Thursday, June 30, 2016

Anecdotes of Aurangzeb – আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান



দ্বিতীয় খণ্ড
১০। কে রাজাকে সঠিক উপদেশ দেয়
বাহাদুর শাহকে কারাগার থেকে মুক্ত করার পর একদিন আওরঙ্গজেব সামনে পুত্রকে বসিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার পিতা, আমি যদি পছন্দ করি, তাহলে রাজমুকুট তোমার মাথায় উঠবে। আমি (আমার বাবা) শাহজাহানের কাজে সন্তষ্ট নই, যেভাবে তিনি দারা শুকোর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, যে মানুষটা সারা জীবন অবিশ্বাসী হিন্দু আর যোগীদের নিয়েই জীবন কাটিয়ে গেল(তাতে আমি বিরক্ত)। বিজয় পেতে গেলে নবীদের মধ্যে সৈয়দদের(যাদের মাধ্যমে তিনি আশীর্বাদ এবং শান্তি বর্ষণ করেন) অর্থাৎ মুহম্মদের, সাহায্য এবং বিশ্বাস প্রয়োজন। আমি এখন তোমায় কিছু উপদেশ দেব; তুমি সেগুলি শুনবে এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। আমি স্থির নিশ্চিত জানি যে সেগুলি বাস্তবে প্রয়োগ করা তোমার চরিত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী, তবুও আমি বাস্তবিক স্নেহের বশে এবং যে ভালবাসা এবং বশ্যতা তুমি আমায় দেখিয়েছে, সেইজন্য তোমায় এই কথাগুলি বলছি।
প্রথম – একজন সম্রাটকে কোমলতা এবং কঠোরতার মাঝামাঝি দাঁড়াতে হয়। এই দুটি গুণের মধ্যে যে কোন একটা যদি অন্যটাকে ছাপিয়ে যায়, তাহলে অনেক সময় তার সিংহাসনের রশিতে টান পড়ে যায় কেননা বেশি আন্তরিক হলে মানুষ সেই ভালবাসার প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে, আর যদি অতিরিক্ত কঠোর হয়, তা হলে বহু হৃদয় রুষ্ট এবং বিদীর্ণ হয়, একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, আমার কাকা সুলতান উলুঘ বেগ, তার ব্যক্তিমাধুর্য এবং অন্যান্য সদগুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি খুব রক্ত পিপাসু সম্রাট ছিলেন, খুব ছোট ছোট আধিকারিকদেরও তিনি মৃত্যু দন্ড দিতেন। তার পুত্র আব্দুল লতিফ তাকে বন্দী করে নেহাওয়ান্দ কারাগারে নিক্ষেপ করে। কারাগারের যাওয়ার পথে রাস্তায় তিনি একজন সাথীকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার পতনের জন্য কে দায়ি বলে আপনি মনে করেন’? তিনি বললেন, ‘আপনার রক্তক্ষুধায় মানুষ আপনার পাশ থেকে সরে গিয়েছে’। আমার সম্মানীয় পূর্বপুরুষ, হুমায়ুন অসাধারণ অবহেলা, গাফিলতি, দায়ালুতা, ক্ষমাশীলতা, দৈনন্দিন কাজকর্মে দুর্বলতা, দেখিয়েছিলেন। বাংলার শাসক শের খাঁ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার স্পর্ধা দেখালেও তিনি বার বার তার কৃতকর্মকে অবহেলা করেছেন, এবং শুধু তার পিতা হাসান শূরকেই শুধু হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছেন, ‘তুমি তোমার পুত্রের কাজ দেখছ, অথচ তুমি তাকে চিঠি লিখে নিবৃত্ত করছ না কেন?’ হাসান উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তার কাজকর্ম, চিঠি লিখে হুঁশিয়ারি দেওয়ার বাইরে চলে গিয়েছে। আমি জানি মহামহিম যে অবহেলা দেখাচ্ছেন, তার ফল কি হতে পারে’।
পরেরটি হল, সম্রাট নিজেকে হালকা করে ফেলবে না, হাল ছেড়ে দেবে না এবং কোন কাজ থেকেই সরিয়ে নেবে না, অবসর নেওয়ার কথা ভাববে না, এই অসহ্য স্বভাবগুলির জন্যই রাষ্ট্রের পতন ঘটে এবং সম্রাটের ক্ষমতা ধ্বংস হয়। যতটা পারা যায়, সারাক্ষণ সব কিছু নিজের নজরে রাখবে।
(কবিতা)পরিচারক এবং সম্রাটের পক্ষে একটা স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা অমার্জনীয় অপরাধ/ জল বাড়তে থাকে গলিত শবে, রাজার নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়/ যে ঘুরে বেড়ায় তাকে (সকলে) রাজার মত সম্মান করে/ ভাল আর সুখী থাকার ইচ্ছে সম্রাটকে বিশ্বাসহীন করে তোলে।
এছাড়াও বলি, তোমার ভৃত্যদের কি করে শিক্ষা দেবে সেটা তোমায়ই ভাবতে হবে, এবং যে কাজের জন্য যে মানুষটি প্রয়োজনীয়, তাকে সেই কাজে নিযুক্ত করতে হবে। সাধারণ জ্ঞানে বলে যে কালীন তৈরি করে, তাকে যদি কামারের কাজ দাও তাহলে কি হতে পারে ভেবে দেখবে! বড় কাজ ছোটদের ওপর চাপিও না, কেননা বড় মনের মানুষ ছোট কাজ করতে আত্মসম্মানে আঘাত পায়, আর ছোট মানুষের বড় কাজ করার ক্ষমতা থাকে না, সেই ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যে অরাজকতা দেখা দিতে পারে।
মন্তব্য – মির্জা উলুঘ বেগ তৈমুরের নাতি এবং মহাজাগতিক ব্রহ্মাণ্ডের তালিকা তৈরির কাজে অন্যতম পথপ্রদর্শক, সমরখন্দের সম্রাট ছিলেন ১৪৪৯ পর্যন্ত, তাঁর পর তাঁর পুত্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং হত্যা করে।

Tuesday, June 28, 2016

Anecdotes of Aurangzeb – আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান

দ্বিতীয় খণ্ড
আওরঙ্গজেবের পুত্র আর নাতিদের বিষয়ে

বাহাদুর শাহ(মুয়াজ্জম)

৯। শাহজাদা মুয়াজ্জমের গ্রেপ্তারি

সম্রাট যখন শাহজাদা মহম্মদ মুয়াজ্জম বাহাদুর শাহকে কারাগারে নিক্ষেপ করার জন্য মনস্থ করে তাঁকে আহ্বান জানালেন, শাহজাদা এলেন ভজনালয়ে। গন্ধ দ্রব্যের দারোগা বক্তাবর খাঁকে মহামহিম বললেন, ‘আমার সন্তানের পছন্দের প্রত্যেকটি আতর নিয়ে এস’। বাহাদুর শা বিনীতভাবে বললেন, ‘এই দাসের নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা কি? (আমার নিজের পছন্দ করে আনা থেকে)কোন গন্ধটায় আপনি, মহামহিম খুশি হন, সেইটা আনি’। সম্রাট উত্তর দিলেন, ‘আমার নির্দেশ আমার আনুগ্রহের নিদর্শন’। বাহাদুর শাহ বক্তাবর শাহকে বললেন, ‘মোমের গন্ধ(আতরইফিন্দ) যা আছে সেটা নিয়ে এস। মহামহিম চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হ্যাঁ আমিও, আমার মনে সেই দূরদর্শী ভাবনাটাই কাজ করছিল বলেই তুমি এখানে এসেছ’। যখন গন্ধটি এল, তখন আওরঙ্গজেব শাহজাদাকে জামার হাতা খুলে দিয়ে এগিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন, যাতে সম্রাট নিজের হাতে সেই গন্ধদ্রব্যটিকে তার হাতে ডলে দিতে পারেন। গন্ধ দ্রব্যটি গায়ে মেখে যখন শাহজাদা মাথা ধন্যবাদ জানানোর জন্য নত করতে পিছিয়ে গেলে, সম্রাট মুহরম খাঁকে নির্দেশ দিলেন, হামিদুদ্দিন খাঁয়ের সাহায্য নিয়ে যেন তার পুত্র এবং চার সন্তানকে নিরস্ত্র এবং আটক করা হয়। তারা যখন প্রথমে মহম্মদ মুয়িজুদ্দিনএর কাছে গেলেন, তিনি তার হাত তরোয়ালের বাঁটে দিলেন। বাহাদুর শাহ ক্রোধে তার সন্তানের প্রতি বলে উঠলেন, ‘শয়তান, তুমি তোমার বিশ্বাসের কেন্দ্র এবং কাবার(পূণ্য সম্রাট) নির্দেশ বিরোধ করছ?’ তার নিজের হাতে তিনি তার (বড়)সন্তানের শস্ত্র খুলে নিয়ে মুহরম খাঁকে অর্পন করলেন। অন্য সন্তানেরা কোন কথা না বাড়িয়ে তাদের শস্ত্র সম্পর্পন করল।

যখন সম্রাট এটা শুনলেন, বললেন, ‘এই ভজনখানা জোসেফের কুঁয়োর স্থান নিয়েছে, এবং সে জোসেফের মর্যাদা অর্জন করল’।

মন্তব্য – শাহজাদা মুয়াজ্জম, পরের দিকে প্রথম বাহাদুরশাহকে আওরঙ্গজেব, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৬৯৫ সালে কয়েদ করেন এবং মুক্তি দেন ৯ মে, ১৬৯৫ সালে। তার পর তাঁকে লাহোরের সুবাদার রূপে পাঠানো হয়। তবে মাসিরই আলমাগিরি এই ঘটনার একটু আলাদা বিবরণ প্রদান করছে। এই উপকথায় যে বক্তাবর খাঁয়ের নাম বলা হচ্ছে, তিনি কখোনোই মিরাটইআলমএর লেখক হতে পারেন না, তিনি মারা যান ৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৯৫ সালে। তার নাম খ্বাজা বক্তাবর, খাঁয়ে রূপান্তরিত হয়েছেন এখানে। এখানে ফিন্দ শব্দটি নিয়ে খেলা করা হয়েছে কেননা ফিন্দের একটি মানে সুগন্ধী মোম আরেকটি মানে বিশৃঙ্খলা। মক্কার কালো চৌকোণা মসজিদটার নাম কাবা, যার দিকে মুখ ফিরিয়ে মুসলমানেরা নমাজ পড়েন। জেকবের সন্তান জোসেফকে তার দুর্বিনীত ভায়েরা শুকনো কুঁয়োয় ফেলে দেয়, তার পরে দাস হিসেবে একজন মিশরের পানে যাওয়া এক বণিককে বিক্রি করে দেয়। এই দুর্ঘটনা জোসেফকে মিশরের প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করে।
(চলবে)

Anecdotes of Aurangzeb – আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান

প্রথম খণ্ড

৮। আওরঙ্গজেবের ইচ্ছে পত্র

সর্বশক্তিমানের যারা অনুগামী, যারা তাঁর পরিতুষ্টি প্রদান করেছেন তাদের ওপর তার দোয়া ঝরে পড়ুক। আমার শেষ ইচ্ছের নির্দেশাবলী দিয়ে যেতে চাইঃ
প্রথম – এই পাপী এবং অন্যয়পর মানুষটির হয়ে হাসানের পুণ্য কবরে চাদর দেবে, কারণ যারা পাপের সমুদ্রে ডুবে রয়েছে তাদের করুণা আর কৃপার দরজা দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এই মঙ্গলকর কর্মটি(ইচ্ছা পত্র রচনাটি) আমার মহৎ পুত্র শাহজাদা আলিজা(মহম্মদ আজম)র উপস্থিতিতে করছি।

দ্বিতীয় – ফেজ টুপি সেলাই করে যে চার টাকা দু আনা রোজগার করেছিলাম, সেটি মহলদার আয়া বেগের জিম্মায় রাখা আছে। সেটা অবহেলিতদের কবরে শবচ্ছেদ দেওয়ার কাজে ব্যবহার করবে, কুরাণ নকল করার শ্রম রূপে তিনশ পাঁচ টাকা আমার নিজের তবিলে রয়েছে নিজের ব্যক্তিগত খরচের জন্য। আমার মৃত্যুর দিন সেগুলি ফকিরদের দান করে দিও। শিয়ারা যেহেতু কুরাণ নকল করা বেআইনি স্বীকার করে, এই টাকাক’টি দিয়ে আমার কবরের আচ্ছাদন কিনে দিও না।

তৃতীয় – শাহজাহা আলিজার মধ্যস্থ থেকে আমার শেষকৃত্যর বাকি কিছু নিও, সেই আমার খুব কাছের সন্তান, আমার শেষকৃত্যর আইনি বেআইনি কাজ তাঁর ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে। এই অনুপায়(আওরঙ্গজেব) ব্যক্তি সেই কাজগুলোর জন্য জবাবদিহি করতে থাকবে না, কেননা মৃতেরা তার উত্তরপুরুষের হাতে থাকে।

চতুর্থ – ঠিক পথে চলতে চলতে (পথ ভুল করে)বিপথের উপত্যকায় গিয়ে পড়া এই ভ্রমণকারীকে মাথা খালি রেখেই কবর দিও কেননা, ছারখার হয়ে যাওয় প্রত্যেক পাপী, খালি মাথায় সর্বশক্তিমানের সামনে উপস্থিত হলেই অনুকম্পা অর্জন করে।

পঞ্চম – আমার কবরে দেওয়া কফিনের মাথাটি গাজি কাপড় দিয়ে আচ্ছাদন দিও। কবরে কোন ঢাকাঢুকি দিও না, আর সে সময় বিধর্মীয় কোন গানবাজনা কোর না বা সাদাসিদা নবীর মাওলাদ দেখিও না।

ষষ্ঠ – এই সাম্রাজ্যের শাসকের(আমার উত্তরাধিকারীর) একটু কাজ করা উচিত, যারা এই দুর্বিনীত হতভাগ্যের(আওরঙ্গজেব) সঙ্গে মরুভূমি, জঙ্গলে(দাক্ষিণাত্যে) ঘুরেছে, তাদের ক্ষমা এবং দোয়া প্রদর্শন করবে। এমনকি তারা যদি কোন ভুলও করে থাকে, উত্তরে তাদের দয়া উপহার দাও এবং (তাদের ভুলগুলি)মার্জনা কর।

সপ্তম – হিসেব রাখার(মুতাসাদ্দি) কাজে পারসিদের থেকে উত্তম আর এই বিশ্বে কেউ নেই। এবং যুদ্ধতেও, সম্রাট হুমায়ুনের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত, কোন দেশ তাদের থেকে উত্তম হতে পারে নি, এবং তাদের জমিতে দাঁড় করানো পদদ্বয়কে নড়াতে পারে নি। সব থেকে বড় কথা তারা তাদের প্রভুর বিরুদ্ধে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে নি। তাদের আশা শুধু সম্মান পাওয়া। কিন্তু তাদের সঙ্গে চলা খুব কঠিন। যে কোনভাবেই হোক তাদের ঠিক পরামর্শ দেবে, এবং তাদের আলাদা আলাদা করে নিয়োগ করবে।

অষ্টম – তুরানীরা সেনা। তারা লড়াই, পিছু নেওয়া, শক্তিপ্রয়োগ করা, রাতের আক্রমণ এবং গ্রেপ্তারের কাজ ভাল পারে। যুদ্ধের মাঝ পথ থেকে কখোনো হঠাতই যদি পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে তাদের কোন সন্দেহ, অসম্মান বোধ হয় না, এর অর্থ ‘ছোঁড়া তীরকে তুমি ফিরিয়ে নিতে পার’ – এবং হিন্দুস্তানিদের মুর্খতার থেকে তারা বহু দূরে বসবাস করে, যারা(হিন্দুস্তানিরা) মনে করে মাথা চলে যাক তবু (যুদ্ধ থেকে) পিছু হঠব না। এই জাতিকে যথাযথ সম্মান দেবে, কেননা অন্যেরা যা পারবে না, তা তারা করে দেখায়।

নবম – বাহারার সৈয়দদের যথোচিত সম্মান দেখাবে, কেননা তারা(নবীর পরিবারের) আশীর্বাদ ধন্য, কুরাণের পুণ্য কবিতায় বলেছে, নবীর কাছের সম্পর্কের মানুষদের তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু দিতে হয়, কখোনোই তাদের সম্মান দিতে বিলম্ব করবে না। পবিত্র কবিতায় বলা হয়েছে, আমি বলছি, এর বিনিময়ে (নবীর)আত্মীয়দের ভালবাসা ব্যতীত তুমি কিন্তু কোন প্রতিদান আশা কোরো না, এই পরিবারের প্রতি ভালাবাসা হল নবীতার প্রতি এওয়া তোমার খাজনা, এবং এই বিশ্বে এর থেকে প্রয়োজনীয় ভালবাসা আর কিছুই নেই। কিন্তু বারহার সৈয়দদের প্রতি সম্পর্ক করতে চরমতম সতর্ক থেকো। তাদের মন দিয়ে ভালবাসবে না, তাদের এমনভাবে পদন্নোতি করবে না, যাতে তারা সাম্রাজ্যের নানান বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেটা দেখবে; এবং তাহলে তারা সাম্রাজ্যটাও চেয়ে বসতে পারে। তাদের যদি একটুও ছাড় দাও তারা তোমার সম্মান হানি করাবেই করাবে।

দশম – সম্রাটকে তার সারা সাম্রাজ্য ঘুরে বেড়াতে হবে; সে যেন এক জায়গায় বসে না যায়, তাতে হয়ত তার বিশ্রাম হবে, কিন্তু(সেই বিশ্রাম) ভবিষ্যতে হাজারো দুর্দশা আর উপসর্গ বহন করে আনবে।

একাদশ – তোমার পুত্রদের বিশ্বাস করবে না। তোমার জীবনকালে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ করবে না। যদি সম্রাট শাহজাহান দারা শুকোর প্রতি যদি এই আচরণ না করতেন, তাহলে হয়ত বৃদ্ধাবস্থায় তাঁকে এই দুঃখের মখ্যে কাটাতে হত না। চিরাচিরিত প্রবাদটি মনে রাখবে ‘রাজার কথা শুকনো হয়’।

দ্বাদশ – রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভটা হল, রাজ্যের ঘটে চলা ঘটাবলীর সঙ্গে সবসময় ওয়াকিবহাল থাকা। একটা মুহূর্তও যদি তুমি গাফিলতি কর, সেই অসম্মান তোমায় দীর্ঘদিন বয়ে চলতে হবে। শয়তান শিবা(শিবাজী)র মুক্তি ঘটেছিল আমার অসতর্কতায়, আমায় শেষ জীবন পর্যন্ত তার প্রতিদান চোকাতে হয়েছে(মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে করে)।

বারো সংখ্যাটি আশীর্বাদক। আমি এই বারোটি নির্দেশ দিয়ে আমার ইচ্ছে পত্র সমাপ্ত করলাম।

(কবিতা) তুমি যদি পড়াশোনা কর, শেখ, জ্ঞানকে চুম্বন করবে,/ আর যদি অবহেলা কর তাহলে হায় হায় হায়।

শিয়াদের মধ্যে অধিকাংশ দ্বাদশ ইমাম অনুসরণ করেন, তাই তাদের বলা হয় ইনসাআসারি(দ্বাদশা); একটি ছোট অংশ প্রথম সাতটি অনুসরণ করেন, তাই তাদের সাবিয়া(সাতিয়া) বলা হয়। তুর্কদের বারো বছরের চক্র রয়েছে।
(প্রথম খণ্ড সমাপ্ত)

দেশিয় সংগঠন চর্চা WATAGএর বন্ধুত্ব তত্ত্ব

WATAG(Weavers Artisan & Traditional Performing Artists Guild)-কে অপার বাঙালি ভালবাসায় ঘিরে থাকা বন্ধুরা, আপনাদের নেতৃত্বে চলা WATAG বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে কিছু কথা ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে হল। বড় লেখা হবে - ধৈর্য হলে দয়া করে পড়বেন, না হলে ছেড়ে চলে যাবেন, গ্রামীনেরা সর্বংসহা, খারাপ লাগে না -

দেশি বিদেশি কর্পোরেট বা দাতা সঙ্গঠনের দান অথবা সরকারি কোন প্রকল্প ছাড়াই একসময় বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘ চলছে, WATAGও সেই পথ বেয়েই নিজের কাজে এগিয়ে চলেছে।
আজও ভাল কাপড় তাঁতে সৃজন হয় - মিলে নয়, ভাল জং ছাড়া লোহার পণ্য বানাতে ডোকরা কামারেরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী - লোহার কারখানায় হয় না, আজও ভাল মাটির কাজ হয় হাতে চালানো চাক আর কুমোরের হাতের জাদুতে, আজও বিষমুক্ত ফসল চাষ করেন চাষী - নিজের হাতে জন্মদেন কোটি কোটি প্রাণের, জীবনদায়ী ওষুধ আজও গাছগাছালি থেকেই গ্রামের পরম্পরার ভিষগেরা তৈরি করেন, ভাল বাঁশের কাজ হাতে হয়, পাটের কাজ তাঁতপোই তাঁতেতে হয় - পাট কলে নয় - বাংলায় রয়েছে প্রচুর শ্রমশক্তি, দক্ষতা, প্রচুর জ্ঞান আর তার নিজস্ব প্রযুক্তি যা দিয়ে বাংলার গ্রাম আজও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, উতপাদক-বিতরকেদের নিয়ে - তাই গ্রামের অর্থনীতির জোরে ২০০৮ সালের বিধ্বংসী কাণ্ডের রেশ ভারতে পড়ে না - সেই বিষ-ঋণের, বড় পুঁজির মদতদার ব্যাঙ্কের দখলি অর্থনীতির জালে জড়িয়ে নেই গ্রাম ভারত - আর তার বিকেন্দ্রিত উতপাদন বিতরণ ব্যবস্থা যেন রক্তবীজের বংশধর, যারা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে জানেন নিদারুণ রাষ্ট্রবিপ্লবেও, বিধ্বংসী শাসকের রুদ্রমূর্তির নিচেও

- একমাত্র দক্ষতা, ঐতিহ্য আর নিজস্ব প্রযুক্তি নির্ভর গ্রামীন উতপাদক, বিক্রেতা আর বিতরকেরা বড় পুঁজির ধ্বংসকর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি

- বাংলার গ্রামের ছোট পারম্পরিক উতপাদকেরা দক্ষতা, জ্ঞান, ঐতিহ্য এবং নিজেদের প্রযুক্তিতে বলবান হয়ে বড় পুঁজির বিরুদ্ধে নিজেদের কৃতকর্মের স্বাক্ষর পেশ করেছেন কয়েক হাজার বছর ধরে - আজও

- এশিয়া, ইওরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকায় তার কয়েক হাজার বছর ধরে নিজেদের উতপাদিত দ্রব্য বিক্রি করেছে ব্রিটিশপূর্ব আমলে বিশিল্পায়ন না হওয়া পর্যন্ত

- ইওরোপকে সে সুতি ভাল রেশম কাপড় পরতে শিখিয়েছে, প্রাকৃতিক নীল রঙ উপহার দিয়েছে, জং ছাড়া লোহা দিয়েছে, প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা করেছে ৭০টা শিল্প দ্রব্য আর ১০০টা কৃষি দ্রব্য

- গ্রামীনদের বহু কলা লুপ্ত করে দিয়েছে ক্ষমতাবানেরা, কিন্তু রয়েও গিয়েছে বহু জ্ঞান, দক্ষতা আর প্রযুক্তি - সেটাই বাংলার সম্পদ

- গত পাঁচ বছরে বাংলা নতুন পথ দেখিয়েছে, আগামী কয়েক দশক সে সেই পথের চলা আরো দৃঢ করবে,

- আজ বাংলার ছোট পরম্পরার উতপাদকেরা এক ছাতার তলায় আসতে প্রস্তুত, নিজেদের এবং আপামর গ্রামীনদের জীবন, জীবিকা, আর্থব্যবস্থা এবং উতপাদন-বিতরণএর পরিবেশ রক্ষায় তৎপর -

-সেই তৎপরতার একটা কাজ হয়েছে Weavers Artisan & Traditional Performing Artists Guild(WATAG) বাংলায় পঞ্জীকৃত হওয়ায়

- এর কাজ অনেকটা চেম্বার অব কমার্সদের মত - কিন্তু খোলা মেলা পুঁজির মত দখলদারির নয় - পেটেন্ট বা কপিরাইটে বিশ্বাস করে না বাংলার গ্রামীনদের মত এই সংগঠন, তাই নিজেদের উতপাদন-বিতরণ-দক্ষতা-প্রযুক্তির স্বার্থরক্ষ - তার জন্য নানান উদ্যম নেওয়া

- নতুন তৈরি হওয়া গিল্ড গ্রামীন-উতপাদক-বিক্রেতা-পরিবেশকদের সম্পূর্ণ স্বার্থরক্ষায় নানান পদক্ষেপের উদ্যোগ কিছু ফল ফলতে শুরু করেছে

- আপনাদের নিরন্তর শুভেচ্ছায় WATAG আজ মাত্র ফেব্রুয়ারিতে পঞ্জীকৃত হয়েই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে শুধু নয়, সে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতেও পারছে। WATAG এমন একটি সঙ্গঠন, যেটি পঞ্জীকৃত হয়েছে দিনাজপুরের একটি গাঁয়ের ঠিকানায়

- বাংলা শুধু শহর-ভিত্তিক তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক স্থল ছিল না তার ভিত্তি ছিল গ্রাম, সেটি এই পদক্ষেপে পরিষ্কার করে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে

- কলকাতা আর জেলা শহরের বাইরের তাকাতে হবে, যদি বাংলার গ্রামকে স্বনির্ভর করার স্বপ্ন দতে হয়, বাংলা-বাঙালিকে শহরের নির্ভরতরা ত্যাগ করাতে হয়

- WATAG এই মাত্র কয়েকমাসে আপনাদের তাত্ত্বিক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি কাজ করেছে-

ক) দক্ষিণ দিনাজপুরের যে গ্রামে সে পঞ্জীকৃত, সেই গ্রামে অন্তত ১০০০ শিল্পী এবং ৪০টা দল নিয়ে একদিনের একটি উত্তররঙ্গ ১৪২৩, দিনাজপুরের গ্রাম সংস্কৃতি উতসব আয়োজন করেছে - সেদিন তিন বেলা সেখানে খেয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ - এটা হয়েছে কোন বেসরকারি সংগঠন বা সরকারি সাহায্য ছাড়াই - শুধু মাত্র সদস্যদের চাঁদায় বিপুল এই কর্মযজ্ঞ চলেছে - এ কাজে সাঁওতাল সমাজের অংশগ্রহন ভোলার নয়

খ। সদ্য তৈরি হওয়া রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়য়ে একটি গ্রাম-প্রযুক্তি-সংস্কৃতি প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা পেশ করেছে, অবিলম্বে এই ডিপ্লোমা পড়াশোনার কাজটি চালু হতে চলেছে - WATAGও হয়ত বাংলা জোড়া এই ধরণের একটি গ্রামকেন্দ্রিক প্রায়োগিক কিন্তু তত্ত্ব নির্ভর শিক্ষা প্রকল্প রূপায়িত করতে যাচ্ছে -

গ। সোফি-সুজয়এর উদ্যমে শ্রাবন-ভাদ্রমাসে(আগস্ট) ১৫ দিনের একটি কর্মশালা আয়োজিত হতে চলেছে কলকাতায়, যেখানে বাংলা-ইওরোপের প্রযুক্তি এবং কারিগরিকলার যৌথ সঙ্গম হবে, এবং সেই উৎপাদনগুলি ইওরোপে বাজারজাত হবে তার নিজের জোরে। একটি বাংলা-জার্মানি যৌথ কর্মীদল গঠিত হবে, যারা নিয়মিত বাজার নিরীক্ষণ করে নতুন প্রযুক্তি-শিল্পকলা মিশ্রণে নব সৃষ্টির কাজ করবে

ঘ। WATAGএর সদস্যদের জমিতে দেশি প্রথায়(দয়া করে একে বিকল্প বলবেন না, এটাই আমাদের নিজস্ব পদ্ধতি, আমরা বিকল্প পদ্ধতিতে এখন রাসায়নিক চাষ করি, সবাই একে জৈব বলেন আমরা বলি দেশি পদ্ধতি) ফসল উৎপাদনের কাজ শুরু গত বছর হয়েছে এবছর ব্যাপকভাবে হবে; হচ্ছে ১। ঢেঁকি ছাঁটা চাল, ২। আমাদের নিজস্ব কিছু সুগন্ধী চাল - পাওয়া যাচ্ছে তুলাইপাঞ্জী, ৩। ওষুধরূপে ব্যবহৃত কিছু চাল, যেমন কালোভাত - যা কর্কট রোগ প্রতরোধক ইত্যাদি

ঙ। মুর্শিদাবাদে তুলো থেকে চরকায় সুতো কেটে ফুলিয়ায় প্রাকৃতিক রঙে ছুপিয়ে ঠকঠকি তাঁতে নীলাম্বরী, পীতাম্বরী, রক্তাম্বরী এবং শ্বেতাম্বরী শাড়ি এবং কাপড় তৈরি - ব্যবসায়িকভাবে এটি আমাদের তাঁতিরা করতে পারছেন, এছাড়া সুতো চাষ করছি WATAG, বাঁকুড়ার ছাতনায়, বর্ধমানের আউসগ্রামে আর নদীয়ার চাতরায়

- চাষ হচ্ছে সাদার সঙ্গে দেশি রঙ্গীন তুলোও - আগ্রহ বিটিতুলোকে দেশ ছাড়া করা - এটা চাষ করে আমরাই পারি - সেই স্পর্ধা বাংলার চাষী, চরকা কাটনি রঞ্জক আর তাঁতিরা দেখাতে পেরেছেন নিজেদের মত করে বড় পুঁজির রাঙ্গানো চোখের সামনে দাঁড়িয়ে

চ। WATAGএর নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র গত এক বছর ধরে চালু রয়েছে হাওড়ার অবনী রিভার সাইড শপিং মলে, নাম 'পরম মাটি' - এখানে বাংলার নিজস্ব নানান গ্রামীন উতপাদন যাকে শহুরে শিক্ষিতরা লোকশিল্প বা হস্তশিল্প বলেন, আমরা বলি গ্রাম উতপাদন, বিক্রি হচ্ছে নিয়মিত

ছ। কিছু প্রকাশনা করা হচ্ছে সদস্য সংগঠন কলাবতী মুদ্রার তরফে - সেটা কত সরাসরি বাজারে আসে তার ব্যবস্থা করা - বই প্রকাশিত হয়েছে
* দীপঙ্কর দে'র এক নীলকণ্ঠ ভারতের ইতিবৃত্ত,
* সুনীল চন্দের দিনাজপুর কথার দ্বিতীয় মঞ্জুষ,
* সোমা মুখোপাধ্যায়ের সরযূবালার ভেষজ কথা এবং মণিমালা চিত্রকরের জীবনী(সম্পূর্ণ রঙ্গিন)।
- এছাড়াও আগে প্রকাশিত হয়েছে
* তাঁতি মনোহর বসাকের নীলাম্বরীর নকশা,
* বিশ্বেন্দু নন্দ ও পার্থ পঞ্চাধ্যায়ী সম্পাদিত হকার কথা,
* আর রয়েছে সঙ্গঠনের মুখপত্র মাসিক পরম - ২৩টি সংখ্যা। - মাঝে বন্ধ ছিল আশাকরা যায় আগামী আশ্বিনে নতুনভাবে ২৪ তম থেকে প্রকাশ পাবে - প্রথা অনুযায়ী আগামী এক বছরের বিশদ প্রচ্ছদ ভাবনা - ১। বস্ত্র বয়ন - দ্বিতীয় মঞ্জুষ, ২। বাংলার মুদ্রা ৩। জেলা পরিক্রমা দুই দিনাজপুর, ৪। ছোটলোক, ৫। বাংলায় ডাচেরা, ৬। বাংলার মাটির পুতুল, ৭। প্রাকৃতিক রঙ, ৮। জেলা পরিক্রমা কোচবিহার, ৯। বাংলার অঙ্ক, ১০। পঞ্জিকা, ১১। মোগল আমলে বাংলা, ১২। বাংলায় পর্তুগিজ।
* আরও একটা দ্বিভাষিক পত্রিকা 'গ্রাম শিল্প পরম্পরা' প্রকাশিত হবে একই সঙ্গে - তার ১২ সংখ্যার বিষয় ১। দশাবতার তাস, ২। বাংলার চিত্রকলা, ৩। শোলার কলকা, ৪। শাঁখ শিল্প, ৫। বিষ্ণুপুরের দুর্গা পট, ৬। দিনাজপুরের কাঠ ও কাগজের গমীরা মুখোশ, ৭। বানাম, ৮। আলপনা, ৯। দেওয়ালি পিতুল, ১০। পট ১১। পোড়ামাটির তুলসিমঞ্চ, ১২। বাঁশের বুনন, ১৩। পাথরের কাজ(মেদিনীপুর, শুশুনিয়া), ১৪। সাঁওতাল আর শবরদের ঘাসের কাজ, ১৫। তাজিয়া, ১৬। পুরুলিয়ার ছো মুখোশ, ১৭। বাজি, ১৮। বীজের গয়না, ১৯। পিতল-কাঁসা, ২০। রন্ধন শিল্প - প্রথম জেলা ?, ২১। নতুন গ্রামের কাঠের কাজ, ২২। বাংলার মেলা, ২৩। মোষের শিঙের কাজ, ২৪। বাংলার মাটির ঘোড়া।

জ। কাজ চলছে http://watag.in/ নামে একটা ছাতা ওয়েবসাইট তৈরি করা, যেখানে বাংলার গ্রাম উতকর্ষ বিক্রি হবে, জানাযাবে বাংলার পরম্পরা, গ্রামীন উদ্যম, তত্ত্ব, তার সদস্যদের নাম, কাজ জ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি

http://watag.in/র কাজ চলছে। এর অধীনে তৈরি হচ্ছে http://lokfolk.in/ একটা ইকমার্স সাইট, হচ্ছে NILAMBARI.IN শাড়ি বিক্রির জন্য আর হচ্ছে বই পত্রিকা বিক্রির জন্য একটা সাইট

ঝ। WATAGএর বন্ধু তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছে - Friends of WATAG. বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিন গ্রাম উতপাদকেদের দিকে
\/ এখনও অনেক কিছু বেঁচে আছে বাংলার গ্রামে সেগুলি যেন 'লুপ্ত' বা 'লুপ্তপ্রায়' না হয়ে যায় তা আগ্রহসহকারে দেখা,
\/ নিজেদের উদ্যোগে যারা এই ধরণের কাজ করেন তাদের WATAGএর খবর দেওয়া এবং এক ছাতার তলায় আনা
\/ http://watag.in/এর খবর ছড়য়ে দিন, বাংলার গ্রাম পরম্পরার উদ্যম উঠে আসুক বিশ্বের দরবারে আড়াইশ বছর আগে যেমন ছিল

বন্ধুদের কাছে অনুরোধ
@ এই কাজে প্রবল সম্পদ প্রয়োজন - WATAGএর সদস্যরা মনে করে না সম্পদ মানে শুধুই অর্থ - অর্থ অবশই প্রয়োজনীয় কিন্তু একমাত্র নয়, সে বিশ্বাস র্থ ছাড়াও করে সম্পদ মানে জ্ঞান, যোগাযোগ, নেতৃত্ব আর সঠিক পথ চিন্তা
@ আপনারা অবশ্যই WATAGএর বন্ধু হোন
@ যারা বাংলার শহরের বাইরে থাকেন, বা গ্রামে পরম্পরার উদ্যমের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে, তারা তাদের অঞ্চলের পরম্পরার উতপাদিত দ্রব্য(শিল্প চাষ আর সেবা) http://watag.in/এ দেওয়ার জন্য WATAGএর সঙ্গে যোগাযোগ করুণ
@ WATAG সাংগঠনিক এবং ব্যক্তি সদস্য করাবার উদ্যোগী হোন, প্রথম বছর ২০০ টাকা পরের বছর ১০০ টাকা - সাংগঠনিক সদস্য হতে গেলে ন্যুনতম ২০ জনকে নিয়ে সদস্য হতে হবে
@ জেলায় জেলায় সাঙ্গঠনিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে পরম মাটির মত আপণ খুলতে উদ্যোগী হোন - WATAG আপনার পাশে দাঁড়াবে

---- আরো সব কিছু ভাবনা ভাবতে শেখান - আপনাদের সংগঠন হিসেবে WATAGএ আপনাদের নেতৃত্ব চাই।

Monday, June 27, 2016

Anecdotes of Aurangzeb – আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান

প্রথম খণ্ড

৭। খাজ্বার যুদ্ধ

সুজার বিরুদ্ধে লড়াইতে নামার আগের দিনে রাত যখন সাড়ে সাত ঘন্টা কেটেছে, আওরঙ্গজেব জানতে পারলেন, (শিবির পাল্টানো)রাজা যশোবন্ত সিংকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে(সুজার পক্ষে লড়াইয়ের) অগ্রগামী সৈন্যদল পরিচালনার। তখন আওরঙ্গজেবের সৈন্য সংখ্যা গোলান্দাজ আর পদাতিক নিয়ে ১৪০০০, এবং পথে পড়া কেন্দ্রিয় সৈন্যবাহিনীর একটা শিবির লুঠ করে বেশ কিছু গোলা আর পশু সম্পদ উদ্ধার করেছেন তিনি। বিপক্ষের সৈন্য কিছুটা হলেও ছিন্নভিন্ন। খবর পেলেন সেই বাহিনী শয়তান যশোবন্ত সিংএর সঙ্গে যোগ দিয়ে তার বিরুদ্ধে লড়াইএর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি তখন তাহাজ্জুদ নামাজে বসে; যশোবন্তের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের দিকে হাত তুলে বললেন, ‘সে যদি যেতে চায়, তাঁকে যেতে দাও’ কিন্তু আর কিছু বললেন না। নামাজ শেষ করে মীর জুমলাকে ডেকে বললেন, ‘যেসব ঘটনা ঘটছে সর্বশক্তিমানের ইচ্ছেতেই ঘটছে, এবং যুদ্ধের মধ্যে যদি এই ভণ্ডটি যদি এই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তাহলে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া মুশকিল’।

তক্ষুণি তিনি দুন্দুভি বাজানোর আর বাহিনীকে বিলম্বে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে একটা হাতর পিঠে চড়ে সারা রাত তার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ প্রান্তরের দিকে চললেন।

প্রভাতের আলো ফুটতেই বোঝা গেল, সুজার সেনা বাহিনী বাঁদিক থেকে আক্রমন করেছে। সেদিকে আওরঙ্গজেবের একটা ছোট কামান বাহিনী রয়েছে। কিছু অসহায় মানুষের জীবন গেল। সঙ্গে সঙ্গে আওরঙ্গজেব তার মাহুতকে চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন, ‘যে কোন উপায়ে তুই আমাকে সুজার হাতির কাছাকাছি নিয়ে চল’। তখনই সম্রাটের পরামর্শদাতা এবং ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মুরশিদ কুলি সম্রাটের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বললেন, ‘সম্রাটের এই ধরণের স্পর্ধা দেখানো ঠিক নয়’। আওরঙ্গজেব উত্তর দিলেন, ‘আমরা কেউই এখোনো সম্রাট হই নি। এই ধরণের ডাকাবুকো কাজ করেই মানুষ সম্রাটের স্তরে উন্নীত হয়, এবং আমাদের কেউ একজন যদি সম্রাট হয়, এবং তার পরেও যদি এই ধরণের সাহস লোপ পায়, তাহলে তার ক্ষমতা বেশিদিন থাকবে না’।

(কবিতা) ‘মানুষই একমাত্র তার গোষ্ঠীর বধুর হাত কঠিনভাবে জড়িয়ে ধরতে পারে/ সেই একমাত্র তার আত্মীয়ের তরবারিতে চুমু দেয়’।
.
মন্তব্য – খাজ্বার যুদ্ধ হয়েছিল ৫ জানুয়ারি ১৬৫৯ সালে। এবং সুজার বাহিনী বিসদৃশভাবে পরাজিত হয়। কামানের যুদ্ধ হয় তবে কম। সুজা তার বাহিনী নিয়ে বাঁদিক থেকে আক্রমন করে। মাসিরউলউমরা বলছে, দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের সুবাদারির আমলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব আমলা খুরাসানি, ধারমত যুদ্ধে নিহত হন, ফলে তিনি কোনভাবেই খাজ্বা যুদ্ধে থাকতে পারেন না। আরেকজন মুরশিদ কুলি খাঁ বাংলার নবাব, সাম্রাজ্যের সেবায় বহু পরে বেতনভুক্ত হন, আর তাহাজ্জিদ মধ্যরাত্রির পরের আদায় হয়।
(চলবে)

Sunday, June 26, 2016

Anecdotes of Aurangzeb – আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান

প্রথম খণ্ড

৬। সিংহাসনের লড়াই এবং আওরঙ্গজেবের সতর্কতা

আওরঙ্গজেব আওরঙ্গাবাদে দারার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে আরসুল শহরের চার মাইল দূরে শিবির ফেললেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, তাঁর সেনাবাহিনীর নানান চাহিদা পূরণ করতে দশ দিনের যাত্রাবিরতি দেওয়া হল। কেউ তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা করত না। সত্যবাদী, সাহসী একমাত্র নাজাবত খাঁ বললেন, ‘প্রথমে আপনি যাত্রার নির্দেশ দিলেন, তারপর দীর্ঘদিন ব্যাপী শিবির গাড়ার নির্দেশ দিলেন। এতে বিপক্ষ উতসাহী করবে’। মৃদু হেসে আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আময় বল কি করে শত্রুরা উতসাহী হবে, তাঁর পরে আমি তোমার উত্তর দেব’। খাঁ বললেন, ‘যখন শত্রু আমাদের এখানে দীর্ঘ দিনের অবস্থানের খবর পাবে, তখন তারা বিশাল সৈন্য বাহিনী পাঠাবে আমাদের পথ রোধ করতে’। তিনি উত্তর দিলেন, ‘এটাই আমি চাই। আমি যদি তাড়াতাড়ি যেতাম তাহলে (দারার)গোটা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হতে হত। কিন্তু যদি আমি এখানে কিছু দিনের জন্য বসে যাই, তাহলে আমি তাদের প্রথম বাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারব। আর যদি সে নিজে নর্মদা পার করে তাহলে তাঁর অবস্থা হবে এই রকম-
যে মানুষটি তাঁর আশ্রয়, তাঁর বাড়ি ছেড়ে বহুদূর যায়,/ সে অসহায় দরিদ্র, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে,/ জলে সিংহকে মাছে খায়/ শুকনো ডাঙ্গায় কুমির খায় পিঁপড়ে।
ঠিক এই জন্যই আমি দেরি করছি, সময় হরণ করার জন্য নয়। এছাড়াও আরও একটি উদ্দেশ্য আছে, সেটি হল আমার সঙ্গে যারা (যুদ্ধে) যাচ্ছে, গরীব ধনী নির্বিশেষে তাদের চরিত্র আমি জানতে ইচ্ছুক। কোন ধনী যদি তাঁর স্বচ্ছলতার জন্য দেরি করে তাহলে তাকে আর বেশি দূর না নিয়ে যাওয়াই ভাল, কেননা ভবিষ্যতে সে বাহিনীর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আমার সঙ্গে যে সব অভিজাতরা যোগ দিতে যাচ্ছে, এবং যাদের আন্তরিকতায় আমি দ্বিমত পোষণ করছি, তারা হয়ত দেরি করবে, অমনযোগী হবে, এবং আমার শিবির থেকে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকবে, এবং যাত্রায় সেই শয়তানি দূর করা সম্ভব হবে না, হয় আমাদের তাদের ছুঁড়ে ফেলতে হবে, না হয় আমায় ফিরে আসতে হবে এবং তাদের নতুন করে বোঝাতে হবে’।

নাজাবত খাঁ এই বাক্য শুনে আওরঙ্গজেবের পদ চুম্বন করল, এবং বলে উঠল, ‘সর্বশক্তিমান জানেন কখন কাকে উচিত কাজে নিয়োজিত করতে হয়’।
আওরঙ্গজেবের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল। মির্জা শাহ নাওয়াজ খাঁ, দাক্ষিণাত্যে নিযুক্ত মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম আধিকারিক, আওরঙ্গজেবের সঙ্গে প্রথম দিনের কুচকাওয়াজে যোগ দিতে এলেন না; দ্বিতীয় দিনের কুচে তাঁর পত্র এল, ‘আমি সম্রাট শাহজাহানের বিশ্বস্ত ভৃত্য হিসেবে বলতে পারি আমি আমার সেনার সব পদ থেকে পদত্যাগ করছি। আমার দারা শুকোর সঙ্গে কোন সংস্পর্শ নেই। আমার এক কন্যা আপনার সঙ্গে বিবাহ হয়েছে, অন্য জনের সঙ্গে মুরাদ বক্সের। দারার সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই যে তাকে আমায় শ্রদ্ধা করতে হবে। মহামহিম আপনি জানেন, আমি কোন যুদ্ধে বা শিবিরে কোন কিছুতেই ভীরুতার বশ্যতা স্বীকার করি’।

উত্তরে আওরঙ্গজেব জানালেন, ‘ঠিকই, লবনের অনুগত্যর অপরিহার্যতা, তোমার মত সত্যকারের রক্তের সম্পর্কের মানুষের কাছে আশা করা যায়। কিন্তু আমি এখানে কিছু দিন শিবির ফেলে আছি। আমি কিছু দিন দৈনিক তোমায় এখানে দেখতে চাই, আর আমি যখন এখান থেকে তাবু ওঠাব তখন তোমায় ছুটি দেব। আর তুমি যদি ব্যক্তি(ফাকির) হয়ে যাও তাহলে আর তোমার জরুরত কি?’ শাজ নাওয়াজ উত্তর দিলেন, ‘এটাও এই ভৃত্যের দায়িত্বের বাইরে। আমি বংশগতভাবে সম্রাট শাহজাহানের আনুগত্য স্বীকার করেছি’।

এর পরে আওরঙ্গজেব রটিয়ে দিলেন তাঁর পেট খারাপ হয়েছে। তিনি আদেশ দিলেন, যারা তাঁকে দেখতে আসবেন, তাঁর তাঁবুতে আসবেন একা, দেহরক্ষী ছাড়াই। দ্বিতীয় দিনে যখন মির্জা শাহ নাওয়াজ খাঁ এলেন ‘অসুস্থ’ আওরঙ্গজেবকে দেখতে, শেখ মীর তাকে অবিলম্বে হাত বেঁধে গ্রেফতার করল। এবং তখনই তাঁবু তোলার নির্দেশ দিয়ে, সেই অবস্থায় তাকে হাতির হাওদায় চড়িয়ে যাত্রা শুরু করল বাহিনী। বুরহানপুরে তাঁকে কয়েদ করা হল। দারা শিকোকে হারাবার পরে জেবউন্নিসা বেগম খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিলেন তিনদিনের জন্য – তাঁর অনুরোধ, তাঁর মামাদাদুকে ছেড়ে দেওয়া হোক – এবং আওরঙ্গজেব ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে মুক্তি দিয়ে আহমেদাবাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করলেন, এই সুবায় মুরাদ বক্সের পর আর প্রশাসক ছিল না। কিন্তু আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আমি মনে শান্তি পাচ্ছি না মানুষটার জন্য(তাকে বিশ্বাস করতে পারছি না), আমাকে বাধ্য হয়ে এই নির্দেশটা দিতে হয়েছে, আমি এই নির্দেশ কিছু দিন পরে নতুন করে মূল্যায়ন করব। সে সৈয়দ, ফলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া খুব কঠিন। নাহলে একটা কথা আছে, কাটা মুণ্ডু কোন গল্প বলে না।

যা আওরঙ্গজেব বলেছিলেন তাই হল। দারার সঙ্গে খাঁ যোগ দেন। আজমেরে যুদ্ধের মধ্যেই তিনি মারা যান।

মন্তব্য – আওরঙ্গজেব আওরঙ্গাবাদ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৬৫৮তে যাত্রা করেন সিংহাসন দখলের লড়াইতে। আরসুলে তিনি একদিন থাকেন(আলমগিরনামা)। বুরহানপুরে একমাস থাকতে হয়। ‘শাহ নাওয়াজ খাঁ আওরঙ্গজেবের সঙ্গ দেন না, বহুরানপুরে নানান আছিলায় দিন কাটাতে শুরু করেন। ২২ মার্চ মাণ্ডুয়ায় পৌছন। সেখানে থেকে আওরঙ্গজেব মুহম্মদ সুলতান এবং শেখ মীরকে বুরহানপুর পাঠান শাহ নাওয়াজ খাঁকে গ্রেফতার করতে। শাহ নাওয়াজ আওরঙ্গজেবের শ্বশুর। এবং উচ্চবংশের সৈয়দ। সেপ্টেম্বরে মুলতান থেকে আওরঙ্গজেব তাঁকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং গুজরাটের সুবাদার নিয়োগ করেন। ১৪ মার্চ ১৬৫৯তে তিনি আজমেরের যুদ্ধে নিহত হন।
(চলবে)

Anecdotes of Aurangzeb – আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান

প্রথম খণ্ড

৪। পুত্রদের প্রসঙ্গে

সম্রাট শাহজাহান মাঝে মাঝে বলতেন, ‘আমার প্রথম পুত্র(দারা শুকো) ভাল মানুষদের শত্রু করে তুলছে; মুরাদ বক্স মদ খেয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে; মহম্মদ সুজার ভালত্ব ছাড়া আর কোন গুণ নেই। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সঙ্কল্প আর বুদ্ধিমত্তা প্রমান করেছে, সেই একমাত্র এক দুর্যোগপূর্ণ কাজটি(ভারত শাসন) সামলাতে পারবে। কিন্তু তার রোগভোগ আর দৈহিক অস্বাস্থ্য আমায় চিন্তায় ফেলেছে।

(কবিতা) তাহলে তিনি আর কাকে বন্ধু বলে ভাবতে পারেন/ এবং কাকে তিনি তার হৃদয় দিয়ে যাবেন।

৫। জয়নাবাদীর সঙ্গে প্রেম

জয়নাবাদীর সঙ্গে প্রেম হয়েছিল এই প্রকারেঃ
দাক্ষিণাত্যে তাকে সুবাদার করার পর তিনি তার সদর আওরঙ্গাবাদের দিকে যাচ্ছিলেন, বুরহানপুরে তিনি পৌছলেন, সেখানের শাসক ছিলেন সাইফ খাঁ(যিনি আসফ খাঁয়ের কন্যা, শাহজাদার মামি, সালিহা বানুকে বিয়ে করেছিলেন। তার সঙ্গে আওরঙ্গজেব দেখা করতে গেলেন। সালিহাও তাকে নেমন্তন্ন করলেন। তার মামির প্রাসাদে, আওরঙ্গজেবের চোখের সামনে থেকে হারেমের কন্যাদের দূরে রাখার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করে নি। এবং আগমন বার্তা সূচিত না করেই শাহজাদা প্রাসাদে পৌছলেন। জৈনাবাদীর পিতৃদত্ত নাম হীরা বাঈ। তিনি তখন একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিলেন ডান হাতে গাছের একটি ডাল ধরে, আর নিচুস্বরে গান গাইছিলেন। তাকে দেখেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে শাহজাদা সেখানেই শুয়ে পড়লেন মূর্ছা যাওয়ার মত করে। সেই সংবাদ তার মামীর কানে পৌঁছল। প্রাসাদে খালিপায়ে ছুটতে ছুটতে এসে তিনি আওরঙ্গজেবকে তার বুকে তুলে নিয়ে কান্না শুরু করলেন দীর্ঘস্বরে। শাহজাদা তার জ্ঞান ফিরে পেলেন ৩ বা ৪ ঘড়ির পর। এবারে তিনি তাকে প্রশ্নের বাণ ছুঁড়ে দিতে শুরু করলেন, ‘এই রোগটা তোমার হল কি করে? এরকম মুর্ছা কি তুমি এর আগে গিয়েছ’? ইত্যাদি। শাহজাদা চুপ করে থাকলেন কোন উত্তর না দিয়ে। আনন্দ, বিনোদন, আতিথেয়তা আর উচ্ছ্বাস সব নষ্ট হয়ে গেল। সক্কলেই কেমন থম মেরে গেলেন। মধ্যরাত্রে শাহজাদা ফিরে পেলেন তার বাক্যশক্তি। ‘আমি যদি আমার রোগ বলি তাহলে আপনি কি তার নিদান দিতে পারবেন’? এই বাক্য শোনার পরে তার মামী উত্তেজিত হয়ে উঠে তার সমস্ত কিছু উজাড় করে কুরবান এবং তাসদ্দক দিতে চাইলেন, বললেন, ‘আপনি কি ধরণের নিদান চাইছেন? আমি আপনাকে সুস্থ করে তুলতে আমার জীবন কুরবান দেব’। তখন শাহজাদা তাকে সব কিছু বললেন খুলে। শুনে তার তো জিভ আটকে গেল, কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। তখন আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আপনি খালিই আমার স্বাস্থ্য-কল্যাণ করতে গিয়ে বেকার অনেক কথা বলেছেন। আপনি যদি আমার নিদানের কোন বার্তা না দিতে পারেন, তাহলে আপনি কি করে আমায় সুস্থ করবেন ভাবছেন!’ উত্তরে মামী বললেন, ‘আমি কি আপনার বলি হব? আপনি অমানুষ সইফ খাঁকে জানেন। তার মত রক্ত খেকো মানুষ বিশ্বে বিরল। তিনি আপনি কেন সম্রাট শাহজাহানকেও পাত্তা দেন না। আপনার অনুরোধ শুনে তিনি প্রথমে হিরা বাঈকে কাটবেন, তাঁরপরে আমাকে হত্যা করবেন। তাকে আপনার প্রেমের কথা বলা মানে আমার জীবন কুরবান করে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু কোন দোষ ছাড়া কেন তার জীবন যায়?’ শাহজাদা বললেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন। আমাকে অন্য কোন পথ নিতে হবে’।

সন্ধ্যার পরে শাহজাদা তার ঘরে ফিরে এলেন। কিচ্ছু খেলেন না। তার অধীন দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান মুরশিদ কুলি খাঁকে ডেকে তিনি পুরো ঘটনাটা বিশদে আলোচনা করলেন যদি কোন সূত্র মেলে। মুরশিদ উত্তর দিলেন, ‘প্রথমে আমি সইফকে ঠিকানা লাগাই(হত্যা করি)। এবং তার পরে যদি কেউ আমায়, আমার সন্ত, আমার পথ প্রদর্শকের কাজ সিদ্ধ করার জন্য হত্যা করে, তাতে আমার কোন হতাশা হবে না, কেননা আমার রক্তের দামে আপনার ইচ্ছে পূরণ করা গেল’। উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি জানি তুমি নিজেকে কুরবানি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার হৃদয় চাইছেনা আমার মামিকে বিধবা করতে। আর কোরানিয় আইনে হত্যা করা পাপ। তুমি সর্বশক্তিমানের নাম নিয়ে সইফ খাঁএর সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা কর।’ মুখের একটা রেখা না বদলে, সেই মূহুর্তে মুরশিদ কুলি বেরিয়ে পড়লেন সইফের সঙ্গে কথা বলতে। সইফ উত্তর দিলেন, ‘শাহজাদাকে আমার সালাম জানাবে। আমি তাঁর মামিকে এই উত্তরটা দেব’। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জেনানা মহলে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘এটায়ক্ষতি কোথায়? আমার আওরঙ্গজেবের বেগম, শাহ নওয়াজ খাঁয়ের কন্যার প্রতি বিন্দুমাত্র লোভ নেই। তাকে বল গিয়ে তাঁর হারেম থেকে তাঁর উপপত্নী ছত্তর বাঈকে (হীরা বাঈয়ের সঙ্গে) বদল করতে’। সইফ আওরঙ্গজেবের মামিকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে তাঁর কাছে যেতে বলল; তাঁর স্ত্রী নিমরাজি হতেই সইফ হুমকি দিল, ‘নিজের জীবন যদি চাও তাহলে চিঠি নিয়ে যাও’। তাঁর যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না, শাহজাদার সামনে গিয়ে সব বলতে বাধ্য হল। খুশি হয়ে উত্তেজিত স্বরে শাহজাদা বললেন, ‘আমার হারেম থেকে একজন দিতে কি ক্ষতি? তাকে এক্ষুনি পালকি বাহনে পৌঁছে দিন, এবং আপনারা দুজনে চলে আসুন, আমার কোন আপত্তি নেই’। একজন খোজাকে দিয়ে সেই বার্তা পাঠালেন তাঁর স্বামীর কাছে। সইফ উত্তর দিলেন, ‘আর কোন ঘোমটা থাকল না’, এবং কোন বিলম্ব ছাড়াই বাঈকে শাহজাদার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

মন্তব্য – এই বর্ণনায় বহু ভ্রান্তি রয়েছে। সইফ খাঁ, মমতাজ মহলের বড় দিদি মালিকা বানুকে বিয়ে করেছিলেন(সালিহা বানু নয়)। শাহজাহানের সিংহাসনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই খন্দেশ থেকে তাঁর কর্মচ্যুতির নির্দেশ হয়, আর তিনি সরকারি কাজ ফিরে পান নি। ১৬৪১এর ২৫ আগস্ট মালিকা মারা যান। ১৬৪০এ তাঁর পতি সইফ খাঁ মির্জা সফি বাংলায় প্রাণ হারান(সূত্র পাদশা)।

মনে হয় মাসিরউলউমারায় যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা কিছুটা কাছাকাছি যায়-
শাহজাহানের ২৩তম(পাণ্ডুলিপি পাঠে ৩০ এবং ৩ দুটোই ভুল সংখ্যা আছে) বছরে(১৬৪৯-৫০) আসফ খাঁএর জামাই, মীর খলিলকে(উপাধি ছিল মুফতাখর খাঁ, সিপাহদার খাঁ এবং খানইজামান) দাক্ষিণাত্যে কামান বাহিনীর প্রধান করে পাঠানো হয়। ১৬৫৩ সালে তিনি ধারুরএর মনসবদার হন। একমাত্র আওরঙ্গজেবের সময় তিনি খণ্ডেশের সুবাদার হন(জুলাই ১৬৮১, মৃত্যু ১৬৮৪)। তাঁর সিংহাসনে বসার আগে থেকেই আওরঙ্গজেব জিয়ানাবাদীকে ভালবাসতেন। তিনি খাঁএর হারেমে ছিলেন। একদিন শাহজাদা তাঁর হারেমের সঙ্গীদের নিয়ে জৈনাবাদ বুরহানপুরের হরিণ বাগানে ঘুরতে গিয়েছেন। শাহজাদার মামী(খানইজামানের স্ত্রী)কে গান শেখাতে আসা জৈনাবাদী শিক্ষিতা গায়িকা এবং চাটুকারিতাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি শাহজাদাকে সামনে দেখেও পাত্তা না দিয়েই ফলাবনত আম গাছ থেকে আম পাড়তে শুরু করেন। এই ঘটনা শাহজাদার হৃদয় চুরি করে নিল। আওরঙ্গজেব তাঁর সমস্ত ধর্মীয় শিক্ষা, সন্তভাব ঝেড়ে ফেলে, নিজের ওপর সব রকমের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লজ্জাহীনভাবে ছলেকৌশলে তাকে মামীর প্রাসাদ থেকে হাসিল করলেন। গল্প বলা হল একদিন সব ধর্মতাত্ত্বিকতা বিসর্জন দিয়ে, তার ধর্মীয় প্রকৃতিকে প্রায় অসম্মান জানিয়ে জৈনাবাদী শাহজাদাকে একপাত্র সুরা পান করতে অনুরোধ করেন। হৃদয়হারা শাহজাদা তা পান করতে উদ্যত হলে, সেই ধূর্ত যাদুকরী তাঁর হাত থেকে পাত্রটা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য ছিল, আপনার প্রেম পরীক্ষা, কোনভাবেই এই অভাগা মদ পান করানো নয়’। এই প্রেম কাহিনী শাহজাহানের কানে পৌঁছল। আওরঙ্গজেব বিদ্বেষী দারা শুকো এই ঘটনায় সম্রাটের কানে বিষ ঢাললেন, ‘এই মিথ্যাবাদী ভণ্ড দুর্বৃত্তকে দেখুন! তাঁর মামীর বাড়ির পোষা কুত্তির দিকে তাঁর নজর গিয়েছে!’ কিছুদিনের মধ্যেই জৈনাবাদীর মৃত্যু হয়। আওরঙ্গজেব তাকে আওরঙ্গাবাদের এক বৃহৎ দীঘির পাড়ে সমাধি দেন। তাঁর মৃত্যুর এক দিন পর আওরঙ্গজেবের শরীর খারা হয়। তাঁর পার্শ্বচর মীর আসকারি(আকিল খাঁ) একান্তে তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘এই ধরণের হৃদয় বিদারক অবস্থায় কোন জ্ঞানের কথা বলা উচিত, যাতে হৃদয় শান্ত হয়’। তখন শাহজাদা কবিতায় উত্তর দিলেন,

‘ঘরে বসে হাহাকার, কোন হৃদয়কে শান্ত করে না,/ একান্ত একা থাকাই কান্নায় হৃদয়ের তপ্ত কটাহ শান্ত করে।

এর উত্তরে আকিল খাঁ বললেন,
কত তাড়াতাড়ি ভালবাসা উদয় হয়, কিন্তু কি সুকঠিন সে,/ কি সুকঠিন বিচ্ছেদ, কিন্তু প্রেমাস্পদকে কে শান্তি দেবে’।

শাহজাদা তাঁর চোখের জল আটকাতে পারলেন না, পদ্যটির লেখকের নাম জানতে চেয়ে সেটি তাঁর স্মৃতিতে রেখে দিলেন।

মানুচি এই গল্পটা এইভাবে বলেছেন,
‘তাঁর হারেমের নাচনেওয়ালির প্রতি আওরঙ্গজেব মন দিয়ে ফেলেন। প্রেমের জন্য তিনি তাঁর নামাজ, তাঁর পড়াশোনা, তাঁর নিয়মনিষ্ঠা সব হারাতে বসেছিলেন। তাঁর জীবন কাটছিল সঙ্গীত আর নাচের মহফিলের মধ্যে দিয়েই। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেকে মদ্যের ভিতর ডুবিয়ে ফেলেন। নাচনেওয়ালির মৃত্যুর পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জীবনে আর কোন দিন তিনি মদ ছোঁবেন না, গান শুনবেন না। পরের দিকে তাকে বলতে শোনা যেত, সর্বশক্তমান খোদা তাকে টেনে নিয়ে আওরঙ্গজেবকে উদ্ধার করেছেন’।

কিন্তু কবে এই ঘটনাটা ঘটল? আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হন দুবার – ১৬৩৬-১৬৪৪ আর ১৬৫৩-১৬৫৭। এই দ্বিতীয়বারের সুবাদারিতে মুরশিদ কুলি খাঁ খুরাসানি এবং মীর আসকারি তাঁর অধীনে কাজ করতেন। ১৬৫৩তে আওরঙ্গজেব ৩৫ বছর বয়সী এবং ছয় সন্তানের পিতা; মনে হয় না তখন যে রকম তাকে হৃদয়হারাভাবে উপস্থাপনা করা হচ্ছে, তিনি সেই বয়সে এতটা হৃদয় চাঞ্চল্য বোধ করবেন। আকবর নিয়ম করে যান, উপস্ত্রীদের নাম হারেমে আসার আগে তাদের শহরের নামে নাম হবে(সূত্র পাদসানামা)। সেই সূত্র ধতে আমরা মহিলাদের নাম পাচ্ছি আকবরাবাদী, ফতেপুরী, আওরঙ্গাবাদী, জয়নাবাদী এবং উদিপুরী। বুরহানপুরের তাপ্তি নদীর তীরের জৈনাবাদ। ইনায়াতুল্লার আহকমএ আমাদের নায়িকার কবরের কথা উল্লিখিত আছে, যদিও সেখানে তাঁর নাম ভুল ভাবে বলা হয়েছে জৈনপুরী।
(চলবে)

Anecdotes of Aurangzeb – আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান

আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান

প্রথম খণ্ড

৩। যুবা আউরঙ্গজেবের অভিজাতদের সম্মান

শাহ জাহানের খুব কাছের অভিজাত, পাঁচহাজারি মনসবদার আলি মর্দান খাঁ, শাদুল্লা খাঁ, বারহার সৈয়দ মীরণ, এঁদের কারোর সঙ্গে দারা খুব বিনীত ব্যবহার করতেন আবার কারোর সঙ্গে হয়ে উঠতেন খুব দুর্বিনীতও। কিন্তু এঁদের সক্কলের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের সম্পর্ক ছিল খুব মধুর। শাহ জাহান যাকে বলতেন বিশ্বস্ত বন্ধু, সেই আলি মর্দান খাঁকে আকবর চিঠিতে সম্বোধন করছেন, সৎ কাজের মানুষ, শাদুল্লা খাঁকে সম্বোধন করছেন, প্রচুর পরিকল্পনার মন্ত্রী এবং বিনীত ছাত্রদের মাথা, বারহার সৈয়দ মীরণকে বলছেন সৈয়দদের সৈয়দ বা নবীর উত্তরপুরুষের বিশ্বের সৈয়দ বা মুহম্মদ। এই তিনজনের প্রত্যেকে এবং অন্যান্যরা যেমন আফজল খাঁ মুল্লা আলাউলমুলক, যিনি খানইসামান থেকে উন্নীত হয়েছিলেন উজির পদে, সক্কলে আওরঙ্গজেবকে অতি পছন্দ করতেন এবং তাঁর অবর্তমানে সাম্রাজ্যে শাহজাদার স্বার্থ যাতে বজায় থাকে তা লক্ষ্য রাখতেন। শাহইবুলন্দইকবাল বা দারা শুকোর কপালে দুর্দিনের চিহ্ন আর আওরঙ্গজেবের কপালে সুদিনের চিহ্ন দেখে শাহ জাহানের হৃদয় ভেঙে পড়েছিল। তিনি দারাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ভুল কাজ না করতে। কিন্তু যখন দেখলেন যে দারা শুকো তার শুভ বার্তায় কান দিচ্ছে না, তখন তিনি বললেন (কবিতা) ...যদি কোন মানুষের ভাগ্য কালো রঙে বোনা হয়, তাহলে জিমজম(মক্কার পুণ্য কুঁয়ো) বা কওসরের(স্বর্গের ঝরণা) জল দিয়ে তা ধুলেও কালো রং সাদা করা যায় না ...তিনি মনেমনে আশা করতেন আওরঙ্গজেব আভিজাতদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করুক যাতে অভিজাতরা আওরঙ্গজেবের অবর্তমানে আওরঙ্গজেবের স্বার্থ না দেখে।

একটি রাজকীয় চিঠিতে আওরঙ্গজেবকে শাহ জাহান নিজের হাতে লিখলেন, ‘বেটা, সম্রাট আর তাদের বাচ্চাদের আত্মা হওয়া উচিত সুউচ্চ এবং মনের বিকাশ হওয়া উচিত আকাশের মত। আমি শুনেছি, আমার দপ্তরের প্রত্যেকের সঙ্গে, তোমার দিক থেকে অন্তত তুমি খুবই বিনীত ব্যবহার কর। তুমি যদি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এই কাজটি করে থাক, তাহলে জানবে সব ঘটনাই সর্বশক্তিমান সাজিয়ে রেখেছেন, তোমার আত্মার নম্রভাব তোমায় কোথাও পৌঁছে দেবে না, এর বদলে তুমি শুধুই অবজ্ঞা পাবে’। এর উত্তরে আওরঙ্গজেব লিখলেন, ‘দয়া, আনুকূল্য দেখিয়ে আপনার সুমিষ্ট কলমে আপনি এই বিনীত দাসকে যা আজ্ঞা দিয়েছেন, তা আমার কাছে যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা দৈববানী। আপনি সত্যি সন্ত এবং আত্মার পথ নির্দেশক। এই লেখা লিখে আপনি যে সম্মান আমাকে প্রদান করলেন, সেটা প্রমান করে আপনার নিরহঙ্কারতা। কিন্তু সম্মান নির্ভর করে মালিক দাস এবং শহর আর বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা তাদের ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন তার ওপর। আপনি যা লিখেছেন, তার বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু আমি বলতে চাই, আমি জানি যে, শয়তানের কাজ হল মানুষের মনে সন্দেহর বীজ উপ্ত করা, সে ভূত একজন আমাদের মধ্যেই রয়েছে’।
(কবিতা)আমার পাপ খণ্ডন কর, ছাড়া আমি কিছুই বলি না/আমার পাপ ক্ষমা কর, সাদামুখে এবং কালো স্মারকে নরাধম আমি।

মন্তব্য – মুল্লা আলাউলমুলক তুনি ফাজিল(আফজল নয়) খাঁকে তৈরি করেন এবং শাহজাহান তাঁকে খানইসামান পদে বসান। আওরঙ্গজেব তাকে উজিরের পদ দেন ৭ জুন ১৬৬৩তে কিন্তু মারা যান ২৩ তারিখে। আবু হামজা আনাস ইবন মালিক ছিলেন মহম্মদের শেষ রক্ষক।
(চলবে)

Anecdotes of Aurangzeb – আহকমইআলমগিরি - আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান



(এই প্রকাশনাটা আগে হওয়া দরকার ছিল)

আওরঙ্গজেবের উপখ্যান
(পার্সি থেকে অনুদিত)
প্রথম খণ্ড
আওরঙ্গজেবের নিজের কাহিনী
১। যুবা আওরঙ্গজেবের হাতির সঙ্গে লড়াই
তখন সম্রাট শাহজাহান লাহোরে ছিলেন। শালিমার বাগানে তিনি প্রায়ই হাতির যুদ্ধ দেখতেন। বাংলা সুবার দেওয়ান তাকে একদা ৪০টা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হাতি পাঠিয়েছিল। সম্রাট ঝুল বারান্দায় বসে – তাঁর চার পুত্র ঘোড়ায় চড়ে রয়েছেন। উল্টো দিকে দাঁড়ানো যুথের মধ্য থেকে একটি হাতি শাহজাহাদের দিকে ছুটে এগিয়ে আসতে থাকে। সম্রাটের পুত্রদের মধ্যে তিনজন সেই মূহুর্তে ডানদিকে ঘুরে পালিয়ে গেল। একটুও ভয় না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন শুধু চৌদ্দ বছরের আওরঙ্গজেব। দৌড়ে আসা হাতিটি আকবরের পাশ দিয়ে চলে যায়। অন্য শাহজাদারা পালিয়ে যাওয়ায় সেটি আরংজেবের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। আওরঙ্গজেবের হাতে তখন শুধু একটি বল্লম। তিনি অস্বাভাবিক দ্রুততায় হাতিটিকে আক্রমন করলেন। হাতির শুঁড়ের আঘাতে শাহজাদার ঘোড়াটি পড়ে গেল। পড়ে গিয়েও আওরঙ্গজেব বল্লমটি ছাড়েন নি। তিনি বল্লমটি হাতির মাথা তাক করে ছুঁড়বেন বলে ঘুরে দাঁড়ালেন। ঝুল বারান্দায় সম্রাট উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন নেমে আসছেন, এমত সময়ে প্রহরীরা ছুটে গিয়ে অবস্থা সামাল দেন। আওরঙ্গজেব আস্তে আস্তে মহামহিমের দিকে হেঁটে আসছেন। সম্রাটের মামার পক্ষের ভৃত্য নাজির ইতিবাদ খাঁ, বৃদ্ধাবস্থায় যতটা পারা যায় দ্রুত এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কান্না জড়ানো গলায় বলতে থাকেন – ‘আপনি সম্রাটের দিকে ধীর পদে এগোচ্ছেন, মহামহিম বিপদাশঙ্কায় অধীর হয়ে পড়েছেন’। শাহজাদা অনুচ্চস্বরে বললেন, ‘হতিটি যদি সেখানেই থাকত আমি হয়ত দ্রুত হাঁটতাম। কিন্তু এখন তো আর উত্তেজিত হওয়ার কোন কারণ নেই’। আওরঙ্গজেবের তাঁর পিতার কাছে পৌঁছবার মাত্র সম্রাট তাকে এক লাখ টাকা ইনাম দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বললেন, ‘পুত্র, খোদাকে ধন্যবাদ, সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে শেষ হল। খোদা না করুন ঘটনাটা যদি অন্যদিকে মোড় নিত তাহলে কি যে অসম্মানের ব্যাপার হত বলা যায় না’। সেলাম জানিয়ে আওরঙ্গজেব উত্তর দিলেন, ‘এটা যদি অন্য ভাবে শেষ হত, তাতে কোন অসম্মান ছিলা না। আমার ভাইয়েরা যা করল, সেটাই চরম অসম্মানের’। কবিতা – মৃত্যু সম্রাটের ওপরেও তাঁর ঘোমটা ছেয়ে দেয়। তাতে কোন অসম্মান নেই।
মন্তব্য – ঘটনাটার বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় আবদুল হামিদের পাদশানামায় – শাহ জাহান আগ্রা দূর্গের ঝুল বারান্দা থেকে হাতির লড়াই দেখতেন(২৮ মে ১৬৩৩)। লড়াই ময়দানে তাঁর তিন পুত্র ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সামনে দাঁড়ান দুটো হাতি। একটি দাঁতালের নাম সুধাকর, দাঁতবিহীন অন্যটির নাম সুরতসুন্দর। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। প্রতিদ্বন্দ্বীরা(শাহজাদা) পালিয়ে যাচ্ছে দেখে সুধাকর আওরঙ্গজেবের দিকে তাক করে ছুটে এল। আওরঙ্গজেব কিন্তু তাঁর ঘোড়াকে সোজা দাঁড় করিয়ে রেখে(পালাতে দেন নি) দৌড়ে আসা হাতিটির কপালে বল্লম ছুঁড়ে মারলেন। হাতিটিকে নিবৃত্ত করতে না পেরে ভৃত্যরা বিভিন্ন ধরণের আতসবাজি(হাউই, চরকি ইত্যাদি) ছুঁড়তে শুরু করে। কিন্তু সেগুলি অগ্রাহ্য করেই হাতিটি তাঁর দাঁতে(শুঁড়ে নয়) করে তাঁর ঘোড়া সহ আওরঙ্গজেবকে মাটিতে ফেলে দেয়। চরম মুহূর্তে আওরঙ্গজেব জিন ছেড়ে লাফ দিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে পড়েন। সুজা হাতের চাবুক দিয়ে হাতিটিকে আঘাত করে ভাইকে সাহায্য করতে আসতে চাইলেও বাজি ফাটানোর বিপুল আওয়াজ, যুদ্ধস্থান ঘিরে থাকা ধোঁয়া, উত্তেজিত মানুষের চিৎকার, গোলোযোগের দেওয়ালে ব্যহত হয়ে, তিনি ভাইয়ের কাছে আসতে পারেন না। সেই সঙ্গে একটা চরকি তাঁর ঘোড়ার কপালে আঘাত করলে ঘোড়াটি চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়তে চায়, সুজা ঘোড়া থেকে পড়ে যান। জয় সিংএর ঘোড়াও স্থানুবত দাঁড়িয়ে থাকে। এই সময়ে সুরতসুন্দর, সুধাকরকে আক্রমন করে। সুধাকর পালিয়ে যায়। আওরঙ্গজেব তখন ১৪ বছরের বালক। সম্রাট তাঁকে ৫০০০ স্বর্ণ মুদ্রা, সুধাকর এবং অন্যান্য উপহার দেন, মোট উপহারের পরিমান ছিল ২ লক্ষ টাকা।
ইতিমদ খাঁকে শাহ জাহানকে দেন তাঁর শ্বশুর ইয়ামিনউদ্দৌলা আসফ খাঁ(সূত্রঃ আবদুল হামিদ, পাদশাহ)।