Sunday, January 3, 2016

কার্ল মার্ক্স বামপন্থা এবং বাঙালী মধ্যবিত্ত

আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পাতার মিত্তিরজা'র আশ্লীল সাক্ষাতকারটা(তবু লাল ঝাণ্ডা দেখলে আমি এখনও স্বপ্নময়) আজকের আনন্দবাজারে(১৮ পৌষ, ৩০ ডিসেম্বর) কি কেউ পড়েছেন?
মিত্তিরজাকে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে কিন্তু বাম্পন্থীরা কোনও দিনই তেমন এগোতে পারে নি, এর উত্তরে সারা জীবন বড় পুঁজির দাসত্ব করেও বিপ্লবী থেকে যাওয়া মিত্তিরজা অম্লান বদনে বলছেন -
তার কারণ ব্যাপক নিরক্ষরতা হেতু সমাজসচেতনতার প্রগাঢ অভাব ... এবং কেরলে কেন বামপন্থীরা সফল তার কারণ ...গরীব মানুষদের একটু-আধটু লেখা পড়ার শেখবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
সাধারণ মানুষ নিয়ে ঔপনিবেশিক মধ্যবিত্তের এই অশ্লীল বচন আর কত কাল? গোড়ায় গলদই থেকে গিয়েছে।
কার্ল মার্ক্স কোনোদিনই ভারতীয় গ্রামীণদের বিষয়ে খুব উচ্চধারণা পোষণ করতেন না - ফলে তার অনুগামীরাও তাঁর পথে হেঁটেছেন, আজও হাঁটছেন - এবং ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তিয় চালচলনে অতিরিক্ত উতসাহী - তাই তাত্ত্বিক আলোচনার আধিবেশনের নাম হয় প্লেনাম, যে কোনো গণসঙ্গঠনের নাম দেওয়া হয় ইংরেজিতে।
মার্ক্স The British Rule in India প্রবন্ধে, (https://www.marxists.org/archive/marx/works/1853/06/25.htm) লিখছেন We must not forget the barbarian egotism which, concentrating on some miserable patch of land, had quietly witnessed the ruin of empires, the perpetration of unspeakable cruelties, the massacre of the population of large towns, with no other consideration bestowed upon them than on natural events, itself the helpless prey of any aggressor who deigned to notice it at all. We must not forget that this undignified, stagnatory, and vegetative life, that this passive sort of existence evoked on the other part, in contradistinction, wild, aimless, unbounded forces of destruction and rendered murder itself a religious rite in Hindostan. ...We must not forget that these little communities were contaminated by distinctions of caste and by slavery, that they subjugated man to external circumstances instead of elevating man the sovereign of circumstances, that they transformed a selfdeveloping social state into never changing natural destiny, and thus brought about a brutalizing worship of nature, exhibiting its degradation in the fact that man, the sovereign of nature, fell down on his knees in adoration of Hanuman, the monkey, and Sabbala, the cow( New-York Daily Tribune, June 25, 1853 প্রকাশিত)।
মার্ক্সএর মতে গ্রাম ভারত মিথ্যা ধর্ম এবং কুসংস্কারের দাস, এবং প্রকৃতি পুজক- brutalizing worship of nature। এখানেই না থেমে আরও বড় করে বললেন, ভারতীয়রা grandeur and historical energies অনুভব করেনি, আর ভারতীয় জনগণ undignified, stagnatory, and vegetative lives যাপন করছেন।
ফলে খুব কম ভারতীয় মার্ক্সবাদীই মিত্তিরজা'র মধ্যবিত্তিয় ধারণার বাইরে বেরোতে পেরেছেন।
দুর্ভাগ্য আমাদের। বা এটাই আমাদের সৌভাগ্যের কারণ - গ্রামীণেরা আজও ইওরোপন্থী মধ্যবিত্ত হয়ে যাননি।

দেশিয় চিকিৎসা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান আন্দোলন এবং ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চা

দীপঙ্কর(দে)দা, ফেসবুকে কয়েক ঘণ্টা আগে একটা পোস্ট করেছিলেন তাঁর শেষ দিকটার স্তবকগুলি ছিল-
...আমরা কি তবে বিজ্ঞানের নামে নিজেরাই অন্ধ কুসংসার প্রচার করেছি?
দলিত ও মুল্নিবাসী দের জ্ঞান কে ধংস করেছি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে?
বিজ্ঞানী ও তথাকথিত বিজ্ঞান কর্মী দের দলে তো উচবর্ণের ই আধিপত্য !
আমাদের বক্তব্য - সেই জ্ঞান ধ্বংস হয় নি আজও - মধ্যবিত্তের বহুল ব্যবহৃত 'লুপ্তপ্রায়' শব্দবন্ধকে দুচ্ছাই করে সেই হাজার হাজার বছরের জ্ঞানচর্চার ধারা (লিখিত ও মৌখিক) চলে আসছে। তাঁকে সমর্থন জানিয়ে অনেক কথা বলার আছে। একটা লেখায় সব ধরা যাবে না। তবু বলা যাক-
সম্প্রতি মানুষের ভাল করার জন্য তৈরি এলোপ্যাথিক বড় বড় ডাক্তারবাবুদের একটা সংগঠনের আ্লোচনাচক্রে আমরা সাগ্রহে যোগ দিয়েছিলাম। গ্রাম্য (কবিরাজি নয় কিন্তু) পরম্পরার চিকিতসা ব্যবস্থা নিয়ে বলতে উঠলেই আমাদের দাগিয়ে দেওয়া হল ভুডু, কালা জাদু, তন্ত্রমন্ত্র ব্যবস্থারূপে। আমাদের বলার ছিল এলোপ্যাথি চিকিতসা (আমরা মনে করি আধুনিক চিকিতসা চলে গিয়েছে বড় পুঁজির তৈরি যন্ত্রদানবের খপ্পরে - চিকিতসক, চিকিতসাকর্মীরা ক্রীড়ানকমাত্র, তাঁরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেন তার ওপর স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ নেই বিন্দুমাত্র) আজও ১৫ শতাংশএর বেশি মানুষের কাছে পৌছতে পারে নি। তার পরেও যারা এই ব্যবস্থার অংশই নয় তাদের দেওয়া করে বিপুল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ, ভর্তুকি, মনোযোগ আকর্ষণ করে এই চিকিতসাব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় স্তরে বিকাশের কাজ হয়।
আজও নানান ভাবে গ্রাম্য চিকিতসা পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে বেঁচে রয়েছেন এদেশের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ। এই জ্ঞানব্যবস্থা বিকেন্দ্রিত। হাসপাতাল নেই। চিকিতসকের চেম্বার নেই। ডাক্তারকে রোগীর বাড়ি যেতে হয়। রোগের নিদান তৈরি হয় গ্রামের ধনসম্বলে(শুধু গাছগাছড়া বললাম না কেননা এখানে ধাতুও ব্যবহার হয়, প্রযুক্তি চিকিতসাকর্মীর নিজস্ব), চিকিতসকের দক্ষতাতে আর রোগীকে তার পরিবেশে রেখে ব্যক্তিগতভাবে জেনে সারিয়ে তোলার অবশ্যম্ভাবী শর্তে - একে বিগত কয়েক দশক ধরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে তারস্বরে - ডাক্তার সাহিত্যিক বনফুল লিখেছেন অগ্নীশ্বর - দেশিয় চিকিতসাব্যবস্থাকে তুশ্চু করে - তা নিয়ে রমরমা সিনেমাও হল - আজও তা নাকি কাল্ট সিনেমা। হায়! ওষুধ যদি গ্রামে তৈরি হয় তাহলে ডাক্তার আর বড় পুঁজি আর তার ধারক মধ্যবিত্তের গঙ্গাযাত্রা - এই ব্যবস্থায় ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পুনর্বাসনের ঠাঁই নেই। মধ্যবিত্ত যে ইওরোপিয় কেন্দ্রিভূত জ্ঞানকে,তাঁর নিজস্ব জ্ঞান বলে ভাবে নিয়েছে বিগত দুশ বছরের ঔপনিবেশিকতায়, সেই ব্যবস্থা আদতে বিকেন্দ্রিত জ্ঞান ব্যবস্থাকে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না - তাই দক্ষিণ-বাম-মধ্যপন্থীদের জ্ঞানচর্চায় কেন্দ্র উপসর্গীয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলির রমরমা(কলকাতায় সেন্টার নামে এক বাম প্রভাবিত মধ্যবিত্ত পুনর্বাসন নামক শিক্ষাকেন্দ্র রমরম করে সরকারি ভর্তুকিতে আজও চলছে)। গ্রামের পরিবেশ, জ্ঞানেই যদি রোগ সারে তাহলে গ্রামীনদের চুষে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে ডাক্তারি পড়া মধ্যবিত্তের গ্রামে যাওয়ার বিতর্কের - গ্রামের ভাল করার প্রশ্ন উঠছে না। গ্রাম আজও নিজে জানে নিজের ভাল কোথায়। এখানেই মধ্যবিত্ত আর তার পালক, বড় পুঁজির অস্তিত্ব সংকট - তাঁরা চায় না গ্রাম স্বনির্ভর হোক - শহরের আর ইয়োরোপ আমেরিকার উপনিবেশ হয়ে বাঁচুক। বড় পুঁজির দরকার লাভ, মধ্যবিত্তের প্রয়োজন চাকরি আর ইওরোপিয়কেন্দ্রিক গণতন্ত্রীয় রাজনীতিতে পুনর্বাসন। রোগী চুলোর দোরে যাক - বেঁচে থাক বড় পুঁজি আর পুঁজির দ্বাররক্ষক মধ্যবিত্ত। তাই এনজিও, স্বাস্থ্য আন্দোলন, বিজ্ঞান কর্মীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন বড় পুঁজির, কেন্দ্রিভূত জ্ঞানের এলোপ্যাথি ব্যবস্থাকে যত দূর সম্ভব গ্রামে পৌছে দেওয়ার।
আরও একটা কথা, সলভিনসএর ছবিগুলি প্রকাশনা করাগিয়েছিল এই বিষয়টি প্রমান করার জন্য - এলোপ্যাথির আগেও, কেন্দ্রিয় কবিরাজি চিকিতসার বাইরেও ভারতে কোটি কোটি মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে জানতেন নিজের মত করে হাজার হাজার বছর ধরে। তাদের রোগও হত, চিকিতসাও হত। তখনকার যে সব পেশাদার মানুষের ছবি এঁকেছেন সলভিনস তাতে দেখা যাচ্ছে, পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সুঠাম, বড় চেহারার মানুষ। আর দীপঙ্করদা যে বিজ্ঞান আন্দোলনের কথা বলেছেন, সেই বিজ্ঞান স্বাস্থ্য আন্দোলন ইওরোপের জ্ঞানচর্চার বিজ্ঞান আন্দোলনকে খুঁটি ধরে আজও টিকে রয়েছে। কলকাতা ভিত্তিক এক বিজ্ঞান সংগঠনের বই - আয়ুর্বেদে বিজ্ঞানএ তাঁরা খুঁজতে যান বিজ্ঞান মানে তাঁরা যা বোঝেন, তা আয়ুর্বেদে রয়েছে কি না - এবং সেই জ্ঞান নির্ভর করে পাতার পর পাতা তাঁরা ভেঙ্গিয়েই যাচ্ছেন আয়ুর্বেদকে, এক চিকিতসককে। আয়ুর্বেদ নিয়ে প্রচুর নাড়াচাড়াঘাঁটা হয়েছে। তা নিয়ে অন্তত আমাদের মাথা ব্যথা নেই - আয়ুর্বেদের কেন্দ্রিয় জ্ঞান চর্চার সঙ্গে গ্রামীন জ্ঞান চর্চার আসীম দূরত্ব - তবুও সেই ব্যবস্থার সমব্যথী আমরা। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষিত বিজ্ঞানকর্মী, স্বাস্থ্য কর্মীরা যা করছেন তা আদতে পশ্চিমী জ্ঞান চর্চার দাঁড়িয়ে অন্য - পূর্বের জ্ঞান চর্চাকে বোঝার চেষ্টা - ঈশপের গল্পের হস্তি দর্শনের সমতুল্য।
এই যে পশ্চিমিয় জ্ঞানচর্চায় বেড়েওঠার ফল ফলছে তাদের গবেষনায়। পড়ছি অবভাস প্রকাশিত 'ভারতের পটভূমিতে চিকিতসা বিজ্ঞানের ইতিহাস' বইটি - লিখেছেন ভারত-পশ্চিমের নানান গুণী - মূলত ইওরোপিয়দের নানান প্রকাশনার অনুবাদ - মূলতঃ ইংরেজিতেই লিখিত নিম্নবর্গের ইতিহাসের ছোঁয়া রয়েছে। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের আলোচনা যেমন আধুনিকতা ,পশ্চিমি গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ(না এলে সমাজতন্ত্র আসবে না তাই কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে আভিবাদন জানিয়ে প্রগতিশীল তকমা দেওয়া হয় - দেশিয় প্রতিক্রিয়াশীলেরা রাষ্ট্রকে কর না দিয়ে, জমি অর্পন না করে জমি লুকিয়ে রাখছেন তার বিশদ বর্ণনাও রয়েছে এবং জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সেই দেশজ প্রতিক্রিয়াশীলদের থেকে জমি উদ্ধার করে ব্রিটিশ রাষ্ট্রের হাতে অর্পন করে প্রগতিশীল আখ্যা পাচ্ছেন, বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খারাপ কিন্তু ব্রিটিশ গণতন্ত্রের মহিমার শেষ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি) বিকাশের অবশ্যম্ভাবী পথের ভিত্তি ধরে আলোচনা এগোয়, তেমনি, আপনি মানুন ছাই না মানুন, এই বইএর নানান প্রবন্ধে ধরে নেওয়া হয়েছে শল্য চিকিতসাই, চিকিতসা শাস্ত্রের অগ্রগতির অন্যতম সোপান। আশ্চর্য, এই বইতে কোথাও বলা নেই ভারতে হিংসক(শল্য চিকিতসা) এবং অহিংসক(জৈন অশল্য) চিকিতসাবিদ্যার ধারা ছিল। বাউল গানে হেঁট মুণ্ড উর্দ্ধপদ বাক্যবন্ধ বা সেই দেশের কথা রে মন ভুলে গিয়েছ... গান প্রমান করে শারীরবিদ্যা জানায় তন্ত্র খুব কম যায় না। বইতে খুবই হাহুতাশ করা হয়েছে ইওরোপের মত ভারতে শল্যবিদ্যা নির্ভর চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভারতে চিকিতসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ঔপনিবেশিক কোম্পানি আমলে ইওরোপিয় হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ কেন্দ্রিক পশ্চিমি চিকিতসাধারা ব্যবস্থাকে এ দেশে প্রবেশের - এদেশের মানুষকে উদ্ধারের ছুতোয় - এ ধরণের জ্ঞানচর্চার প্রয়োজন আজও আছে। এধরণের চিকিতসাবিদ্যা গবেষণায় মৌখিক পরম্পরা ধরার কোনো চেষ্টাই থাকে না । বা বলা হয় না ভারতের চিকিতসাবিদ্যা অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে ইওরোপিয় চিকিতসাবিদ্যার ভিত।
ফলে মধ্যবিত্তের উন্নয়নের গ্রামবিলাস তাই হয়ে ওঠে ইওরোপিয়তার ঔপনিবেশিকতার বড় পুঁজির হাত শক্ত করার নতুনতম হাতিয়ার। আর মধ্যবিত্তের পুনর্বাসনের হাতিয়ার।

Shilpotaluk and traditional artisans, শিল্পতালুক আর পরম্পরার শিল্প উদ্যোগী

আজ সকালে রেডিওর খবরে শুনলাম দশটা 'হস্তশিল্প'কে শিল্পতালুকে পরিণত করা হচ্ছে। এ নিয়ে এখনও কোন সরকারি সমীক্ষা চোখে পড়েনি বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের -ফলে তার কি করতে চাইছেন তাও জানা যায় নি। কিন্তু বিষয়টা আলোচনাযোগ্য - কেননা লক্ষ লক্ষ গ্রামীন উতপাদকের রুটি রুজির ভবিষ্যত নির্ভর করছে এই পরিকল্পনায়।
সেই জন্য কিছু কথা বলা দরকার বলে মনে করছে সংঘ।
আশ্চর্যের বিষয় হল যে, ভারতের এবং রাজ্য সরকারগুলির গ্রাম শিল্পগুলিকে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে ফেলছে।দেখে নেওয়া যাক ক্ষুদ্র আর ছোট শিল্পের সংজ্ঞা কি। এই দপ্তরের নীতিতে যে শিল্প সেবা ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা আর উতপাদনের ক্ষেত্রে ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ(এ নিয়ে পরে আলোচনায় আসছি) করতে পারে তাঁরা ক্ষুদ্র শিল্প বলে পরিচিত হয়। ছোট শিল্প তকমা পাওয়া যায় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে।
এবারে বলা যাক গ্রাম শিল্পগুলি বিষয়ে। যে মানুষটি/গুলি সমাজে থেকে মূলত গ্রামের বাজারের জন্য বাঁশের, মাটির, পাটের, কাগজের মণ্ডের, গালার, শীতলপাটির ইত্যাদির জিনিস বানাচ্ছেন, তাদের বিনিয়োগ কি সেই প্রশ্নে ঢোকা যাক। তার কাঁচামাল সংগ্রহ করেন তাদের স্থানীয় এলাকা থেকে - হয়ত তাদের নিজেদের সম্পত্তি থেকেই। কাঁচামাল কিনতে খুব বেশি মানুষকে বাজারে যেতে হয় না - ব্যতিক্রম শাঁখ, গালা, ধাতু ইত্যাদি হাতে গোণা কিছু উতপাদন। ফলে তারা কাঁচামালে বিনিয়োগ করলেও তা খুব অল্পই। তাদের শ্রম নিজেদের বা স্থানীয় এলাকা থেকেই পাওয়া যায় - শিক্ষণকেন্দ্রর প্রয়োজন হয় না। দক্ষতা তৈরি হয় পুর্বপুরুষের জ্ঞানে। হাতিয়ার বলতে কিছু লোহা বা কাঠের যন্ত্রপাতি - যা ব্যবহার করতে বিদ্যুতের বিন্দুমাত্র প্রয়োজন হয় না। আর কাজের যায়গা বলতে তার বাড়ির উঠোন। এরা কেউ বড় শিল্পপতি হতে চাননা। কেউ প্রাণান্তকর চেষ্টায় তার পাশের উতপাদন ব্যবস্থা কিনে নিয়ে নিজের তহবিল বাড়াতে চান না - চাইলেও পারেন না। হাজার উতপাদক, হাজার হাজার বিক্রেতা - এই উতপাদন ব্যবস্থার এটাই জোর। এই উতপাদন ব্যবস্থার কোনো কেন্দ্র নেই। তাই বহু চেষ্টায় একে মেরে ফেলা যাচ্ছে না। এরা বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, ব্যাঙ্কের ঋণ ব্যবস্থার বাইরে। এদের চেষ্টা হয়েছে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে - কিন্তু খুব একটা সফল হয়নি ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি। আর এরা ব্যাংকের ধার চাওয়া নিয়েও খুব একটা ব্যস্ত বলে শুনিনি। ফলে পশ্চিমি শিল্পবিপ্লবীয় ছাঁচে, ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র থেকে ছোট থেকে মাঝারি শিল্প হয়ে ওঠার বিন্দুমাত্র প্রণোদনা নেই এই শিল্প উদ্যোগীদের। এরা কেউ বড় পুঁজির তৈরি বাজারের সরবরাহ শৃংখল হয়ে উঠতে খুব একটাও যে চেষ্টা করবেন, তারো উপায় নেই এই উতপাদন ব্যবস্থায়। যে কাজটা হকারদের নিয়ে করার চেষ্টা করা হয়েছে - তাদের আইন এনে।
যে সংগঠনগুলি এই মানুষদের নিয়ে কাজ করেন(যার মধ্যে ব্যতিক্রম সংঘ, সে শিল্পীদের জন্য কাজ করে না, সেটি গ্রামশিল্পী বা গ্রাম উতপাদকেদের নিজস্ব সংগঠন) তারাও কোনোদিন এই বিষয়গুলি নিয়ে ভেবছেন কিনা জানা যায় না। তাঁরা বরাবর চেষ্টা করেছেন সরকারি নীতিতে এই মানুষগুলিকে কিভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা করা। আদতে এই সঙ্গঠনগুলির মূল লক্ষ্য - যে কোন উপায়ে দান সংগ্রহ করে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চাকরি নিশ্চয় করা।
একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। আমাদের কাছে এসেছিলেন ভারত সরকারের এনএসডিসির দান পাওয়া এক সংগঠন যারা দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে ইচ্ছুক। তাদের প্রশ্ন ছিল আমরা তাদের সঙ্গে মিলেগ্রাম শিল্পীদের দক্ষ করে তুলতে পারি কি না। তাঁরা প্রায় বিনা মূল্যে দেওয়া শিক্ষণ শেষে শংসা পত্র দেবনে - যাতে তাই নিয়ে চাকরির বাজারে নামতে পারেন তাঁরা। আমরা বিনীতভাবে বলেছিলাম এই প্রকল্পে আমরা যোগ দিতে পারছি না। কেননা এই প্রকল্পর উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের চাকরি যোগ্য করে তোলা। কিন্তু গ্রাম শিল্পীদের চাকরি দরকার নেই। এরা সক্কলে দক্ষ। এদের কি করে নতুন করে দক্ষ করে গড়ে তোলা যাবে। এরা কেউ কর্পোরেট চাকরিযোগ্য হতে চায় না।
ফিরি পুরনো কথায়, এই সংগঠনগুলো কেউ সরকারকে বলনা যে এই গ্রাম উতপাদকেদের জন্য প্রয়োজন আলাদা নীতি তৈরি করা। তাঁরা তা জানেন, বোঝেন কিনা জানিনা।সরকার বা সরকারি সংগঠনগুলিকে এই বিষয়ে জানানোর কোনো তাগিদ তাদের আগেও ছিল না আজও নেই। তাদের উদ্দেশ্য যেন তেন উপায়ে সরকার বা বিদেশ থেকে প্রকল্প সংগ্রহ আর তার রূপায়ন। তার পর সক্কলে উচ্ছনে যাক তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
ফলে রাজ্য সরকার যে ডিআইসির মার্ফত এই শিল্পতালুকএর প্রস্তাব করছেন, তা ভবিষ্যতে মার খেতে বাধ্য। এই শিল্প তালুকের ধারণার সঙ্গে ছোট গ্রামীন উতপাদনের কোনো যোগ নেই। একটি বড় এনজিও চেষ্টা করছেন আমলাদের রসেবশে রেখে যে কোনো উপায়ে কর্মসাধন। তার সঙ্গে গ্রাম শিল্পের উতপাদকেদের ব্যবসার উন্নয়নের কোনো যোগ নেই।