরের। পাঠ্যক্রমে ছিল ফার্মেসি, মেটিরিয়া মেডিকা, ফিজিওলজি এনাটমি। এছাড়াও হাতে কলমে অভিজ্ঞতার জন্য ছাত্রদের নেটিভ হাসপাতাল, সাধারণ হাসপাতাল, কোম্পানি ডিসপেনসারি, আই ইনফার্মারি এবং ডিপার্টমেন্ট অব দ্য সুপারিন্টেরন্ডেন্ট অব ভ্যাকসিনেশনে শিক্ষানবিশী করতে হত।

এনএমআই থেকে সফলভাবে বেরোনো চিকিতসকেদের সম্মান বাড়াতে সাধারণ ভাবে দেশি ডাক্তারদের যে ধরনের মাইনের স্তর নির্দ্ধারিত হয়, তার থেকে বেশি বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত করে সরকার। সোনাউতে(???) ১৫ থেকে ২০ হল, আর গ্যারিসনে হল ২০ থেকে ২৫। আর ঠিক হল দেশি ডাক্তারদের সাত বছরের চাকরির পরে গ্যারিসনে মাইনে হবে ২৫ টাকা আর ফল্ডে হবে ৩০টাকা(টাকার পরিমানটা কত ছিল তার একটা আন্দাজ দেওয়া যেতে পারে, বিদ্যাসাগ মহাশয়ের পিতা ঠাকুরদাস ১৮২০ সালে মাসিক ২ টাকা রোজগার করে, তার কলকাতায় থাকার মাসিক খরচ এবং তার পরে উদ্বৃত্ত দেশে পাঠাবার তোড়জোড় করছেন, এবং নিজেকে স্বচ্ছচল ভাবছেন - অনুবাদক)। এর সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, তাকে ন্যুনতম ১৫ বছর চাকরি করতে হবে, যদি না কোন রোগ বা প্রতিবন্ধকতা হয়১৫। মাইনে বাড়িয়ে সরকারি সেবায় নেওয়ার টোপ দেওয়া হল দেশি ডাক্তারদের। এনএমআই বন্ধ করে দেওয়ার ঠিক আগে আগে, ৪ জানুয়ারি ১৮৩১ সালে পলিটিক্যাল এন্ড মিলিটারি কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে কোম্পানির বাংলার কোর্ট অব ডায়রেক্টর্স এনএমআইর সব সফল চিকিৎসককে পেনসন পাওয়ার অধিকারী ঘোষণা করে।

১৮৩৫ সালে এনএমআইএর দিন শেষ হয়ে গেল। এই বছরে এতদিনের যৌথভাবে দুই চিকিৎসা শিক্ষা পাশাপাশি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত রদ করা হয়। সেই সিদ্ধান্তটি কি এবং সেটি কি করে বাস্তবায়িত হল সেটি নিয়ে এবারের আলোচনা।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৫ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

তৃতীয় অধ্যায়
বাংলায় দেশিয় চিকিৎসা বিষয়ক নীতি
মধ্য যুগের শাসকেরা যেভাবে আয়ুর্বেদকে বৈজ্ঞানিক কর্মের সঙ্গে জুড়ে নেন, ব্রিটিশ ভারতেও উনবিংশ শতকে দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ঠিক একই ধরনের নীতি অনুসরণ করে। প্রত্যেক শাসকের শাসনকালে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা নতুন রূপ ধারণ করেছে।

দেশজ চিকিৎসাব্যবস্থা সংক্রান্ত ব্রিটশদের অনুসৃত নীতি সমূহকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রাথমিক স্তরটি চলে ১৮৬০ পর্যন্ত দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থারই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছিল এবং পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আত্মীকরণ করছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল চিকিৎসা আর ফার্মাকোপিয়ার তাত্ত্বিক মিলের ফলে।

দ্বিতীয় স্তরে ব্রিটেনে চিকিতসা ব্যবস্থায় পেশাদারিত্ব এবং ওষুধ তৈরিতে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের মাত্রা বাড়তে থাকায় দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব শুরু হয়। প্রথম দুটি অবস্থায় রাষ্ট্র অর্থনৈতিক কারণেই দুই ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচার করার উদ্যম গ্রহন করে, বিশেষ করে দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচারে উদ্যমী হয়। এর ফলে দুটি চিকিৎসা বিদ্যা বাধ্য হয় পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলিয়ে চলতে।
উনবিংশ শতের শেষের দিকে তৃতীয় এবং শেষ স্তরে ইওরোপে রসায়ন শিল্প এবং চিকিৎসকেদের পেশাদারিত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। এই স্তরে পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা দেশজ চিকিতসাবিদ্যা থেকে বহুদূর সরে যেতে থাকে এবং পূর্বের তুলনায় পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা দেশজ চিকতসাবিদ্যার সামনে কালান্তক যমের মত হয়ে দাঁড়ায়। এই হুমকির সামনে পড়ে জাতিয়তাবাদী আন্দোলন দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশ আর প্রচারের ডাক দেয়।

নিচের লেখায় আমি দেখাতে চেষ্টা করব দেশজ চিকিৎসা সংক্রান্ত সংগঠনে দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষায় ইংরেজবাদীদের হস্তক্ষেপে ইংরেজিমাধ্যমে পড়াশোনা চালু হওয়ার আগে কিভাবে হাত ধরাধরি করে চলেছিল। তবুও দেশজ চিকিতসাবিদ্যায় উতসাহ থেকেই যায় পরের দিকেও। এটির দুটি রূপ দেখা যায়, প্রথমত দেশজ ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং দ্বিতীয়ত দেশিয় মানুষের ত্রাণের কাজে দেশজ চিকিতসকেদের নিয়োগ করা।

দেশিয় চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্রে চিকিৎসা শিক্ষা
উনবিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ চিকিতসকেরা দেশিয় চিকিতসা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণার উদ্যম নিয়েছিলেন। ১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডায়রেক্টর্স জানান, আমাদের মনে হয়েছে (এই চিকিৎসা ব্যবস্থার) ভেষজ এবং ওষুধে ভাল কিছু রয়েছে এবং সেইগুলি আমাদের চিকিতসাব্যবস্থায় প্রয়োগ করা যায়, এবং সেই জ্ঞান চিকিতসকেদের পক্ষে উপযোগী হতে পারে। এই আদানপ্রদানে দেশের চিকিৎসাবিদ্যা এবং অন্যন্য বিজ্ঞান আধুনিক সুযোগসুবিধেগুলি গ্রহন করার উদ্যম দেখাবে১।

দেশজ চিকিৎসাবিদ্যায় গুরুত্ব নিয়ে এই প্রথম সরকারিভাবে উতসাহ দেখানো হল। আদতে এর পূর্বপ্রেক্ষা হল, ১৭৯০-১৮০০ সালে উইলিয়াম জোন্সএর স্মৃতিকথা বোটানিক্যাল অবজারভেশনস অন সিলেক্ট প্ল্যান্টস এবং ১৮১৩ সালে এইনসলির মেটিরিয়া মেডিকা ইন হিন্দোস্তান প্রকাশ।

দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থায় উতসাহের প্রমান পাওয়া গেল কলকাতা সংস্কৃত কলেজ এবং কলকাতা মাদ্রাসা তৈরির পর নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সস্টিটিউশন(এখন থেকে এনএমআই) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এর ভিত্তপ্রস্তরটি স্থাপিত হল ১৮২২ সালের ৯ মে এবং সরকারি নির্দেশনামাটি প্রকাশিত হল ২১ জুন২। নির্দিষ্ট নীতিমালা এনএমআইএর জন্য তৈরি করার পরিকল্পনা হল। বেঙ্গল মেডিক্যাল বোর্ডকে এই কাজের বিশদ দায়িত্ব দেওয়া হল। ছাত্র ভর্তি এবং নির্দিষ্ট শিক্ষার প্রেক্ষিতে দেশজ চিকিতসকেদের কিভাবে এনএমআইতে নেওয়া হবে সেই নীতিমালার মূল সূত্রগুলি আমাদের জানা জরুরি। এনএমআইএর আরেকটি নাম হল স্কুল অব নেটিভ ডক্টরস, এবং এই ধরণের শিক্ষা কেন্দ্র ব্রিটিশ ভারতে প্রথম তৈরি হল।

শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ২০তে বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত হল। এই শিক্ষালয়ে প্রবেশের জন্য হিন্দুস্তানি অথবা পার্সি ভাষা জানান বাধ্যতামূলক হল। পরিকল্পনার তৈরি সময় ধার্মিক বৈষম্য করা হয় নি, এর অর্থ হল এই শিক্ষা গ্রহনে জাতিগত বৈষম্যও করা হল না। পাঠগ্রহনের পরীক্ষায় সফল হওয়ার পর আর্থিক সাহায্য এবং চাকরির আশ্বাস দেওয়া হল। শিক্ষা গ্রহনের সময় বাতসরিক ৮টাকা জলপানি দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। এনএমআই শিক্ষান্তে ছাত্রদের সেনাবাহিনিতে ভর্তির নির্দেশ জারি হল গভর্নরের নির্দেশে৪। প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা হল সিভিল এসিস্ট্যান্ট সার্জেন এবং তাকে সহায়তা করার নিয়োগের প্রস্তাব হল জন্য দুজন দেশিয় চিকিৎসকের। বহুজ্ঞানী প্রাচ্যবিদ ড জন টেইলর এনএমআইএর প্রধান(সুপারিনটেন্ডেন্ট) মনোনীত হলেন।

দেশিয় ভাষায় শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হল। দেশিয় ছাত্রদের অসুবিধের কথা ভেবে মানবের শবদেহ নয়, পশুর শব নিয়ে কাটাছেঁড়ার ব্যবস্থা হল। শারীরবিদ্যা, ঔষধ বিদ্যা এবং শল্য চিকিৎসা নিয়ে একটি পাঠ্যক্রম তৈরি হল এবং শিক্ষার জন্য অনুবাদেরও ব্যবস্থা হল। এই পুস্তকগুলির মাধ্যমে ছাত্ররা বাংলায় এই প্রথম ইওরোপিয় চিকিতসাবিদ্যার মূল তত্ত্বগুলি সম্বন্ধে পরিচিত হল। হাতে কলমে কাজের জন্য পশুর দেহ ব্যবচ্ছেদ এবং হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীদের শবদেহের ময়না তদন্তের কার্যপ্রনালী অনুসরণ করত। মেডিক্যাল বোর্ডের নির্দেশে এবং সুপারিন্টেনডেন্টের দেখাশোনায় ছাত্রদের বিভিন্ন হাসতাপাল এবং কেন্দ্রে পাঠান হত। যারা ইওরোপিয় হাসপাতালে অতিরিক্ত শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের জন্য যেত তাদের ওষুধ তৈরির দপ্তরে কাজে লাগানো হত, বিভিন্ন ওয়ার্ডে এবং ওষুধখানায় পাঠানো হত যাতে তারা বাঁধাছাঁদা আর ওষুধ তৈরিতে দক্ষ হতে পারে। আর যারা বাংলার নেটিভ হস্পিটালের সঙ্গে যুক্ত, হাসপাতালের কাজের জন্য পাঠালে তাদের মেডিক্যাল আধিকারিকদের অধীনে দেওয়া হত যাতে তারা হাসপাতালের কাজ করতে পারে।

এনএমআইকে আরও সংগঠিত করতে উদ্যমী হয় বাংলা সরকার। ১৮২৪ সালে সরকারি নির্দেশে ডাক্তারির সঙ্গে জোড়া শব্দসমূহগুলিকে নাগরি ও পার্সি ভাষায় রূপান্তরিত করে ছাপার ব্যবস্থা করা হল। মেসার্স বাথগেট এন্ড কোম্পানির থেকে ৭০৯টাকা দিয়ে দুটি কঙ্কাল কেনার নির্দেশ জারি হল ১০ জুন ১৮২৪ সালে। ১৮২৬ সালে কলকাতা সংস্কৃত কলেজে আর কলকাতা মাদ্রাসয় চিকিৎসাবিদ্যা শেখাবার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ঠিক হল কলকাতা সংস্কৃত কলেজে শেখানো হবে আয়ুর্বেদ এবং কলকাতা মাদ্রাসয় শেখানোর ব্যবস্থা হবে য়ুনানি। এই দুটি শিক্ষা কেন্দ্রই সুরকারি অনুদানে পোষিত৮। এনএমআইতে এই বছর ছাত্র সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০ করার এবং ৪ জন সহকারী – দুজন হিন্দু, দুজন মুসলমান নিযুক্ত করার নির্দেশিকা জারি হয়। প্রত্যেক দেশি ডাক্তার তৈরিতে সরকারের খরচ পড়ত মোটামুটি ১০০০ টাকা।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৪ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা




 দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূত্র
এইচ সিজারিস্ট, আ হিস্ট্রি অব মেডিসিন
ডি এম বোসের সম্পাদনায় আ কনসাইজ হিস্ট্রি অব সায়েন্স ইন ইন্ডিয়ায়(এবার থেকে কনসাইজ হিস্ট্রি) এস এন সেনএর প্রবন্ধ সার্ভে অব সোর্স মেটিরিয়াল
বি এল গর্ডন, মেডিসিন থ্রু আউট এন্টিকুইটি
ডি পি চট্টোপাধ্যায়, হোয়াট ইজ লিভিং হোয়াট ইজ ডেড ইন ইন্ডিয়ান ফিলোজফি এবং তাঁর আরেকটি প্রবন্ধ সায়েন্স এন্ড সোসাইটি ইন এন্সিয়েন্ট ইন্ডিয়া
এস এন দাশগুপ্ত, হস্টোরি অব ইন্ডিয়ান ফিলোজফি
শ্রী গুলাবকিনভর্ব আয়ুর্বেদিক সোসাইটির প্রকাশনায় চরক সংহিতা
যে আর হালদার, মেডিক্যাল সায়েন্স ইন পালি লিটারেচার
ডি পি চট্টোপাধায়ের স্টাডিজ ইন দ্য হিস্টোরি অব সায়েন্স ইন ইন্ডিয়ায় জে য়লির ফিজিসিয়ান এন্ড থেরাপি
এ আল ব্যাসাম, ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া
বি ফ্যারিংটন, হেড এন্ড হ্যান্ড ইন এন্সিয়েন্ট গ্রিস
যে ফিলিওজাত, দ্য ক্লাসিক্যাল ডক্ট্রিন অব ইন্ডিয়ান মেডিসিন
এইচ এইচ রিজলি, দ্য ট্রাইব এন্ড কাস্টস অব বেঙ্গল
এল যোশী, স্টাডিজ ইন দ্য বুদ্ধিস্ট কালচার অব ইন্ডিয়া
এন ওয়াগলে, সোসাইটি এট দি টাইম ইন বুদ্ধ
রোমিলা থাপার, আ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া
এন দত্ত, মহাযান বুদ্ধিজম
যে মিত্র, আ হিস্ট্রি অন মেডিসিন ফ্রম প্রি-মৌর্য টু কুশান পিরিয়ড
কে সি চক্রবর্তী, এন্সিয়েন্ট ইন্ডিয়ান কালচার এন্ড সিভিলাইজেশন
টি সিদ্দিকি, য়ুনানি মেডিসিন ইন ইন্ডিয়া
এ এইচ ইজরায়েলি, এডুকেশন অব য়ুনানি মেডিসিন ডিউরিং মুঘল পিরিয়ড
এন এইচ কেশোয়ানি, মেডিক্যাল এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া সিন্স এন্সিয়েন্ট টাইমস
কনসাইজ হিস্ট্রিতে, এম জেড সিদ্দিকি, দ্য য়ুনানি-টিব(গ্রিক মেডিসিন) ইন ইন্ডিয়া
এম এ অল-ওয়াহাব জাহুরি, এন এচিভমেন্টস অব ইন্ডিয়ান ফিজিশিয়ানস
ও পি জাগগি, মেডিসিন ইন মেডিভ্যাল ইন্ডিয়া
পি বালা, দ্য আয়ুর্বেদিক সিস্টেম অব মেডিসিন – ইটস ফেট ইন মেডিভ্যাল ইন্ডিয়া
আর এইচ মেজর, আ হিস্ট্রি অব মেডিসিন
এন এইচ কেশোয়ানি সম্পাদিত দ্য সায়েন্স অব মেডিসিন এন্ড ফিজিওলজিক্যাল কন্সেপ্টস ইন এন্সিয়েন্ট এন্ড মেডিভ্যাল ইন্ডিয়ায় আর এল ভার্মা এবং সম্পাদকের প্রবন্ধ, য়ুনানি মেডিসিন ইন মেডিভ্যাল ইন্ডিয়াঃ ইটস টিচার এন্ড টেক্সটস
আই এ খান, দ্য মিডল ক্লাসেস ইন মুঘল এম্পায়ার
ইরফান হাবিব, দ্য এগ্রারিয়ান সিস্টেম অব মুঘল ইন্ডিয়া, ১৫৫৬-১৭০৭
পি কুতুম্বিয়া, মেডিসিন ইন মেডিভ্যাল ইন্ডিয়া
বালা, দ্য আয়ুর্বেদিক এন্ড য়ুনানি সিস্টেমস ইন মেডিভ্যাল ইন্ডিয়া
(চলবে)

Monday, February 20, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৩ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

এর আগে অনুবাদ এবং সংহিতাকরণ এবং য়ুনানি এবং আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসার ইতিহাস নিয়ে যে আলোচনা করলাম তাতে পরিষ্কারব মধ্য যুগে চিকিৎসার জ্ঞান কিন্তু প্রণালীবদ্ধতার দিকে এগোচ্ছিল। সিদ্দিকি বলছেন, ভারতের বিভিন্ন অংশের হেকিমেরা আয়ুর্বেদিয় এবং য়ুনানি চিকিৎসা শাস্ত্র আর তাদের চিকিৎসার জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে সেগুলির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রচুর প্রকাশনা করছেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের গতিশীলতার আরেকটা প্রমান হল রস(পারদ) শাস্ত্রের বিকাশ৮৯। ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে চিকিৎসা জ্ঞানে পারদ বিষয়ক শাস্ত্রের প্রবেশ এই শাস্ত্রটিকে অনেক দূর এগিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। এই সময়ে নাড়ি পরীক্ষাও চিকিৎসা কর্মের অঙ্গাঙ্গী কর্ম হয়ে ওঠে।

হেকিম ইসকান্দার য়ুনানি এবং হেকিম শরিফ খানের মত দুজন লব্ধ প্রতিষ্ঠ চিকিৎসক, পরিকল্পিত ভাবে ভারতজুড়ে য়ুনানিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে গিয়েছেন। প্রথম জন উনিবিংশ শতে দাক্ষিণাত্যে যান। হায়দার আলি এবং টিপু সুলতান ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে উতসাহিত করেন, যেহেতু তারা নিজেরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। সে সময়ে অনেকগুলি তামাদি হয়ে যাওয়া বা ভুলে যাওয়া বই পার্সিতে অনুদদিত হয়। গ্রিকো-আরব চিকিতসকেদের কাছে দাক্ষিণাত্য বরাবরের জন্য জানাশোনার এলাকা। শরিফ খানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শারা-ই-হুমিয়ত-ই কানুন এবং ইলাজ অল-শরিফি। য়ুনানির প্রচারে তালিফ ই-শরিফি, ইসকান্দর য়ুনানির শেষ বৌদ্ধিক কাজ। প্র্যত্যেকটা শব্দের তিনি হিন্দিতে অনুবাদ করেন যাতে প্রত্যেক সাধারণ মানুষ পড়তে পারেন। শরিফ খান অন্যদিকে খানদান-ই-শরিফি নামক য়ুনানি চিকিতসকের পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। পরিবারের শেষ প্রখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন হেকিম আজমল খান, যিনি তার পরিবারের পরম্পরার বয়ে নিয়ে সারা দেশে য়ুনানি চিকিতসা ব্যবস্থার প্রচার করেছেন।
ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে দাক্ষিণাত্য য়ুনানি চর্চার বড় অঞ্চল ছিল। এই অঞ্চলে বিপুল পরিমান য়ুনানি চিকিৎসা এবং জ্ঞানচর্চা নিথিকরণ এবং প্রচারের কাজ করেছেন বিপুল সংখ্যায় লেখক-চিকিতসকেরা। আসিফ জা এবং সিকন্দর জাএর রাজত্ব চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজকর্ম উতসাহ দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিল। দাক্ষিণাত্যের ভেষজের যতদূর সম্ভব বিশদ বিবরণ য়াদগার-ই রাজাই এই সময়ে লিখিত। দস্তুরি আম সিকন্দর জাহি এবং মুজারিবাত-ই জামাল য়ুনানি পদ্ধতিতে রোগ নির্নয়, নাড়ি এবং মুত্র পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা এবং সভাসদেদের চিকিতসাবিষয়ক গবেষণার উল্লেখ করেছে। ওয়ালাজাহির সময়ে দাক্ষিণাত্যে কিভাবে চিকিৎসা হত, তার জামালএ তার বিশদ বর্ননা রয়েছে৯১।

মনে হয় য়ুনানি আর আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ব্যবস্থা একই পথ ভ্রমন করেছিল তার তাত্ত্বিক একতার আর রাজাদের যৌথ চিকিতসাব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। হয়ত রাজাদের মনে হয়েছে এই দুই চিকিৎসা ব্যবস্থা তাদের স্থিতির পক্ষে হানিকারক নয় তাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। হাতে গোণা হেকিম ছাড়াও, মুঘল ভারত বিপুল সংখ্যায় বৈদ্যশাস্ত্রীকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে – বিশেষ করে মুঘল মধ্যবিত্ত মনসবদারেরা। বাহিনীতে বৈদ্যরা চাকরিও করেছেন৯২। মনসবদারদের বাহিনীতে শিফাখানায় চিকিতসকেরা চাকরি করতেন রাষ্ট্রীয় বেতনে। রাষ্ট্র এবং মনসবদারেরা তাদের বাহিনীতে বৈদ্যদের সেবাটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। তবে এটা হয়ত সত্যি যে আয়ুর্বেদের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা খুব জরুরি শর্ত ছিল না। মনসবদারদের বাহিনীর সঙ্গে যে সব চিকিৎসক থাকতেন তাদের কাজ ছিল যুদ্ধে বা অসুস্থ সেনার চিকিৎসা। সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর যুদ্ধের গতি বজায় রাখার জন্য তাদের সেবাটা জরুরি ছিল। কোন কোন সময় ছোট শহরে হাসপাতাল তৈরি করলে সেখানে কিছু হেকিম আর বৈদ্যর চাকরি হত। ছোট ছোট শহরে যে সব হাসপাতাল চলত সেগুলি চালানোর দায় যার নাম “আলতামঘা” ছিল অভিজাত এবং জায়গিরদারদের ওপর৯৬। খান বলছেন, যদিও বৈদ্যরা সরকারিভাবে মনসবদার বা সরকারি সেবাকেন্দ্রে চাকরি করতেন, - রাজ্য স্তরে হেকিমি আর বৈদ্যদের সংখ্যা ছিল বিপুল।

মধ্যযুগে দুধরণের চিকিৎসক ছিলেন, একদল রাজারাজড়া মনসবদার এবং অভিজাতদের সঙ্গে কাজ করতেন, অন্যদিকে গ্রামে গ্রামে বিপুল সংখ্যায় চিকিৎসক কোন রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছাড়াই চিকিৎসা করতেন। রাজ দরবারে, রাজসভায় কাজ করতেন তারা থলিভরা সম্মানজনক মাইনে পেতেন, এদের অধিকাংশ পার্সি, মোটামুটি ধনবান এবং তাদের প্রভূত সামাজিক পদমর্যাদা ছিল। তাদের কেউ কেউ সত্যিকারের ধনী হয়েছেন, কেউ কেউ এত ধনী আর খ্যাতি পেয়েছেন যে কেউ কেউ অভিজাত পরিগণিত হয়েছেন, তবে মোট চিকিৎসক জনসংখ্যার খুবই ভগ্নাংশ এরা৯৮।

মুঘল ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার উচ্চতম শৃঙ্গ বজায় ছিল সপ্তদশ শতক পর্যন্ত, যতক্ষণনা ভারতে রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। মুঘল রাজত্বের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে আঘাত করতে থাকে। জয়গিরদারদের ওপর বিধিনিষেধ, কৃষকদের ওপর অত্যাচার, এবং জমিদারেরা কৃষকদের থেকে বেশি রাজস্ব তুলতে না পারায় সাম্রাজ্যের প্রশাসনে বিদ্রোহ দেখা দিল১০০। প্রচুর ফাটল এবং দ্বন্দ্বের উতপত্তি ঘটল। জমিদারেরা চাষীদের থেকে যেমন রাজস্ব তুলত, তেমনি তাকে সেনানী হিসেবে ব্যবহারও করত। না খেতে পাওয়া, গৃহহীন চাষীর সংখ্যা বাড়তে থাকল। একের পর এক তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াল। মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরের মানুষ একজোট হচ্ছিলেন। এই বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং রাষ্ট্রের মারমুখী হয়ে ওঠার মধ্যের দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও চিকিৎসকেরা কিন্তু মনসবদারদের পৃষ্ঠপোষকতার নিরাপত্তা পেয়ে এসেছে।
এটা মনে করা হয়ত সঠিক হবে, মধ্য যগের ভারতে বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসক ছিলেন – কিছু রাজদরবারে বা অভিজাতদের সেবা দিতেন, কিছু মনসবদারদের অধীনে চাকরি করতেন এবং শেষে বিপুল সংখ্যক রাষ্ট্রের সাহায্য ব্যতিরেকে রাজ্যস্তরে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং সমাজে সেবা দিতেন। চাকরির সুযোগ খুবই সীমিত ছিল। এই তথ্য থেকে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে স্থানীয় গ্রাম/ছোট শহরস্তরে চিকিতসকেদের চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা বিপুল ক্ষেত্রে রাজসভা নির্ভর ছিল না। হয়ত তারা সেই এলাকাতেই প্রশিক্ষিত হতেন এবং সেখানেই তাদের সেবা দিতেন।

মধ্যযুগে বিদ্রোহী সামাজিক গোষ্ঠীর বিদ্রোহ জনিত ভারতীয় সমাজে বেড়েও চলা দ্বন্দ্বের জোরে ভারতে নতুন প্রশাসন এল। পৃষ্ঠপোষক মধ্যবিত্ত মনসবদারি এবং রাষ্ট্রটিও ব্রিটিশ রাজত্বে শাসনে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাওয়ায়, এই সময়ে দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা কিছুটা পিছু হঠল১০০। বাংলায় মুসলমান পৃষ্ঠপোষণা চলে যাওয়ায় প্রচুর শহুরে চাকরি লোপ পেয়ে গেল, সেনা, কুশলী পরম্পরার কারিগর, করণিকদের কাজ গেল।

আয়ুর্বেদিয় চিকিতসকেরা পেশাদার ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েইছে(বিশদে ৪র্থ অধ্যায়ে) – কিন্তু প্রাচীন এবং মধ্য যুগে ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার যেদিকে পরিবর্তন আসছিল সেটা ইঙ্গিত করে পেশাদারিত্বের দিকেই যাওয়ার। চিকিৎসা শিক্ষা দীর্ঘমেয়াদী। জীবককে তক্ষশীলায় সাত বছর ধরে শিক্ষা নিতে হয়েছে। চিকিৎসা শাস্ত্রে উল্লিখত ধর্মীয় সূত্র/আচার অনুযায়ী চিকিৎসককে চিকিৎসার জন্য বৈধতা নিতে হয়। শেষতমভাবে দরবারে চাকরি চলে যাওয়ায় সামাজিকভাবে চিকিতসাবিদ্যার ওপরে গ্রহনের ছায়া পড়েছে। পরের অধ্যায়গুলিতে আমি আলোচনা করব, উনবিংশ শতকে, ভারতীয় চিকিৎসার এই উপাদানগুলি পেশাদারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশে সাহায্য করবে, হয়ত সে অবস্থায় ছিল সেই স্তরে পৌঁছবে না।
(চলবে)

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১২ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

বাবরের সময়ের জনৈক চিকিৎসক, হাকিম য়ুসুফ বিন মহম্মদ, আয়ুর্বেদ আর য়ুনানির মূল কাঠামো সংহত করে একটি চিকিৎসা শাস্ত্র প্রণয়ন করেন। তিনি আয়ুর্বেদ আর য়ুনানি দুটিরই স্বাস্থ্যবিধি, রোগ নির্নয় পদ্ধতি এবং চিকিৎসাকর্মরমত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সংগ্রহ করেন। বাবরের সেনাবাহিনীতে বহু দক্ষ চিকিৎসক এবং শল্য চিকিৎসক ছিলেন।

হুমায়ুনের দরকারের দার্শনিক-চিকিতসক, মৌলানা মহম্মদ ফজল প্রণীত করেন পার্ল অব সায়েন্স – ১২টি বিভিন্ন জ্ঞানের একটি রত্নপেটিকা, এর মধ্যে চিকিৎসা শাস্ত্রও রয়েছে। তার পুত্র আকবর সংহিতাকর্মে জ্ঞানীদের উতসাহিত করতেন। তার রাজত্বকাল বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং সামাজিক বিষয়ে বিকাশেরে জন্য চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশে অনুবাদকর্মকে এতই গুরুত্ব দিতেন, যে তার রাজত্বে তিনি কটি অনুবাদ এবং সংহিতাকর্ম বিভাগই খুলে দেন। এটা স্বাভাবিক যে রাজা/সম্রাট যদি উতসাহিত হন তাহলে তার সময়ে বিপুল কাজের সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। সেই সময়ে ফাওয়াইদ অল ইনসান নামক একটি সংহিতা তৈরি হয়। এটিতে ভারত আর ইরানের খাদ্যাভ্যাস, ওষুধ ব্যবহার এবং চিকিতসায় তার প্রভাব নির্নয় করা হয়। মুঘল সাম্রাজ্যে তা বলে আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসাব্যবস্থা কিন্তু উপেক্ষিত হয় নি৭৯। পারসিক চিকিসক৭৯ ছাড়াও আকবর হিন্দু চিকিৎসকও৮০ নিয়োগ করেছিলেন। আকবরের সময়ের আরেকটি চিকিতসা সংক্রান্ত পুঁথি তাবাকত-ই-আকবরিতে দরবারের বেশ কিছু হিন্দু চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করেছে। তারা আকবরের সময়ে খাজঞ্চিখানা থেকে সরাসরি মাইনে পেতেন। আমরা দেখলাম আকবরের রাজত্বে য়ুনানি এবং আয়ুর্বেদ সব থেকে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পায়।

জাহাঙ্গীরের সময়ে হাকিম রুহুল্লা আয়ুর্বেদে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে একটি অনুবাদ কর্ম করেন, এছাড়াও তিনি দুধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসকেরা কি ধরণের পদ্ধতি এবং রীতিনীতি অনুসরণ করেন সে বিষয় নিয়েও পুস্তক রচনা করেন। জাহাঙ্গীর চিকিৎসা শাস্ত্রে এতই পটু ছিলেন যে নিজে সফলভাবে রোগের দাওয়াই নিদান দিতে পারতেন৮৩।

জাগগি বলছেন, জাহাঙ্গীরের পরে শাহজাহানের সময় মধ্যযুগে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা উন্নতির চরম শৃঙ্গে আরোহন করে। সারা দেশ জুড়ে তিনি হাসপাতাল তৈরি করান। জনৈক শল্য চিকিৎসক, মাসিউজ্জামানহাকিম নুরুদ্দিন মহম্মদ আবদাল্লা, আকবর, জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের সময়ে য়ুনানি এবং ভারতীয় শল্য চিকিৎসা এবং চিকিতসকেদের নিয়ে নানান পুঁথির সংহিতা প্রণয়ণ করেন। শাহজাহান দিল্লিতে একটি বড় হাসপাতাল তৈরি করেন, যেখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা করা হত। জাহাঙ্গীরের পুত্র আমানুল্লা খান বা হাকিম নুর আল বিন মহম্মদের মত কিছু চিকিৎসক খ্যাতির চরম শিখরে ওঠেন। আকবর শাহজাহানের সময় সম্রাট এবং অভিজাতদের নানান পুস্তকে দরবারি চিকিতসকেদের সঙ্খ্যার যে সব বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলি হল, আকবরের সময় পার্সি চিকিৎসক ছিল ১৪, ভারতীয় ১২, অন্যান্য ১৩ মোট ৩৯, শাহজাহানের সময় এই সংখ্যাটি ছিল যথ্যাক্রমে ৭, ৩, ১, মোট ১১।

এরপরে চিকিতসকেদের পৃষ্ঠপোষণা ক্রমাগত কমেছে। তবে আমরা এটা স্পষ্ট জানি যে মুঘল রাজত্বে চিকিৎসা এবং আরোগ্য কেন্দ্র তৈরি করার উতসাহ দেওয়া হত এবং সেখানে অসুস্থদের সুস্থ করে তোলা হত। এটাও হতে পারে সম্রাটেরা বুঝতে পারলেন চিকিতসকেদের বেশি দরবারে না রেখে বিভিন্ন সংগঠনে তাদের চিকিৎসা করতে দেওয়া উচিত যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হতে পারে। পরের দিকে আমরা দেখেছি এই কেন্দ্রগুলি, চিকিতসক আর অন্যান্য কর্মীর জন্য বিশেষ অর্থ সাহায্য হত।

আওরংজেবের সময়ে য়ুনানি চিকিৎসাবিদ্যায় বিপুল সংখ্যক প্রকাশনা হয়েছে। এই সময়টা য়ুনানি চিকিৎসা বিদ্যার জন্য খুব অনুগ্রাহী ছিল। তবে আয়ুর্বেদকে তিনি যে বর্জন করে নির্বাসনে দিয়েছিলেন, এমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। এধরণের পদক্ষেপ নিলে কোন না কোন চিহ্ন থেকেই যেতই এবং তার সিংহাসনে বসার সময়ে আমরা দেখেছি, দুটি চিকিতসা ব্যবস্থাই মুঘল রাজত্বে একইভাবে বিকশিত হয়ে এসেছে। আওরঙ্গজেব মফস্বল, ছোট শহর এবং এমন কি গ্রামেও চিকিৎসা কেন্দ্র(হাসপাতাল) তৈরি করে ছিলেন। নবাব খায়ের আন্দেশ খান, প্রখ্যাত লেখক-চিকিৎসক, এমন একটা চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি করেছিলেন, যেখানে হাকিম এবং বৈদ্যরা চিকিৎসা করতেন একসঙ্গে এবং রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হত।

এটাও পরিষ্কার যে স্থানীয় মুসলমান শাসকেরাও হাকিম এবং বৈদ্যদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মুঘল সম্রাটেরা চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য “আকুয়াফ” নামক বিশেষ অনুদান বরাদ্দ করতেন, যে বরাদ্দ কেন্দ্র, তার চিকিৎসক এবং কর্মচারীর জন্য ব্যয় হত। মাদ্রাসাগুলি যাতে ঠিকমত চলে, তার জন্য মুঘল সাম্রাজ্য বিপুল বরাদ্দ করেছিল। য়ুনানি শিক্ষাকেন্দ্র সম্পর্কে রাজকীয় বরাদ্দের যথেষ্ট প্রমান পাওয়া যাচ্ছে, যদিও আয়ুর্বেদিয় শিক্ষা কেন্দ্র সম্বন্ধে এ ধরণের উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে না, তবুও মনে হয় সেই পরিমানটা খুব নগণ্য ছিল না।
মহম্মদ তুঘলকের সময় তাকে প্রতিস্পর্ধা দেওয়া দাক্ষিণাত্যের বাহমনি রাজারা জনগনের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যদিও তার কোন বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না।
(চলবে)