Tuesday, December 27, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৩৯ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

১৬৫৬ সালের শেষের দিকে আওরঙ্গজেব সরাসরি কুতুব শাহকে হুঁশিয়ারি দিলেন যে তিনি যদি জমিদারদের উস্কানি দেওয়া বন্ধ না করেন, এবং যে সব সাম্রাজ্য-নিয়ন্ত্রিত মহাল তারা দখল করেছেন, সেখান থেকে তাঁর সেনা তুলে না নেন, এবং এই কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কামগার বেগের হাতে (প্রশাসনের ভার) তুলে না দেন তাহলে তিনি তাঁর রাজ্য দখলের অভিযান শুরু করবেন। মহালগুলির যত রাজস্ব সুলতান তুলেছেন সেগুলি নিয়ে কামগারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতেও নির্দেশ দিলেন তিনি।

বীজাপুরের বিষয়ে ২১ জুন ১৬৫৬ তারিখে মীর জুমলার সুলতানের কাজকর্ম বিষয়ে উল্লেখ করে চিঠিটি পাওয়ার আগে মালুজি - যার ভাই জিঞ্জি দখলে কিলাদারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, তাঁর জন্য মীর জুমলা সাম্রাজ্যের কাজে নিয়োগ করারও সুপারিশ করেছিলেন, তাঁর ভাইকে নিজের দেহরক্ষী হতে বললেন। বুঝলেন দিল্লির সভায় বীজাপুরের বিরুদ্ধে আনা কোন আভিযোগ টিঁকবে না, তিনি মীর জুমলাকে তাঁর সাংকেতিক ভাষায় চিঠি লিখতে বললেন এবং সুলতানকে বীজাপুরের মুঘল হাজিব মার্ফতও হুমকি দিলেন।

যদিও আওরঙ্গজেব মীর জুমলা আধিকৃত কর্ণাটকে বিভিন্ন দাক্ষিণাত্যের ক্ষমতাবানদের আভিযানের উৎসাহ নানাভাবে বিশেষ করে হুমকি চিঠি দিয়ে আটকাচ্ছিলেন, কিন্তু তার পাশাপাশি কূটনীতিও প্রয়োগ করতে তিনি ভুল করেন নি। মীর জুমলার নির্দেশে শাহজী ভোঁসলার সঙ্গে বহু চিঠিচাপাটি আদান প্রদান করে তাঁকে আলাপালোচনার গতিপ্রকৃতি জানিয়ে রাখছিলেন। মীর জুমলার কর্ণাটক রক্ষায় শাহজীর সাহায্য তিনি নিয়েছিলেন সুলতানের সঙ্গে দারার চক্রান্ত রুখতে, তার বদলে তিনি তাঁকে বিশেষ কিছু সুবিধেও দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, হিন্দু বিদ্রোহ রুখতে শাহজীকে চিঠি লেখেন আওরঙ্গজেব, প্রয়োজনে মীর জুমলাকেও চিঠি লিখতে অনুরোধ করে বললেন সম্রাটের কাছে শাহজী বিষয়ে যে আবেদনটি পড়ে রয়েছে – যিটি ছিল আদিল শাহের বাহিনীর ওপর শাহজীকে আক্রমণের ছক - সেই পরিকল্পনার ভবিষ্যত দাঁড়াল তা তাঁকে জানানো হোক। তাঁর চিঠিটি শেষ করছেন এই বলে, ‘আদিল শাহের মত অবিশ্বাসী মানুষের ওপর আঘাত করলে কি হতে পারে, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই, বরং এটি অতীব প্রয়োজনীয় কর্ম বলে আমি মনে করি। (কবিতা) তোমার যা ভাল, তা আমারও ভাল।’।

৬। আওরঙ্গজেবের প্রতি মীর জুমলার যুক্তিহীন অবিশ্বাস
মীর জুমলার কর্ণাটক বাঁচাতে আওরঙ্গজেব কি কি ভূমিকা নিয়েছিলেন, সে সম্বন্ধে মুন্সি কাবিল খানের যে অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে, তাতে প্রমান দাক্ষিণাত্য জয়ের প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। নানান তথ্যের সমাহারে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আওরঙ্গজেব কর্ণাটক বাঁচাতে কিছু নিজের বিচারবুদ্ধিমত উদ্যোগ নিয়েছিলেন আর কিছু মীর জুমলার পরামর্শক্রমে নিয়েছিলেন, এবং প্রত্যেকটি পদক্ষেপের যুক্তি বর্ণনা করে মৃদুভাষায় যে সব চিঠি আওরঙ্গজেব আর তাঁর মুন্সি, মীর জুমলাকে লিখেছিলেন, তাতে প্রমান হয় যে মীর জুমলার দখল করা ভূখণ্ডটি রক্ষায় আওরঙ্গজেব যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন; তাই তাঁর প্রতি মীর জুমলার সন্দেহ শুধু ভিত্তিহীন ছিল তাই নয়, আওরঙ্গজেব ভীষণ দুরবস্থার মধ্যে যে সেই কাজটি করেছেন, সেই সম্মানটুকু তাঁর প্রাপ্য ছিল। দূরে বসে খবর পাওয়ার দেরিতে মীর জুমলার মনে ক্ষোভ জমেছে এই অভিযোগ করাই যায়, বিশেষ করে যেভাবে ডাকচৌকিগুলির ওপরে আক্রমণ নেমে আসছিল, সেই সংবাদে মাথা ঠাণ্ডা রাখা খুব কঠিন ঠিকই – কিন্তু আওরঙ্গজেবের ওপর অবিশ্বাস যে খুব একটা ন্যয় সঙ্গত এ কথা মোটেই বলা যাবে না। সে ঘটনাগুলি ঘটেছিল, তা কিন্তু সম্রাট আর তাঁর উজিরের কাজকর্মের নীতিতেই হচ্ছিল। দুজনেই চেয়েছিলেন এলাকায় থাকা আওরঙ্গজেব কর্ণাটকের নিরাপত্তায় দায়িত্ব নিন। কিন্তু অকুস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি যে রণনীতি আর কূটনীতি অনুসরণ করেছিলেন, তা ছিল তাতক্ষণিক সিদ্ধান্তের ফল। সেগুলি ক্ষতস্থনা হয়ত উপশম করে কিন্তু আরোগ্য করে না। তাঁর হাতে প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনীর জোর ছিল না, যথেষ্ট সেনা রাখার অনুমতিই ছিল না। একটা বিষয় পরিষ্কার, যে মীর জুমলা কর্ণাটক থেকে প্রস্থানের পরে সেখানকার বাহিনীর পরিমান কমিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও বহু ঘটনা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে গিয়েছিল। যেমন এর আগে আমরা দেখেছি, দারার উচ্চাশা পুরণের গোপন চক্রান্ত কুতুব শাহের গোঁ বাড়তে এবং আওরঙ্গজেবের বারংবার হুমকিকে উপেক্ষা করতে সাহায্য করেছিল। দারার উতসাহে দুজন দক্ষিণী সুলতানই আওরঙ্গজেবের হুঁশিয়ারি প্রকাশ্যে অমান্য করার সাহস পেয়েছিল এবং তারা বুঝতে পারছিল আওরঙ্গজেবের ওপর শাহেনশার পুরোপুরি বিশ্বাস নেই, এবং সম্রাট তাঁর থেকে বার বার জবাবদিহি চেয়ে পাঠাচ্ছেন, এমন গুজবও কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আওরঙ্গজেব প্রকাশ্যেই মীর জুমলাকে বলেছিলেন আমার বক্তব্য বা লেখার কোন প্রভাব পড়ছে না। তিনি উজিরকে বলেন যে ডাকচৌকিগুলি ঠিকঠাক কাজ করা মুশকিল কেননা, ইন্দোর আর বুরহানপুরের জায়গিরের মধ্যেকার ডাকচৌকিগুলিতে থাকা মানুষেরা মন দিয়ে কাজ করছে না।

৭। গোলকুণ্ডা আক্রমণের দ্বিতীয় পরিকল্পনায় বাধ সাধলেন মীর জুমলা
১৬৫৬র মাঝের দিকে মীর জুমলার মনে কর্ণাটক এবং তাঁকে নিয়ে যে সব রটনা ছিল সেগুলি দূর করার চেষ্টা করলেন আওরঙ্গজেব। তাঁর বক্তব্য ছিল সমস্যা সমাধানের সূত্র আসতে হবে দিল্লি থেকেই। দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের ইচ্ছে ছিল যে এই বিষয়ে মীর জুমলা সম্রাটের সামনে তাঁর রাজনীতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করুক, যাতে তিনি দুই সুলতানকেই চিঠি লিখে তাদের শয়তানি কাজকর্মে দাঁড়ি টানতে সক্ষম হন। কিন্তু ক্রমশঃ তিনি বুঝছিলেন দাক্ষিণাত্যের অবস্থা শুধু আর হুমকি দিয়ে সামলানো যাচ্ছিল না, প্রয়োজন ছিল সরাসরি মেঠো রণনীতি বিশেষ করে আক্রমণের রাস্তা অবলম্বন করার। দারার চক্রান্ত আর উস্কানি রুখতে তিনি সুলতানি রাজ্য দুটিকে আক্রমন করার প্রস্তাব মীর জুমলাকে দিলেন। ‘’তুমি যদি মনে কর যে আমি তোমার কাজে অবহেলা করছি, তাহলে আমি বলব তোমারও মনে রাখা উচিত এই দুর্বিসহ অবস্থাকে সামলানোর একটা দায় সম্রাটের ওপরও বর্তায়, যাতে কর্ণাটক বিষয়ে(নীতি গ্রহণে) কোন ত্রুটি না থেকে যায়’। তিনি আবারও বললেন, ‘তুমি গোলকুণ্ডার অবস্থা ভালভাবেই জান। এই বিষয়ের তদ্বির নির্ভর করছে সম্রাটের সুখ-ইচ্ছার ওপর, এবং আশাকরব, তুমি বিষয়টি তাঁর সামনে এমনভাবে উপস্থিত করবে যাতে কর্ণাটক বিষয়ে যারা লোভ করছে তাদের বিচ্ছিন্ন ও নির্বিষ করে দেওয়া যায়।’ হিন্দু বিদ্রোহ দমন করতে আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন দিল্লির বাহিনী এসে যেন ‘আমাদের কাজ’ কর্ণাটকের সামনে চোখ রাঙিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে কুতিব শাহী বাহিনীকে হঠিয়ে দিক, কেননা এখন আর শুধু চোখ রাঙ্গানিতে কাজ হচ্ছে না। ঘটনা যখন পেকে উঠল, মুঘল দূত হাজি শফি কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে কর্ণাটক থেকে বহু কষ্টে ফিরে এলেন, সে সময় আওরঙ্গজেব সরাসরি মীর জুমলাকে প্রস্তাব দিয়ে বললেন অন্তত একবারও যেন খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগে তিনি সম্রাটের অনুমতি নিয়ে দাক্ষিনাত্যে আসেন। দিনের পর দিন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তুমি যা ভাল মনে কর, কর। তুমি যদি একে সামলাতে চাও তাহলে তাড়াতাড়ি চলে এস, যাতে আমরা দুজন হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারি। ভবিষ্যতে কিন্তু কোন উদ্যমই যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হবে না। আমি জানি তুমি কত বড় সেবার কার্যে আছ, তোমার জ্ঞান প্রজ্ঞা দূরদৃষ্টি অতুলনীয়; তাই তাড়াতাড়ি বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পরিকল্পনা প্রস্তুত কর, অমনযোগী হয়ো না।

আওরঙ্গজেব শেষ পর্যন্ত কুতুব শাহী রাজত্ব উচ্ছেদ এবং তাঁর জন্য একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন দিল্লি থেকে চলে আসেন এমনও প্রস্তাবটা দিয়ে ফেললেন মীর জুমলাকে। ‘সুলতানের মনোভাব আর অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষদের চক্রান্তের কথা অবিদিত নেই তোমার কাছে। এই জন্য আমি কুতুবউলমুলককে উচ্ছেদ করতে চাই এবং তাঁকে ক্ষমতায় রাখার প্রস্তাব আমাকে কেউ দিক চাই না। কর্ণাটকের ভবিষ্যতের জন্য এবং সময় সারণী দেখে আমার মনে হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কাজটা সমাধা করতে ফেলতে হবে। এই বিষয়টা সুলতানকে পাঠানো চিঠিতে বিশদে বলা হয়েছে, এবং চিঠিটির বিষয়টি নিয়ে তুমি নিশ্চই সম্রাটকে বোঝাবে এবং দেখবে এটিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাতে বাস্তবে রূপায়িত করা যায়, এবং তাঁর জন্য দেরি না করে ফর্মান জারি করার ব্যবস্থা করবে।’ ততক্ষণ দাক্ষিনাত্যে তিনি তাঁর বাহিনী বাড়াবার প্রস্তাব দিলেন, বললেন প্রয়োজনে কাজি মহম্মদ হাসানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্ণাটক আসার ব্যবস্থা নিতে।

এটা পরিষ্কার যে আওরঙ্গজেব সরাসরি মীর জুমলাকে দাক্ষিনাত্য অভিযানে নেতৃত্ব দিতে বলছেন। ঘটনাগুলি পরিষ্কার করে তাঁর সামনে পেশ করলেন – সুলতানেরা সাম্রাজ্যের নির্দেশিকা, সুবাদারি নিশান এবং হুঁশিয়ারি অমান্য উপেক্ষা করেছেন, সুলতান হিন্দু রাজা জমিদারদের উষ্কানি দিয়েছেন যাতে তারা বিদ্রোহ করে, এবং বীজাপুরের সহায়তায় একটা বড় ধরণের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করছে সুলতান, এবং এই ছোট বাহিনী নিয়ে তাঁর পক্ষে মীর জুমলার জায়গির বাঁচানো মুশকিল – মীর জুমলাকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, হয় তিনি সম্রাটকে রাজি করিয়ে আওরঙ্গজেবের সামরিক অভিযানের অনুমতি নিন, না হয় তাঁর ১২ বছরের শ্রমের ফল দখল রাখার কথা মন থেকে মুছে ফেলুন। দাক্ষিনাত্যের অবস্থা এবং তাঁর সমাধান সম্পর্কে এক মত হয়েও দুজন পরিকল্পক এক মত হতে পারলেন না। আওরঙ্গজেব চাইলেন মীর জুমলা কর্ণাটকের রাজনীতির মাধ্যমে দাক্ষিনাত্যের সমস্যার সমাধান করুণ, আর মীর জুমলা চাইলেন যে এই কাজটা শুরু হোক বীজাপুর দিয়ে। এই বিষয়ে দুজনের মধ্যে ছোটখাট বিরোধ দেখা দিল। উজির দিল্লিতে বসে বুঝতে পারছিলেন না কেন আওরঙ্গজেব তাঁর প্রস্তাবে দ্বিধান্বিত হচ্ছেন এবং সাড়া দিচ্ছেন না। আওরঙ্গজেব জানালেন তিনি অতীতে বারংবার উজিরের প্রস্তাবে কাজ করেছেন - কেন তুমি এখানে আমার অবহেলা দেখছ, যার মূল্য অঙ্কের খাতায় ধরে না? আর এই দেশটার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাক, এবং আমাদের শত্রুরা উৎসাহিত হয়ে আমাদের নিয়ে মৃত্যুমিছিল করুক সেই পরিকল্পনায় আমি কি করে সায় দেব? সর্বশক্তিমান না চান, এই চিন্তা আমার মন কুরে কুরে খাচ্ছে। অবাক হয়ে যাচ্ছি তুমি একে বাধ্যতা ধরে নিলে।

কর্ণাটকের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, এই প্রশ্নে এবং এবং সম্ভাব্য সামরিক অভিযানে যখন সারা দাক্ষিনাত্য উত্তাল, বীজাপুরি সুলতানের হঠাত মৃত্যু দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে নতুন বাঁকের সৃষ্টি করল এবং বীজাপুরের দিকে সবার নজর ঘুরে গেল।
(চলবে)




পিনাকী ভট্টাচার্য

এই বিষয়ে লেখার ইচ্ছে হবার পিছনে একটি গল্প আছে। ডাঃ তাবাসসুম খান ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরের একজন প্রথিতযশা এক্সিকিউটিভ। মধ্যপ্রাচ্যের এবং মুসলিম দেশগুলোর ফার্মা মার্কেট নিয়ে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ বলা চলে। একসময় একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি জন্য তিনি আবার আমার সহকর্মীও ছিলেন বলা চলে। যখন আমরা দুজনেই সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়েছি তখন মালয়েশিয়ায় একটা বায়টেক প্রোজেক্টের সাম্ভব্ব্যতা যাচাইয়ের কাজ একসাথে করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তখন তাঁর প্রজ্ঞা আর বিভিন্ন সেক্টরে যোগাযোগের মাত্রা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।
কয়েকদিন আগে গ্লৌবাল ইসলামিক ইকনোমিক ফোরামে ডাঃ তাবাসসুমের একটা বক্তব্যের ভিডিও দেখলাম, যেখানে তিনি হালাল ভ্যাক্সিনের যৌক্তিকতা নিয়ে বলছেন। আমি আগ্রহ নিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনি। তাঁর বক্তব্যের মুল পয়েন্ট ছিল।
“হালাল বিষয়টা এসেছে শারিয়া থেকে, তাই ওষুধের কার্যকারিতা, সেফটি, কোয়ালিটির সাথে শারিয়া যুক্ত করে আমরা ইসলামিক দুনিয়াকে বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টের একটা কমপ্লিট প্যাকেজ দেবো। আমাদের ক্লাসিফাই করতে হবে কী কী অবশ্যই হালাল হতে হবে; কী কি জিনিস হালাল হতে পারে; এবং কী কী অবশ্যই হালাল হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিৎ নয়; যেমন, আমাদের কখনোই হালাল “টাই” (নিজের পরিধেয় টাই দেখিয়ে বললেন) তৈরির চেষ্টা করতে যাওয়া উচিৎ নয়, তাহলে এটা কৌতুকপ্রদ হবে।”
আমি উনাকে বললাম যে “হালাল” বিষয়টা ইসলামের বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রস্তাবনার সাথে যুক্ত। এটা শারিয়া নয় কোরআন থেকে উৎসরিত। “হালাল” সংক্রান্ত ধারনাটি আরো পরিচ্ছন্ন ভাবে উপস্থাপিত করা গেলে আপনার কাজের সুবিধা হবে। পশ্চিমা বিশ্বের পাশে ইসলামের বিজ্ঞানের একটা নতুন প্যারাডাইম আপনি দাড় করাতে পারবেন।
আমি তাঁর জন্য ইংরেজিতে একটা লেখার ড্রাফট ও তৈরি করি। কিন্তু ভদ্রলোক আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না। হয়তো ভেবেছেন এই শর্মা আবার ইসলাম নিয়ে কথা বলে কেন? তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিজ্ঞান সম্পর্কে ইসলামের প্রস্তাবনা সংক্রান্ত একটা লেখা বাংলায় লিখবো।
যেকোন চিন্তা বা চর্চা স্বয়ংভু নয় তার ভিত নিহিত থাকে একটা দর্শনের ভিতরে। আমরা আজকে যেই আধুনিক পশ্চিমা বিজ্ঞান দেখি তার ভিত এনলাইটেনমেন্টের জমিনে এবং বস্তুত গ্রেকো রোমান খ্রিস্ট্রিয় চিন্তা থেকেই পশ্চিমা বিজ্ঞানের চিন্তা কাঠামো তৈরি হয়েছে। পশ্চিমারা বিজ্ঞান থেকে যা চায় যেভাবে চায় ঠিক সেভাবে প্রাচ্য তা চায়না, বা সেভাবে চায়না। ইসলাম বিজ্ঞান থেকে কী চেয়েছে কীভাবে চেয়েছে সেটা পশ্চিমের চাওয়া থেকে কতটা ভিন্ন সেটা তলিয়ে দেখার দরকার আছে।
এই প্রসঙ্গেই আসে ইসলামের বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রস্তাবনা। এই প্রস্তাবনার ভিত্তি হচ্ছে প্রকৃতি সম্পর্কে ইসলামের ধারণা, জ্ঞান ও মূল্যবোধের ঐক্য এবং ন্যায় ও কল্যাণ। ইসলামিক বিজ্ঞানের একটা কন্সেপচুয়াল ম্যাট্রিক্স আছে। এই ম্যাটিক্সের উৎস কোরআন। এই ম্যাট্রিক্স থেকেই ইসলামিক বিজ্ঞানের সংস্কৃতি ও চর্চার পথ উৎসরিত। এই ম্যাট্রিক্সে দশটা ধারণা বা কনসেপ্ট আছে। চারটি একক ধারণা; আর ছয়টি জোড়ায় যুক্ত ধারণা। জোড়ায় যুক্ত ধারণা গুলি তিনটি ইতিবাচক ধারণা আর তিনটি নেতিবাচক ধারণা। নিচের ডায়াগ্রামে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।

ইসলামিক বিজ্ঞানের কন্সেপচুয়াল ম্যাট্রিক্স। ফিলজফি অব সাইন্স অ্যা গ্রাফিক গাইড থেকে নেয়া
এই কন্সেপচুয়াল ম্যাট্রিক্সকে যখন মূল্যবোধে রুপান্তরিত করা হয় তখন এই ধারনাগুলি থেকে উদ্ভুত মূল্যবোধ বৈজ্ঞানিক অন্বেষাকে একটি সার্বিক ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসে। এই ম্যাট্রিক্সই তথ্য, উপাত্ত এবং মূল্যবোধকে একটি প্রাতিষ্ঠানিকতার অধীনে নিয়ে আসে যেই যেই প্রতিষ্ঠান সমাজের কাছে দায়বদ্ধ।
কিন্তু ঠিক কীভাবে এই মূল্যবোধ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে একটি সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে?
ম্যাট্রিক্সটি দেখুন। প্রথমেই আছে “তৌহীদ” যার আক্ষরিক অর্থ ঐক্য এবং যেই ঐক্য আল্লাহর একত্বের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত। এই আল্লাহর ঐক্য সর্বব্যাপী মূল্যবোধ হয়ে ওঠে যখন এই ঐক্য জাহির করে বিশ্বমানবের ঐক্য, মানুষ এবং প্রকৃতির ঐক্য এবং জ্ঞান ও মূল্যবোধের ঐক্য। এই তৌহিদের ধারণা থেকেই আসে খলিফার ধারণা। সকল মরণশীল প্রাণী আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বরং আল্লাহর কাছে তাঁর সকল কাজ এমনকি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির চর্চার জন্য দায়বদ্ধ। খলিফা মানে ট্র্যাস্টিশিপ, এর অর্থ মানুষের এই পৃথিবীর প্রাণ ও প্রকৃতির উপর একছত্র অধিকার নাই, সে এগুলোর মালিক নয়, এগুলোকে সে ধ্বংস করতে পারেনা। সে শুধু তার সংরক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং এটাই তাঁর পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক যাত্রায় দায়িত্ব। এবং যেহেতু জ্ঞান প্রকৃতির ধ্বংস করে আহরন করা যায়না আবার বিজ্ঞানীকে নিছক একজন পর্যবেক্ষক হিসেবেই ইসলাম কল্পনা করেনা তাই জ্ঞানের পথ হচ্ছে ইবাদতের পথ, যেই পথে আত্ম, তৌহীদ আর খলিফা সম্পর্কে উপলব্ধি করবে। তৌহীদ আর খলিফা সম্পর্কে উপলব্ধিই হচ্ছে ইবাদত। একটি নির্দিষ্ট অবশ্য পালনীয় ইবাদত পদ্ধতি হচ্ছা “সালাত”। সালাতের মানে হচ্ছে সংযোগ। স্রস্টার সাথে সৃষ্টির সংযোগ যখন সৃষ্টি স্রষ্টার মাধ্যমে সকল সৃষ্টির সাথে সংযোগ স্থাপন করে সেটাই সালাত। আল্লাহর একত্বের উপলব্ধির অনেক দৃষ্টিভঙ্গির একটি হচ্ছে জ্ঞানের সাধনা। যদি বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড ইবাদত হয় তাহলে এটা নিঃসঙ্কোচে বলা যায় ইসলামের এই বিজ্ঞান যা আসলে ইবাদত তা প্রকৃতি এবং প্রাণের বিনাশ করবেনা। এমনকি কোন অপচয় বা “রিয়া” করবেনা কোন জুলুমের উপায় হবেনা এমনকি এমন কোন ফলের লক্ষ্যে ধাবিত হবেনা যা “হারাম”। ইসলাম সেই বিজ্ঞান চর্চা করবে যা গণমুখী আর ন্যায়ে সম্পৃক্ত। উল্লেখিত কন্সেপচুয়াল ম্যাট্রিক্সের সাথে যা সর্বসম হবে সেটাই ইসলামিক বিজ্ঞান চর্চা করবে; এর বাইরে নয়। এর বাইরের কোন বিজ্ঞানের প্রপঞ্চ ইসলামিক বিজ্ঞান হতে পারেনা।
কন্সেপচুয়াল ম্যাট্রিক্সে “হালাল” শুধু খাদ্য বা সৎ উপার্জনের অর্থেই ব্যবহার করা হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছে যে কোন ধরনের প্রশংসনীয় লক্ষ্য (প্রেইজ অর্দি গৌল) কেও। তাই ইসলামিক বিজ্ঞানে পারমানবিক বোমা হারাম কারণ সেটা ব্লেম অর্দি, জুলুমের উপায়, প্রকৃতি ও প্রাণ বিনাশী। কুমিরের চামড়ার টাই তৈরিও হারাম কারণ সেটা প্রকৃতি ও প্রাণ বিনাশী এবং অপচয়। ইসলামিক বিজ্ঞান প্রাণ ও প্রকৃতি বিধ্বংসী নয়। এটা অতিশয় কৌতূহল উদ্দীপক যে ইসলামের স্বর্ণযুগে কেমিস্ট্রিতে মুসলিম বিজ্ঞানিরা পৃথিবী সেরা হলেও তাঁরা “বারুদ” আবিস্কার করেনি। আপনি সেই সময়ের মুসলিম বিজ্ঞানিদের এমন কোন বিজ্ঞান চর্চা খুজে পাবেন না যা প্রাণ ও প্রকৃতি বিনাশি।
“ল” অব নেইচ্যারের ধারণা এসেছে ইহুদি খ্রিসচিয়ান চিন্তা এবং সেই সময়ের ইউরোপের রাজতান্ত্রিক একনায়কি ধারনার জমিনে দাড়িয়ে। এই প্যারাডাইম না থাকলে ইউরোপের পক্ষে এই ল অব নেইচ্যারের চিন্তা করাও অসম্ভব ছিলো।
টমাস কুনের লেখার সাথে যারা পরিচিত তাঁরা জানেন যে এক একটি ঐতিহাসিক অবস্থায় জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চার অগ্রগতি ঘটে এক-একটি আদিকল্পকে (প্যারাডাইম) আশ্রয় করে। তারই ভিত্তিতে একেকটি বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী বা ঘরানা গড়ে ওঠে, তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক চিন্তা ও পরীক্ষা চলে তার আদর্শে রচিত নানা মডেল বা প্রতিকল্পকে কেন্দ্র করে। সেইসব চিন্তার ফল আবার বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলির উদ্যোগে ঐ আদিকল্পটিকেই প্রচার করে বিজ্ঞানের নানা শাখায়।
এরপরে এমন সময় আসে যখন নতুন প্রশ্ন আর সমস্যার উত্তর বা সমাধান ঐ আদিকল্প থেকে আর পাওয়া যায়না। তখনই সেই পুরনো আদিকল্প সংকটে পরে এবং নতুন আদিকল্প তাকে প্রতিস্থাপিত করে। এভাবেই মানুষের জ্ঞান ও সভ্যতা অগ্রসর হয়। এটা শুধু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সত্য নয় জ্ঞানকাণ্ডের যেকোন শাখার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। গ্রীক ম্যাথামেটিক্স বা নিউটনিয়ান ফিজিক্স এমনই দুটো আদিকল্প বা প্যারাডাইম।
আদিকল্প বা প্যারাডাইম হিসেবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলাম কী ভুমিকা রেখেছে সেটাই বিজ্ঞান প্রশ্নে ইসলামের ন্যারেটিভ।

পশ্চিমা বিজ্ঞানের মনোজগত, প্রকৃতিকে বশীভূত করার চেষ্টা
পশ্চিমা বিজ্ঞানের অবস্থান ইসলামিক বিজ্ঞানের বিপরীতে। তাঁরা প্রকৃতিকে বশীভূত করতে চায়। প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করে নিজের মুক্তি চায়। সেকারনেই পশ্চিমা বিজ্ঞান প্রকৃতি বিধ্বংসী। ইসলামে কোথায় কোথায় বিজ্ঞান আছে সেটা দেখানো এই লেখার উদ্দেশ্য নয় বরং ইসলাম বিজ্ঞান চর্চার একটা দিক এবং নিশানা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেই দিকটা কি ভ্যালুজের উপর প্রতিষ্ঠিত সেটা দেখানোই এই লেখার লক্ষ্য। পশ্চিমের বিজ্ঞানও এনলাইটেনমেন্টের জমিতে যার গুঢ় অর্থ সে খ্রিস্ট তন্ত্রের উপর দাড়িয়ে তার চর্চা করে। তাই ইসলামকে পশ্চিমের চিন্তার সার্টিফিকেইট নেয়ার প্রয়োজন নেই। ইসলামের যেই নিজস্ব বিজ্ঞান চিন্তা আছে আর সেটা পশ্চিমের চাইতে অনেক বেশী গণমুখী, অনেক কল্যাণময়, অনেক ন্যায়ের।
দোহাই ও টোকাটুকিঃ
১/ Encyclopaedia of the History of Science, Technology, and Medicine in Non Western Culture. edited by Helaine Selin
২/ Within the Four Seas–: Introduction to Comparative Philosophy; By Ulrich Libbrecht
৩/ Sardar, Ziyauddin. 1984. The Touch of Midas : science, values and environment in Islam and the West. Manchester: Manchester University Press.
৪/ Introducing Philosophy of Science: A Graphic Guide by Zianuddin Sardar (এই বই থেকেই ছবি ও গ্রাফিক্স নেয়া হয়েছে কিছুটা সম্পাদনা করে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৩৮ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৩।নতুন ব্যবস্থায় মীর জুমলার মনোভাব
কর্ণাটকে তাঁর বিজয়ের ফল ধরে রাখতে মীর জুমলা বদ্ধ পরিকর, এখন সেটি মুঘল সাম্রাজ্যের অধীন, তাঁর জায়গির রূপে পরিগণিত। আমর আগেই দেখেছি, কর্ণাটকে নিজের প্রশাসনিক পকড় আরও গভীর করতে, এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সম্পদ একত্রিত করতে, আওরঙ্গজেবের গোলকুণ্ডা দখলের ডাকে তিনি কত দেরি করে এসেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের উজিরের পদে যোগ দেওয়ার পরেও কর্ণাটকের নানান বিষয়ে তিনি গভীর মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু বাস্তবিকভাবে কর্ণাটকের ঘটমান বর্তমান থেকে বহু দূরে ছিলেন তিনি, অথচ তাঁর পুরোনো শত্রুরা নিজেদের কূটনীতি আর পরস্পরের মধ্যে জোট করে দাঁত-নখ শানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল কর্ণাটক দখলে, ফলে সরাসরিভাবে কর্ণাটক দেখভালে, তাঁর ঈর্ষান্বিত জোটবাঁধা শত্রুদের থেকে কর্ণাটক বাঁচাতে তাঁকে সরাসরিভাবে নির্ভর করতে হচ্ছিল আওরঙ্গজেব আর কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারীর ওপর। কর্ণাটক যেহেতু এখন মুঘল অঞ্চল, তাঁর মনে হল সেটি মুঘল সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় থাকবে। কাবিল শাহের স্তোকবাক্যে তাঁর ধারণা হয়েছিল আওরঙ্গজেবও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। মীর বারবার আওরঙ্গজেবকে তাঁর জায়গির কিভাবে সামলাতে হবে সে বিষয়ে বিশদ নির্দেশনামা পাঠাচ্ছিলেন। বিশেষ করে ডাকচৌকি নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন এবং আওরঙ্গজেবের হাজিবকে নির্দেশ দেন এগুলি নতুন করে গড়ে তোলার। আওরঙ্গজেব তাঁর বন্ধুর অনুরোধে সাড়া দিচ্ছিলেন, যদিও কিছু কিছু তাঁর ইচ্ছের বাইরে হছিল, তবুও তাঁকে চিন্তা করতে বারণ করেন। কিন্তু কুতুব শাহের দখলদারি মনোভাব বাড়তে থাকায় মীর জুমলার চিন্তা বাড়ল বই কমল না; ফলে তাঁর মনে হল আওরঙ্গজেব তাঁর নির্দেশ মানছেন না এবং জায়গির নিয়ে তার উৎসাহ কম।

৪। মীর জুমলার সন্দেহ দূর করার উদ্যম নিলেন আওরঙ্গজেব
ফলে আওরঙ্গজেবকে মীর জুমলার সন্দেহ দূর করতে গা ঘামাতে হয়েছিল। যখন তাঁর পিতা সম্বন্ধে আওরঙ্গজেব খুব কড়া মন্তব্য এবং চড়া মনোভাব প্রকাশ করতেন, সেখানে কর্ণাটক বিষয়ে তাঁর পিতার সিদ্ধান্তে তিনি নরম সুর প্রকাশ করায়, কর্ণাটক বিষয়ে তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে মীর জুমলার সন্দেহ জাগে। মীর জুমলাকে আশ্বস্ত করার ভাষাটিও একই নরম সমঝোতার ধরণের বলে মনে করলেন। তিনি তাঁর শত্রুদের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ, পরশ্রীকাতরতা এবং মিথ্যাচারের অভিযোগ আনলেন, বললেন শয়তনি পরিকল্পকদের পরিকল্পনায় কর্ণাটকের কি হাল হয়েছে তা বর্ণনা করলেন এবং বিষয়টা শান্ত রাখতে তাঁকে কোন কোন পদক্ষেপ করতে হয়েছে তাও তিনি বললেন। তাঁর বন্ধুকে উদ্বিগ্নতা থেকে উদ্ধার করতে তিনি গোয়েন্দা সমীক্ষা, আমলা আর অন্যান্য শুভচিন্তকদের দেওয়া অভিযোগপত্র এবং সম্রাটকে পাঠানো তাঁর আবেদনপত্র মীরজুমলাকে লেখা চিঠিতে জুড়ে দিলেন। ১৬৫৬ সালের আগস্ট মাসে উজিরকে তাঁর পদক্ষেপে আস্থা পেশ করতে বলে লিখলেন, ‘সাম্রাজ্যিক সমস্ত কাজে চিন্তামুক্তভাবে জুড়ে থাক, ভেবোনা আমি তোমার ভাল চাই না। (কবিতা) তুমি সকলের হৃদয়ে রয়েছ। কেউ তোমার সমকক্ষ নয়।’

এ ছাড়াও অরেক চিঠিতে তিনি লিখছেন, সম্রাটের তাঁর ওপর অবিশ্বাসে নানান কাজে তাঁর হাত বাঁধা থাকা সত্ত্বেও তিনি কিভাবে সদা সতর্কভাবে, সুচারুরূপে কর্ণাটকে সেনার পরিমান বাড়ানো এবং কিলাদার এবং সীমান্তে থাকা সেনানায়কদের দায়-দায়িত্ব পালন এবং সদা সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন। বারবার তিনি উজিরকে বলেছেন তিনি কোনভাবেই তাঁর জায়গিরের ব্যবস্থাপনায় ঢিলে দিচ্ছেন না এবং তাঁর শত্রুদের আক্রমণকে তিনি কোঁনভাবেই ছোট করে দেখছেন না, যতটুকু পদক্ষেপ করার করছেন।

৫। মীর জুমলার কর্ণাটক বাঁচানোয় আওরঙ্গজেবের পদক্ষেপ সমূহ
বাস্তবে, মীর জুমলার অনুপস্থিতিতে যে দুর্যোগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে কর্ণাটকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার কাজ করেছেন বন্ধু আওরঙ্গজেব। গোলকুণ্ডায় মুঘল হাজিব কাবাদ বেগকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তিনি হায়দ্রাবাদ এবং সিদ্ধাঔতের মধ্যের ডাকচৌকি স্থাপন করেন। দেওয়ান মুর্শিদকুলি খানকে প্রবীন আমলা মহম্মদ তাহিরকে নির্দেশ দিলেন তুহুলদারদের আওতায় থাকা গোমস্তাদের বকেয়া কাজগুলি সম্পাদনে সচেতন করে দেওয়ার। তিনি আগ্রাসী সুতলানকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে কোনভাবেই যেন বর্তমান স্থিতাবস্থা ভাঙ্গা না হয় এবং মীর জুমলা দিল্লি না পৌছলে কোন প্রশাসনিক রদবদল এবং ডাকচৌকির ওপর হামলাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। সম্রাটের ফরমান ছাড়া সুলতানের কর্ণাটক দখল করা শুধু হঠকারী হবে তাই নয় অপরিণামদর্শীও হবে বলে হুঁশিয়ারি দিলেন। যদি মীর জুমলা তাঁর বিরুদ্ধে সম্রাটের কানে অভিযোগ তোলেন, তাহলে কিন্তু কর্ণাটকে আগুণ জ্বলতে পারে। তিনি সুলতানকে বললেন কর্ণাট সীমান্ত থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে সম্রাটের নির্দেশের অপেক্ষা করুণ। বারংবার আওরঙ্গজেবের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও দারার উস্কানিতে সুলতান ডাকচৌকির ওপর হামলা বন্ধ করলেন না এবং সীমান্ত থেকে আবদুল জব্বারকে সরিয়েও নিলেন না। তখন আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে এই কথাগুলি জানিয়ে তাঁর গভীর চিন্তা প্রকাশ করলেন। মীর জুমলা এই বিষয় নিয়ে সরাসরি সম্রাটের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেই নির্দেশক্রমে আওরঙ্গজেব সুলতানকে জানালেন, কয়েকজনকেমাত্র মহালগুলির প্রশাসনে রেখে তিনি যেন আবদুল জব্বারকে সীমান্ত থেকে তুলে নেন এবং ইসমাইল বেগের নেতৃত্বে বাহিনী পাঠিয়ে ডাকচৌকিগুলি সারানোর ব্যবস্থা করেন। মীর জুমলা সম্রাটের কাছে জোর আর্জি পেশ করেন যে মহম্মদ শরিফকে হায়দ্রাবাদের পাঠিয়ে ডাকচৌকিগুলি সারাবার ব্যবস্থা করা হোক এবং আওরঙ্গজেবকে অনুরোধ করলেন তাঁর দূত মার্ফত সুলতানকে এবিষয়ে চিঠি পাঠাতে। নিজের লেখা চিঠি এবং মহম্মদ শরিফ মার্ফত(আগস্ট ১৬৫৬) আওরঙ্গজেব সুলতানকে হুঁশিয়ারি দিলেন যাতে তিনি সম্রাটের ফরমান অবজ্ঞা না করেন। উদ্বিগ্ন মীর জুমলা কাবাদ বেগকে ডাকচৌকি সারানোর কাজে দেরি হওয়ায় দোষী ঠাওরালেন। এই এবং নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্দেশ অমান্য করা অযত্ন, অদক্ষ এবং দীর্ঘসূত্রী মনোভাবের জন্য তাঁকে দায়ি করলেন। মীর জুমলার অনুরোধে তিনি কাবাদ এবং তাঁর হিন্দু বন্ধুদের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন যাতে এই উদাহরণে সংশ্লিষ্টদের চৈতন্য হয়। তাঁকে হাজিবের পদ থেকে সরিয়ে আহমদ বেগকে নিয়োগ করা হল এই মনোভাবে যে তিনি নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করবেন এবং ঘটনাবলী আর সুলতানের মনোভাব আর চাহিদা সম্বন্ধে সম্রাটকে সঠিক এবং তথ্যসন্ধানী সমীক্ষা পাঠাবেন। ১৬৫৬র শেষের দিকে আওরঙ্গজেব নির্দেশনামা জারি করে বললেন যে খানের(মুয়াজ্জম খান, মীর জুমলা) নামে হায়দ্রাবাদ থেকে কর্ণাটকের মধ্যে যে ক’টি ডাকচৌকি রয়েছে সেগুলি ঠিকঠাক চালাতে এবং তাঁর সুরক্ষা দান করতে সরাসরি সাম্রাজ্যের সেবায় অন্তর্ভূক্ত হল (সরকারইজাহানমদার) এবং কুতুব খানকে এ বিষয়ে সাবধান থাকতে বললেন।

কাম্বামের ব্যাপারটা আওরঙ্গজেব সমাধান করতে গেলে নিজের জামাই মার্ফত আওরঙ্গজেবকে সুলতান অনুরোধ পাঠিয়ে বলেন সেখানে যেন তিনি ইসমাইল বেগকে না পাঠান। শাহজাদা এই চিঠিটা আওরঙ্গজেবকে পাঠিয়ে দিলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে রাখলেন ‘তাঁর শয়তানি অযত্নের ফল তিনি পাচ্ছেন এবং তাঁর ফলে কর্ণাটকে যদি কোন হানি ঘটে বা গোলযোগ শুরু হয়, তাহলে তাঁর ফল ভোগ করবে আপনার উত্তরাধিকারী(তাজালউল কাওয়াঈদ উইলিয়ত মাউরুসি)’।

আওরঙ্গজেব, সুলতানের হিন্দু বিদ্রোহে উসকানির বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, ‘এই বিদ্রোহের কি কারণ আমি বুঝতে পারছি না, যার ফল শুধুই ক্ষতি এবং তুমি আর তোমার জমিদারেরা এই অব্যবস্থা থেকে কোন লাভ পাবে? জমিদারদের সতর্ক করতে চিঠি লেখ, তোমার আধিকারিকদের তুলে নাও নাহলে... তুমি লজ্জায় নিজের দাঁতে নিজের আঙুলই কাটবে।’ যখন শুনলেন যে কর্ণাটকের ভার মীর জুমলার হাতে দেওয়া হয়েছে, তিনি হাজি শফি মার্ফত প্রত্যেককে, বিশেষ করে জমিদারদের, কর্ণাটকে থাকা তাদের সেনাপতিদের, সেখানকার মুঘল আধিকারকদের(কাজি মহম্মদ হাশিম, কৃষ্ণা এবং খ্বাজা মহম্মদ আরিফ কাবাদ বেগ হাজিব) এবং কুতুব শাহকে চিঠি লিখলেন। বিশেষ করে রয়ালকে লেখা চিঠিতে ভয় এবং আশার(বিম ও উমিদ) কথা বললেন। কাজি মহম্মদ হাশিম, কৃষ্ণা এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে একটি মুঘল বাহিনী সিদ্ধাঔতে গিয়ে আবদুল জাব্বারকে পরাজিত করল। কিছু দিনের জন্য হতাশায় এবং ক্ষতিতে সুলতান নিজেকে সংযত রাখলেন। ডাকচৌকি আগের মত কাজ করতে লাগল।
(চলবে)

Monday, December 26, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৩৭ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

দ্বিতীয় পর্ব
১। মুঘল সাম্রাজ্যে মীর জুমলার জায়গির হল কর্ণাটক
কুতুব শাহীর বিরুদ্ধে মীর জুমলার বিদ্রোহ শেষ হয়েছে, মুঘল বাহিনী হায়দ্রাবাদে ঢোকা বন্ধ রয়েছে, কুতুব শাহ আর মুঘলদের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু যে অঞ্চলের জন্য এই সব বিবাদ-ঝগড়া, কর্ণাটকের দায়িত্ব কার হাতে থাকবে সেই মূল বিষয়টার কোন সমাধান তখনও হয় নি। সুলতান স্বাভাবিকভাবেই এই সম্পদশালী এলাকাটি নিজের তাঁবেতে রাখতে চাইলেন, কেননা তাঁর কর্মচারী তাঁরই সম্পদে এই এলাকাটি দখলে নিয়েছিল। আগেই আমরা দেখেছি, আওরঙ্গজেবের চোখ কিন্তু কর্ণাটকের ওপরেই নিবদ্ধ ছিল। ১৬৫৬র মার্চে তিনি উজির সাদুল্লা খানকে বলেন, ‘কর্ণাটকের বিষয়ে বলি, মীর জুমলার গোমস্তাদের অধীনে, সেখানে বেশ কিছু হিরের খনি রয়েছে, আর রয়েছে সমুদ্র বন্দরও; এখন সেটি সাম্রাজ্যের সম্পত্তি, সময় এলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গোলকুণ্ডা থেকে রামগির(পাইনগঙ্গা আর গোদাবরীর মধ্যেকার স্থান – আজকের মানেকদুর্গ আর চিন্নর) দখল করে তেলেঙ্গানাকে উত্তর কর্ণাটকের শাসনে নিয়ে এসেছিলেন আওরঙ্গজেব। এবারে এক দিক থেকে অন্য দিকে যেতে আর গোলকুণ্ডার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হল না – সরাসরি সেনাবাহিনী নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হল। সুলতানকে কর্ণাটক দখলে রাখার সমস্ত রকম পরিকল্পনায় জল ঢালছিলেন তিনি।

মীর জুমলা দিল্লি পৌঁছবার আগেই কুতুব শাহ কর্ণাটক দখলে রাখার চেষ্টার খামতি দেন নি। তিনি কর্ণাটক এবং পৈতৃক রামগীর দুর্গ দখলে রাখতে চেয়ে শাহজাহানকে আবেদন করেন। তাঁর ধারণা ছিল এই প্রস্তাবে আওরঙ্গজেব তাঁকে সায় দেবেন, এমন কি তিনি জাহানারাকে দিয়ে এই প্রস্তাব সম্রাটকে দেওয়ানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন। আওরঙ্গজেব সুলতানকে অপেক্ষা করতে বললেন, কেননা ঠিক হয়েছে মুয়াজ্জম খানের পদে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত এই বিষয়টি নিয়ে কোন আলোচনাই হবে না। আওরঙ্গজেবের প্রস্তাবে কান না দিয়ে কুতুব শাহের দিল্লির দূত মুল্লা আব্বাস সামাদ, দারার মাধ্যমে সম্রাটকে আবেদন জানান এবং দারা সম্রাটের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হলেন। মোটামুটি ঠিক হল পুরোনো রাজ্যের অধিকারের সঙ্গে কর্ণাটকেরও অধিকার থাকবে সুলতানের। সুলতান তাঁকে বা তাঁর উকিলকে এড়িয়ে সরাসরি সম্রাটের কাছে দরবারে চরম প্রকূপিত হয়ে আওরঙ্গজেব সুলতানকে উদ্ধত বললেন এবং জানালেন এটা ঠিক হয়েছিল মীর জুমলা দিল্লি না পৌছলে এটির সমাধান সম্ভব নয়।

মীর জুমলাও সুলতানকে তাঁর গ্রাস কেড়ে নিতে দেবেন না ঠিক করলেন। আওরঙ্গজেব সুলতানের বিরুদ্ধে সম্রাটের কাছে যে আবেদন করবেন ঠিক করেছেন, পরিকল্পনা করলেন সেটি মীর জুমলাকে দিয়েই করাবেন। চিঠির পর চিঠি দিয়ে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে নির্দেশ দিচ্ছেন কিভাবে বাবা বাছা করে সম্রাটকে নিজের মতে নিয়ে আসতে পারেন। দিল্লিতে পৌছনোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আওরঙ্গজেব নির্দেশ দিলেন যে তিনি যেন সম্রাটের থেকে অবিলম্বে কর্ণাটকের দখলের ফরমান নিয়ে নেন, এবং দারা-মুখী সুলতানের রাজসভার রাজনীতি পরাস্ত করেন। হায়দ্রাবাদ অভিযানের আওরঙ্গজেব সম্রাটকে কর্ণাটকের মত এলাকা কেন দখলে রাখতে হবে সেইটি বুঝিয়েছিলেন। সেটা তাঁকে প্রভাবিত করে নি। কিন্তু এবারে উদয় হয়েছেন মীর জুমলা। আওরঙ্গজেবের সূত্রে জানা যাচ্ছে, মীর জুমলা নিজের বাচনভঙ্গীতে, উপহারে সম্রাটকে কিছুটা হলেও বশ করে ফেললেন। মীর জুমলার হাতে কর্ণাটকের মণিমাণিক্য দেখে লোভাতুর হয়ে সম্রাট সুলতানকে কর্ণাটক দেওয়ার মানসিকতা বদলে ফেললেন, ঠিক হল এটি মীর জুমলাই দখলে রাখবেন(জুলাই, ১৬৫৬) সম্রাটের কাছ থেকে সরাসরি নিয়ে, সাত বছর রাজস্বহীনভাবে তাঁর ব্যক্তিগত জায়গিররূপে। ততদিনে কুতুব শাহের আবেদন নাকচ হয়ে গিয়েছে যদিও তিনি কর্ণাটকের বদলে বছরে ১৫ লক্ষ টাকা পেশকাশ দিতে চেয়েছিলেন। এখন আওরঙ্গজেব, সুলতানের কর্ণাটক দখলের কাতর আবেদন সম্রাটের কাছে পৌঁছতে আস্বীকার করলেন, ব্যঙ্গভরে বললেন দরকার হলে সরাসরি পাঠান। কুতুব শাহ কি করে কর্ণাটকের দখল হারালেন এবং সেটি কি করে মীর জুমলার হাতে, সেটি বিশদে বর্ণনা করে আওরঙ্গজেব আকাশ থেকে পড়া সুলতানকে লিখলেন, ‘হায়দ্রাবাদে সুলতানের সেনা প্রবেশের সময় আমি তোমায় বলেছিলাম, তোমার যে কোন চাহিদা পূরণে সম্রাটকে খুশি করতে তুমি তোমার পছন্দের যত মহামূল্যবান রত্ন রয়েছে সে সব তাঁকে দাও। কিন্তু তুমি আমার কথা শোনো নি। অন্যদিকে মীর জুমলা সম্রাটকে তাঁর পছন্দের হিরে, জহরত এবং মহামূল্যবান গয়না আর অন্যান্য মূল্যবান জিনিস উপহার দিয়ে তাঁর কাজ করিয়ে নিল... আমি তোমায় সব বলেছিলাম। আমার পরামর্শ মত চললে অবস্থা এরকম সঙ্গীন হত না। যারা কথা না শুনে কাজ করে, তাদের কোন কিছু বলাই অপরাধ।’ মীর জুমলা নিজের বাহুবলে যেটি দখল করেছিলেন, সেটি এবারে মুঘল সম্রাট আইন সিদ্ধ করেদিলেন।

২। দাক্ষিণাত্যের ক্ষমতাবানেদের প্রতিক্রিয়া
কর্ণাটক থেকে মীর জুমলার প্রস্থান এবং সেনার পরিমান কমানোয় চরম ঈর্ষায় ভোগা সারা দাক্ষিণাত্যের ক্ষমতাবানদের মধ্যে নতুন করে এই এলাকাটি দখলের চক্রান্ত পেকে উঠতে বসল। যতদূর সম্ভব যৌথভাবে দুই সম্রাট তাদের সেনাবাহিনীকে এই কাজে শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে দিতে থাকেন। আবদুল জব্বার খানের নেতৃত্বে কুতুব শাহ একটি বাহিনী উত্তর কর্ণাটকের অভিযানে পাঠিয়েছিলেন যাতে তিনি তাঁর পুরোনো এলাকা দখলে আনতে পারেন, আদিল শাহ জিঞ্জির কেল্লাদারকে উত্তেজিত করলেন ১৬৫৬র জুনের মধ্যেই মীর জুমলার দখলে থাকা কর্ণাটকের দক্ষিণতম এলাকাটি দখল করতে। চন্দ্রগিরির রাজা তাঁর হারানো জমি উদ্ধারে সৈন্যসাজ করতে শুরু করলেন। যারা মীর জুমলার কাছে নানাভাবে পরাজিত হয়েছিল, স্বার্থবদ্ধ ঈর্ষায় জর্জরিত হয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিলেন।

সব থেকে উদ্যমী হয়ে উঠলেন কুতুব শাহ। বুঝলেন, আলোচনা আর কূটনীতির দিন শেষ, এবার সময় হয়েছে মাঠে নেমে লড়াই করার তাঁর সঙ্গে তো কূটনীতির জাল তো রইলই। দারার প্ররোচনায়, কুতুব শাহ আওরঙ্গজেবের একের পর এক হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে কর্ণাটক আর কাম্বামের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি দিলেন, মনে মনে ইচ্ছে বাধা আর ধোঁকা দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য সাধন। সীমান্ত থেকে তাঁর সেনাবাহিনী না সরিয়ে তিনি সেনাপতি আব্দুল জাব্বারকে নির্দেশ দিলেন মীর জুমলার তৈরি করা ডাকচৌকিগুলোতে বাধা দিতে এবং তাঁর ব্যবসায়িক দালালদের সঙ্গে ঝগড়া বাধানোর, যাতে কর্ণাটকের আভ্যন্তরীণ প্রশাসনে গোলযোগ তৈরি হয়। কর্ণাটকে সাম্রাজ্যের আধিকারিক পৌঁছনোর আগেই কুতুব শাহ বেশ কিছু মহালে রাজস্ব তোলার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন।

কুতুব শাহের এই সব ছোটখাট গণ্ডগোলের থেকে আরও বড় সমস্যা দাঁড়াচ্ছিল পুলিকট। স্যান থোম, আর পুনামাল্লির হিন্দু নায়েক, জমিদার, ভিজাদারদের, বা রয়ালের অধীনে থাকা কর্ণাটকে সিপাহীরা যারা যারা মুসলমান শাসনে ছিল, তাদের মাথা খাওয়ার উদ্যম। গাণ্ডিকোটার কিলাদার হাজি সুলেইমান লিখছেন, তারা সক্কলে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিল, রাস্তা বন্ধ করে দিল এবং হরকরাদের কাজ না করতে হুঁশিয়ারি দিল। এবং শ্রীরঙ্গ যে উচ্চমানের রাষ্ট্র পরিচালনা করে এসেছেন ১৬৫৬ পর্যন্ত, তাঁর উদ্যমে হারানো জমি এবং সম্মান উদ্ধারের চেষ্টা দেখা গেল এই সময়ে। একে শুধু স্থানীয় সামন্তদের হুজ্জুতি-হ্যাঙ্গাম বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। যদিও মীর জুমলা তাঁর শাসন ক্ষমতার প্রমান দিয়ে তার জয় করা অঞ্চলে প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তিনি স্থানীয় হিন্দু রাজা, জমিদার সামন্তদের স্বাধীনতার ইচ্ছের মাথা একেবারে মুড়িয়ে দিতে পারেন নি বরং তাদের মন্দির ধ্বংস করে মূর্তি দখল নিয়ে মন্দির আর ব্যক্তিগত মানুষের জমানো সোনাদানা দখল করে তাদের বিশ্বাসে ঘা দিয়েছেন। যদিও কর্ণাটক কাজে দাক্ষিণাত্যের দুই সুলতান একটা দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, কিন্তু বড় ভূমিকা পালন করেছেন শ্রীরঙ্গ রয়াল নিজে এবং জমিদারেরা। আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে, সুলতানী সেনা বাহিনীর উপস্থিতি তাদের এই বিদ্রোহের পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করেছে। আওরঙ্গজেব, শাহকে হুঁশিয়ারি দিয়ে লিখলেন, ‘তোমার আধিকারিকদের দিয়ে(যাদের নাম এই চিঠির সঙ্গে জুড়ে দিলাম) দেশের জমিদারদের হায়দ্রাবাদে ডাকিয়ে এনে উত্তেজিত করিয়ে তুমি এই অঞ্চলে অব্যবস্থার বীজ বপন করেছ...তুমি ভাগ্যহীন রয়ালের বিশ্বাসও অর্জন করেছ এবং তাঁর হাজিবের সঙ্গে একজন আধিকারিক পাঠিয়েছ, এবং কয়েকটি মহালের(তাঁর বিশদ বিরবরণ দেওয়া হল) খানেদের গোমস্তাদের থেকে অধিকার কেড়ে নিয়েছ। একটি সুশাসিত দেশকে তুমি টালমাটাল করে দিয়েছ।’ চেম্বার্স ন্যারেটিভএ এই মন্তব্যটি পাওয়া যাচ্ছে, ‘গোলকুণ্ডার রাজা কর্ণাটককে রয়ালের হাতে তুলে দিলেন।’

শুরুর দিকে হিন্দুরা সহজেই সাফল্য লাভ করে। রয়াল তিরুপতি দখল করলেন, কাঞ্জিভরম, চিংলেপুট এবং পুলিকট দখল করার পরিকল্পনা করলেন। ১৬৫৬র অক্টোবরে মাদ্রাজের আশেপাশের পুনামাল্লির প্রাসাদ ছাড়া, শ্রীরঙ্গর শ্বশুর ভেঙ্গম রাজার সহায়তায় বহ এলাকা দখল করে নিলেন, এবং ভেঙ্গম রাজা পেড্ডাপোলিয়াম দখল করলেন। মীর সঈদ আলি, মীর জুমলার পুনামাল্লির সুবাদার, পুলিকটে পালিয়ে গেলেন, সেখানেই মীর জুমলার প্রায় সমস্ত সম্পদ রাখা ছিল। এটা নবাবের সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করল। তাল্লিয়ারদের একসঙ্গে করে ভেঙ্গম রাজা পুলিকটের দিকে অভিযান করলেন এবং শ্রীরঙ্গর সেনাপতি কোনারি চেট্টিকে নির্দেশ দিলেন পুনামাল্লি ঘিরে থাকা এলাকার মানুষদের জমায়েত করে গোটা দেশতা দখল করতে। কোনারি, নবাবের স্যান থোম, মায়লাপুর এবং পুনামাল্লির সুবাদার, বালা রাউকে গ্রেফতার করলেন স্যান থোমের কাছে তাল্লিয়ারদের বিশ্বাসঘাতকতায়। তারা মীর জুমলার ২০টি এবং ১৬টি অন্যান্য মুসলমান ব্যবসায়ীর হাতি, দখল করে মাদ্রাজে নিয়ে এল।

এই দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নবাবের সেনাপতি টুপাকি কৃষ্ণাপ্পা নায়েক, লিঙ্গম নায়েকের নেতৃত্বে ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক বাহিনী পাঠিয়ে কোনারি চেট্টিকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিল। পুনামাল্লির পথে কোনারির সঙ্গে দু দিনে কয়েকবার ছোটখাট লড়াই হল। হিন্দুরা পুনামাল্লি প্রাসাদ দখল না করার কারণ হল কোনারি সেটি দখল করার কাজে অসম্ভব দেরি করে যা বিশ্বাসঘাতকতাও বলা যায় এবং সে মীর জুমলার সেনাকেও দেরি করে আক্রমণ করে, সেই সুযোগে তাদের বিপক্ষ একজোট হয়ে তাদের হারিয়ে দেয়। তাঁর সপক্ষে বলা যায় মুসলমানেদের বিরুদ্ধে হারার পরে পুলিকট ঘিরে বসে থাকা ভেঙ্গম রাজা তাঁর সঙ্গে জুটি বাঁধে কিন্তু তারা লিঙ্গম নায়েককে হারাতে পারে নি। রয়ালের হিন্দু সেনাপতিরা মাদ্রাজের কাছে পেড্ডানাকিপেট্টায় সেনা সহ পালিয়ে গিয়ে সেখানের আশ্রয় চায় কিন্তু মুসলমান বাহিনী তাদের কচুকাটা করে।

বিজাপুরের সহায়তায় কুতুব শাহ মীর জুমলার বাহিনীর ওপর বড় হামলার পরিকল্পনা করে। আওরঙ্গজেব তাঁর বিরুদ্ধে আবারও হুশিয়ারি দিয়ে লেখেন, ‘তুমি বীজাপুরের ধ্বংস চাইছ। কর্ণাটক দখলের হুজুগ তোমার মাথা থেকে এখনও যায় নি। তুমি পাগলের মত কাজ করছ। যখন গোলকুণ্ডা রাজ্য দুদিকে শক্তিশালী সেনাবাহিনী দিয়ে ঘেরা, তুমি তখন তোমার শয়তানি পরিকল্পনা হাসিল করতে কর্ণাটক দখল করতে বাহিনী পাঠাচ্ছ। এর আগে তুমি জমিদারদের খেপিয়ে তুলে গোলযোগ তৈরি করেছ, কখনো তুমি ডাকচৌকিগুলোতে হামলা করেছ। এধরণের কাজ কোর না। বিজাপুরকে বিপথগামী কোর না। দূরদৃষ্টি বজায় রাখ, মনের আয়নায় ঘিরে থাকা কুজ্ঝ্বটিকা সরিয়ে অনেক কিছু দেখতে পারে...’।
(চলবে)

Sunday, December 25, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৩৬ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৬। উজিরের দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের সঙ্গে সম্রাটের মধ্যস্থতা
গোলকুণ্ডার লুঠের মাল(জিকাদা, ৩০তম জুলুস) নিয়ে সুলতানের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের যে বিরোধ ঘটে তার ঘটনাপ্রবাহ থেকে পরিষ্কার যে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের হয়ে কাজ করছিলেন। যেভাবে নিজের কাজকর্ম সমর্থন করে আওরঙ্গজেব পাদশাহকে চিঠি লিখছিলেন তাঁর প্রতি অনাস্থার প্রেক্ষিতে এবং মীর জুমলাকে সম্রাটের সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ করছিলেন, তাঁর থেকে পরিষ্কার, সম্রাট আর তাঁর দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের মধ্যে মীর জুমলা মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছেন। সম্রাটের অভিযোগ ছিল গোলকুণ্ডায় কুতুব শাহের থেকে বেশ কিছু দামি রত্ন আওরঙ্গজেব এবং তাঁর পুত্র উপহার স্বরূপ নিয়েছেন তাঁকে না জানিয়ে, এবং সম্রাটের এই ধারণাটি বিরুদ্ধে তিনি মীর জুমলাকে প্রতিবাদ পত্র লেখেন। শায়েস্তা খান এবং মীর নিজে কুতুব শাহের পাঠানো ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার পেশকাশ নিরীক্ষণ করার পরে স্বয়ং মীর মন্তব্য করেন এই অকিঞ্চিৎকর উপহার সম্রাটের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। মীর জুমলার কাছে খবর ছিল যে সুলতান, আওরঙ্গজেবের উপস্থিতিতে সম্রাটকে উপহার দিতে চান না। সে ঝগড়ার খবর মীর জানতেন। আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে জানান যে সম্রাট গোটা পেশকাশগুলি এই তাড়াতাড়ি নিজের কব্জায় করতে চাইলেন, যে আওরঙ্গজেবের পক্ষে সুলতানদের থেকে সেই পেশকাশ নিয়ে সম্রাটের কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। আওরঙ্গজেবের এই বেকায়দা অস্বস্তিতে দুজন সুলতান উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিলেন, এবং শেষ পর্যন্ত কিভাবে তিনি সেই সমগ্র পেশকাশ, এমনকি তাঁকে আর তাঁর পুত্রকে দেওয়া উপহারটুকু দিল্লিতে সুলতানের দরবারে পাঠিয়েছিলেন, সেই সংবাদ মীর জুমলাকে দিয়েছেন(মীর জুমলা দেখেছেন, সেগুলি ছিল কালো দাগওয়ালা একটি হিরে, একটি চার হাজার টাকাও দাম নয় এমন নীলকান্তমণির আংটি)। তিনি মীর জুমলাকে লেখেন আমার যদি কিছু লুকোনোর থাকত, তাহলে সেগুলি আমি কেন তোমায় দেখাতাম... আর আর আমি মাত্র কয়েকটি হিরে জহরত নিয়ে কি করব যখন আমার সারা জীবন-অলঙ্কারটাই উতসর্গ করে দিয়েছি সম্রাটের পায়ে?

এই বিষয়ে মীর জুমলার উৎসাহ তৈরি করতে আওরঙ্গজেব অভিযোগ করে বলেন যে তাঁর নিজের নগদ সহ যে টাকা সম্রাট নিয়ে নিয়েছেন, তাতে তাঁর নিজের ক্ষতি হয়েছে ২০ লক্ষ টাকা। দক্ষিণী সেনাবাহিনী ৬ মাসের বেতন পায় নি। সেই সুযোগে যদি সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেয়, তা তাহলে সম্রাট তাকে সাম্রাজ্য রক্ষার যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটি পালন তো করতে পারবেনই না, এবং মীর জুমলার নিজের রাজ্য কর্ণাটক এবং বিশেষ করে যেখানে আদিল শাহ চেষ্টা করছেন কর্ণাটক দখল নেওয়ার, সেটির সঙ্গে অন্যান্য প্রদেশের শান্তিরক্ষা করা, খুব কঠিন হয়ে যাবে, আর মীর জুমলা নিজে সাম্রাজ্যের বাহিনী এবং দুই সুলতানের মিলিত বাহিনীর আপতিক শক্তি তো জানেনই। আওরঙ্গজেবের মনে হয়েছে গোলকুণ্ডা অভিযান তাঁর এবং তাঁর পুত্রের পক্ষে শুধুমাত্রই অপমান বয়ে এনেছে। তিনি মীর জুমলাকে বললেন এই সমস্ত তথ্য সুযোগ সুবিধে মত সম্রাটের সামনে উপস্থিত করতে। যেহেতু মীর জুমলা নিজে গোলকুণ্ডা বিষয়ে সম্রাট এবং সুবাদার কাবলি খানের খগড়া সম্বন্ধে বিশদে জানেন, ফলে উজির যখন সম্রাটকে তাঁর বক্তব্য পেশ করবেন, তখন সমস্ত দক্ষতা দিয়েই নিশ্চই সেই কাজটি সম্পন্ন করবেন। এর ফলে হয়ত সরাসরি আওরঙ্গজেবের কোন ঐহিক উপকার হবে না, কিন্তু এর মাধ্যমে যদি সম্রাটের মনে যে বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটি দূর হয়ে যায়, সেইটুকুই তাঁর পাওনা হবে।

৭। আওরঙ্গজেব আর মীর জুমলার মধ্যে বিরোধ
দুই সঙ্গীর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনার জেরে বিরোধ তৈরি হতে থাকে। আওরঙ্গজেব জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়েছেন, যে মীর জুমলা সম্রাটকে কুতুব শাহের একটি গোপন আহদানার নকল দেখিয়েছেন, যেখানে তিনি নিজের হাতে লিখে বলেছেন যে তিনি মহম্মদ সুলতানকে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাচ্ছেন।

এর পাশাপাশি মীর জুমলা ক্ষুব্ধ ছিলেন যে আওরঙ্গজেব খাস বা আম দরবার করেন না। অন্যদিকে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে জানিয়েছেন যে তাঁর সম্রাটের ওপর ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, আর যেহেতু মীর জুমলা রাষ্ট্রের বড় বড় বিষয় নিয়ে বড়ই ব্যস্ত, সেহেতু আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত জীবনের এইসব ছোটখাট সমস্যা নিয়ে তাঁর মাথা ঘামাবার সময়ই নেই। প্রকাশ্য সভায় না যাওয়ার উতর হিসেবে তিনি বলেন, সেদিন তাঁর উপবাছিল এবং দেওয়ানি আম বা খাস তখনও তৈরি হয় নি।

একই সঙ্গে আওরঙ্গজেব জানতে পারলেন যে মীর জুমলা ওমাদাতুল মুলক খান জাহান(শায়েস্তা খান)এর সঙ্গে মিলে কোন তুচ্ছ বিষয়ে সম্রাটের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেটা যদি সম্রাটের কোন নিকটাত্মীয় সম্বন্ধে তাঁর কান ভাঙ্গানোর চেষ্টা হওয়া খুব অসম্ভব। বা আওরঙ্গজেবের পাশের সুবা মালওয়া থেকে শায়েস্তা খানের বদলি হয় তাহলে তা তাঁর পক্ষে যাবে না। কিন্তু যখন মীর জুমলা সহৃদয়ভাবে বিষয়গুলি মিটমাটের চেষ্টা করতে গেলেন, সেই চেষ্টা দেখে আওরঙ্গজেব মন্তব্য করলেন, ‘যদিও মীর জুমলা(রুখউসসুলতানত, সাম্রাজ্যের স্তম্ভ)র পক্ষ থেকে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটেছে, সেটি মানবিকভাবে দেখতে হবে। সর্বশক্তিমান তাকে সফল হওয়ার মন্ত্র দান করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের বন্ধুত্ব পালনে সে সদা তৎপর। আমাদের উভয়ের বন্ধুত্ব রক্ষা এবং সেটি বিকাশে এগিয়ে আসতে হবে। খানের উকিলকে আমাদের পক্ষে আনতে হবে, যাতে সে অন্যদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে না পারে।’
এই ঘটনা সাময়িকভাবে দুজনের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল, কিন্তু কর্ণাটক নিয়ে এই ভুলবোঝাবুঝি বাড়ল, কেননা মীর জুমলার মনে হল যে আওরঙ্গজেব তাঁর জাগিরগুলি দেখাশোনা করতে খুব একটা উতসাহী নয়। এই মুহূর্তে আওরঙ্গজেব তাঁর উজিরের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না, এবং মীর জুমলার মনের দ্বিধা দূর করতে তিনি সব ঘটনা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।
(চলবে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৩৫ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৩। মীর জুমলার পৃষ্ঠপোষকতা
সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় মীর জুমলা অনুগ্রহ বিতরণের প্রভূত ক্ষমতা অর্জন করেন। তিনি যেহেতু সম্রাটের কৃপাদৃষ্টির ভাগিদার ছিলেন, এবং শাহজাহানের ওপর তাঁর প্রভাব অসীম ছিল, তাই আওরঙ্গজেব চাইতেন তাঁর পছন্দের আমলাদের হয়ে তিনি যেন সম্রাটের সঙ্গে মধ্যস্থতা করেন। দাক্ষিণাত্যের বক্সী, সাফি খানের ওপরে সম্রাট অপ্রসন্ন ছিলেন, তাকে সভায় ডাকিয়ে এনে শাস্তিও দিয়েছিলেন। তাঁর শাস্তির বিষয়টি নিয়ে তিনি মীর জুমলাকে জানান পাদশাহের অপ্রীতির বিষয়টাই ভিত্তিহীন এবং তাঁর শাস্তি অন্যায় অবিচার হয়েছে। তাঁর মত আমলার দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তাঁর মত যোগ্য প্রার্থীর জন্য দাক্ষিণাত্যে বক্সী বা ওয়াকিয়ানবিস ছাড়া অন্য পদ নেই। এরকম যোগ্য মানুষকে কোন কারণ ছাড়া শাস্তি দেওয়া এবং অপমান করা হয়েছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন এবং একটি চিঠি লিখে বলেন, খান, মীর জুমলাকে উঁচু দৃষ্টিতে দেখেন, ফলে তাঁর হয়ে ওকালতি/মধ্যস্থতা করা যুক্তিযুক্ত হবে এবং একই সঙ্গে জুড়লেন, ‘...তোমার দপ্তর থেকেই এই জটিলতা কাটাতে হবে।’ এছাড়াও দাক্ষিণাত্যের দক্ষ এবং অভিজ্ঞ দেওয়ান মুর্শিদকুলির বিষয়টিও মাথায় রাখতে বললেন। এছাড়াও পরলোকগত পয়নঘাটের দেওয়ান আজম খানের পুত্র আহমদ নগরের সার্বিক দায়িত্বে থাকা মুলতাফত খানের(১৬৫৬) বিষয়টিও হিসেবে রাখতে বললেন।

একই সঙ্গে উজিরকে মুনসি কাবলি খান, উপযুক্ত এক আধিকারিক এবং অসাধারণ সেনানী আদম খান খেসগির কথাটাও হিসেবের মধ্যে রাখতে অনুরোধ করলেন। মুরাদকে বহুকাল সেবা করে খেসগি বিজাপুর সরকারে যোগ দিয়েছে এবং সে তার কাজ দায়িত্ব সহকারে সম্পাদন করে। আওরঙ্গজেব তাকে ডেকে পাঠান কিন্তু তাকে সাধারণ ৫০০ জাট এবং ১০০ সওয়ারের মনসব পদ দেন। তিনি এতে সুন্তুষ্ট নন, তাঁর লক্ষ্য সম্রাটের সভা।

৪। আওরঙ্গজেবের অসাধারণ সঙ্গী মীর জুমলা
সম্রাটের দরবারে মীর জুমলার উল্কাস্বরূপ উত্থান আওরঙ্গজেবের নিজের অভিপ্সা এবং উচ্চাশা পূরণের সূচকের সিঁড়ি তৈরি হল বলা যেতে পারে। মীর জুমলার দায়িত্ব এবং তাঁর ভাগ্যের উড়ানে যে প্রতিশ্রুতি আওরঙ্গজেব তাকে দিয়েছিলেন, তা সত্য হওয়ায় তার প্রতি আওরঙ্গজেবের ভালবাসা আরও বাড়ল। আওরঙ্গজেবের শিবির থেকে মীর জুমলা চলে যাওয়ার পর চিঠির পর চিঠিতে দাক্ষিনাত্যের সুবাদার তাঁর প্রতি গভীর ভালবাসা, বন্ধুত্ব আর বন্ধু বিচ্ছেদে তীব্র বেদনার প্রেমানুভূতি - একজন প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে ছেড়ে গেলে যে ভাব উদয় হয় তা বারবার আকুতি সহকারে জানিয়েছেন। ‘তোমার সঙ্গে থাকার আকুল ইচ্ছে থাকলেও নিষ্ঠুর সময় আমাদের মধ্যে একটা বিচ্ছেদের কঠোর দেওয়াল তুলে দিয়েছে। (কবিতা) সে এল আর গেল। আমার হৃদয়কে সমবেদনা জানাতে কিন্তু সে বেশিক্ষণ বসল না। সর্বশক্তিমান (আমাদের)মিলন ঘটাবার পথ উন্মুক্ত করে দিন...’। আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে বললেন তিনি তাঁর চিরকাল বাধ্য হয়েই থাকবেন। ২৭ জিকাদা/৬ সেপ্টেম্বর ১৬৫৬(?) সালে মীর জুমলার চিঠির উত্তরে তিনি লিখছেন, ‘শুধু সাদায় কালোয়, হৃদয় থেকে উৎসারিত প্রেমানুভূতি আর বন্ধুত্বকে বিচার করা যায় না। যে অকপট উদ্দেশ্য তুমি চিঠিতে প্রকাশ করেছ, এবং আজকাল করে চলেছ, তাতে আমার প্রতি তোমার বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখছি। আমি হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে সেটা অনুভবও করছি। আমি নিশ্চিত জানি, সব পরিকল্পনা ভাবনাচিন্তা রূপায়নে ভাগ্য তোমার সাথে থাকবে। সর্বশক্তিমান তোমায় সেই শক্তি প্রদান করুণ।’ এই উচ্ছ্বসিত ভাবের প্রকাশে একটা বিষয়ই নিশ্চিত করে, উজির মীর জুমলা দাক্ষিণাত্যের দেওয়ানের অমূল্য জোটসঙ্গী ছিলেন।

৫। উজির মীর জুমলার শাহজাদা দারার বিরুদ্ধাচরণ
তাঁর নিজের স্বার্থপূরণে উজিরকে ব্যবহার করা আওরঙ্গজেবের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রাজসভায় দারাকে রুখতে পারলেই একমাত্র তাঁর উচ্চাশা পূরণ হতে পারে। কিন্তু মীর জুমলা সবে দিল্লিতে এসেছেন এবং সঙ্গীসাথী হীন, তাই আওরঙ্গজেব জাহানারাকে অনুরোধ করলেন, মীর জুমলার প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাকে প্রত্যেক বিষয়ে সমর্থন করতে। জাহানারা সম্মতি জানালে তিনি মীর জুমলাকে বললেন অবিলম্বে ঈশা বেগের মাধ্যমে জাহানারাকে ‘অদেখা’ সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জানানো দরকার এবং তাঁর সমর্থন জোগাড়ের জন্য তাকে বলা, এই রাজসভায় জাহানারা ছাড়া মীর জুমলার অন্য কোন গতি নেই, তিনি তাঁর সম্মান জাহানারার পায়ের কাছে লুটিয়ে দিচ্ছেন। অন্যান্য অভিজাতর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে পরামর্শ দিলেন, বললেন, জ্ঞানীর থেকে দূরে থাকা জরুরি কাজ নয়।

দিল্লির রাজসভায় মীর জুমলার কূটনৈতিক দক্ষতার প্রভাব দেখা গেল অবিলম্বেই। আমরা আগেই দেখেছি, কর্ণাটকে থাকাকালীন তিনি, বিজাপুরী সুলতানের প্রতি বিদ্বিষ্ট শাহজী ভোঁসলাকে মুঘলদের পাশে দাঁড়াবার জন্য রাজি করেয়েছিলেন। মীর জুমলা শাহজীকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রত্যায়িত করেন আওরঙ্গজেব। রাজসভায় মুঘল উজির হিসেবে এসে দারার ইচ্ছের বিপক্ষে গিয়ে শাহজীর প্রতি পুরোন প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে তিনি সম্রাটকে সেই বিষয়ে এগোতে পরামর্শ দিলেন। তাঁর প্রস্তাবে আওরঙ্গজেব সম্মতি দিলেন এবং বললেন, শাহজীর প্রতি যে সব মিথ্যে অভিযোগ এসেছে তা যেন খণ্ডানোর চেষ্টা মীর জুমলা করেন।

বিজাপুরের উপঢৌকনের প্রভাবে দারা যেভাবে সম্রাটকে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে মীর জুমলা যেভাবে সম্রাটের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আওরঙ্গজেবের পক্ষ ধরে সওয়াল করেন, তা আওরঙ্গজেবের কাছে চিত্তগ্রাহী বিষ্ময় রূপে উপস্থিত হয়েছিল। নিজের উকিলের কাছে সেই সংবাদ জেনে আওরঙ্গজেব, মীরজুমলার মুন্সি কাবলি খানকে তাঁর প্রভু সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ‘আমি এর থেকে বেশি মীর জুমলার থেকে প্রত্যাশা করি (চশমাদস্ত মা আজ ইশান পেশ আজ ইন অস্ত)। আমি জানি আমার ভালর জন্য সে প্রত্যেক পদক্ষেপ করা থেকে নিজেকে বিচ্যুত করবে না। এবং আমি যা বলছি, তাঁর থেকেও বেশি কাজ সে করবে এটা আমার বিশ্বাস। তিনি মীর জুমলাকে জানালেন যে সাম্প্রতিক অতীতে আদিল শাহ সম্রাটকে এমন কিছু চোখ ধাঁধানো পেশকাশ পাঠাতে পারেন নি, পাঠিয়েছেন মাত্র ৪ লাখ টাকা(প্রতিশ্রুত ৯ লাখ টাকার পরিবর্তে) এবং আবুল হাসান এটি সম্রাটের সামনে উপস্থিত করবে। এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে সম্রাটের সামনে উপস্থিত করতে উজিরকে বললেন, এবং যদি এই প্রশ্নটা যদি আবার ওঠে, তাহলে উত্তরটা এমন দিও যাতে শত্রুরা(এক্ষেত্রে দারা) পস্তায়।
(চলবে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৩৪ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

২। রাজস্ব প্রশাসন এবং আর্থিক বিষয়
দেওয়ানি দপ্তর মীর জুমলা সামলেছিলেন ১৫ মাসের কাছাকাছি সময় ধরে – ১৭ জুলাই তাঁর পদ পাওয়ার দিন থেকে ১৬৫৭র সেপ্টেম্বরের পদচ্যুতির দিন পর্যন্ত। ওই সময়ে তিনি পাঁচ মাস দিল্লিতে কাটান, বাকি দশ মাস তাঁর কাটে বিজাপুরের বিরুদ্ধে অভিযানে। উজির পদে কাটানোর সময় – সে রাজধানিতেই হোক বা যুদ্ধ ক্ষেত্রেই হোক, মীর জুমলা কিন্তু যুদ্ধে বা প্রশাসনে তাঁর বন্ধু, দার্শনিক এবং পথ নির্দেশক, যিনি তাঁর নিরাপত্তার ভার নিয়েছিলেন, আওরঙ্গজেবের হয়ে কাজ করার এবং তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার করার ভূমিকাই পালন করে গিয়েছেন।

মীর জুমলার যে প্রশাসনিক ঝামেলার ব্যবস্থাপনার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেই অসুবিধেগুলি কি ছিল আর এখন বিশদে জানা যায় না। আদাবইআলমগিরিতে কয়েকটা রাজস্ব এবং আর্থিক ঘটনার কথা বলা হয়েছে তা মূলত দাক্ষিণাত্যের। এর থেকে পরিষ্কার যে আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন মীর জুমলা তাঁর পক্ষের সওয়াল স্বয়ং পাদশাহের সামনে করুণ। তিনি মীর জুমলাকে বলেন যে রামগীর(আজকের মানেকদুর্গ এবং চিন্নুর) এলাকার রোজগার হিসেবে, মুঘল হাজিব কাবাদ বেগের সামনে কুতুব শাহ বলেছিলেন মহম্মদ নাসির ১,২০,০০০ হুণ রাজস্ব দেবেন, সেই তথ্যটা বিলকুল সত্য নয়, সেটা অর্ধেক, ৮০,০০০ হুণ হবে; কুতুব শাহের হিসেব সর্বৈব মিথ্যা।

দাক্ষিণাত্যের আর্থিক বিষয়ে আওরঙ্গজেব খুব আর্থিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন। সেই সঙ্কট আরও বেড়ে গিয়েছিল সম্রাটের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে। জাগিরের মূল্য থেকে মাত্র একাংশ উদ্ধার হচ্ছিল সাম্রাজ্যের। বছরের ক্ষতি বেড়েই চলছিল, যা জাগিরদারদের আঘাত করছিল ফলে দাক্ষিণাত্যের সেনা বাহিনীর অবস্থা চরম দুর্দশার মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছিল। আওরঙ্গজেবের একটা প্রস্তাব ছিল যে জাগিরের একাংশ তাকে এবং অন্য প্রদেশের সর্বোচ্চ আধিকারিককে দেওয়া হোক, সেটা সম্রাট মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় প্রস্তাবটা, তাঁর বেতনের নগদটি মালওয়া আর সুরাট থেকে দেওয়া হোক, সেই প্রস্তাবটি কিন্তু তিনি মানেন নি। ব্যাপক যুদ্ধ চলতে থাকায় কৃষি জোর মার খেল, জনসংখ্যা কমল আর স্থানীয় প্রতিশোধের সংঘর্ষ বাড়ল। শাহজাহান আওরঙ্গজেবের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন কৃষকদের এবং কৃষির অবস্থা উন্নতির জন্য সচেষ্ট হতে।

দাক্ষিণাত্যের খুব কুশলী দেওয়ান মুর্শিদকুলি, কেন্দ্রকে লিখে জানালেন যে জুলুসের ২৮ তম বছরে(১৬৫৫) বীর পরগণাটি বাতসরিক রোজগারের দুই-তৃতীয়াংশ আয় দিচ্ছে এবং তিনি আশা করছেন, পরের বছরে এই পরিমানটি বাড়তে পারে। এই পরগণার আওরঙ্গজেবের উকিলের বেতন বছরে ২ কোটি দাম, এটিকে তাদের জাগিরের মধ্যে ধরেন নি, কিন্তু মালুজি এবং অন্যান্য জাগিরের হিসেব বিবেচনা করেছেন এবং আশা করছেন ছাড়(তাখফিফ) দেওয়ার পরে সেই পরিমান ছমাসের মধ্যে উদ্ধার হবে। সম্রাট মীর জুমলাকে প্রশ্ন করলেন মুর্শিদ কুলির রাজস্ব সমীক্ষা সত্যি কি না, এবং শাহ বেগ খান বীর না নিয়ে অন্য পরগণা কেন নিলেন এবং তিনি মুর্শিদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিতে বললেন, কেন শাহ বেগ খান বীর নিল না।
উত্তরে আওরঙ্গজেব সেই বছরের এবং আগের বছরের আয়ের উতপাদনের বিস্তৃত সংখ্যাতত্ত্ব পাঠালেন, যাতে মীর জুমলা এই বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেন। তিনি জানালেন শাহ বেগ বীর নেন নি বীরের দুর্দশা বা কৃষির অব্যবস্থার(খারাবি ও বিরাণি) কারণে নয় বরং অন্য কোন কারণের জন্য। গোলকুণ্ডা দখলের লড়াইতে শাহ বেগ খানকে আহমদ নগর থেকে ডেকে পাঠানো হল। তিনি তাঁর পরিবারের জন্য আলাদা আলাদা ছড়য়ে ছিটিয়ে থাকা জাগির না দিয়ে ঠিকঠাক একটি পরগণা চাইছিলেন যেখান থেকে তিনি রোজগার করতে পারবেন। আওরঙ্গজেব তাকে ঐ পরগণাটি দিলেন বার্ষিক সাড়ে তিন কোটি দামের বিনিময়ে, যেটি খতিয়ানে(লেজারশিট বা আফ্রাদিতাউজি) দেখানো ছিল। গোলকুণ্ডা থেকে ফিরে আওরঙ্গজেব দেখলেন বীর পরগনা জুড়ে দিয়ে তাঁর মনসব বাড়ানোর প্রস্তাব সম্রাট অনুমোদন দেন নি। ফলে এটি তিনি শাহ বেগের থেকে কেড়ে নেওয়া যুক্তিযুক্ত বলে মনে করলেন না। মুর্শিদ কুলি খানের সম্বন্ধে শাহজাহানের মনে ওঠা কোন রকম দ্বিধা দূর করতে তিনি মীর জুমলাকে লিখলেন, ‘মুর্শিদ কুলি একজন শিরদাঁড়া সোজা আর কর্মদক্ষ (রাস্তওদুরস্তি অস্ত) আমলা। তিনি এই মিথ্যে সমীক্ষা লিখতে পারেন না। তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, তার সপক্ষে বলার কোন প্রয়োজন পড়ে না। তিনি সেবাপরায়ণ(কর-আমাদান) আধিকারিক। যদি তাকে না বসিয়ে দিয়ে সাম্রাজ্যের কাজে লাগিয়ে রাখা যায় তাহলে ভাল হয়।’ আওরঙ্গজেব প্রস্তাব দিলেন, তবুও যদি মনে হয় মুর্শিদ কুলির কার্যকলাপে প্রশ্নবোধক চিহ্ন মুছে ফেলা যাচ্ছে না, তাহলে একজন আধিকারিক পাঠিয়ে তাঁর কাজগুলি তদন্ত করে দেখা হোক। তিনি প্রস্তাব দিলেন, ‘পাদশাহকে এটা জানিও... জানিও আমি যেমন করে বিষয়গুলি উপস্থাপন করে ঠিক সেই ভাবে কাজটা কোরো।’

এটা আমরা জেনে গিয়েছি যে উজির মীর জুমলা, খুরদর্দ(তৃতীয় পারসিক মাস) মাস পর্যন্ত ইরাজ খান আর তাঁর ভাইয়ের বেতন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন এবং আওরঙ্গজেব জানিয়ে দিয়েছিলেন এই ব্যবস্থা আগামী দিনেও কার্যকর হবে।
আগামী দিনের ভর্তুকির অর্থনীতিটি সামলাতে সম্রাটের নির্দেশে ‘মীর জুমলা জুমলাতউলমুলক’ দাক্ষিণাত্যের করণিকদের(মুতসুদ্দি) লিখলেন, যাদের মনসব বাড়ানোর দরকার হয়ে পড়েছে, আর যারা নতুন মনসব পাবে, তাদের জাগিরের বেতন অর্ধেক হয়ে যাবে এবং সাম্রাজ্যের সনদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বেতন পৌঁছবে, তাঁর আগে নয়। এই নির্দেশের পরে দাক্ষিণাত্যের দেওয়ানেরা এটি বাস্তবায়িত করার জন্য উদ্যোগী হলেন। কিন্তু এই বেতন পাওয়ার সময় দীর্ঘায়িত করার নির্দেশে দাক্ষিণাত্যের মনসবদারেরা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন এবং যতদূর সম্ভব পাদশাহকে আবেদন করলেন এবং বললেন যে, তারা এতই গরীব তাঁদের পক্ষে একজন করে উকিল পাঠিয়ে তাদের বিষয়টা সম্রাটের সভায় তোলার সামর্থ নেই। অবস্থা বিগড়োচ্ছে দেখে আওরঙ্গজেব তাদের অভিযোগ সংবাদচিঠিতে জুড়ে সম্রাটের বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। এটির প্রতিক্রিয়ায় সম্রাট নির্দেশটি বদলে বললেন যে সনদ যাওয়া পর্যন্ত বেতন বাকি থাকবে না। সিদ্ধান্ত হল যে দাক্ষিণাত্যের রাজস্ব আধিকারিককে বক্সী মার্ফত এই অনুমোদিত নির্দেশটি পাঠানো হবে, তখনই অর্ধেক বেতনটি পাওয়া যাবে এবং সনদ স্থানীয়ভাবেই প্রচার করা হবে।

দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের সময়ে যে সব মনসবদার প্রথমবার পদনিয়োগ পেয়েছেন, বা যাদের মনসব বেড়েছে, এবং যাদের নাম বক্সী সাফি খান দিল্লিতে আওরঙ্গজেবের উকিলকে পাঠিয়েছেন, তাদের বিষয়ে আওরঙ্গজেব, দিল্লিতে সম্রাট শাহজাহানের বক্সী ইতিকাদ খানকে সাম্রাজ্যের মহাফেজখানার থেকে তাদেরর সক্কলের নাম এবং তথ্য যাচাই করতে অনুরোধ করলেন এবং তাদের দপ্তরে সরাসরি সাম্রাজ্যের অনুমোদন না পাঠিয়ে, তাদের নামের সঙ্গে সাম্রাজ্যের পাঞ্জা বসিয়ে দেওয়া হোক বললেন। তিনি আরও প্রস্তাব করলেন যে, আগামী দিনে এইভাবে প্রত্যেক মাসে আলাদা আলাদা করে হিসেব পাঠিয়ে দেওয়া হোক যাতে সম্রাটের অনুমোদন নিয়ে সেটি অবিলম্বে আওরঙ্গজেবের উকিলের হাতে পৌঁছে যায়। ফলে তিনি চাইলেন ইস্তিয়াক খান এই বিষয়ে হাত ধুয়ে পড়ে থাকুক, কেননা এই বিষয়টি সাম্রাজ্যের স্বার্থে এবং সংহতির জন্য জরুরি এবং এটি মানুষের ক্ষোভ দূর করবে।
(চলবে)

Saturday, December 24, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৩৩ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৬০০০ ঘোড়সওয়ার, ১৫০০০ পদাতিক, ১৫০টা হাতি এবং বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর সম্পদ, নগদ অর্থ, সোনায় মোড়া অস্ত্রশস্ত্র, হিরে নীলকান্ত মণি, জহরত, পণ্য, আসবাব ইত্যাদি নিয়ে মীর জুমলা, আওরঙ্গজেবের শিবিরের দিকে চললেন। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন মালিনজী, নাসিরি খান, এবং তাকে আনতে পাঠানো মীর সামসুদ্দিন। হায়দ্রাবাদে শাহজাদা সকাশে তিনি আবির্ভূত হলেন অভিজাত নন, শাহজাদারূপে। ২০ মার্চের জ্যোতির্বিদের গণনা করা শুভ মুহূর্তে তিনি শাহজাদার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁর শিবিরে, যার ‘পরিচর্যা আর অবধানে’ তিনি দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি, তাকে ৩০০০ ইব্রাহিম পেশকাশ দিলেন, এবং প্রত্যুত্তরে কিছু উপহারও পেলেন। আওরঙ্গজেব তাঁকে খিলাকতখানায় নিয়ে গেলেন, এবং যেন সেখানে মীর জুমলা নতুন জীবন লাভ করলেন। গোলকুণ্ডার সঙ্গে শান্তি চুক্তির পক্ষকাল পরে, ১৪ এপ্রিল আওরঙ্গজেব মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। মীর জুমলা তাঁকে আর তাঁর পুত্রকে কয়েক লক্ষ টাকার উপঢৌকন দিলেন।
(তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত)

চতুর্থ অধ্যায়
মুঘল উজির রূপে মীর জুমলা
প্রথম ভাগ

আওরঙ্গজেবের দূত হিসেবে উজিরিকর্ম
১৬ এপ্রিল হায়দ্রাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়ে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ইন্দৌর গেলেন ২ মে। প্রায় একসঙ্গে একপক্ষকাল কাটিয়ে তাঁরা দুজনে আগামী ভবিষ্যতের কাজকর্ম নিয়ে বিশদে আলোচনা করলেন, বিশেষ করে রাজধানীর সিংহাসনের দিকে নজর রেখে আগামী দিনের রণসজ্জা কিভাবে সামলানো যায় সে ভাবনা ভাবতে শুরু করলেন। তাঁকে গোপনে শুভেচ্ছা এবং তাঁর বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি দিলেন মীর জুমলা। ইন্দৌর থেকে আওরঙ্গজেব তাকে আর তাঁর পুত্রকে নিয়ে কাজি আরিফের সমবিব্যহারে রাজধানী যাবার নির্দেশ দিলেন, সেটা ৩ মে। ন্যায়দণ্ডধারী মহম্মদ বেগ ১০ এপ্রিলের ফর্মান অনুযায়ী মীর জুমলাকে মুয়াজ্জম খান(মহিমান্বিত বন্ধু) উপাধি এবং রণবাদ্য সহ অনেক কিছু উপহার দিলেন।

দিল্লিতে ডেকে পাঠানোর চিঠির প্রতিক্রিয়ায় তিনি ইন্দোর ছাড়লেন ৭ মে। রাস্তাতেও তিনি আওরঙ্গজেবের সঙ্গে নিয়মিত চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন। সম্মান পাওয়ায় সংবাদে আওরঙ্গজেব তাকে অভিনন্দন জানালেন, এবং সম্রাটের ডাকের প্রতিক্রিয়ায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিল্লি পৌঁছনর বার্তা দিলেন, আর বললেন, পথে নান্দেরে তাঁর সঙ্গে খ্বজা আহমেদ আরিফ যোগ দেবেন। তিনি আরও জানতে চাইছিলেন মীর জুমলা মহম্মদ আমীনকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন, না কি তাকে ইন্দোরে রেখে গিয়েছেন। এছাড়াও কর্ণাটকের জমিদারদের মন জয় করতে পেরেছেন কিনা তাও প্রশ্ন করলেন। উত্তরে জানালেন, মীর মহম্মদ আমীন বুরহানপুর পর্যন্ত এসে প্রচণ্ড বর্ষায় আর এগোতে পারেন নি। ২৭ জুন আওরঙ্গজেব খবর পেলেন যে মীর জুমলা পাদশাহের থেকে ব্যক্তিগত চিঠি পেয়েছেন। এই খবরে আওরঙ্গজেব ভীষণ খুশি হয়ে মীর জুমলাকে লিখলেন, ‘...আমার মন ভাগ্যের ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি দেখতে চাই তোমার সব পরিকল্পনা সফল হচ্ছে। আমি কিন্তু তোমার বর্তমানের ছোটখাট সম্মান পাওয়ায় খুব একটা প্রীত হচ্ছি না। আমি জানি তুমি আরও ওপরের দিকে তাকয়ে রয়েছ, সেটা তোমার অধরা থাকবে না। তা খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবে রূপ পাবেই, যদিও তাতে শত্রুদের চরম ঈর্ষা আর হাহাকার বন্ধ হবে না। (কবিতা) অপেক্ষা কর কখন তোমার ভবিষ্যতের ভোর হবে, এটাই শেষ প্রহর।’

আওরঙ্গজেব সাদুল্লা খানের মৃত্যুতে একজন সহযোদ্ধা হারিয়েছিলেন, তাই তিনি সাম্রাজ্যের বাহিনীতে মীর জুমলার মত দক্ষ মানুষ চাইছিলেন অধীর আগ্রহে। তিনি মীর জুমলাকে সরিয়ে রেখে(বাফার এজেন্ট) দারার বিরুদ্ধে ঘুটি সাজাবার পরিকল্পনা করছিলেন। আওরঙ্গজেব শাহ্নওয়াজ খানকে লিখলেন, ‘সাদুল্লা খানের মৃত্যুতে আমি এক শুভচিন্তককে হারিয়েছি। এখন মুয়াজ্জম খান আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বিশ্বাসী আমার ইচ্ছেয় এগোতে শুরু করেছে, আবার ধারণা এ বিষয়ে সর্বশক্তিমান আমাদের সঙ্গে আছেন’। উল্টো দিকে দারা, মীর জুমলাকে সামরিক বাহিনীতে নেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন। দারার শিবিরের সমস্ত বিরোধিতা সরিয়ে রেখে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের যে গোলযোগ চলছে, তা মেটাতে পাদশাহ, মীর জুমলার ওপরেই আস্থা পেশ করার সিদ্ধন্ত নিলেন; তাঁর স্থির নিশ্চয় ছিল যে পারসিকদের থেকে কান্দাহার উদ্ধার করার ক্ষমতা একমাত্র মীর জুমলারই রয়েছে।

রাজধানীর দিকে সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে গৌরবময় মীর জুমলার যাত্রা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দিল্লিতে থাকা মানুচি লিখছেন, ‘যে অঞ্চল হয়ে তিনি যাচ্ছেন, সেখানের প্রশাসক তাকে সম্মান জানাচ্ছেন উপঢৌকন পাঠিয়ে... দিল্লির কাছাকাছি আসতে সম্রাট সব সব থেকে বড় সেনানায়ক পাঠিয়ে সসম্মানে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করেন। রাজা গেলে রাস্তা এবং তাঁর পাশের দোকানগুলি যেমন সজ্জিত করা হয়, সম্রাটের নির্দেশ ছিল, মীর জুমলার যাত্রাপথেও ঠিক তেমনি সজ্জা করার।’ ২৫ রমজান ১০৬৭, ৭ জুলাই ১৬৫৬, মীর জুমলার দিল্লির কাছাকাছি আসার সংবাদ পেয়ে সম্রাট মীর আতিশ কাশিম খান এবং দানিশমন্দ খান বক্সীকে শহরের বাইরে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনার নির্দেশ দিলেন। শুভ দিনে তিনি সম্রাটের সঙ্গে দেখা করলেন এবং সভায় সভাসদেদের মধ্যে তাঁকে সব থেকে উঁচু আসনে বসার সম্মান দিলেন পাদশাহ।

সম্রাটকে তিনি ১০০০ মোহর এবং কিছু দামি গয়নাগাঁটি নজর হিসেবে দিলেন যার মধ্যে ছিল কর্ণাটকের হিরের খনির কিছু বাছাই করা হিরে। সেদিন সম্রাট তাঁকে আরও একটি বিশেষ খিলাত দিলেন এবং তাঁর পদ মর্যাদা হাজারি হাজার সওয়ারে বৃদ্ধি করলেন, এবার থেকে তিনি ৬০০০ জাত এবং ৬০০০ সওয়ারের পদে বৃত হলেন। ৭ এপ্রিল ১৬৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লা খানের দেহান্ত হয়। সম্রাট তাঁর মৃত প্রধানমন্ত্রীর পদ, সমগ্র সাম্রাজ্যের দিওয়ানিকুল বা দিওয়ানিআলম অর্থাৎ দিওয়ানের প্রধানমন্ত্রীর পদে বরণ করলেন মীর জুমলাকে। এছাড়াও তাঁকে একটি বহুমূল্যের রত্নে সুসজ্জিত কলমদানি, বিশেষ হাতিশাল থেকে ১০টা হাতি, ঘোড়াশাল থেকে ২০০ ঘোড়া, একটি মাদি হাতি, ৫ লাখ টাকা উপহার হিসেবে দিলেন। মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে তাঁর পাওয়া সম্মান এবং উপহার সম্বন্ধে জানালে, উচ্ছ্বসিত শাহজাদা লিখলেন, ‘আশাকরি সর্বশক্তিমান তোমায় পাদশাহকে খুসি করার মন্ত্র উপহার দিক, যার ফলে তুমি আদতে সর্বশক্তিমানকেই আরাধনা করছ।’ শাহজাহান কুতুব সাহকে লিখলেন, ‘দৈনিক উপহারে উপহারে সম্মানে সম্মানে মীর জুমলার আভিজাত্য যেন বেড়েই চলেছে।’ এছাড়া উপহার স্বরূপ পাদশাহ মীর জুমলাকে রাজস্বমুক্ত কর্ণাটক শাসনের অনুমতি দিলেন।

১৬৫৫-৫৬ বছরটি মীর জুমলার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গোলকুণ্ডার অশক্ত সুলতানের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়াই শুধু নয়, মীর জুমলা কর্ণাটক নিজের তাঁবে রাখলেন তাই নয়, সম্রাটের আন্তরিক ইচ্ছেয় তাঁর নিজের জাগির হল সেই এলাকাটি। এছাড়াও তাঁর শত্রু হয়ে ওঠা পুরোনো প্রভুর হাত থেকে সাম্রাজ্যের পক্ষ্মপুটে শেষমেশ নিরাপদ আশ্রয়ও পেলেন। তাঁর দীর্ঘ সফল রাজনৈতিক জীবনের শিক্ষা নবিশীর দিন শেষ হল এই বছরেই। ভাগ্য তাকে আগামী দিনে ঝড়ঝঞ্ঝ্বাময় ভবিষ্যৎ সামলানোর রণপরীক্ষার দিকে ঠেলে দিল এত দিনে।
(চলবে)

নোটবন্দী এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (আদতে গণহত্যা) বাঙালির শিরদাঁড়া বাঁকানোর প্রথম সফল কর্পোরেট প্রকল্প, '৭৬ - ওয়াটাগের ভাষ্য

হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও ১১৭৬ সালে বাংলা খেতে পারে নি কেননা কর্পোরেট ব্রিটিশ সম্পদ আর শিক্ষায় লুঠ চালচ্ছিল - সেটা বলতে হব... না হলে বাঙলায় কর্পোরেট উদ্দেশ্যপূর্ণ লুঠের ইতিহাস, বাঙালির শিরদাঁড়া বেঁকানোর ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে... তাই একটু সংযোজন...

সেদিনেরটা আর আজকের মুদ্রা বাতিলের হয়ত একটা তুলনা টানা যাচ্ছে - কিন্তু ইতিহাসটা আরও ব্যপ্ত - ১৭৭০এর বাংলা আর বাঙালির ওপরে যে প্রথম বড় ঝাপটা এসেছিল তা কিন্তু শুধু মুদ্রা তুলে নেওয়ায় হয় নি - সেটা একটা অংশ ছিল - একমাত্র ছিল না - তার সঙ্গে কর্পোরেট লুঠ চলছিল - সেটা আজও চলছে মুদ্রা বাতিলের পাশাপাশি - সেটা দেখানো দরকার।

কারণ সে সময় গ্রাম বাংলায় সর্বব্যপী মুদ্রার ব্যবহার ছিল না। সেই প্রথম গ্রাম বাঙ্গালির শিরদাঁড়া ভাঙ্গার কর্পোরেট চক্রান্ত - তাঁর পরে বার বার সেই চক্রান্ত হবে, হচ্ছে। সঙ্গে কর্পোরেট লুঠটা দেখাতে হবে। না হলে শুধু মুদ্রা বাতিলের চক্রান্ত তত্ত্ব দাঁড়াবে না।

যে কর্পোরেট লুঠটা শুরু করেছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭য় মীর জাফরের সময় সেই লুঠটা কিন্তু আজও শেষ হয় নি - সেই কোম্পানিকে মডেল বানিয়ে লুঠটা চলছে বরাবরই - এটা বলতে হবে - নইলে দাঁড়াবে না। মুশকিল হল আজ খুব বেশি মিডিয়া(সোসাল হলেও) কর্পোরেটের গায়ে হাত দিতে উতসুক নয় - তাই কর্পোরেটদের দায় এড়িয়ে যাওয়ার কাজ করছেন তারা।

আমাদের কর্পোরেট বাঁচানোর দায় নেই - দায় গ্রামীন উতপাদকেদের প্রতি...

তাই অসাধারন লেখক, উপন্যাস লিখে জেল খাটা চন্ডীচরণ সেনের মহারাজা নন্দকুমার - শতবত্সর পূর্বের বঙ্গের সামাজিক অবস্থা থেকে কিছু লেখা তুলে দেওয়া গেল---
১৭৬৮ সনের বঙ্গদেশে অত্যল্প শস্য উত্পন্ন হইয়াছিল। প্রজাগণ যে করদিতে পারে এরূপ সাধ্য ছিল না। কিন্তু এ বত্সর প্রজাগণের নিকট হইতে কড়াক্রান্তি হিসাব করিয়া কর আদায় করা হইল। কৃষকগণ আপন আপন গৃহের বীজ ধান্য পর্যন্ত বিক্রয় করিয়া কর দিতে হইল। প্রজার গৃহে আর অধিক বীজ ধান্য রহিল না। এদিকে ইংরাজ বণিকগণ অনেক ধান্য ক্রয় করিয়া অধিকতর মূল্যে বিক্রয়ার্থ মান্দ্রাজ প্রভৃতি প্রদেশে প্রেরণ করিতে লাগিলেন।
ইহার পর ১৭৬৯ সালে আবার অনাবৃষ্টি হইল। একদিকে কৃষকের গৃহে বীজ ধান্যের অভাব বহিয়াছে, তাহার উপর আবার অনাবৃষ্টি। সুতরাং ১৭৬৮ সাল অপেক্ষাও এ বত্সর অত্যল্প শস্য হইল। প্রায় সমুদায় ধান্য ক্ষেত্রই এক প্রকার শূন্য হইয়া পড়িয়া রহিল। কলিকাতার গবর্ণর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় পূর্বেই সৈন্যদিগের নিমিত্ত যথেষ্ট চাউল ক্রয় করিয়া রাখিলেন। সৈল্য দিগের প্রাণরক্ষ্যা হইলেই তাহাদের ন্যায় সঙ্গত বাণিজ্য চলিবে। দেশের লোকের নিমিত্ত কে চিন্তা করে।
যে অল্প পরিমান শস্য হইয়াছিল, তাহা বিক্রয় করিয়া প্রজাগণ স্বীয় স্বীয় দেয় কর আদায় করিল। কার্টিয়ার সাহেব এই সময় কলিকাতা গবর্ণর ছিলেন। তিনি কোর্ট অব ডিরেক্টরের নিকট লিখিলেন – কোন ভাবনা নাই। অনাবৃষ্টি নিবন্ধন দেশে অধিক শস্য না হইলেও কর আদায় সম্বন্ধে কোন বিঘ্ন উপস্থিত হইবে না।
কিন্তু বত্সর শেষ হইতে না হইতে ভায়ানক দুর্ভিক্ষ সমুপস্থিত হইল। দেশ শুদ্ধ লোকের হাহাকারে বঙ্গদেশ পূর্ণ হইল। সহস্র সহস্র নর নারী সহস্র সহস্র বালক বালিকা দিন দিন অকালে মৃত্যুগ্রাসে নিপতিত হইতে লাগিল। বঙ্গদেশ একেবারে শ্মশান হইয়া পড়িল।
Dire scenes of horrir, which no pain can trace,
Nor rolling years for memory’s page efface
বঙ্গদেশ অরাজক! বঙ্গে আর এখন কোন প্রজাবত্সল রাজা নাই। এ দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত লোকদিগকে যে কেহ এক মুষ্টি অন্ন দিয়া ইহাদের প্রাণ বাঁচাইবে এমন কোন লোক নাই।
মহম্মদ রেজা খাঁর হাতে রাজ্য শাসনের ভার রহিয়াছে, সে রাজপ্রাসাদে দুগ্ধফেননিভ শয্যায় শয়ণ করিয়া রহিয়াছে। একবারও প্রজার দুরবস্থার বিষয় চিন্তা করে না। এ নরপিশাচের হৃদয়ে দয়াধর্মের লেশমাত্রও নাই। এ নির্দয়ের নাম স্মরণ করিলেও মন অপবিত্র হয়।
দেশে অনেক ধনী লোক রহিয়াছে। কিন্তু এবার আর সে ধনী লোকদিগের কিছু করিবার সাধ্য নাই। কি কৃষক, কি ধনী, কাহারও ঘরে অন্ন নাই। ধনীর গৃহে যথেষ্ট রৌপ্যমুদ্রা আছে, যথেষ্ট স্বর্ণ মহর রহিয়াছে, কিন্তু দেশে চাউল ক্রয় করিতে পারা যায় না। সুতরাং ধনী, দুঃখী, কৃষক, ভূম্যাধিকারী, সকলেরই সমান অবস্থা। সকলেই বলিতেছে মা অন্নপূর্ণা অনাহারে প্রাণ বিসর্জন হইল – মা অন্ন প্রদান কর। অন্ন-অন্ন-অন্ন- সকলের মুখে কেবল এই চিতকার শুনা যায়। কোথায় গেলে অন্ন মিলিবে এই চিন্তা সকলের মনে উদয় হইল।
দেশের অনেক ধান্য ইংরাজ ক্রয় করিয়া কলিকাতা রাখিয়াছেন। পূর্ণিয়া, দিনাজপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ হইতে লোক কলিকাতাভিমুখে যাত্রা করিল। গৃহস্থের গৃহে কুলকামিনীগণ সন্তান বক্ষে করিয়া কলিকাতাভিমুখে চলিল। আহা! চন্দ্র সূর্যের মুখ যাহারা কখনো অবলোকন করে নাই, যাহারা কখনও গৃহের বাহিরে বাহির হয় নাই, আজ সেই কূলবধু সন্তান ক্রোড়ে করিয়া ভিখারিনীর বেশে কলিকাতা চলিল। স্বীয় স্বীয় অঞ্চলে স্বর্ণমুদ্রা এবং বিবিধ আভরণ বান্ধিয়া একমুষ্ঠি অন্ন ক্রয় করিবার প্রত্যাশায় দেশ ছাড়িয়া চলিল।
কিন্তু ইহাদের মধ্যে অনেকেই কলিকাতা পর্যন্ত পৌঁছতেই সমর্থ হইল না। শতশত কূলকামিনী, শতশত সুস্থকায় পুরুষ পথেই অনাহারে জীবন হারাইল। সন্তানবত্সলা জননী সন্তান বক্ষে করিয়া কলিকাতা যাত্রা করিয়া ছিলেন, কিন্তু সন্তান অনাহারে মরিয়াগেল। তাঁহার ক্রোড় শূণ্য হইল। জননী সন্তান শোকে এবং ক্ষুতপিপাসায় উন্মত্ততার ন্যায় হইয়া অনতিবিলম্বেই মানবলীলা সম্বরণ করিলেন।
ভ্রান্ত নর-নারীগণ! তোমরা বৃথা আশায় প্রতারিত হইয়া কলিকাতা চলিয়াছ। যে চাউল কলিকাতায় সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা তোমরা পাইবে না। তোমরা মরিলেই কি আর বাঁচিলেই কি। তোমাদের নিমিত্ত কে চিন্তা করে। আর কি ভারতে প্রজা বত্সল রামচন্দ্র আছেন। উদারচেতা আকবর আছেন। অর্থগৃধ্নু রাজা কি কখন প্রজার মঙ্গল কামনা করে। তাহার সৈন্যের প্রাণ রক্ষা হইলেই হয়। সুতরাং সৈন্যদিগের নিমিত্ত তন্ডুল সংগৃহীত হইয়াছে। তাগহাদের প্রাণ অতি মূল্যবান। তাহারা মরিয়াগেলে কে মানবমন্ডলীর স্বাধীণতার মূলে কুঠারাঘাত করিবে। কে মহম্মদ রেজা খাঁর সদৃশ নরপিশাচের একাধিপত্য সংরক্ষণ করিবে।
কৃষক! তিমি কোন আশায় কলিকাতা চলিয়াছ। তুমি দেশের অন্নদাতা হইলেও তোমাকে কেহই একমুষ্টি অন্ন দিবে না। ঐ দেখ, ধনীর গৃহে কুলকামিনীগণ স্বার্ণমুদ্রা অঞ্চলে বান্ধিয়া তন্ডুল ক্রয় করিবার নিমিত্ত কলিকাতা যাইতেছে। ইহার একমুষ্ঠি অন্ন মিলিলেও মিলিতে পারে। ইহার সঙ্গে টাকা রহিয়াছে। কিন্তু বিনামূল্যে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীগণ কাহাকেও একমুষ্ঠি অন্ন দিবে না। কৃষকগণ! তোমরা গৃহে ফিরিয়া যাও। তোমাদের পরমায়ু এবার নিশ্চয় শেষ হইয়াছে। তোমার এ সংসার পরিত্যাগ করাই ভাল। পরমেশ্বর তাহার অমৃত ক্রোড়ে তেমাকে স্থান প্রদান করিবেন। এ নরপিশাচ পরিপূর্ণ শ্মশান সদৃশ বঙ্গদেশে থাকিয়া তুমি কখন সুখ শান্তি লাভ করিতে পারিবেনা।

Friday, December 23, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৩২ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৬। মীর জুমলার পুত্রের এবং সম্পত্তির মুক্তি
৭ জানুয়ারি নান্দেরে শাহজাদা মহম্মদের সসৈন্যে উপস্থিত হওয়ার সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও মহম্মদ আমীনকে মুক্তি দেননি গোলকুণ্ডার সুলতান। ২৪ তারিখের সম্রাটের কঠোর শব্দে লেখা ফার্মান এবং শাহজাদার হায়দ্রাবাদের দুই স্তর আগে পৌছোনোর সংবাদে হঠাতই যেন ঘুমের ঘোর থেকে জেগে উঠলেন তিনি। মহম্মদ আমীনকে এবং তাঁর পরিবারকে গোলকুণ্ডার মুঘল হাজিব, আব্দুল লতিফ এবং আওরঙ্গজেবের দূত আবদুল কাশেম আর সঈদ আলির হাতে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে নিয়াজ বেগ আর আজিজ বেগ মার্ফত সম্রাটকে মুক্তিদানের দেরির জন্য কৈফিয়ত দিয়ে পাঠালেন। ২১ জানুয়ারি, হায়দ্রাবাদ থেকে ২১ কোস দূরে মহম্মদ আমিন তাঁর ‘সাহায্যকারী’ শাহজাহার সঙ্গে দেখা করলেন, তিনি আমীনকে বললেন রণনৈতিকভাবে সঠিক সময় না আসা পর্যন্ত যেন তিনি মীর জুমলার জন্য অপেক্ষা করেন। যেহেতু কুতুব শাহ তাঁর পরিবারের সম্পত্তি হস্তান্তর করে নি, সেই অজুহাতে শাহজাহা সেনা নিয়ে হায়দারাবাদের দিকে এগিয়েই চললেন। ২২ জানুয়ারি এই সংবাদে সুলতান তড়িঘড়ি নিরাপদে আশ্রয় নিলেন তাঁর মহম্মদনগরের(গোলকুণ্ডার) প্রাসাদে। হায়দ্রাবাদের ৫ মাইল দূরে হুসেন শাহ হ্রদের পাশে উপস্থিত হয়ে শাহজাদা পরিখা খোঁড়ার এবং গোলকুণ্ডা দুর্গের সামনে মাইন পোঁতার নির্দেশ দিলেন। যদিও সেনাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল শহরের সাধারণ মানুষের ক্ষতি না করার, কিন্তু ২৪ তারিখে হায়দ্রাবাজ জুড়ে লুঠতরাজ চলল। বিজাপুরি সেনাপতি আফজল খাঁ হায়দ্রাবাদের ৪০ মাইল জুড়ে সেনা মোতায়েন করেছিলেন, তাই আর দেরি করা বিপজ্জনক হয়ে যাবে চিন্তা করে নান্দের থেকে অভিযান শুরু করে ১৮ জানুয়ারি গোলকুণ্ডায় পৌছলেন আওরঙ্গজেব। তিনি অপেক্ষা করছিলেন মীর জুমলার আগমনের জন্য। তাঁর মতলব, যদি সম্রাট শাহজাহান অনুমতি দেন তাহলে গোলকুণ্ডা দখল করবেন, না হলে মীর জুমলার দখল করা সম্পত্তি এখন যেটি গোলকুণ্ডা রাষ্ট্রের দখলে সেটি উদ্ধার করবেন এবং পরিশোধ না করা পেশকাশও উদ্ধার করবেন এবং কুতুব শাহের থেকে উজ্জ্বল কোন উপহার বাগাবেন। হতবুদ্ধি, কিংকর্তব্যবিমূঢতার ভোগা কুতুব শাহ এখন আওরঙ্গজেবকে যে কোন প্রকারে শান্ত করতে তীব্রউতসুক হয়ে মীর ফরাসের তত্ত্বাবধানে সোনায় মোড়া হাতি, ঘোড়া, চারটি পুঁটলি হিরেজহরতসহ গয়না পাঠালেন, এবং তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব সেই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। সুলতানের দূত মোল্লা আব্বাস সাইহানদ, এমন কি দারা এবং জাহানারা মার্ফতও শাহজাহানের কাছে রাহতের আবেদন করলেন। আওরঙ্গজেবের ধারণা হল সম্রাট তাঁর আবেদন মেনে নেবেন এবং প্রকারন্তরে সুলতানকে কর্ণাটক দখলের অনুমতিও দিয়ে দেবেন – অথচ এই বিস্তৃত, সম্পদশালী, চোখে দেখা যায় না এমন সম্পদে ভরপুর, দূর্গ এবং ধনীদের অধ্যুষিত অঞ্চলটি মীর জুমলা স্থানীয় জমিদারদের থেকে জয় করেছিলেন। কোন কারণে সম্রাট তাকে মাফ করে দিলে আওরঙ্গজেবের পায়ের তলার মাটি সরে যাবে। মীর জুমলার আসার গুরুত্বটাই হারিয়ে যাবে। তাঁর আশংকা হল, এই সাজিয়েগুজিয়ে তোলা ঘটনাপ্রবাহটি হাতের বাইরে চলে যাবে। তাই তিনি পাদশাহের কাছে প্রার্থনা করে জানালেন, যতক্ষণনা মীর জুমলার সন্তান সেখানে পৌঁছচ্ছে, ততক্ষণ যেন পাদশাহ কুতুব শাহের কোন প্রার্থনারই উত্তর না দেন, বিশেষ করে কুতুব শাহের দূত রাজধানীতে পৌছনোর আগেই মীর জুমলা হায়দ্রাবাদের পৌঁছে যাবেন।

হায়দ্রাবাদের লুঠতরাজের সময় মীর জুমলার পুত্রকে শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দায়িত্ব দিয়েছিলেন, কুতুব শাহের সম্পত্তি এবং আসবাবপত্র রক্ষার। কুতুব শাহের দূত হাকিম নিজামুদ্দিন আহমদকে মুঘল শিবিরে নজরদারিতে রাখা হল, এই অভিযোগে যে সুলতান মীর জুমলার সম্পত্তি হস্তান্তর করতে দেরি করেছেন। শেষ পর্যন্ত ২৯ জানুয়ারি ১৬৫৬ কুতুব শাহ মীর জুমলার ১১টি হাতি, ৬০টা ঘোড়া এবং অন্যান্য জব্দ করা সম্পত্তি মহম্মদ সুলতানের নজরদারিতে ফিরিয়ে দিলেন।

৭। আওরঙ্গজেবের শিবিরে মীর জুমলার আগমন
গোলকুণ্ডা ঘেরাও করে রাখার মাসগুলি ধরে আওরঙ্গজেব মীর জুমলার আগমনের প্রতীক্ষা করছিলেন। একের পর এক গোপনীত বার্তা পাঠিয়ে তাকে বলা হচ্ছিল এই সোনালি সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে চলেছে, তাই যততাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যেন এসে আওরঙ্গজেবের শিবিরে যোগ দেন। কিন্তু মীর জুমলা নিজের ঘর না গুছিয়ে অর্থাৎ বিজিত কর্ণাটকের প্রশাসন না সামলে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব সম্পদ না গুছিয়ে আসতে পারছিলেন না। খ্বাজা আরিফ মহম্মদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মীর জুমলাকে কর্ণাটক থেকে রওনা করিয়ে দেওয়ার – কিন্তু তিনি বিফল হলেন। ১৬৫৬ সালে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে জানালেন তার দেরির কারণ, এবং অনুরোধ করলেন তাঁর বক্তব্য যেন সম্রাটকে জানানো হয়। ১০ জানুয়ারি তিনি মীর জুমলাকে একবার তাঁর ভবিষ্যিত পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন অর্থাৎ ১৮ তারিখে মহম্মদ সুলতান হায়দ্রাবাদ পৌঁছবে এবং যতদূর সম্ভব তিনি পৌঁছবেন ২০ তারিখে। তিনি লিখলেন, ‘আমার সমস্ত চেষ্টা হবে যেভাবে কুতুবুউলমুলক মহম্মদ আমীনকে গোলকুণ্ডায় গ্রেফতার করেছে, আমি ঠিক সেইভাবেই তাকে গ্রেফতার করব। তুমি দূর্গ এবং নিজের সম্পত্তি আগলানোর ব্যবস্থা করছ ভাল কথা, কিন্তু সব কিছু ফেলে রেখে এবং সময়ের দিকে নজর রেখে যত তাড়াতাড়ি হায়দ্রাবাদে পৌছনোর চেষ্টা কর’। কুতুব শাহ তাঁর পুত্রকে মুক্তি দিলেও আওরঙ্গজেব তাঁর পরিকল্পনা থেকে সরতে রাজি ছিলেন না, এবং বললেন খুব শীঘ্র এসে এই বিশদ পরিকল্পনাটি রূপায়িত কর, এবং মহম্মদ মুমিনকে তাকে আনতে পাঠালেন। মীর জুমলাকে আবার লিখলেন, ‘এই ঘটনার শেষ ফলের প্রতি উদাসীন থেকো না, এবং এক মুহূর্তও অপব্যয় কর না।’ তাঁর অনুরোধে তিনি ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০০ ঘোড়সওয়ার বাহিত হয়ে আবার আবদুল লতিফকে পাঠালেন মীর জুমলাকে আনতে। কিন্তু মীর জুমলার পথে দেরি ঘটল তাঁর সাঁজোয়া বাহিনীর শ্লথ গতির জন্য। দিনের পর দিন যায় মীর জুমলা আর আসেন না। দিন যায় আওরঙ্গজেব জিততে থাকেন ততবেশি কুতুব শাহ শাহেনশাহর প্রতি করে মার্জনা ও শান্তি ভিক্ষা করতে থাকেন এবং এই বার্তা আওরঙ্গজেবের কাছে আসতে থাকে নিয়মিত। জেতার মুহূর্তে যখন তাঁর আশা ফলবতী হতে চলেছে অথচ মীর জুমলা পৌছচ্ছেন না, তখন হতোদ্যম হয়ে এবং প্রায় হতাশায় ডুবে পড়ে সুবাদার তাঁর সাথীকে মার্চ মাসে লিখলেন, ‘আমি তাকে(সুলতান) নগ্ন করে দিতে পারি, আমার বিশ্বাস তুমি রাস্তায় আছ... কুতুব শাহ এখন ক্ষমা ভিক্ষা করছে... তাঁর জামাই মীর আহমদকে আমার কাছে পাঠিয়েছে এই বলে যে আমার জন্য তাঁর মা অপেক্ষা করছেন, যেন আমার পুত্র তাঁর কন্যাকে বিবাহ করে... কিন্তু আমি তাকে শান্তিতে থাকতে দেব না... আমার উচ্চাশার আকাশ্চুম্বী, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।’

অবশেষে আওরঙ্গজেবের অপেক্ষার অন্তহীন অপেক্ষার সময় শেষ হল। ৮ মার্চ মীর জুমলা কৃষ্ণা পার হয়ে ১৮ মার্চ তাঁর শিবিরে উপস্থিত হলেন। সেটি হাসান সাগর হ্রদের ৮ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সাম্রাজ্যের ফার্মান আর খিলাত নিয়ে খ্বাজা আরিফ কৃষ্ণার তীরে পৌঁছলেন।
(চলবে)