Monday, February 29, 2016

দেশজ সংস্কৃতিচর্চা - জনরা(জঅনঅরা) - রাজবংশী গহনা







বেশ কয়েক বছর ধরে দিনাজপুরের রাজবংশী রাজত্বে যাচ্ছি। কিছু কিছু বাড়িতে তাঁদের গয়না দেখ মুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু সেগুলি এখন আর তৈরি হয় না প্রায় বললেই চলে।
সত্যিই লুপ্তপ্রায় বললে অত্যুক্তি হয় না।
এটির মূল কাঁচামাল রূপো।
তো অনেকদিন ধরেই এগুলি নতুন করে তৈরি করার পরিকল্পনা চলছিল।
দিন পনের ধরে সাংগঠনিকভাবে সে কাজ শুরু হয়েছে দিনাজপুরে।
সবকিছুর মূলে আমাদের সম্পাদক মধুমঙ্গল মালাকার
কাজ চলছে।
তার কিছু ছবি পাঠিয়েছেন আমাদের নবীনতম সদস্য গৌরব মালাকার - মধুদার ভাইপো, রাজবংশী ভাষায় ভাস্তা।
আপনাদের সক্কলের আশীর্বাদ চাই

উপনিবেশবাদ বিরোধীচর্চা - আর্যভট থেকে আম্বেদকর৩



কোন গবেষক যদি ‘সঠিক’তার দাবি করা উইকিপিডিয়ায় আর্যভট বিষয়ে দেখতে যান তাহলে কিন্তু কোথাও তাঁর জাত সম্বন্ধে একটা কথাও বলা নেই - বরং তিনি যে উপবীতধারী ব্রাহ্মণ, তাঁর চিহ্নওয়ালা একটা মূর্তির ছবি ছাপা হয়েছে সেখানে। পরোক্ষে বলে দেওয়া হয়েছে তাঁর জাত কি, যেভাবে পাঠ্য অঙ্কপুস্তকে কালো গ্রিসের অঙ্কচর্চকদের ককেসাসিয় চেহারার দেখানো হয়। Inter University Centre for Astronomy and Astrophysics (IUCAA), Puneতে এই অনৈতিহাসিক মূর্তিটি রাখা হয়েছে। রাজুজী বলছেন, IUCAAর জনসংযোগ আধিকারিক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রশ্ন করেন আর্যভট পৃথিবীকে কোথায় কদম্বাকার বলেছেন তাঁর উল্লেখ জানতে। তিনি তাঁর যথাবিহিত উত্তর দিয়ে বললেন যে তাঁর নামের বানানটা যেন ঠিক করে নেওয়া হয়। সেই আধিকারিক তাঁকে জানালেন সংস্থার প্রতিষ্ঠাকার জয়ন্ত বিষ্ণু নার্লিকর তাঁকে ঠিক বানানটি জানিয়েছেন। তার উত্তর যখন রাজুজী তাঁকে প্রশ্ন করলেন, তাহলে কেন নার্লিকর সম্পাদিত পাঠ্য পুস্তকে আর্যভটের নাম বিকৃত ছাপা হয়েছে, তিনি সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যান।

IUCAAসূত্রে উইকিপিডিয়ায় যে ছবিটি ব্যবহার করা হল তাতে একটাই বার্তা গেল ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চায় দলিতদের/অব্রাহ্মণদের কোন স্থান ছিল না। ব্রিটিশ অনুগামীরা নতুন ধরণের জাত ব্যবস্থা ভারতে পত্তন করলেন। মেকলে এবং মার্ক্স-এঙ্গেলসদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানে বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে উপনিবেশ উন্নত ছিল – যার তাত্ত্বিক প্রতিধ্বনি বিদ্যাসাগর এবং রামমোহন রায়ের কাজে ছড়িয়ে পড়েছে নব্য জ্ঞানচর্চায় এবং তাঁরা দেশজ পড়াশোনা ছেড়ে ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান পড়ানোর দাবি করছেন বুক বাজিয়ে। বা জেসুইট পাদ্রিরা কনণবিদ্যার অক্ষহৃদয় না বুঝেই নকল করে আর্যভটের হাতে শুরু হওয়া বিদ্যাটিকে ইওরোপে নিয়ে গেলেন। তখনকার শ্রেষ্ঠ ইওরোপিয় মাথা, দেকার্ত আর নিউটন সেটাকে বুঝতেই পারলেন না। এ প্রসঙ্গে রাজুজীর অসাধারণ স্তবকটি তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না - In the spirit of Kant, a reverse racist might say white-skinned people lacked the brains. However, the inferior Western misunderstanding of the calculus, coated with a redundant Western metaphysics, is what is taught in our universities today. Academics (mostly Western dominated) are unwilling to discuss publicly the claim why Western calculus is superior. The claim of superiority will fall to pieces if discussed publicly

আবেদন নতুন করে ভাবি। নতুন করে আমাদের পূর্বজরা যে সভ্যতা তৈরি করে গিয়েছেন তার জোরের জায়গা আলোচনা করি। তবেই তৈরি হবে আন্দোলনের ভিত। নয়ত ফক্কা।

উপনিবেশবাদ বিরোধীচর্চা - আর্যভট থেকে আম্বেদকর২



ভারতের অঙ্ক দর্শন এবং ইতিহাসকার চন্দ্র কান্ত রাজুর দারুণ একটা দুপাতার হিন্দি প্রবন্ধ দলিত ঔর বিজ্ঞান। যদিও আমরা পশ্চিমি মতে ভারতীয় ইতিহাসে যুগ বিভাজনে বিশ্বাস করি না, বলতে পারি প্রাচীন থেকে মধ্যযুগে বাংলার দলিতেরা শুদ্ররা মূলত তান্ত্রিক, বৌদ্ধ, এবং পরে ইসলামি রাজত্বের অংশ হয়ে ঈর্ষনীয় বৌদ্ধিক, কৃষ্টিগত এবং অকেন্দ্রিভূত উৎপাদনভিত্তিক বিশ্বজোড়া বাণিজ্য বিকাশের স্তরে পৌছে ছিল। রাজুজী তাঁর কালচারাল ফাউন্ডেশন অব ম্যাথেমেটিক্স শুরুই করছেন আর্যভট(এই নামের বুৎপত্তি নিয়ে কয়েকদিন আগেই একটা প্রকাশনা দিয়েছিলাম। আশাকরি সেটি মাথায় রয়েছে – শুধু বলি, ক্ষমতায় থাকা মানুষজন যখন আর্যভটকে সুচতুর ভাবে আর্যভট্ট বলতে শুরু করে, সেই উচ্চারণকে পাঠ্যপুস্তকের অংশ করে দেন তখনই ইতিহাসকে নতুন করে দেখতে হয়)এর জ্ঞানচর্চার অবদান দিয়ে। তিনি বিলছেন, আর্যভট used a numerical technique of solving differential equations to compute precise sine values। আজও মঙ্গলে চন্দ্রযান পাঠাতে সেই পদ্ধতিতেই গণনা করতে হয়। এবং আর্যভট প্রথম গোল পৃথিবীকে তুলনা করেছেন কদম্বের সঙ্গে তাঁর গোলধ্যায়৭এ।

গত কয়েক দশকে ঔপনিবেশিক পশ্চমি লুঠেরা বড় পুঁজি নির্ভর কেন্দ্রিভূত প্রযুক্তি/বিজ্ঞানকে উচ্চতর বিশ্বজ্ঞনের শ্রেণীতে ফেলে ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানকে দেশজ জ্ঞান হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছে এবং এটি আমরা সোনা মুখে মেনে নিয়েছি, ঠিক যেমনভাবে ভুলে ভরা পশ্চিমে কলণবিদ্যাকে উচতর জ্ঞানার্জন বলা হয়েছে। এই যুক্তিতে বলা হচ্ছে নিম্নবর্ণের ভাগ্যভাল তাঁরা এই উচ্চজ্ঞানচর্চার বেদীতে আরোহন করছেন। অর্থাৎ কেউ কেউ সফল হচ্ছেন মাত্র, সেটি নিয়ম নয়। কিন্তু ভারতে আর্যভট একমাত্র অউচ্চবর্ণ ছিলেন না। বলা যাবে না তিনি দলিত হিসেবে ভারতীয় জ্ঞানচর্চায় ব্যতিক্রম ছিলেন। ঠিক তাঁর পাঁচ দশক পরে আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় আর্যভট। কৌসাম্বী বা আম্বেদকরের মতে এই সময়ে কিন্তু মনুস্মৃতি সঙ্কলিত হচ্ছিল। তবুও কিন্তু দ্বিতীয় আর্যভট তৈরি হয়েছিলেন। আর পঞ্চম শতের পাটনার আর্যভটের অনুগামী হিসেবে ১৫শ শতে এলেন দক্ষিণ ভারতের উচ্চতম জাতের নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ, যিনি আর্যভট পদ্ধতির অঙ্কবিদ্যাকে চারিয়ে নিয়ে গেলেন নতুন উচ্চতায়। নীলকান্তের পুঁথি শীর্ষক সোমস্তুভমএ তিনি আর্যভট সম্বন্ধে ভাষ্য লিখছেন। আমাদের নতুন করে ঔপনিবেশিক সময়ের তৈরি করা বিভাগকে নতুন করে ভাঙ্গার চিন্তা করতে হবে যেখানে বলা হয়েছে ভারতের জ্ঞানচর্চায় দলিতদের স্থান ছিল না, এবং দুস্তর ভৌগোলিক ব্যবধান ছিল বিন্ধ্যর দুপাশে।

ভারতে জাতিভেদ একটা বাস্তব কাঠামো। সেটা যেমন বাস্তব, তেমনি ভারতীয় জ্ঞানচর্চায়, উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থায় অউচ্চবর্ণের, দলিতদের অবদান উচ্চবর্ণদের থেকে অনেক বেশি। সেটা আরও ঘোর বাস্তব। গত প্রকাশনায় বাংলার উৎপাদন-বিতরণ, জ্ঞানচর্চার পরিবেশ বর্ণনাতে তা কিছুটা চুম্বকে বলা গিয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা এবং তার ধ্বজাধারীদের জ্ঞানচর্চায় নব্য পশ্চিমি জ্ঞানচর্চকদের সূত্রে ভারতে এক্কেবারে অন্য ধরণের জাতিবাদী আখ্যান তৈরি হল। যে ভিত্তিভূমি গড়ে গিয়েছিলেন পূর্বের অব্রাহ্মণ জ্ঞানতাত্ত্বিকেরা, সেই ভিত্তিভূমিকে অস্বীকার করার প্রবণতা শুরু হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ছাতায়।

তাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে উঠলেন আর্যভট। তাঁর জাতি চরিত্র পালটে ফেলার উদ্যম গ্রহণ করা হল। নামের বানান উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে পাল্টে দিয়ে তাঁকে দেখানো হল ব্রাহ্মণ রূপে। ব্রহ্মগুপ্ত কিন্তু তাঁর গুরুর নাম আর্যভট লিখেছেন অন্তত একশ বার তাঁর রচনায়। যে মানুষটি পাইএর মান নির্ণয় করলেন, দশমিক ব্যবস্থাকে জোর ভিত্তি দিলেন, আর্ভটিয়া লিখলেন, আল খোয়ারজমি যার নাম উল্লেখ করেছেন তাঁর রচনায়, যিনি সাইন(জ্যা), কোসাইন(কোজ্যা), ভারসাইন(উতক্রমজ্যা), ইনভার্সসাইন(অতক্রম জ্যা), সাইন নামতা(টেবল) নয়, দশমিকের পরে, শুন্য থেকে নব্বই ডিগ্রি পর্যন্ত ৩.৭৫ ডিগ্রি অন্তরে ভার্সসাইন (1 − cos x) তালিকা সঠিক চার সংখ্যা পর্যন্ত গণনা করেছিলেন, আজও মঙ্গলগ্রহে উপগ্রহ পাঠানো হয় আর্যভটের অঙ্ক কষার পদ্ধতিতে, সেই মানুষটার জাতি চরিত্র পাল্টে দিলেন আধুনিক ভারতের জ্ঞানচর্চকেরা।

Sunday, February 28, 2016

উপনিবেশবাদ বিরোধীচর্চা - আর্যভট থেকে আম্বেদকর১




কয়েকদিন আগেই পড়ছিলাম সঞ্জয় পাসোয়ানের কালচারাল ন্যাশনালিজম এন্ড দলিত বইটি। আমরা, বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ বা গঠিত হতে চলা উইভার, আরটিজান ট্রাডিশনাল আর্টিস্টস গিল্ডের সদস্য, যারা গ্রামজ উতপাদন ব্যবস্থা, প্রযুক্তি আর সংগঠন বিষয়ে অল্পস্বল্প নজর দিয়েছি। আমাদের পথচলা দর্শনের সঙ্গে, এই বইটির ভাষ্য কিছুটা হলেও মিলে যায়। তাঁর বক্তব্য ব্রিটিশ উপনিবেশপূর্ব সময়ে ভারতে দলিতদের অবস্থান খুব খারাপ ছিল না – এই ভাষ্যে কিন্তু তিনি জাত ব্যবস্থায় কোনভাবেই উচবর্ণের অবস্থান সমর্থন করছেন না - আমরাও। তিনি বাল্মিকী, বেদব্যাস, কবীর থেকে রবিদাসের জীবনী আলোচনা করেছেন। দক্ষিণের এজাভা পরিবারের নারায়ণ গুরুর কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। আমরা এখানে বাংলার নানান সম্প্রদায়ের কথা বলতে পারি। সঞ্জয়জী জোর দিচ্ছেন এডাম সমীক্ষার বাংলা-বিহারের শিক্ষা ব্যবস্থার তথ্যে, যেখানে তথাকথিত বর্ণাশ্রমের উপরের দিককার মানুষদের থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক-ছাত্র ছিলেন দলিত মানুষেরা।

আজ ভারতে দলিত আন্দোলন নতুন উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে। অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াইটা তো করতেই হবে, তার আগে প্রয়োজন আমার কি ছিল, সে বিষয়ে নিরন্তর আলোচনা, যার একটি ঝাঁকি আমরা সঞ্জয় পাসোয়ানজীর বইটিতে পেয়েছি, নিজেরা আলোচনা করছি পরম নামক এক চটি মাসিক পত্রিকায়। কি হারিয়েছি, তার হাহুতাশ তো আছেই। কিন্তু যে কেন্দ্রিভূত দর্শনের জাতিবিদ্যা তৈরি হয়েছে ভারতে বিগত কয়েক শতক ধরে ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চায়, তাকে সবার আগে প্রশ্ন করতে হবে। হাজার হাজার বছর ধরে বিকেন্দ্রীভূত, বৈচিত্র্যময়, আসাধারণ এক সভ্যতার ভিত্তিভূমি গড়ে তুলেছেন মূলত দলিতেরা – তাই ভারত সভ্যতা শুদ্র সভ্যতা – দলিত সভ্যতা – এটা বলতে হবে। তাঁরাই পারেন কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে নিজেদের দর্শন দিয়েই প্রশ্ন করতে। বড় পুঁজির দর্শনের ভেতরে দাঁড়িয়ে তা হয়ত হবে না। নতুনভাবে দেখতে হবে বড় পুঁজি ভিত্তিক লুঠেরা পশ্চিমি গণতন্ত্র, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্বের ভিত্তিকে – নিজেদের তৈরি পঞ্চায়েতি গণতন্ত্র, নিজেদের বিকশিত জ্ঞানচর্চার মহিমা দিয়ে। ভারতে তৃণমূল স্তরে আজও সেই দর্শনে টিকে থাকার উদ্যম রয়েছে।

দুঃখের বিষয় সেই উদ্যমের অভাব রয়েছে ইংরেজি শিক্ষিতদ দলিত নেতৃত্বের মধ্যে। তাঁদের অধিকাংশই বড় পুঁজির তৈরি করা বিজ্ঞনের অংশ হতে চান, হতে চান এই উৎপাদন ব্যবস্থার একটি শৃঙ্খল। বিনীতভাবে বলার চেষ্টা করব শিক্ষিত দলিত নেতাদের এই তাত্ত্বিক অবস্থানে বড় পুঁজিরই লাভ – যখন তাঁরা বলেন ‘একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে সমাজ ও সভ্যতায় অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটেছে। সমাজের সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রও প্রসারিত হয়েছে বহুল্যাংশে। আজ প্রত্যন্ত-অজপাড়াগাঁয়ে বসবাসকারী নিতান্ত আখ্যাত, হত-দরিদ্র মানুষও আগামী দিনে উন্নত সভ্যতার সংস্পর্শে এসে নিজের জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখে... ইত্যাদি(সমাজ বিপ্লবে মতুয়াধর্ম, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, সঙ্ঘাধিপতি, মতুয়া মহা সংঘ, শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর স্বর্ণ-সংকলন, পাতা ১৭)’। এ নিয়ে এখন তর্কে প্রবেশ করব না। তোলা রইল।

ভারতকে দলিত সভ্যতা বলতে গেলে নিজেদের জোরের জায়গা, কেন আমরা আলাদা, আমরা কি গড়ে তুলেছিলাম, সেটা জানাতে হবেই। ‘উন্নত সভ্যতা’বিশিষ্ট ‘একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের’ কেন্দ্র বড় শরিকের দর্শনের অনুবর্তী হয়ে হাতেগোণা মানুষ হয়ত স্বচ্ছল থাকতে পারবেন, পিঠ চাপড়ানি পাবেন, কিন্তু নিজস্ব সভ্যতার যে পরিচয় গড়ে উঠেছিল কয়েক সহস্র বছর ধরে, সেই পরিচয় তৈরি হবে না।

Monday, February 22, 2016

উপনিবেশবাদ বিরোধীচর্চা - রাষ্ট্রভাষা বনাম মাতৃভাষা

কয়েক ঘন্টা আগে চাকমা সমাজের এক বন্ধুর তৈরি ছবিতে দেখলাম সেখানে ভাষা বিষয়ে তাঁরা একটা সমঝোতার রাস্তা নিয়েছেন - বলেছেন বাংলা রাষ্ট্রভাষা আর চাকমা আমার মাতৃ ভাষা।
এতো জাতিরাষ্ট্রবাদী নেশন স্টেটের ভাষা।
আমরা ভারতে দেখেছি যে রাষ্ট্রভাষা বা রাজভাষা কিভাবে অন্য ভাষাগুলিকে তিলে তিলে হত্যা করার দিকে এগোচ্ছে।
ফলে আজ আমাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করতে হবে আগ্রাসী রাষ্ট্রভাষা(দিল্লিতে হিন্দি, কলকাতায় বা ঢাকায় বা আগরলায় বাংলা) কি ভাবে হত্যা করতে উদ্যত হয় সমাজের নিজের ভাষা, উপভাষা ইত্যাদি দাগিয়ে দিয়ে, পাঠ্য পুস্তকে অবশ্যম্ভাবী বাংলামাধ্যমে পড়ার বাধ্যবাধকতার মধ্যে দিয়ে।
তাহলে কি রাষ্ট্রভাষায় পাঠ্যপুস্তক হবে আর সরকারি কাজকর্ম চলবে? যদি মাতৃভাষায় সরকারি কাজকর্ম না হয়, তাহলে মাতৃভাষার কাজ কি হবে - শুধু কথা বলা?
দুই ভাষার মধ্যে সম্পর্ক কি হবে? আদৌ কি কোন সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে?
ঘোমটা পরে নব্যউপনিবেশবাদ ঘাপটি মেরে বসে নেই তো?
বন্ধুরা কি বলেন?

Wednesday, February 17, 2016

ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাস - কলণবিদ্যা


THE METHODOLOGY OF INDIAN MATHEMATICS প্রবন্ধে নামহীন এক লেখক লিখছেন, (যতদূর সম্ভব ধরমপালজী)
Detailed proofs are provided in the Indian texts on mathematics is due to Charles Whish who, in an article published in 1835, pointed out that infinite series for π and for trigonometric functions were derived in texts of Indian mathematics much before their ‘discovery’ in Europe. Whish concluded his paper with a sample proof from the Malayalam text Yuktibhāùā of the theorem on the square of the diagonal of a right angled triangle and also promised that:
A further account of the Yuktibhāsā, the demonstrations of the rules for the quadrature of the circle by infinite series, with the series for the sines, cosines, and their demonstrations, will be given in a separate paper: I shall therefore conclude this, by submitting a simple and curious proof of the 47th proposition of Euclid [the so called Pythagoras theorem], extracted from the Yuktibhāsā.

সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় আপনাদের।

Monday, February 15, 2016

পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল - আমাদের আরও কিছু বক্তব্য

ইপ্সিতারা তাঁদের ব্লগে এটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনায় কেউ কেউ বলছেন কিছুটা হলেও এটিতে বলা হয়েছে মুসলমানের হানাদারিতে বাংলার জ্ঞানচর্চা গোল্লায় গেল। আর উপন্যাস হিসেবে এটি খুব খাজা - নীরদ চৌধুরীর ভাষায় শস্তা পেপারব্যাক জাতীয় উপন্যাস। আমাদের উত্তর-
আমাদের ধারণা ইসলামি আমলে সব জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা নষ্ট হয়ে গেল বোধহয় তা বলা মুশকিল - উনি তা বলতে চেয়েছেন কি না প্রথম পাঠে বুঝি নি - বুঝতে হবে পরের দিকে কোনো একসময় পড়ে - একটু গোলা লোক আমরা - মাথা খুব পরিষ্কার নয় - প্রথম পাঠে সবকিছু বুঝতে পারি না। শ্রুতি একটা বড় অবলম্বন ছিল পড়ুয়া আর অধ্যাপকদের। শুধু পুঁথি পড়াই জ্ঞানচর্চার অবলম্বন ছিল না - এটা আমরা সক্কলে জানি - শুধু জ্ঞানদেওয়ার মত করে বলাগেল। প্রায় দুশো বছর আগে চার্লস উইশের কলণ সম্বন্ধে লেখাটি যুদ্ধবাজ ইসলাম পরবর্তী অন্ধ্রে ভারতীয় অঙ্কচর্চার দুহাজার কাছাকাছি বছরের ধারাবাহিক উদাহরণ - এটা দেখিয়েছেন চন্দ্রকান্ত রাজু।
তবে আমাদের ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় না যে জ্ঞানচর্চার উদাহরণ দিয়েছেন সেগুলি শুধু বাংলার জ্ঞানচর্চা। যে অঙ্কের উদাহরণ দিয়েছেন, তা ভারতীয় জ্ঞানচর্চা। তবে বাংলায় এ সময় ধাতুবিদ্যার রসরত্নসমুচ্চয় বা কৃষি পরাশরের মত প্রযুক্তির বিষয় কিন্তু লেখা হয়েছে।
আর উপন্যাসের আঙ্গিক নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই। সে বিচারের অধিকার আমাদের আছে বলে মনে করি না। বাংলা লেখায় মা সরস্বতী আমাদের দলের সক্কলে। বিদ্যাসাগর মশাই বলে গিয়েছেন তিনি বাজারে সরস্বতীকে বাঁদর নাচ নাচাচ্ছেন - আমরা কোন ছার। আমাদের কিছুমিছু বলার আছে তাই বাধ্যহয়ে কলম ধরি।
আমরা শুধু বলতে চেয়েছিলাম প্রীতম বাবু যা করেছেন, তা ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় ব্যতিক্রম - কেননা বাংলা/ভারতের জ্ঞানচর্চার ইতিহাস খুব বেশি উপন্যাসে ধরা নেই - যদিও বাংলার খুব বেশি উপন্যাস পড়েছি এমন দাবি করা যাবে না - অধিকাংশ উপন্যাস রাজনীতির ঘণঘটা - হাজারি প্রসাদ দ্বিবেদীর বানভট্ট কি আত্মকথার অনুবাদ বাণভট্টের আত্মকথা বা মহাশ্বেতা দেবীর বর্গি হামলার সময়ের আন্ধারমাণিক বা চৈতন্যর সমসাময়িক বিবেকবিদায় পালাতেও কেন্দ্রে রাজনৈতিক ঘটনা। শুধু বাংলার অর্থনীতি ধ্বংসের সময়টি অপূর্ব দক্ষতায় ধরেছিলেন চণ্ডীচরণ সেন মশাই - তথ্যে দাঁড়িয়ে থেকে।

পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল - প্রীতম বসুঃ অসাধারণ একটি বাংলা উপন্যাস


গুরুমা, জয়া মিত্র দিদির আর্ষবাক্য তুলে ধরে বলি, যে বই বা লেখা আমরা পড়তে পড়াতে ভালবাসি, সে লেখা আমি আমাদের পত্রিকায় ছাপাই - যাতে বহুমানুষ তা পড়েন। এই উপন্যাসখানাও তাই - এটির প্রচার হোক। আমাদের খুব ভাল বরাত এটি আমাদের হাতে এসে পড়েছে। সাধারণত গল্প-উপন্যাস আমাদের পাঠতালিকায় থাকে না। বইমেলায় ইপ্সিতা অমরবাবুর একটা বই ধরিয়েছেন - চোখের মাথা খেয়ে না বলতে পারি নি - কিন্তু বন্দরের সান্ধ্যভাষা অসাধারণ লেগেছে।
ফিরি পঞ্চাননমঙ্গলে।
ঐতিহাসিকেরা যে সময়কে বলেন বাংলার মধ্যযুগ, যে যুগে নাকি 'বাঙ্গালা সাহিত্যের তো কোনো নিদর্শন তো নাই-ই, বাঙ্গালা ভাষারও কোনো হদিশ পাওয়া যায় না(সুকুমার সেন উবাচ - যদিও কেন তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার কথা ভুলে গেলেন কে জানে - যেখানে মেয়েরাই সমাজের সূত্রধর আর ক্ষমতায় থাকা ছেলেরা যেন রঙ্গিন সুতো জড়ানো পুতুল - তাঁদের যে যা বলছে তাঁরা সেটি অম্লান বদনে বিশ্বাস করে যান - আর মেয়েরা ছেলেদের নানান দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করেন, নিজেদের বলে, বুদ্ধিতে, দক্ষতায়)' সেই সময় ধরেছেন তিনি। পাঁচমুড়া গ্রামে পঞ্চাননমঙ্গল পুঁথি খোঁজা নিয়ে ২৩০ পাতার কাছাকাছি এই উপন্যাস। পঞ্চাননমঙ্গলে কবিতায় প্রকাশ হয়েছে নানান অঙ্কের সূত্র।
তো আজ আমরা জিভার্গিস যোশেফএর ক্রেস্ট অব দ্য পিকক, বা চন্দ্র কান্ত রাজুর নানান গবেষণার কাজে জেনে গিয়েছি, পাইএর মান আবিষ্কার, শূন্যের প্রয়োগ, ত্রিকোনোমিতির প্রয়োগ, সৌরজগতের গড়ন, কমলালেবুর আকারের পৃথিবীর ব্যাস গণন সহ হাজারো আবিষ্কার ইত্যাদি ভারত-চিন-আরব সভ্যতার দান। আর্যভট্ট গ্রুপএর গবেষণায় জেনে গিয়েছি, কিভাবে পূর্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান পশ্চিমে প্রবাহিত হল, যদিও পশ্চিম এটি স্বীকার করে না আজও। পশ্চিমের বহু আগে এগুলি পূর্বে আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে(বিনীত ভাবে বলি পরম অঙ্ক সংখ্যায় এই তত্ত্বগুলি যতটা পারা যায় আলোচনা করেছে)। অঙ্কের এই সূত্রগুলি পঞ্চাননমঙ্গলে কবিতায় লিখে রাখা হয়েছে ধর্মীয় সূত্রের আকারে। উপন্যাসে প্রীতম বসু দেখিয়েছেন বাংলা লিপির বিবর্তনের ইতিহাসও - অসাধারণ সেই বর্ণনা - বছর বছর ধরে কিভাবে লিপি আজকের বাংলা লিপিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
অসাধারণ বললে কম বলা হয়। প্রথমত বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসে লেখকেরা ঐতিহাসিক নানান তথ্য দিতে খুব কুণ্ঠিত থাকেন। তাঁদের ধারণা হয় পাঠক এটি পড়বেন না। কিন্তু এই উপন্যাসে অসম্ভব কুশলতায় প্রীতম মিলিয়েছেন সেদিনের তথ্য-বাস্তব। দীনেশ সেন, বিনয় ঘোষ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যারা পড়েছেন, তাঁদের এত দিন পরে মনে হবে, এই তথ্যগুলি কি মুন্সিয়ানায় গপ্পে রূপান্তরিত করা গেল।
তবে তিনি যেটি প্রমান করার চেষ্টা করেছেন, মুসলমান হানাদারেরা এই সভ্যতায় এসে কেন শুধু বই পুড়িয়েছেন - তার বক্তব্য তাঁরা জ্ঞানবিজ্ঞানের যে সূত্রাবলী ভারত থেকে নিয়ে গিয়েছেন সেই কথা যেন বিশ্বে ছড়িয়ে না পড়ে সেই জন্য - সে তত্ত্ব কজন মানবেন তা বলা কঠিন - কিন্তু সেটি লেখকের বিশ্বাস - তা না হলে বেছে বেছে শুধু পুঁথি পোড়ানো হল কেন - সত্যি সত্যি তার কথা শোনাই যায়।
তবে এটি কোনোভাবেই বিজেপি বা সংঘ তত্ত্ব অনুসারী লেখা নয় - এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় - তার সব তত্ত্বের প্রমান লেখক তার উপন্যাসে দিয়ছেন - সংস্কৃততে অঙ্কের সূত্র লিখে দিয়ে।
এ প্রসঙ্গে বলি, বিজেপিওয়ালাদের ভারত সভ্যতা বিষয়ে উদ্ভট সব দাবি আদতে পশ্চিমি বিজ্ঞানের, জ্ঞানচর্চার উপনিবেশচর্চার নানান সূত্র প্রমান করতে সাহায্য করছে করে তা তাঁরা জানেনো না।
 শুধু কতগুলি মন্তব্য -
১) আর্যভট্ট বোধহয় নয় - আর্যভট - চন্দ্রকান্ত রাজু উবাচ - আর্যভট্ট হলে এটি ব্রাহ্মণ - আর আর্যভট হলে অন্য সমাজের মানুষ।
২) নদীটার নাম বোধহয় আত্রায়ী - আত্রেয়ী নয়।
৩) উপন্যাসে উল্লিখিত শবরদের খাদ্য না পেয়ে শুকিয়ে যাওয়ার তথ্য বোধহয় খুব বেশি ঐতিহাসিক কি? যে মানুষদের বন ছিল মা, তাঁদের রোগভোগ সেদিনের; যেদিন থেকে ব্রিটিশ রাজত্ব জঙ্গল ধ্বংস, লুঠ করে উপনিবেশের(শুধু ভারতেরই নয় ব্রিটিশ বিশ্বের) রাস্তা, বিশাল বিশাল যুদ্ধ জাহাজ, রেলগাড়ি, বাংলো-আসবাব, বড় কারখানার জন্য নানানবিধ সামগ্রী লন্ডনে নিয়ে যেতে শুরু করতে, জঙ্গলের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হল এই মানুষদের থেকে, জাঙ্গুলে জমি ছিনিয়ে নেওয়া হল পশুপালক/চারকদের থেকে, দেওয়া হল কৃষকদের অতিরিক্ত রাজস্বের জন্য, তখন থেকে জঙ্গলে থাকা মানুষদের মহিলাদের অধঃপাতে যাওয়া শুরু(বীণা লালের দারুণ লেখা আছে কিভাবে জমির চরিত্র বদল হওয়ায় পাঞ্জাবে পণপ্রথা শুরু হল)। বিশেষ করে ১৭৯১ সালে ভারতে আসা ডেনিস চিত্রকর সল্ভিনের আঁকা ছবিতে সে সময়ের সাধারণ মানুষের ছবি রয়েছে। তাতে কিন্তু সক্কলে সুগঠিত চেহারার। ঠিক মুসলমান আক্রমনে বাংলার জ্ঞানচর্চার ভিত কিছুটা নড়ে গিয়েছিল, কিন্তু অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে নি - তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১৭৫৭র পরের লুঠ, ৭৬এর গণহত্যা আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের।
যে ছিদ্রগুলির কথা বললাম ছিদ্রান্বেষীর ছিদ্র বার করা - খুব গুরুত্বের একটা নয় - ফাঁকা কলসি তো একটু বেশিই শব্দ করে।
তবু শত মুখে বলি, পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের তুলনা সে নিজেই - আমাদের বুক একটু চওড়া হল - কেউ এতদিনে বাংলার জ্ঞানচর্চা ভিত্তিক তথ্য নির্ভর করে উপন্যাস লিখলেন - সেগুলি শুধুই জ্ঞান দেওয়া নয় - এটা ভেবেই আনন্দ লাগছে।
বাংলার লক্ষ লক্ষ গ্রামীন উতপাদকের পক্ষ থেকে লেখককে একটু বেশি শুভেচ্ছা।
আবারো অনুরোধ করব, এটি খুঁজে পড়ুন আর পড়ান।

Thursday, February 11, 2016

প্রত্নতত্ত্বভূমির কাব্যতীর্থযাত্রী - জয়দেবের কেন্দুবিল্ব২



গীতগোবিন্দে তাঁর যে আত্মপরিচয় রয়েছে তাতে নিজের সম্বন্ধে শুধু বলেছেন, শ্রীভোজদেবপ্রভবস্য বামাদেবীসুতশ্রী জয়দেবকস্য। পরাশরাদিপ্রিয়বন্ধুকণ্ঠে শ্রীগীতগোবিন্দ কবিত্বমস্তু।। অর্থাৎ পিতা ভোজদেব, মাতা বামাদেবী। প্রিয়বন্ধু পরাশর তাঁর দোহার আর গায়েন। এবারে বোঝা গেল কেন গ্রাম বাংলার মানুষ আজও তাঁর অনুগামী? সেই আটশ বছরের দোহার আর গায়েনের পরম্পরা আজও গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিতে বিদ্যমান।
জয়দেবের কাব্য অনুকরণ যুগে যুগে ঘটেছে – বাংলায় তো বটেই। তাঁর জীবন নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে নানান উপাখ্যান। বনমালী দাসের জয়দেবচরিত্র, কৃষ্ণদাসের ভক্তমাল, জগন্নাথ দাসের ভক্তরচিতামৃত বা সেদিনের কবি অধর চক্রবর্তী লীলা ও নিত্যভাবে শ্রীজয়দেব পদ্মাবতীর উপাখ্যান নামে পুরাণ জাতীয় কাব্য রচনায় উঠে এসেছে অন্যান্য উপাখ্যানের সঙ্গে ‘দেহি পদপল্লবমুদারম’এর কাহিনী - কবি ‘স্মরগরল খণ্ডনং, মম শিরসি মণ্ডনং’ পর্যন্ত লিখে ভাবতে ভাবতে গঙ্গা স্নানে গিয়েছেন। ইত্যবসরে স্বয়ং ভগবান কবির রূপ ধরে পদ্মাবতীর অতিথি হয়ে গীতগোবিন্দের পুঁথি খুলে লিখে দিয়ে যান ‘দেহি পদপল্লবমুদারম’। অসাধারণ এই উপাখ্যানের গুণমূল্য। শুধু ভক্তিভাবের নয়, তাঁর সঙ্গে জুড়ে যায় এক কবিবরের নন্দন চেষ্টার অসামান্য অন্ত্যমিলন। এই কাহিনীর থেকে বড় রোমাঞ্চকর আর বোধহয় কিছুই নেই। এই স্মৃতিটুকুই যদি ঐতিহাসিক নাও হয়, তাহলে বাংলার গীতিকাব্যের প্রথম ও প্রধান স্রষ্টার স্মৃতি-বিজড়িত স্থানটি যে সেদিন থেকেই কাব্য, সঙ্গীতপ্রেমী গ্রামীন বাঙালীদের তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে, ব্যাপকতম জনসমাবেশে, তা বুঝতে কোষ্ঠি বিচার করতে হয় না।
কেঁদুলিতে রয়েছে রাধাবিনোদের মন্দির। কথিত এটি কবির বাসস্থানের ভিটের ওপরে তৈরি। ১৯২৩-২৪ সালের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বাতসরিক সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, it is an example of the nava-ratna or the nine towered type of temple, in which, one central tower is surrounded by two sets of corner towers at two different levels. The façade of the temple is richly decorated with brick tiles representing the various incarnations of Vishnu and scenes from the Ramayana, including the war between the monkeys and demons. বাংলার প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে রাধাবিনোদের মন্দিরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব যথেষ্ট। মন্দিরের পিছনে একটি পিতলের রথ রয়েছে, তাঁর এচিংএর কাজ দৃষ্টিনন্দন বাংলার কর্মকারদের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম।

মেলাকৃতি
মেলা হয় পৌষ-সংক্রান্তিতে কেঁদুলিতে বা যেমন মাঘে দধিয়াবৈরাগীতলায়। এই সময় নতুন ধান ওঠে চাষী আর গৃহস্থের ঘরে। মেলাগুলির অর্থনৈতিক বনিয়াদ তৈরি হয়েই যায়। হাজার হাজার বলা ভাল লাখে লাখে কাব্যতীর্থযাত্রী গ্রামীন অন্নসত্রগুলিতে খেয়ে যান। পৌষের শেষদিনে এই মেলার শুরু। সেদিন হলো "অধিবাস'পরেরদিন অর্থাৎ মাঘের প্রথম শুরুতে মকর স্নান করে সাধু, সন্ন্যাসী, বৈষ্ণব ভক্ত ও অন্যান্যেরা মেলা দর্শন করেন, ঘুরে ঘুরে। এদিন হল "নাম'মানে অস্থায়ী আশ্রমের প্যান্ডেল গুলোতে রাধা গোবিন্দের নামগান হয় সারা দিন রাত। আর বাউল ফকিরেরাও নিজেদের আনন্দমেলায় ডুবিয়ে রাখেন নেচে গেয়ে। শেষ দিন "ভোগ'সাধু, সন্ন্যাসী, ভক্তদের মাটির মালসায় ভোগ খাইয়ে "সেবা' করা হয় নানা অস্থায়ী আখড়াগুলোতে।
জয়দেব বা কেঁদুলিযে নামেই ডাকি না কেন, এই গ্রামের আসল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করার মতো। এই গ্রামে শাক্ত ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্ক। আর মেলার নাম যদিও জয়দেব মেলা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা বাউলদেরই মেলা। এখানে এই মেলা উপলক্ষে যত বাউল সমাগম হয় তত আর কোথাও হয় না। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে সিলভ্যাঁ লেভি, কে না এসেছেন বাউলদের, বলা ভাল বাংলার ইতিহাসের শেকড়ের টানে। বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস যে লুকিয়ে আছে এই মেলার প্রকাশভঙ্গীতে। সেই শেকড়ের জাল ছাড়িয়ে খুঁজে নিতে হয় ইতিহাসের ভিত্তিপ্রস্তর। সেই ইতিহাসকে আজও ধারণ, লালনপালন করেছেন আজস্র গ্রামীণেরা তাঁদের নিজস্বতার প্রণাম দিয়ে বংশপরম্পরায়। আউল বাউলদের সঙ্গে জয়দেব-কেঁদুলিতে খুঁজে নিতে হয় সেই প্রত্নতত্ত্বের ভূমি। বাংলার বাউলেরাই জয়দেবের গীতিগঙ্গার অন্যতম প্রবাহ। অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে বাউলরা ধরে রয়েছেন তাঁর উত্তরাধিকার। গীতগোবিন্দ আজও কেঁদুলির বালকেরা গান গেয়ে বেড়ায় – আর মনে মনে গেয়ে বেড়ান অজস্র গ্রামবাংগালী – যাদের জন্য আজও টিকে রয়েছে কেন্দুবিল্বের মেলা জয়দেব উপসর্গে – নিজের জোরে।