Wednesday, September 22, 2010

Panchali

Panchali a genre of narrative folk songs. The word, panchali, originates from panchal or panchalika, meaning puppet. Others believe that the word refers to the five elements of this genre: song, music, extempore versifying, poetic contests, and dance. In earlier times it also included a puppet dance. In the 18th-19th centuries, the puppet dance was dropped. Instead, the main singer would dance, wearing nupur (anklet bells), and holding a flywhisk and cymbals. At times he would act the part of different characters. The ramayana, mahabharata, mangalkavya and similar narrative verses were often recited in the style of panchali. Some legends also used to be recited in a similar fashion.
Panchali subjects include ancient legends and folk tales as well as contemporary topics. One principal singer would enact the main story with recitation, rhymes and songs. In course of the evolution of the panchali, more singers joined the principal singer to play such instruments as mrdanga (tabor), dhol (drum) and kanshi (bell-metal gong).
The panchali underwent some changes towards the close of the 18th century when poetic contests, physical gestures and acting were introduced. In the 19th century dialogue for the principal singer was added as was the character of a clown who used to generate laughter by mimicking different social oddities through songs, recitation of rhymes or dances. Most popular among the social issues were remarriage of women, income tax problems, and the members of Young Bengal who were opposed to idol worship. The panchali later gave birth to the popular jatra songs.
dasharathi roy was a famous panchali composer. He used to be a professional kaviyal or versifier. Dasharathi Roy's panchali helped make the common people interested in education, literature and religion as well as to become socially conscious. The influence of kavigan may be noticed in the panchali of manomohan bose. Some other famous panchali composers of the time were Thakurdas Dutta (1801-1876), Rasikchandra Ray (1820-1892), Brajamohan Ray (1831-1876), Rasikchandra Goswami, Nandalal Ray and Krishnakamal Goswami. Famous panchali include Shitalar Panchali and Satyanarayan or Satyapirer Panchali.

Monday, September 20, 2010

Dandabhukti


Dandabhukti a territorial unit of ancient Bengal, located in the southwestern part of West Bengal (India). Dandabhukti or Dandabhuktimandala emerged into prominence in the first half of the seventh century AD when it was ruled by Mahapratihara Shubhakirti, who was a subordinate ruler under shashanka, the King of gauda. Samanta-maharaja Somadatta, who served under Shashanka, was entrusted with the administration of Dandabhuktimandala and Utkala. Dandabhukti is mentioned as a distinct geopolitical unit in several epigraphic records: the two Midnapur copper plates of Shashanka, Irda copper plate of the Kamboja rulers of Bengal, and the Tirumulai inscription of Rajendra Chola. sandhyakar nandi also mentions it in his ramacharitam. On the basis of the available evidence Dandabhukti may be taken to have comprised the southwest of Bengal, particularly southern and southwestern regions of the modern district of Midnapur in West Bengal and a part of the district of Balasore in Orissa. The memory of Dandabhukti survives in the name of the modern locality of Dantan/Datan in the district of Midnapur.
Two copperplate grants of a Bhaumakara queen refer to Dandabhukti mandala as being attached to the Uttara-Toshali and having contained Tamala-Khanda and Daksina-Khanda districts. These two districts have been identified with Tamluk and Dakinmal respectively, which are also mentioned as parganas in the Mughal revenue accounts of Midnapur district. The Irda copper plate (10th century AD) records the inclusion of the Dandabhukti mandala within the Vardhamana bhukti, ruled by the Kamboja Kings. The Tamil Tirumulai inscription (11th century AD) records the name of Dandabhukti, distinct from southern and northern Radha, and its location is placed between Orissa and southern Radha.
The well-known archaeological sites like Tamluk, Bahiri and Dantan/Datan in Midnapur district, West Bengal produced numerous antiquities throwing light on the trade, commerce and culture of the coastal region of the Bay of Bengal. tamralipti may have been included within the Dandabhukti settlement.

Dhivar


Dhivar (Fisher) a shudra sub-caste. Fishing by occupation, dhivars are mentioned in Vrhaddharma Purana as one of two fishermen sub-castes along with Jalik. Brahmavaivarta Purana cites Dhivar and Kaivarta as asat (dishonest) Sudras. Other fisher classes include the Kaivartas and Mahisyas. In 1071-72 Kaivarta farmers rebelled against Mahipala II and set up an independent Kaivarta kingdom. At present the Dhivar use the surnames Malo, Barman, Rajbangshi and Das. Apart from their traditional occupation, modern-day Dhivars also take up other jobs or trades.

Saturday, September 18, 2010

A Theme Puja by Kalaboti Mudra - থিম পুজোর অঙ্গনে ঠাকুরপুকুর ক্লাব আর চারিয়ে যাওয়া শিল্পভাবনা

There are a folk belief of people of the Nabadwip, Nadia - Ravan played the role of the Ghatak(Mediator) between the Marriage of Shiva and Parvati. This marriage hold at this place.
At the Basanti Puja ceremony, the entire folk community of Nabadwip curiously arrange a marriage between with great fanfare. This is the theme of this year of Thakurpukur Club. The pujo consists of a head installation (Lingam Head) of Shiva and a ak chala Parvati (sans sons and daughters). At the Dashami both of them are engaged. Local businessmen use to donate their business interests (products) to the marriage ceremony.
This is a living tradition and practiced at a heartland of Bengal. This tradition is being practiced for long years there and a song (caricature) of Shiva was held at the marriage day .

Kalaboti Mudra is executing this event on behalf of the club. All the folk and tribal craftspersons are presenting their traditional artifacts to commemorate this event. Devi is coming in Palanquin and accompanied with her husband to the Kailas Parbat by a boat - both the logistics will be stationed at the place.

Here we are putting the press release in Bangla for our readers(non-bangla speaking communities can translate it.)


2010-এর শারদীয়া পুজোয় ঠাকুরপুকুর ক্লাবের নিবেদন - শিব-দুর্গার বিয়ে
...নদে ভেসে যায় লৌকিক নদের আদত অর্থ নদিয়া আমরা যাচ্ছি নবদ্বীপে - শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্মস্থানে, আজও যেখানে সংস্কৃত ভাষা নিয়ম করে অতি যত্নসহকারে শেখানো হয়, এই ইন্টারনেটের যুগেও - প্রাচীন বাংলার বিদ্যাজীবিদের তীর্থস্থানও নদিয়ার নবদ্বীপ শহর বাসুদেব সার্বভৌম, রঘুনাথ শিরোমণি, রামগোপাল তর্কতীর্থ একদা ছিলেন ভারতজয়ী পণ্ডিতশ্রীচৈতন্যধন্য নবদ্বীপে পাড়ায় পাড়ায় পা রাখলেই শিহরণ জাগেএ হেন নবদ্বীপের সোঁদা গন্ধে গা ভাসাতে কেই বা না চাইবেন?
বিগত কয়েক বছর ধরেই দক্ষিণ কলকাতার ঠাকুরপুকুর ক্নাব, থিম পুজোর অঙ্গনে প্রবেশ করে বেশ সাড়া ফেলেছে৷ এ বছর ঠাকুরপুকুর ক্লাব, কলাবতী মুদ্রার সহায়তায় পা বাড়িয়েছে পাশের জেলা নদিয়ার নবদ্বীপ শহরের লৌকিক অঙ্গনে৷ বেশ কয়েক দশক ধরে নবদ্বীপের বাসিন্দারা বাসন্তী পুজোয় শিব-পার্বতীর বিয়ে দেন৷ তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস এই বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন দৈত্যরাজ রাবণ স্বয়ং৷ বিয়ে উপলক্ষ্যে নানান সাজে সেজে ওঠে নবদ্বীপের নানান পাড়া৷ মুণ্ডমূর্তি এবং গৌরীপট্টবিহীন শিবকে বিয়ে দেওয়া হয় সন্তান সন্ততি ব্যতীত উমার সঙ্গে৷ এমত এক কৌতুহল উদ্দীপক এক উত্সবে অংশ গ্রহণ করেন পোড়ামা তলা, যোগনাথ তলা, গোন্দল পাড়াসহ নানান এলাকার সর্বজন এই কাজের সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্য অংশ- স্থানীয় মানুষ, ব্যবসায়ী নির্বিশেষে হবু দম্পতিকে নানান সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য দ্রব্যসব উপহার দেওন
এমত একটি লৌকিক ঘটনা, ঠাকুরপুকুর ক্লাব নিজেদের অঙ্গণে এনে উপহার দিতে চলেছে রাজ্যের আপামর জনসাধারণকেনবদ্বীপের লৌকিক এই অনুষ্ঠানের মূল রূপটি বজায় রেখেই ঠাকুরপুকুর ক্লাব চেষ্টা করেছে এই বদলে যাওয়া সময়কে আলতো হাতে ধরার বিশেষ করে বাংলার ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের লৌকিক-আদিবাসী জীবনের মৃত-প্রায়মৃত নানান শিল্প আঙ্গিককে খুঁজেপেতে নিয়ে এসে এই উপহার সামগ্রীতে সামিল করতে চায় সে, যে কাজের মধ্যে শুধু সেই জীবনের শৈল্পিক দিকটি শুধু প্রকাশ পাবে তাই নয় বাংলার লৌকিক-আদিবাসী শিল্পকলা নিয়েও আকর্ষণ জন্মাবে দর্শকমনে
এই বিবাহের ঘটনাটিকে সামনে রেখে এবং পুজোয় দর্শকদের নিরাপত্তার নানান দিক মাথায় রেখে ঠাকুরপুকুর ক্লাব দুটি পথ ভাঙা কাজ উপহার দিতে চলেছেন - প্রথমটি বাংলার সনাতন বাংলা কাঠামো বাড়ির পুনরুজ্জীবণ, যেখানে আটবাহুবিশিষ্ট তিনতলা মাটির দেওয়ালযুক্ত বাড়ির দুটি তলা দাঁড়িয়ে থাকছে নিচের তলাটির ওপর ভর করে, ভূমির ভরে নয়, ওপরের সমস্ত ওজনটি বহন করছে ভূমিসংলগ্ন নিচের তলাটি আর যে বাঁশ দিয়ে সে ব্যতিক্রমী বাংলা কাঠামোটি তৈরি হচ্ছে, সেই কাঠামোকে কোনোরকমই না ঘিরে, অনাবৃত বাঁশগুলিকে দেওয়া হচ্ছে মুগ্ধ শিল্পের রঙএর ছোঁয়া, আর পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের মেল্লির সাজমাটির দেওয়ালে দেওয়ালে তৈরি হবে নানান ধরণের লৌকিক-আদিবাসী শৈল্পিক রিলিফ
সব থেকে আর্ষণীয় অংশটি হল বাংলার নানান অঞ্চলের লুপ্তপ্রায় লৌকিক-আদিবাসী শিল্পীরাএই বিয়ের সংবাদে আপ্লুত শিল্পীরা উপহার দিচ্ছেন তাঁদের বাপ-দাদারা যুগযুগ ধরে যে ধরণের শিল্পকর্ম করছেন তার নমুনা উত্তরবঙ্গের শিল্পীরা দিচ্ছেন শোলার নানান কাজ, মেল্লি, কাঠের কাজ, দক্ষিণবঙ্গের লৌকিক শিল্পীরা দিচ্ছেন মাটি, কাঠ, গালার, ধাতুর পুতুল, জয়নগরের প্রাক্তণ পটুয়ারা দিচ্ছেন পুতুল, বীরভূম থেকে আসছে প্রায় লুপ্তহতেচলা শেরপাই, আসানসোল থেকে আসছে চাক ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়া শিল্পীদলের মাত্রএকজনেরই মাটির পুতুল, বীরভূম থেকে দুর্গাপট, দশাবতার তাস, মেদিনীপুরের শিংএর কাজ, দক্ষিণদাঁড়ির মনসার ঘট, আদরিনী সরা, লক্ষ্মী-দুর্গাসরা, শাঁখের কাজ, জলঙ্গীর মত্স্যজীবি মেয়েদের আলপনা, পশ্চিম মেদিনীপুরের দেওয়ালের রিলিফের কাজ, পাথরের কাজ, পট ছাড়াও নানান লৌকিক-আদিবাসী কাজের সম্ভারউত্সাহী দর্শকের জন্য থাকছে স্থানে স্থানে ঘটনা আর শিল্পের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা যে লৌকিক বর্ণনার বর্ণমালা ধরে তিনি চলেযেতে পারবেন লৌকিক জীবনের কুড়ে, খোঁজ পাবেন নতুন এক শিল্প ভাবনার যে ভাবনাটির মূল হয়ত লুকিয়েছিল কলকাতার বাইরের গ্রাম-শহরের মিলিত সাধনায়
সামগ্রিকভাবে এই বিয়ের কাজে যে মূল কাঠামোটি তৈরি করা হচ্ছে তাতে একধারে থাকছেন একাকীনী দেবী, অন্যদিকে থাকছেন মু্ণ্ডমূর্তি শিববিবাহ হবে দশমীর দিনদেবীকে বিয়ের মণ্ডপে নিয়ে আসা হবে পালকিতে করে, আর বিবাহের পর পতিদেবকে সঙ্গে নিয়ে কৈলাসে যাবেন নৌকো বাহনে, যে নৌকো আর পালকিও তৈরি থাকছে প্রাঙ্গনে
এমত ব্যতিক্রমী পুজোর ব্যতিক্রমী শৈল্পিক কাজের সঙ্গী হয়ে, সে শিল্পের প্রচারে শুধু মহাদেব বা জগন্মাতার হয়েই নয়, বিয়েতে উপহার দেওয়া বাংলার সমগ্র লৌকিক-আদিবাসী শিল্পীর পক্ষ থেকে বাংলার সংবাদমাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে ঠাকুরপুকুর ক্লাবআপনারা আসুন, শিল্প দেখুন আর শারদীয় উত্সবের গন্ধমাখা এই সময়ের মৃতপ্রায় শিল্পের আর ঐতিহ্যের গাথা রচনা করে বাঁচতে দিন এই যুগের শিল্পীদেরঅলমিতি বিস্তারেণ
সম্পাদক, ঠাকুরপুকুর ক্লাব

Friday, September 17, 2010

A Call from Poet Joya Mitra - Asking Your Participation

This is a small school with a big difference. Not exactly a school, its neither a formal daycare centre. The children themselves have named it Maj-orha - The Funhouse.
The area is Rampurhat in Birbhum dist. Large Part of the place is full of stone quarries. Many of the tribal families here go for their livelihood to these stone quarries and crushers. The elder children can’t continue their studies, as they have to look after the younger ones. For the whole day these kids are left to take care of themselves.
3years ago a group of activists both tribal and non-tribal, in their wildest dreams of love planned a shelter for the children at a village called Garia. So the ‘Funhouse’ came into being, starting at first with 4 later 15 children under a Mahua tree. Some volunteers accompanying and teaching them. They also kept talking to the mothers. Now there are nearly 50 students aged from 3-12 years from three villages. Maj-orha is now housed in a two-storied brick-and-mud building with thatched roof. The kids stay there from 7 in the morning to 5 in the afternoon. They receive breakfast lunch and afternoon snacks here. They also get the basic educative skills and some more trainings that will come to their help in future life.
6 trained local young men and women keep them company the whole day. In these three years almost 60 children of the 3 villages have learnt basic three R’s quite well. After just two years in Maj-orha they are able to write their daily experiences in Bengali and Santhali.
They draw with unusual skill and imagination. They sing and dance their culture. Learn the history and geography of their own villages and can speak with their heads held high looking straight into the listeners’ eyes. These students are our promising, wonderful young friends.
Some working youth and students in and outside the country used to pull a fund for giving ‘Fun House’ the care of financial support. But with the spiraling rise of daily goods and the global recession our source of sustenance is drying up. The question is troubling our mind how can we run the centre and continue to feed these our children properly. We know there are so many underfed or hungry kids but we are now thinking about just these 50 odd small mouths. A minimum of the Rs 1,000 is needed for a day’s food including fuel.
We turn to you for sharing with them at least two day’s food a year. That will be yours gift of love. Their brightly smiling faces will be your awards.
Think. Tell others. Please try to broaden the ring of friendship and care so that more children can enter the fold.

Thursday, September 16, 2010

Murshidabad Painting

Murshidabad Painting a new school of painting with traditional mughal qalam at its root developed in Murshidabad, the capital of the far-flung Mughal province of Bengal during the first quarter of the 18th century. This province was earlier a great centre of art and culture during the Pala and Husain Shahi period. The Mughals too patronized art and culture of the area.
Murshidabad School was established under the direct patronage of its governors when dispersed court artists of the crumbling Mughal Empire took refuge at the court of Murshidabad in search of their livelihood. During 18th century Murshidabad emerged into a new era of prosperity as a result of European trade and settled government. It is not certain whether any royal atelier of Murshidabad was formed under its first subahdar MURSHID QULI KHAN (1716-1727). He was a pious ruler who despised all sorts of luxury. Yet some paintings of his time - Murshid Quli Khan holding darbar by the Bhagirathi River (c 1720), Muharram processions, festivals on Khwaja Khizir - are preserved in a folio of Clive Album now housed in the India Office Library, London. The style of these paintings are local variations of regional Mughal albums. No extant examples of paintings under the aegis of the next subadhar SHUJAUDDIN MUHAMMAD KHAN (1727-1739) have come down to us.
The real Murshidabad style of painting came into vogue under the next ruler ALIVARDI KHAN (1740-1756). A contemporary historian Ghulam Hussein Salim is of opinion that Alivardi Khan was an avid patron of art and culture. Some of the paintings of his court, entitled 'Nawab Alivardi Khan hunting Roe Buck' (c 1750-1755), 'Alivardi Khan seated on a Garden Terrace in conversation with his nephews', are now preserved in the India Office Library. These are evidence of the early Murshidabad atelier and this aged ruler favoured darbar and hunting scenes, somber moods, chilly palette, dominant whites and grays in both hunting and court scenes.
Under SIRAJUDDAULA, the grandson of Alivardi Khan, Murshidabad painting reached its highest apogee. His liberal views widened the horizon of Murshidabad court painting. Apart from formal court scenes and scenes of conversation his painters were encouraged to portray the cosy scenes of the zenana and also ragamala scenes. Thus a renewed vitality is noticed in the art activities of Siraj's brief reign. Like the pleasure loving later Mughal rulers scenes portraying women in romantic love scenes, as well as scenes portraying women in various activities in the zenana, and also women outside their precints were favoured by Sirajuddaula. Among the numerous raga and ragini scenes were depicted by the court artists. Among the ragas, hindola raga, gujari ragini, kakubha ragini, madhumadhavi ragini, bangali ragini etc are noteworthy. Lovers amidst a romantic landscape or on a royal terrace or on a river cruise are the most favourite scenes of this period.
Like their Mughal precursors, the Murshidabad artists painted on hand made papers in gouche. They worked on Mughal qalam. Themotifs of semi circular bushes bordering the terrace, the placid river with storks dotted on its banks overlooking the terrace; also far away vistas of undulating hillocks with schematically arranged semi-circular shrubs are indicators of Murshidabad provenance.
Under the next ruler MIR JAFAR (1757-1760), Murshidabad atelier witnessed no remarkable change in the style of painting except losing vitality and charm of Siraj's period. During this period Puran Nath, alias Hunhar, a renowned artist from Lucknow joined the Murshidabad atelier.A beautiful painting by Puran Nath, now preserved in the Victoria & Albert Museum, London, depicts Nawab Mir Jafar and his son Miran inspecting armies amidst a vast field. Other miniatures representing single portrait of the nawab amidst barren natural settings, formal court scenes, etc recall the style of Alivardi Khan's atelier for their similarity of themes and choice of somber atmosphere and pallid colour scheme.
The Lucknow painters who worked under Mir Jafar continued to work in the atelier of the next ruler MIR QASIM (1760-63). Among them the most renowned painter was Dip Chand, from whose meticulous brush came the famous portrait of Gurgan, a courtier of Mir Qasim, which is now preserved in the Victoria & Albert Museum. Formal court scenes of the nawabs were also painted during this period, which are reminiscent of the paintings of his preceeding rulers. By the time of Mir Qasim, the arrival and predominance of Lucknow artists brought in a remarkable change in the Murshidabad style, when the prevailing Mughal qalam was replaced by the Lucknow qalam. Portraits of nawabs and courtiers overwhelmed by exaggerated emotion, with fine stipplings of grey and brownish ground, the flower beds at the back drop of the portraits, yellow palette of the lily pond are indicators of Lucknow qalam.
The defeat and deposition of Mir Qasim by the English and the ascendancy of the aged puppet Nawab Mir Jafar for a second term to the masnad of Murshidabad, disturbed the congenial atmosphere needed for the promotion of art and culture. The patronage now passed on to the opulent zamindars, Muslim nobles, Hindu and Jaina businessmen and British officials residing near Murshidabad, who employed the disbursed artists to illustrate popular Hindu-Muslim manuscripts as well as muraqqas (picture albums) containing portraits of Mughal rulers, nawabs, courtiers, representation of ragamalas etc. Among those manuscripts and albums Dastur-i-Himayat, Razamnama, Nala Damayanti, Nabwa Daman, Ragamala, and Nayaka-Nayikabheda miniatures received the patrons favour. In the illustrations of Hindu gods and religious themes the artists represented local varieties of Hinduism in Bengal, such asVaishnavite and Tantric mode. While depicting those miniatures, the artists faithfully represented the flora and fauna of Bengal in a rather naive and folkish manner. However, the famine of 1769 dealt the final blow to the last vestiges of Murshidabad painting when the famine-striken poor artists took shelter at the Britsh master's atelier where they adapted themselves to the European influenced company style of painting.

Tuesday, September 14, 2010

শাঁখ শাখার বারোমাস্যা - অলিমিতি

শঙ্খপুরান
শঙ্খের বৈজ্ঞানিক নাম টারবিনেলা পাইরাম(Turbinella pyrum)৷ এটি একটি porcelaneous shell৷ অর্থ এমন একটি কাঠামো, যার ওপরের অংশ শক্ত, উজ্জ্বল আর স্বচ্ছ৷ ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধরনের শঙ্খ পাওয়া যায় প্রধাণত ভারত মহাসাগর আর তার আশেপাশের সাগরে৷
শঙ্কুআকার অনুযায়ী শঙ্খকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, দক্ষিণাবর্তী শঙ্খ আর বামাবর্তী শঙ্খ৷
বাদ্যযন্ত্র হিসাবে শঙ্খের ব্যবহার বেশ পুরোনো৷ বিশেষ করে যুদ্ধে৷ একে শঙ্খনাদ বলাহয়৷
প্রচলিত ভারতীয় আচারে শঙ্খনাদ বন্ধুত্বের দ্যোতক আর শত্রুদের হৃদকম্প স্বরূপ৷
শাঁখ বাজিয়ে পুজো করার রীতি বহুদিনের৷ বর্তমানে শাঁখ বাজিয়ে নানান অধর্মীয় অনুষ্ঠানের, আচারভিত্তিক অনুষ্ঠানেরও সূচনা করা হয়৷
ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ অনুসারে শঙ্খে যৌথভাবে দেবী লক্ষ্মী আর ভগবান বিষ্ণুর বাস৷ ফলে পুরাণে শাঁখের সঙ্গে বিষ্ণুদেবের একটি সমীকরণ গড়ে তোলা হয়েছে৷ শাঁখে রাখা কোনো জলে স্নানকরা যেকোনো পবিত্র জলে স্নানের সমান৷ শঙ্খ সদ্ম পুরাণ অনুসারে শ্রীবিষ্ণু এবং গাভীর চিত্র সামনে রেখে স্নান করা দশলক্ষ যজ্ঞের সমান৷ আর বিষ্ণুদেবের চিত্র সামনে রেখে শঙ্খ জল মাথায় দেওয়ার অর্থ গঙ্গাজলে স্নানের পূণ্যর সমান৷
ব্রাহ্মণ্যধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধধর্মেও আটটি মহাপ্রতীক অষ্টমঙ্গলের অন্যতম একটি শঙ্খ৷
শঙ্খ ত্রিবাঙ্কুর রাজের প্রতীক৷ প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার জাফনা রাজের পতাকায় ব্যবহার হয় শঙ্খ৷ বাংলার পাশের রাজ্য ওড়িশার বিজু জনতা দলের নির্বাচনী প্রতীক শঙ্খ৷
শঙ্খ ভগবান বিষ্ণুর অন্যতম প্রতীক৷ ভাগবান বিষ্ণু ছাড়াও মত্স্য, কুর্ম, বরাহ এবং নরসিংহ এই চার অবতারও শঙ্খধারী৷ জগন্নাথদেব বিষ্ণুদেবের অবতার বিশেষ, তাই পুরীর অপর নাম শঙ্খ ক্ষেত্র৷
নেপালের গণ্ডকী নদীতেই একমাত্র পাওয়া যাওয়া শালগ্রাম শিলা ভগবান বিষ্ণুর প্রতীক রূপেও পুজো হয়৷ শঙ্খ, চক্র গদা, পদ্ম লাঞ্ছিত শালগ্রাম শিলা ভগবান কেশবরূপে পুজিত হন৷
পুরাণ অনুসারে শঙ্খ এবং লক্ষ্মী দেবী দুই ভাইবোন, দুজনই শমুদ্র উত্থিত৷
এছাড়াও পুরাণে, বা সাহিত্যে জলজ প্রাণীরূপে শঙ্খ আর নাগেদের এক গোত্রভূক্ত করা হযেছে৷ মহাভারত, হরিবংশ আর ভগবত্ পুরাণ অনুসারে নাগেদের কয়েকটি নাম উল্লেখ করা গেল – শঙ্খ, মহাশঙ্খ, শঙ্খপাল, শঙ্খচূড়৷ শেষ দুটি নাম জাতকের কাহিনীতেও পাওয়া যায়৷

শাঁখ শাখার বারোমাস্যা - অন্তমণ্ডল

শাঁখের করাত
খুব বেশী মানুষ জানেন না, যে শাঁখা বাঙালি বউদের, ঐতিহ্যের গর্ব, সেই শাঁখা খুব শক্ত ও কঠিন হওয়ায় এটা যে কেউ কাটতে পারে না৷ শাঁখা কাটার জন্য বিশেষ দক্ষতা ও যন্ত্র লাগে৷ প্রাচীন ভারতে যেহেতু প্রতিটি পেশাকেই আলাদা গোত্রে আলাদা করে দেয়া হয়েছিল, তাই শাঁখার যারা কারিগর, তাদেরও একটা নির্দিষ্ট গোত্র ছিল, যার নাম বাংলায় শাঁখারী৷ শাঁখা কাটা ও কারুকাজ করে বাজারজাত করাই তাদের কাজ, অন্য কেউ এটা করতে পারে না৷
শঙ্খশিল্পের কাজের মধ্যে কুরা ভাঙা, গেঁড়াপাড়া, ঝাঁপানি, শাঁখা কাটাই, গাঁড়াসাজি, ডিজাইন করা, মালামতি করা ও পুটিং দেয়া৷ শাঁখারিরা শঙ্খ কাটতেন শাঁখের করাত দিয়ে, এখন কাটা হয় বিদ্যুতের যন্ত্রে৷ বিদ্যুতকাটাই যন্ত্রর প্রভাবে বিগত কয়েক দশকে তাঁদের জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন হাজার হাজার শিল্পী, শিল্পীদের চোখে আজ কাজ না পাওয়া, ঠিকঠাক নজুরি না পাওয়ার হতাশা, অন্যান্য লোকশিল্পের মতই শাঁখা শিল্পে অস্তরাগের ছোঁয়া, যান্ত্রিক যুগে এসে এখন এ কাজে মেশিন ব্যবহৃত হলেও শিল্পটি অগ্রসর হতে পারছে না৷ কেননা শাঁখা বিদ্যুতচালিত যন্ত্রে কাটা হলেও আদতে কিন্তু সূক্ষ্মকাজ করতে হয় হতেই, শাঁখ আর শাঁখার দাম বেড়ে চলেলেও শিল্পীদের মজুরি বাড়ে না, দেড় দুহাজার পেতেই মুখের রক্ত উঠেযায়, একজন দক্ষ শিল্পী দিনে ১৫/২০ জোড়া শঙ্খ পণ্য তৈরি করতে পারেন৷ তাতে তার দিনে একশ পঞ্চাশ থেকে দুইশ টাকা আয় হয়৷ সলভিনস্ ১৭৯২তে কলকাতায় এসে বাংলার শিল্পী, পরিবহনসহ নানান প্রকৃতি, পেশার মানুষের ছবি এঁকেছিলেন৷ সেখানে সুগঠিত শাঁখারি আর শাঁখের করতের একটি ছবিও পাই৷
নক্সী কাঁথার মাঠএও আমরা পাই শাঁখের করাতের উল্লেখ -
আজকে রূপার সকলি আঁধার, বাড়া-ভাতে ওড়ে ছাই, কলঙ্ক কথা সবে জানিয়াছে, কেহ বুঝি বাকি নাই |
জেনেছে আকাশ, জেনেছে বাতাস, জেনেছে বনের তরু ; উদাস-দৃষ্টি য়ত দিকে চাহে সব যেন শূনো মরু |

চারিদিক হতে উঠিতেছে সুর, ধিক্কার! ধিক্কার!! শাঁখের করাত কাটিতেছে তারে লয়ে কলঙ্ক ধার |ব্যথায় ব্যথায় দিন কেটে গেল, আসিল ব্যথার সাঁজ, পূবে কলঙ্কী কালো রাত এল, চরণে ঝিঁঝির ঝাঁজ! অনেক সুখের দুখের সাক্ষী বাঁশের বাঁশীটি নিয়ে, বসিল রূপাই বাড়ির সামনে মধ্য মাঠেতে গিয়ে |
রূপসাধনে শঙ্খের ব্যবহার
গহনারূপে, বাদ্যযন্ত্ররূপে এর ব্যবহার যেমন অবশ্যম্ভাবী তেমনি প্রসাধনী ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে৷ প্রসাধনী রূপে শাঁখাগুঁড়ো, শঙ্খচুরের উল্লেখ পাওয়া যায় ভারতের নানান সাহিত্য আর পুরাণে, অতীতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অধিকাংশই শাঁখার গুঁড়াকে পাউডার বা প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহার করত৷ আজও নানান জাতের প্রসাধনীর ভীড়ে ব্রণের দাগ তুলতে বা সাধারণভাবে ব্যবহারের জন্য হিন্দু সমাজে তো বটেই মুসলিমদের অনেকেও এগুঁড়ো ব্যবহার করে থাকেন৷ শঙ্খ কাটার সময় শঙ্খের গুঁড়া বের হয়, যা মুখের দাগ দূর করতে ব্যবহার করে মেয়েরা৷ আজ শহরের শাঁখারীবাজারগুলো থেকে শঙ্খগুঁড়া কিনে নিয়ে যায় প্রসাধন কোম্পানি, বিক্রি করে কোটি কোটি কাঞ্চনমূল্যে৷
আয়ুর্বেদে শঙ্খের ব্যবহারের নির্দেশ
শঙ্খধৃত জলেতে ঔষধিগুণের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে-
1) রাতে শাঁখে জল ধরে রেখে পরেরদিন ত্বকে সেই জল ঘষলে ত্বকের নানান রোগে মুক্তিঘটে
2) ত্বকে সাদা দাগ তুলে বলা হচ্ছে, শাঁখে 12 ঘন্টা জল ঘরে রেখে সেই জল সাদা দাগগুলোতে বোলাতে হবে, কয়েকদিন বাদেই সাদা দাগের উপশম ঘটবে
3) রাতে শাঁখের জলে গোলাপ জল মিশিয়ে পরের দিন সেই জল মাথার চুলে লাগাতে হবে, চুলের ঘণত্ব আর কাজলত্ব বহুদিন বজায় থাকবে, সেই জল ভ্রু বা দাড়িতে ঘসলেও সেচুলগুলিও কালো হবে
4) শাঁখে রাখা 12 ঘন্টার জস পান করলে পাকস্থলী বিষয়ক সমস্যা বা অন্ত্রে ক্ষতও সারানো যায়
5) সেই 12 ঘন্টা রাখা একই জলে সাধারণ জল মিশিয়ে চোখ ধুলে চোখের নানান রোগ ভাল হয়, উজ্জ্বল হয়,
6) চোখের নিচে কালো দাগে এই জল বুলোলে কয়েকদিন পর সেই দাগ উঠে যায়
7) ব্রণর দাগের ওপরে এই জল বোলালে সেই কালো দাগ উঠে যায়
এছাড়াও শাঁখ বাজানোর শব্দের কম্পনে জীবানু নাশের কথাও উল্লেখ পাওযা যায় আয়ুর্বেদে, তাই নানান মঙ্গল কর্যে শঙ্খবাদনের নিদান দেওয়া হয়৷
বাংলার শাঁখারিরা
হাজার হাজার বছর ধরে যে শিল্পীরা, প্রযুক্তিবিদেরা শাঁখ, শাঁখা তৈরী করে আসছেন, তাদের কথা না বললে শাঁখার নিয়ে প্রবন্ধের ইতি টানা যাবে না৷
সাধারণ আমরা ভুলে যাই, আমাদের পথ দেখানো বিশেষজ্ঞরাও ভুলে যান, বাংলা তথা ভারতেরর আবহমানকাল ধরে লৌকিক শিল্পীরা বাজারে যাঁরা শুধুই পশরা সাজিয়ে বসেন, তাঁরা যে শুধু ব্যাপারিই নন, তাঁরা আমাদের প্রত্যহিক জীবনের থোড়-বড়ি-খাড়াভাবে বেঁচে থাকার প্রণোদনার উত্সস্বরূপ৷ এঁদের একটি বড় অংশ বহুদিন ধরেই অবহেলায় সমাজের প্রন্তে পড়ে থাকেন৷ অথচ তাদের এই অবহেলা বোধহয় প্রাপ্য ছিল না৷ এদের তুলনা শুধুই এঁরা৷ লৌকিক শিল্পীদের এক বড় অংশ শাঁখারিরা এক দেহে প্রযুক্তিবিদ, শিল্পী আবার যখন তাঁরা তাঁদের নিজস্ব শিল্পদ্রব্যের পশরা সাজিয়ে বসেন – তখন তাঁরা ব্যাপারী৷ সেই শিল্পদ্রব্যের ওপর নানান শৈল্পিক কাজ করার দায এঁরাই নিজেদের কাঁধে তুলে নেন, আর সেই বংশ পরম্পরায কাজের যেন ঘরানা তৈরি হয়ে যায় শহর থেকে শহরে মহল্লা থেকে মহল্লায়৷
এঁরা যুগযুগ ধরে শঙ্খসহ নানান শিল্পের প্রযুক্তি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে বাঁচিয়ে রেখে দেশের লৌকিক প্রযুক্তির সেবা করে চলেন৷ হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের দেশের লৌকিক শিল্পীরা তাঁদের সাধের প্রযুক্তি বাঁচিয়ে রেখেছেন, শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, বাজারও তৈরি করে চলেছেন নিজেদের দক্ষতায়৷ এধরণের শিল্পী কারিগরের পাশে আজও কিন্তু সশক্তভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাংলার মহিলারাই, যাঁরা নীরবে বয়ে নিয়ে চলেন দেশের সংস্কৃতি৷
এক সময় দাক্ষিণাত্যের শিল্পীরা শঙ্খকে 'পারওয়া' নামে অভিহিত করতেন৷ ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন- ভগ্নস্তূপ থেকে শঙ্খশিল্প আবিষ্কার হয়, বাংলার গীতিকায়ও শংখের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ ঐতিহাসিক জেমস হরনেল লিখেছেন যে, দক্ষিণ ভারতের মাননার উপসাগরের তীরে শঙ্খশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে৷ তখন গ্রিক ও মিশরীয় বণিকদের মাধ্যমে তামিলের শঙ্খ রপ্তানি হত৷ তবে তামিলনাড়ু, দাক্ষিণাত্য, গুজরাট এবং বাংলায় শঙ্খশিল্পের চূড়ান্ত প্রসার ঘটে৷ বঙ্গের নারীরা দেবালয়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত শঙ্খের অলঙ্কার ব্যবহার করতেন৷ বাংলার মেয়েদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল শঙ্খের গহনা৷
শঙ্খ শিল্পায়ন নবশাখ শ্রেণীভুক্ত শঙ্খবণিক সমপ্রদায়ের বৃত্তি বা পেশা৷ শঙ্খ মানুষের পুরনো স্মৃতিবাহী একটি উপাদান৷ কারণ শাঁখা, সিঁদুর সনাতন হিন্দু ধর্মের সদস্যদের ব্যবহৃত চিহ্ন৷ হিন্দু সধবা নারীর জন্য হাতের শাঁখা অপরিহার্য৷ বিয়ের সময় হিন্দু মেয়েদের গায়ে হলুদ দিয়ে ধর্মীয় আচার পালনের মাধ্যমে নবপরিণীতাকে শাঁখা পরানো হয়৷ সুতরাং শাঁখা হিন্দু নারীদের বৈবাহিক অবস্থার ইঙ্গিতবাহী স্বামীর অস্তিত্ব প্রকাশ এবং দাম্পত্য সুখের পরিচায়ক৷ স্বামীর প্রয়াণে হাতের শাঁখা ভেঙে ফেলা হয়৷ শাঁখার ব্যবহার দেখা যায় মন্দির কিংবা গৃহে পূজার উপকরণ হিসেবে৷ সেগুলো হলো বাদ্যশঙ্খ এবং জলশঙ্খ৷ শাঁখারিরা পেশার সঙ্গে ধর্মের ঘনিষ্ঠতা অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানের পাশাপাশি নিজেদের পেশাকে পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করে৷ গবেষকদের ধারণা, প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে দক্ষিণ ভারতে শঙ্খশিল্পের উদ্ভব৷ কালক্রমে ঢাকা আর বিষ্ণুপুর শহর শঙ্খশিল্পের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে৷ শঙ্খশিল্পকে কেন্দ্র করে অতীতে দাক্ষিণাত্য, ঢাকা, বরিশাল, বগুড়া, নদীয়া, মাদ্রাজ, কলকাতা, বিষ্ণুপুর, রংপুর, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে এক বিশেষ শিল্পসমাজ বিকশিত হয়৷ এ শিল্পের সঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে জড়িত৷ শঙ্খশিল্পের বিকাশে অর্থনৈতিক ও পৌরাণিক ইতিহাস জড়িত৷ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রুচিবোধের মাধ্যমে শঙ্খশিল্পের ঐতিহাসিক পরিচয় ফুটে ওঠে৷
কলকাতার এক শাঁখারিপাড়ায় বাংলার হাজারো শাঁখার দোকানেরমত শাঁখার একটি দোকান সাজিয়ে বসেছেন নাগ পরিবার৷ কতশত বছর আগে তা আর তাদের মনে নেই৷ দোকানে নানা রকমের শাঁখা থরে থরে সাজানো৷ ভারি দৃষ্টিনন্দন, নজরকাড়া এবং একটির কারুকার্য আরেকটির থেকে পুরোপুরি আলাদা৷ কোনোটাতে যদি ময়ূরের ছাপ তোলা, তবে অন্যটাতে আছে হাতির মুখ৷ যথেষ্ট ধৈর্য ও শৈল্পিক মন না থাকলে সম্ভব নয় এমনভাবে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা৷ একটা শঙ্খ কেটে পাঁচ থেকে বড়জোর ছটা শাঁখা তৈরি হয়৷ তিন শ থেকে দেড় হাজার টাকায় একজোড়া শাঁখার বিক্রি৷ শাঁখার ওপর নানান পাথর বসানো হয়, বসানো হয় স্বর্ণ৷ শুধু শাঁখাই নয়, হিন্দুদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস ও বিয়ের টুকিটাকি সামগ্রী—মুকুট, সিঁদুর, পলা—এসবও পাওয়া যায় এখানে৷ প্রতিদিনের সান্ধ্য আরতির প্রধান বাদ্য শঙ্খও পাওয়া যায় এসব দোকানে৷ পরিবার প্রধান বললেন, শ্রীলঙ্কা বা মাদ্রাজ থেকে একটি শঙ্খের আমদানির দাম পড়ে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা৷ এ রকম একটি শঙ্খ কেটে চার-পাঁচটির বেশি শাঁখা তৈরি করা যায় না৷ এতে এক জোড়া শাঁখার উত্পাদনমূল্য কমপক্ষে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পড়ে৷ দেখা গেছে, শঙ্খবণিকেরা এ রকম এক জোড়া দেশি কারুকাজের শাঁখার দাম রাখছেন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা৷ শঙ্খ ঘরসজ্জা ও অলংকার হিসেবেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়৷ পদ্মডুগী, সাত দানা (সাতগাছা চুড়ি), পাঁচ দানা ও তিন দানার চুড়ি এবং সাদা বালা ও আউলাবেশী বালা এখন সবচেয়ে বেশি চলে৷ তবে সামর্থ্যবানেরা শাঁখার ওপর এখন স্বর্ণের কারুকাজ করে হাতের বালা হিসেবেও পরেন৷ যদিও শঙ্খ কাটায় তেমন খরচ নেই৷ তবে এক জোড়া শাঁখায় নকশা করার মজুরি প্রায় ২০০ টাকা৷ বণিকেরা বলেন, এখানে শিল্পীর মজুরি কমানো সম্ভব নয়৷ তাই শাঁখারী, নকশাকার ও শঙ্খ কেনার খরচ মিলিয়ে এক জোড়া শাঁখার যে উত্পাদন খরচ পড়ে, তাতে লাভ রেখে বেশি দামে শাঁখা বিক্রি করে লাভ করা অসাধ্যপ্রায়৷
শাঁখারীপাড়ার আর এক দোকানি নাগপরিবারের পারিবারিক ব্যবসা প্রায় ৭৫ বছরের৷ তিনি বলেন, ‘যে শামুক থেকে শাঁখা বা শঙ্খ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি করা হয়, তা আসে শ্রীলঙ্কা থেকে৷ এ ছাড়া কেবল মাদ্রাজে এই শাঁখ পাওয়া যায়৷ আমরা ছয় মাস পরপর শ্রীলঙ্কায় যাই, অনেক শঙ্খ নিয়ে আসি৷ তারপর আমরা নিজেরা শাঁখের করাত দিয়ে কাটি এবং তার ওপর শিল্পীদের দিয়ে ডিজাইন করাই৷’ তিনি জানান, ১৫-২০ রকম নকশার শাঁখা এখন বাজারে পাওয়া যায়৷ তার মধ্যে বেকি নামের নকশাটা বেশি চলছে৷ অতীতে শাঁখার গহনা গড়ার জন্য শাঁখের করাত- সংস্কৃতে যাকে কুশ বলে- ব্যবহৃত হত৷ এ এলাকায় এখনো প্রায় ৭০/৮০টি পরিবার এ শিল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং তাদের একমাত্র পেশাও বটে৷ কিন্তু সীমিত গন্ডির মধ্যে থেকে বিদেশ, দেশেক নানান প্রান্তথেকে কাঁচামাল আমদানি করে এ শিল্পের মাধ্যমে উপার্জন করাটা দায় হয়ে পড়েছে৷
শাঁখা যদি-বা সব সমুদ্রেই জন্ম নেয় কিন্তু তারা যে শাঁখা দিয়ে কাজ করেন তা কেবল ভারত মহাসাগরে জন্ম নেয়৷ আর এ শ্রেণীর শাঁখা তাদের শ্রীলংকা ও মাদ্রাজ থেকে চড়া দামে আমদানি করতে হয়৷ যার ফলে লাভের অংক খুব বেশি থাকে না কিন্তু তারপরও ক্রেতাদের সন্তুষ্ট রাখা যায় না৷ এ কারণেই অনেক শাঁখারী বাপ-দাদার শিল্পকর্ম বা ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে উপার্জনের জন্য অন্য পথ ধরেছেন৷ কিন্তু তারপরও তাদের অনেকেই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন৷

Sunday, September 12, 2010

শাঁখ শাখার বারোমাস্যা - চারুমণ্ডল

বাংলা সাহিত্যে শাঁখ, শাঁখা
হাতে শাঁখা পরে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় বাঙালি মেয়েরা শাঁখ বাজিয়ে স্মরণ করেন সম্পদের দেবী লক্ষ্মী দেবীকে - শঙ্খ বাজিয়ে তোমায় ঘরে এনেছি; সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে আসন পেতেছি৷ প্রদীপ জ্বেলে নিলাম তোমায় বরণ করে, জনম জনম থাকো আমার এঘরে, এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে৷
বাংলার শহুরে বা লৌকিক সাহিত্যে বার বার উঠে এসেছে শাঁখ আর শাঁখা অনুষঙ্গ, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তার গ্রাম্য ছড়া সংগ্রহে উল্লেখ করেছেন পার্বতী আর মহাদেবের শাঁখা আর শাঁখারির এক কৌতুকতর সাংসারিক কোন্দল৷ শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ গ্রাম্যছড়া সংগ্রহের মাধ্যমে বাংলার লোকসম্পদ সংগ্রহের এক আন্দোলনের সূচনা করে এই নাম জানা-অজানা শিল্পীদের, সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মাননা জানান, রবীন্দ্র জন্ম সার্ধশতবছরে লৌকিক শিল্পীদের পক্ষথেকে গঙ্গা জলে গঙ্গাপুজোর আদলে ঠাকুর রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম জানানো হল রবীন্দ্রনাথের এই লেখাটি ছাপিয়ে-
যে ছড়ার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি তাহাতে দেবদেবীর একটি গোপন ঘরের কথা বর্ণিত আছে৷
শিব সঙ্গে রসরঙ্গে বসিয়ে ভবানী৷ কুতূহলে উমা বলেন ত্রিশূল শূলপাণি৷৷ তুমি প্রভু, তুমি প্রভু ত্রৈলোক্যের সার৷
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের বরুণ তোমারি কিংকর৷৷ তোমার নারী হয়ে আমার সাধ নাহি পোরে৷ যেন বেন্যা পতির কপালে প’ড়ে রমণী ঝোরে৷৷ দিব্য সোনার অলংকার না পরিলাম গায়৷ শামের বরন দুই শঙ্খ পরতে সাধ যায়৷৷ দেবের কাছে মরি লাজে হাত বাড়াতে নারি৷ বারেক মোরে দাও শঙ্খ, তোমার ঘরে পরি৷৷
ভোলানাথ ভাবিলেন, একটা কৌতুক করা যাক, প্রথমেই একটু কোন্দল বাধাইয়া তুলিলেন৷
ভেবে ভোলা হেসে কন শুন হে পার্বতী , আমি তো কড়ার ভিখারি ত্রিপুরারি শঙ্খ পাব কথি৷৷ হাতের শিঙাটা বেচলে পরে হবে না, একখানা শঙ্খের কড়ি৷ বলদটা মূল করিলে হবে কাহনটেক কড়ি৷৷ এটি ওটি ঠাক ঠিকাটি চাও হে গৌরী, থাকলে দিতে পারি৷ তোমার পিতা আছে বটে অর্থের অধিকারী৷ সে কি দিতে পারে না দুমুটো শঙ্খের মুজুরি৷৷
এই-যে ধনহীনতার ভড়ং এটা মহাদেবের নিতান্ত বাড়াবাড়ি,….স্ত্রী যখন ব্রেস্‌লেট প্রার্থনা করে কেরানিবাবু তখন আয়ব্যয়ের সুদীর্ঘ হিসাব বিশ্লেষণ করিয়া আপন দারিদ্র্য প্রমাণ করিতে বসিলে কোন্‌ ধর্মপত্নী তাহা অবিচলিত রসনায় সহ্য করিতে পারে৷ বিশেষত শিবের দারিদ্র্য ওটা নিতান্তই পোশাকি দারিদ্র্য, তাহা কেবল ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ সকলের উপরে টেক্কা দিবার জন্য, কেবল লক্ষ্মীর জননী অন্নপূর্ণার সহিত একটা অপরূপ কৌতুক করিবার অভিপ্রায়ে৷ কালিদাস শংকরের অট্টহাস্যকে কৈলাসশিখরের ভীষণ তুহিনপুঞ্জের সহিত তুলনা করিয়াছেন৷ মহেশ্বরের শুভ্র দারিদ্র্যও তাঁহার এক নিঃশব্দ অট্টহাস্য৷ কিন্তু দেবতার পক্ষেও কৌতুকের একটা সীমা আছে৷ মহাদেবী এ সম্বন্ধে নিজের মনের ভাব যেরূপে ব্যক্ত করিলেন তাহা অত্যন্ত স্পষ্ট৷ তাহাতে কোনো কথাই ইঙ্গিতের অপেক্ষায় রহিল না৷
গৌরী গর্জিয়ে কন ঠাকুর শিবাই, আমি গৌরী তোমার হাতে শঙ্খ পরতে চাই৷৷আপনি যেমন যুব্‌-যুবতী অমনি যুবক পতি হয়, তবে সে বৈরস রস, নইলে কিছুই নয়৷৷ আপনি বুড়ো আধবয়সী ভাঙধুতুরায় মত্ত, আপনার মতো পরকে বলে মন্দ৷৷
এইখানে শেষ হয় নাই–ইহার পরে দেবী মনের ক্ষোভে আরো দুই-চারটি যে কথা বলিয়াছেন তাহা মহাদেবের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্বন্ধে, তাহা সাধারণ্যে প্রকাশযোগ্য নহে৷ সুতরাং আমরা উদ্‌ধৃত করিতে ক্ষান্ত হইলাম৷ ব্যাপারটা কেবল এইখানেই শেষ হইল না; স্ত্রীর রাগ যতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে, অর্থাৎ বাপের বাড়ি পর্যন্ত, তাহা গেল৷
কোলে করি কার্তিক হাঁটায়ে লম্বোদরে, ক্রোধ করি হরের গৌরী গেলা বাপের ঘরে৷৷
এ দিকে শিব তাঁহার সংকল্পিত দাম্পত্য-প্রহসনের নেপথ্যবিধান শুরু করিলেন–
বিশ্বকর্মা এনে করান শঙ্খের গঠন৷ শঙ্খ লইয়া শাঁখারি সাজিয়া বাহির হইলেন-, দুইবাহু শঙ্খ নিলেন নাম শ্রীরাম লক্ষ্মণ৷ কপটভাবে হিমালয়ে তলাসে ফেরেন৷৷ হাতে শূলী কাঁখে থলি শম্ভু ফেরে গলি গলি৷ শঙ্খ নিবি শঙ্খ নিবি এই কথাটি ব’লে৷৷ সখীসঙ্গে বসে গৌরী আছে কুতূহলে৷ শঙ্খ দেখি শঙ্খ দেখি এই কথাটি বলে৷৷ গৌরীকে দেখায়ে শাঁখারি শঙ্খ বার ক’ল্ল৷ শঙ্খের উপরে যেন চন্দ্রের উদয় হল৷৷ মণি মুকুতা-প্রবাল-গাঁথা মাণিক্যের ঝুরি৷ নব ঝলকে ঝলছে যেন ইন্দ্রের বিজুলি৷৷
দেবী খুশি হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–
শাঁখারি ভালো এনেছ শঙ্খ৷ শঙ্খের কত নিবে তঙ্ক৷৷
দেবীর লুব্ধভাব দেখিয়া চতুর শাঁখারি প্রথমে দর-দামের কথা কিছুই আলোচনা করিল না; কহিল-
গৌরী, ব্রহ্মলোক, বৈকুণ্ঠ, হরের কৈলাস, এ তো সবাই কয়৷ বুঝে দিলেই হয়৷হস্ত ধুয়ে পরো শঙ্খ, দেরি উচিত নয়৷৷
শাঁখারি মুখে মুখে হরের স্থাবর সম্পত্তির যেরূপ ফর্দ দিল তাহাতে শাঁখাজোরা বিশেষ সস্তায় যাইবে মহাদেবীর এমন মনে করা উচিত ছিল না৷
গৌরী আর মহাদেবে কথা হল দড়৷ সকল সখী বলে দুর্গা শঙ্খ চেয়ে পরো৷৷ কেউ দিলেন তেল গামছা কেউ জলের বাটি৷ দেবের ঊরুতে হস্ত থুয়ে বসলেন পার্বতী৷৷ দয়াল শিব বলেন, শঙ্খ আমার কথাটি ধরো–
দুর্গার হাতে গিয়ে শঙ্খ বজ্র হয়ে থাকো৷৷ শিলে নাহি ভেঙো শঙ্খ, খড়েগ নাহি ভাঙো৷ দুর্গার সহিত করেন বাক্যের তরঙ্গ৷৷ এ কথা শুনিয়া মাতা মনে মনে হাসে৷ শঙ্খ পরান জগৎপিতা মনের হরষে৷৷ শাঁখারি ভালো দিলে শঙ্খ মানায়ে৷ ভাণ্ডার ভেঙে দেইগে তঙ্ক, লওগে গনিয়ে৷৷
এতক্ষণে শাঁখারি সময় বুঝিয়া কহিল–
আমি যদি তোমার শঙ্খের লব তঙ্ক৷ জ্ঞেয়াত-মাঝারে মোর রহিবে কলঙ্ক৷৷
ইহারা যে বংশের শাঁখারি তাঁহাদের কুলাচার স্বতন্ত্র; তাঁহাদের বিষয়বুদ্ধি কিছুমাত্র নাই; টাকাকড়ি সম্বন্ধে বড়ো নিস্পৃহ; ইঁহারা যাঁহাকে শাঁখা পরান তাঁহাকে পাইলেই মূল্যের আর কোনোপ্রকার দাবি রাখেন না৷ ব্যবসায়টি অতি উত্তম৷
কেমন কথা কও শাঁখারি কেমন কথা কও৷ মানুষ বুঝিয়া শাঁখারি এ-সব কথা কও৷৷
শাঁখারি কহিল–
না করো বড়াই দুর্গা না করো বড়াই৷ সকল তত্ত্ব জানি আমি এই বালকের ঠাঁই৷৷ তোমার পতি ভাঙড় শিব তা তো আমি জানি৷ নিতি নিতি প্রতি ঘরে ভিক্ষা মাগেন তিনি৷৷ ভস্মমাখা তায় ভুজঙ্গ মাথে অঙ্গে৷ নিরবধি ফেরেন তিনি ভূত-পেরেতের সঙ্গে৷৷
ইহাকেই বলে শোধ তোলা! নিজের সম্বন্ধে যে-সকল স্পষ্ট ভাষা মহাদেব সহধর্মিণীরই মুখ হইতে মধ্যে মধ্যে শুনিয়া আসিয়াছেন, অদ্য সুযোগমত সেই সত্য কথাগুলিই গৌরীর কানে তুলিলেন৷
এই কথা শুনিয়া মায়ের রোদন বিপরীত৷ বাহির করতে চান শঙ্খ না হয় বাহির৷৷ পাষাণ আনিল চণ্ডী, শঙ্খ না ভাঙিল৷ শঙ্খেতে ঠেকিয়া পাষাণ খণ্ড খণ্ড হল৷৷ কোনোরূপে শঙ্খ যখন না হয় কর্তন৷ খড়গ দিয়ে হাত কাটিতে দেবীর গেল মন৷৷ হস্ত কাটিলে শঙ্খে ভরিবে রুধিরে৷ রুধির লাগিলে শঙ্খ নাহি লব ফিরে৷৷ মেনকা গো মা,
কী কুক্ষণে বাড়াছিলাম পা৷৷ মরিব মরিব মা গো হব আত্মঘাতী৷ আপনার গলে দিব নরসিংহ কাতি৷৷
অবশেষে অন্য উপায় না দেখিয়া দুর্গা ধূপদীপনৈবেদ্য লইয়া ধ্যানে বসিলেন৷
ধ্যানে পেলেন মহাদেবের চরণ দুখান৷
তখন ব্যাপারটা বুঝা গেল, দেবতার কৌতুকের পরিসমাপ্তি হইল৷
কোথা বা কন্যা, কোথা বা জামাতা৷ সকলই দেখি যেন আপন দেবতা৷৷
এ যেন ঠিক স্বপ্নেরমতো হইল৷ নিমেষের মধ্যে-
দুর্গা গেলেন কৈলাসে, শিব গেলেন শ্মশানে৷ ভাঙ ধুতুরা বেঁটে দুর্গা বসলেন আসনে৷ সন্ধ্যা হলে দুইজনে হলেন একখানে৷৷
কিন্তু কড়া জবাব দিয়া কার্যোদ্ধার হয় নাই৷ বরং তর্কে পরাস্ত হইলে গায়ের জোর আরো বাড়িয়া উঠে৷ সেই বুঝিয়া দুর্গা তখন-
গুটি পাঁচ-ছয় সিদ্ধির লাড়ু যত্ন ক’রে দিলেন৷
দাম্পত্যযুদ্ধে এই ছয়টি সিদ্ধির লাড়ু কামানের ছয়টা গোলার মতো কাজ করিল; ভোলানাথ এক-দমে পরাভূত হইয়া গেলেন৷ সহসা পিতা কন্যা জামাতার ঘনিষ্ঠ মিলন হইয়া গেল৷ বাক্যহীন নন্দী সকৌতুক ভক্তিভরে দ্বারপার্শ্বে দাঁড়াইয়া মনে মনে হাসিতে লাগিল-
সম্ভ্রমে সম্ভাষণ করি বসলেন তিন জন৷ দুগা, মর্তে যেয়ে কী আনিবে আমার কারণ৷৷ প্রতিবারে কেবলমাত্র বিল্বপত্র পাই৷ দেবী বললেন, প্রভু ছাড়া কোন্‌ দ্রব্য খাই৷৷ সিঁদুর-ফোঁটা অলকছটা মুক্তা গাঁথা কেশে৷ সোনার ঝাঁপা কনকচাঁপা, শিব ভুলেছেন যে বেশে৷৷ রত্নহার গলে তার দুলছে সোনার পাটা৷ চাঁদনি রাত্রিতে যেন বিদ্যুৎ দিচ্ছে ছটা৷৷ তাড় কঙ্কণ সোন্‌ পৈঁছি শঙ্খ বাহুমূলে৷ বাঁক-পরা মল সোনার নূপুর, আঁচল হেলে দোলে৷৷ সিংহাসন, পট্টবসন পরছে ভগবতী৷ কার্তিক গণেশ চললেন লক্ষ্মী সরস্বতী৷৷ জয়া বিজয়া দাসী চললেন দুইজন৷ গুপ্তভাবে চললেন শেষে দেব পঞ্চানন৷৷ গিরিসঙ্গে পরম রঙ্গে চললেন পরম সুখে৷ ষষ্ঠী তিথিতে উপনীত হলেন মর্তলোকে৷৷ সারি সারি ঘটবারি আর গঙ্গাজল৷ সাবধানে নিজমনে গাচ্ছেন মঙ্গল৷৷
অথবা সাধারণ গ্রামীণ ছড়ায় বারবার উঠে আসছে শাঁখের কথা
মাসি পিসি বনকাপাসি, বনের মধ্যে টিয়ে৷ মাসি গিয়েছে বৃন্দাবন দেখে আসি গিয়ে৷৷ কিসের মাসি, কিসের পিসি, কিসের বৃন্দাবন৷ আজ হতে জানলাম মা বড়ো ধন৷৷ মাকে দিলাম শাঁখা শাড়ি, বাপকে দিলাম নীলে ঘোড়া৷ ভাইয়ের দিলাম বিয়ে৷৷ আবার মায়ে দিল সরু শাঁখা, বাপে দিল শাড়ি৷ ঝপ্‌ ক’রে মা বিদেয় কর্‌-, রথ আসছে বাড়ি৷৷ আগে আয় রে চৌপল-, পিছে যায় রে ডুলি৷
গীতায় পাচ্ছি কুরু পাঞ্চালের নানান বীরের হাতে ধৃত শঙ্খের নাম-
তস্য সঞ্জনয়ন্ হর্ষ্ কুরু-বৃদ্ধঃ পিতামহঃ ৷ সিংহ নাদম্ বিনদ্য উচ্চৈঃ শঙ্খম্ দধ্‌মৌ প্রতাপবান ৷১২৷ ততঃ শঙ্খাঃ চ ভের্যাঃ চ পনব আনক গোমুখাঃ ৷ সহসা এব অভ্যহন্ন্ত সঃ শব্দঃ তুমুলঃ অভবত্ ৷১৩৷ ততঃ শ্বেতৈঃ হয়ৈঃ যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ ৷ মাধবঃ পান্ডবঃ চ এব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্‌মতুঃ ৷১৪৷ পাঞ্চজন্যম্ হৃষীক-ঈশঃ দেবদত্তম্ ধনঞ্জয়ঃ ৷ পৌন্ড্রম্ দধ্‌মৌ মহাশঙ্খম্ ভীমকর্মা বৃক-উদর ৷১৫৷ অনন্ত বিজয়ম্ রাজা কুন্তীপুত্রঃ যুধিষ্ঠিরঃ ৷ নকুলঃ সহদেবঃ চ সুঘোষ-মনিপুস্পকৌ ৷১৬৷ কাশ্যঃ চ পরম-ইষু-আসঃ শিখন্ডী চ মহারথঃ ৷ ধৃষ্টদ্যুম্নঃ বিরাটঃ চ সাত্যকি চ অপরাজিতঃ ৷১৭৷ দ্রুপদঃ দ্রৌপদেয়াঃ চ সর্বশঃ পৃথিবী পতে ৷ সৌভদ্রঃ চ মহা বাহু শঙ্খান দধ্‌মুঃ পৃথক্ পৃথ্ক ৷১৮৷সঃ ঘোষঃ ধার্তরাষ্ট্রাণাম্ হৃদয়ানি ব্যদারয়াত্ ৷ নভঃ চ পৃথিবীম্ চ এব তুমুলঃ অভ্যনুনাদয়ন ৷১৯৷
বঙ্গার্থ- তখন কুরু বংশের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম দুর্যোধনের হর্ষ উত্পাদনের জন্য সিংহের গর্জ্জনের মত অতি উচ্চনাদে তার শঙ্খ বাজালেন৷ তারপর শঙ্খ ভেরী পনক আনক ঢাক এবং গোমুখ সিংঙ্গা সমুহ হঠাত্ একত্রে ধ্বনিত হয়ে এক তুমুল শব্দের সৃষ্টি হল৷ অন্যদিকে শ্বেত অশ্বসমুহ যুক্ত একদিব্য রথে স্থিত শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুন উভয়ে তাদের দিব্য শঙ্খ বাজালেন৷ তখন শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চজন্য নামক শঙ্খ বাজালেন৷এবং অর্জুন বাজালেন তার দেবদত্তক নামক শঙ্খ এবং বিপুল ভোজন প্রীয় ভীমকর্মা সেন বাজালেন পৌন্ড্র নামক তার ভয়ঙ্কর শঙ্খ৷ কুন্তীপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির অনন্ত বিজয় নামক শঙ্খ বাজালেন, এবং নকুল এবং সহদেব বাজালেন সুঘোষ এবং মনিপুস্পক নামক শঙ্খ৷ হে মহারাজ তখন মহান ধনুর্ধর কাশিরাজ, প্রবল যোদ্ধা শিখন্ডি,ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট এবং অপরাজিত সাত্যকি, দ্রুপদ দ্রৌপদীর পুত্রগন, সুভদ্রার মহা বলবান পুত্র এবং অন্য সকলে তাদের নিজ নিজ পৃথক শঙ্খ বাজালেন৷ শঙ্খ নিনাদের সেই শব্দে আকাশ বিদীর্ন হল৷ পৃথিবী কম্পিত হল এবং তার ফলে ধৃতরাষ্টের হৃদয় প্রবল ভয়ে বিধ্বস্ত হল৷
সাধারণ তুসু গানেতেও লৌকিক জীবনে শঙ্খ ব্যবহারের উল্লেখ পাই - আমার তুষু সিনানে গেছে কালীদহের পুকুরে, কোথায় এক ব্রাহ্মাণ এসে শঙ্খ পরায় তুষুরে, শঙ্খ যে পরলি মাগো মূল্য লিব কার কাছে, ঘরে আছে অবৈ দেবরাজ মূল্য নাও গা তার কাছে, ওহে ওঠে অবৈ দেবরাজ মূল্য দাও হে আমারে, তোমার কন্যা শঙ্খ পরিল কালীদহের পুকুরে, শঙ্খ যে পরলি মাগো হাতে কেমন সেজেছে, অথবা, কি আনন্দ লাগলো মনে, আদিবাসী পাবনে, শাঁখ বাজালো ও দিদিরা, দে উলু দে সকলে, নিয়ে আয় তোরা বরনডালা, টুসুর মায়ের ঘর সাজা, পদ্ম ফুলটা পাতে দিব, হলুদ ফুলের বিছানা, সুগন্ধর ধূপ জ্বেলে দেব, দেব জ্বেলে দীপ বাতি, সারা রাতি থাকব বসে, টুসুর মায়ের পাশে, কি আনন্দ লাগলো মনে, আদিবাসী পাবনে৷
আবার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতর প্রথম পরিচ্ছেদে পূর্ণ, ছোট নরেন, গোপালের মা শীর্ষক কথায় পাই শাঁখা পরা হাত আর শাঁখারীর কথা- “রণজিত রায় ওখানকার জমিদার ছিল৷ তপস্যার জোরে তাঁকে কন্যারূপে পেয়েছিল৷ মেয়েটিকে বড়ই স্নেহ করে৷ সেই স্নেহের গুণে তিনি আটকে ছিলেন, বাপের কাছ ছাড়া প্রায় হতেন না৷ একদিন সে জমিদারির কাজ করছে, ভারী ব্যস্ত; মেয়েটি ছেলের স্বভাবে কেবল বলছে, ‘বাবা, এটা কি; ওটা কি৷’ বাপ অনেক মিষ্টি করে বললে -- ‘মা, এখন যাও, বড় কাজ পড়েছে৷’ মেয়ে কোনমতে যায় না৷ শেষে বাপ অন্যমনস্ক হয়ে বললে, ‘তুই এখান থেকে দূর হ’৷ মা তখন এই ছুতো করে বাড়ি থেকে চলে গেলেন৷ সেই সময় একজন শাঁখারী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল৷ তাকে ডেকে শাঁখা পরা হল৷ দাম দেবার কথায় বললেন, ঘরের অমুক কুলুঙ্গিতে টাকা আছে, লবে৷ এই বলে সেখান থেকে চলে গেলেন, আর দেখা গেল না৷ এদিকে শাঁখারী টাকার জন্য ডাকাডাকি করছে৷ তখন মেয়ে বাড়িতে নাই দেখে সকলে ছুটে এল৷ রণজিত রায় নানাস্থানে লোক পাঠালে সন্ধান করবার জন্য৷ শাঁখারীর টাকা সেই কুলুঙ্গিতে পাওয়া গেল৷ রণজিত রায় কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় লোকজন এসে বললে, যে, দীঘিতে কি দেখা যাচ্ছে৷ সকলে দীঘির ধারে গিয়ে দেখে যে শাঁখাপরা হাতটি জলের উপর তুলেছেন৷ তারপর আর দেখা গেল না৷ এখনও ভগবতীর পূজা ওই মেলার সময় হয় -- বারুণীর দিনে৷
অরু দত্ত তরু দত্ত দুই বোন শাঁখা পরা হাতের কিংবদন্তী বর্ধমানের যোগাদ্যার কাহিনী লিখেছিলেন ইংরেজি পদ্যয়, গত শতাব্দে, যার কুড় কিন্তু সারা বাংলার গ্রামেগঞ্জের লৌকিক কাহিনীতে ছড়িয়ে রয়েছে৷ ঠিক একই কাহিনি আমরা পাই হাওড়ার রাজবল্লভী দেবীর প্রতিষ্ঠার কিংবদন্তীতেও
আর বাংলার মেয়েদের কথা, বাংলার পরিবেশের কথা জীবনানন্দ ছাড়া আর কেইবা তার তুলতুলে পলিমাটিময় কলমে বলেছেন, রূপসী বাংলায় বারবার লিখেছেন-
১)দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ- শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে, শঙ্খের মতো কাঁদে : সন্ধ্যায় দাঁড়াল সে পুকুরের ধারে,
২)চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি- শাদা শাঁখা- বাংলার ঘাস, আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ-আপনার মনে, ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে;- চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস-
৩)ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে, শিয়রে বৈশাখ মেঘ-শাদা-শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড়, নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে- কোনো এক শঙ্খবালিকার, ধূসর রূপের কথা মনে হবে-এই আম জামের ছায়াতে
৪)সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন, তাহাদের হলুদ শাড়ি — ক্ষীর দেহ — তাহাদের অপরূপ মন
৫)চলে গেছে বহু দূরে; — দেখোনিকো, বোঝানিকো, করোনিকো মানা, রূপসী শঙ্খের কৌটা তুমি যে গো প্রাণহীন — পানের বাটায়৷

Saturday, September 11, 2010

শাঁখ শাখার বারোমাস্যা - মধ্যমণ্ডল

শঙ্খাসুরের রক্ত থেকে শঙ্খ
বাঙালী ঐতিহ্যের একটি নির্দিষ্ট স্থান দখল করে আছে শাঁখা৷ শাঁখা ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় আচারভিত্তিক কর্মকান্ডই সুসম্পন্ন হয় না৷ হিন্দু নারীদের সধবা হওয়ার প্রতীকই হলো শাঁখা৷ পৌরানিক কাহিনীতে শাঁখার উত্‍পত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে- শঙ্খাসুরের স্ত্রী তুলসী দেবী ছিল ঈশ্বর নারায়ণে বিশ্বাসী খুবই সতীসাধ্বী নারী৷ কিন্তু শঙ্খাসুর ছিল ঈশ্বরবিমুখ অত্যাচারী৷ তার পাপের শাস্তিস্বরূপ তাকে ঈশ্বরের আদেশে হত্যা করে ভারত মহাসাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়৷ পতিব্রতা তুলসী তা সইতে না পেরে স্বামী এবং নিজের অমরত্বের জন্য ঈশ্বরের কাছে বিনীত প্রার্থনা করে৷ ঈশ্বর তার প্রার্থনা মঞ্জুর করে তার দেহভস্ম থেকে তুলসী গাছ এবং সমুদ্রে হত্যা করা স্বামীর রক্ত থেকে শঙ্খ বা শাঁখা উত্‍পত্তি করেন৷ এখানেই শেষ নয়, তুলসী দেবীর ধর্মপরায়ণতায় সন্তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর তুলসী ও শাঁখাকে তাদের সম্প্রদায়ের ধর্মীয় কাজে ব্যবহারের আবশ্যকতা নির্ধারণ করে দেন৷ সেই থেকে পতিব্রতা তুলসীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে হিন্দু সম্প্রদায় তুলসী ও শাঁখার ব্যবহারের প্রচলন করে৷ এ কাহিনী সূত্রে বলা যায় খ্রীষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে (মহাভারতের যুগে) শাঁখার ব্যবহার শুরম্ন হয়৷ হিন্দু সমাজে শান্তির প্রতীক, মঙ্গলের প্রতীক শাঁখার ব্যবহার বহুল প্রচলিত৷ তবে শাঁখা দিয়ে গড়া গহনা ও বাদ্যশঙ্খের ব্যবহার ছাড়া তাদের সামাজিকতা ও ধর্মীয় কার্যাদি অচল বলা চলে৷ বিবাহিত নারীদের তো বরের দেয়া শাঁখার বালা ধারণ করতেই হবে৷ আর পূজা-অর্চনা, সামাজিক, মাঙ্গলিক বা যেকোন শুভ অনুষ্ঠানে বাদ্য শঙ্খের ধ্বনি ছাড়া তা অসম্ভব বলেই ধরে নেয়া যায়৷
শাঁখের প্রকারভেদ
সাধারণত শাঁখা হয় বামাবর্তী, কিন্তু হাতে গোণা যে সব শঙ্খ দক্ষিণদিকে মুখ করা তাদের দক্ষিণাবর্তী শঙ্খ বলাহয়৷ সনাতন ব্রাহ্মণ্যধর্মে কিন্তু দক্ষিণাবর্তী শঙ্খের চাহিদা আর তার গুরুত্ব বেশ বেশি, এ ধরণের শঙ্খ খুব বেশি পাওয়া যায়না বলেই হয়ত৷ দক্ষিণাবর্তী শঙ্খ দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক৷ আমরা যেন মনেরাখি ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে দক্ষিণ দিকটি সম্পদের দেবতা কুবেবের দিক, সে জন্যও হয়ত দক্ষিণবর্ত শঙ্খের দাম৷ সুপুরি থেকে বড় নারকেলের পরিমানমত হয়ে থাকে দক্ষিণাবর্তী শঙ্খ৷ আজকের বাজারে একটি সাধারণ দক্ষিণাবর্তী শঙ্খের দাম দেড় হাজার টাকা থেকে দুহাজার টাকা প্রতি গ্রাম, আবার দক্ষিণাবর্তী শঙ্খের দুধেলা প্রকারের দাম হয় গ্রাম প্রতি দু হাজার টাকাও৷ কখোনো আবার লক্ষণ, রং আর নানান উপাদানের উপর নির্ভর করে দাম ওঠে গ্রাম প্রতি দশহাজার টাকা পর্যন্তও৷ মাঝারি পরিমানের একটি দক্ষিণাবর্তী শঙ্খের দাম ওঠে প্রায় দশ থেকে পনের লাখ টাকা৷
ভারতে যেসব শঙ্খ ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে শঙ্খের ব্যবহার হয় দুভাবে ৷ আস্ত শঙ্খ আর কাটা শঙ্খ, যেখানথেকে তৈরি হয় শাঁখা, নানান শঙ্খজাত দ্রব্য৷ আস্ত শঙ্খ আবার ব্যবহার করা হয় দুভাবে৷ তার একটি বাদ্যশঙ্খ অন্যটি জলশঙ্খ৷ আর কাটা শঙ্খ দিয়ে হয় শাঁখা, আংটি, চুনসহ নানা উপকরণ৷
বাদ্যশঙ্খ : শ্রীলঙ্কা থেকে আসা শঙ্খ পরিষ্কার করে পেছনের অংশ কেটে বাদ্যশঙ্খ তৈরি করা হয়৷ এ শঙ্খ বিশেষ কায়দায় ধরে কাটা অংশ মুখে লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে শব্দের সৃষ্টি করা হয়৷ এ শব্দকে বলা হয় মঙ্গলধ্বনি৷ পূজার আগে বা বিশেষ ক্ষণে বাদ্যশঙ্খ বাজিয়ে মঙ্গলধ্বনি দেওয়া হয়৷ প্রতিটি মন্দির অথবা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে বাদ্যশঙ্খ একটি প্রয়োজনীয় উপকরণ৷
জলশঙ্খ : জলশঙ্খ অনেকটা বাদ্যশঙ্খের মতোই৷ তবে এতে জলশঙ্খের মতো পেছনের অংশ কাটা হয় না৷ আস্ত শঙ্খটিকে চিত করে রেখে তার মধ্যে জল রাখা হয়৷ জল রাখা হয় বলেই এর নাম জলশঙ্খ৷ জলশঙ্খের জল পূজার কাজে ব্যবহৃত হয়৷ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জলশঙ্খে রাখা জল গঙ্গার জলের মতোই পবিত্র মনে করেন৷ জলশঙ্খ মন্দিরে বা ঘরে একটি ত্রিপদের ওপর রাখা হয়৷
বাদ্যশঙ্খ ও জলশঙ্খ উভয়ের গায়ে নকশা করা থাকে৷ নকশা ছাড়া শঙ্খও ব্যবহার কম নয়৷
সাধারণত প্রতিটি শঙ্খে গায়ে দেখা যায় ফুল, লতাপাতার নকশা৷ বিশেষ কিছু শঙ্খের ওপর মা কালী, রাধা-কৃষ্ণ, দুর্গা প্রতিমার নকশাও দেখা যায়৷ দিনের পর দিন কাটাকাটি করে একটি শঙ্খের ওপর নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়৷ নকশা করা প্রতিটি শঙ্খ বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম উপাদান৷ শখের হাঁড়ি, কাঠের পুতুল, মনসার মঞ্জুষ, পাথরের তৈজস, শোলার কদম, লক্ষ্মী সরার মতোই নকশা করা শঙ্খ লোকশিল্পের উপাদান৷ ঐতিহাসিক কেদারনাথ মজুমদারের 'ঢাকার বিবরণ' (১৯১০) গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে সে সময় ঢাকার কারখানার জন্য শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকা থেকে তিন-চার লাখ টাকার শঙ্খ আমদানি করা হতো৷ শঙ্খগুলোর ছিল তিতকৌড়ি শঙ্খ (লঙ্কা দ্বীপ), পটী শঙ্খ (সেতুবন্ধ রামেশ্বর), ধলা শঙ্খ (সেতুবন্ধ রামেশ্বর), জাহাজী শঙ্খ (সেতুবন্ধ রামেশ্বর), গুড়বাকী (মাদ্রাজ), সরতী, দুয়ানী পটী (মাদ্রাজ), আলাবিলা শঙ্খ, জলী শঙ্খ (মাদ্রাজ)৷ শাঁখারিদের অর্থনৈতিক অবকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে শঙ্খশিল্পের ওপর৷ শাঁখারিরা শঙ্খের অলঙ্কার তৈরির জন্য বেশ কয়েক প্রকারের শঙ্খ ব্যবহার করে৷ এগুলোর নাম আজকাল আর উল্লেখ পাওয়া য়ায না – আগেকার পুস্তক থেকে য়া পাওয়া গেল দিলাম - তিতপুটি, রামেশ্বরী, জামাইপাটি, পাঁজি, দোয়ানি, মতি ছালামত, পাটী, গায়বেশী, কাব্বাম্বী, ধনা, জাডকি, কলকো, নারাখাদ, খগা, তিতকৌড়ি, গড়বাকী, জাহানী, সুর্কীচোনা, সরতী, আলাবিলা প্রভৃতি৷ এসব শঙ্খের প্রাপ্তিস্থল শ্রীলঙ্কা, মাদ্রাজের উপকূল৷

Friday, September 10, 2010

শাঁখ শাখার বারোমাস্যা - নাম্দীমুখ

(এই লেখাটি তৈরির পথে লোকফোক-এর বিশ্বেন্দু বহু মানুষের, বহু ওয়েবসাইটের, বহু সংবাদপত্রের পরামর্শ, সহায়তা, অকৃপণ ও অযাচিত আনুকূল্য নাভ করেছে৷ এই ক্ষুদ্র পরিসরে সকলের নাম বলা না গেলেও, এই লেখাটি দেখে অনেকই বুঝবেন তাদের হস্তবলেপনের তথ্য৷ সব্বাইকে ব্লগ আর কলাবতী মুদ্রার পক্ষথেকে প্রণাম, ভালবাসা আর শুভেচ্ছা)
প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শাঁখা-সিঁদুর পরা একটা মেয়ে ঘরে জ্বালিয়ে দেয় সন্ধ্যাপ্রদীপ৷ উলুধ্বনি দিয়ে বাজায় শঙ্খ, প্রদীপ দেয় তুলসিমঞ্চে৷ পরিবারের প্রতি, স্বামীর প্রতি, স্বজনের প্রতি, নানান সম্পর্কের প্রতি মঙ্গল কামনায় প্রণাম করে এবং তার পরিবেশের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় শাঁখা ছোঁয়ায় কপালে৷ প্রান্ত বাংলার গ্রামে গ্রামে লাখো লাখো বিবাহিত মেয়ে আজও তুলসি তলায় শাঁখা হাতে পরে প্রণাম দেয়৷ আমাদের বিবাহিত মেয়েটাও হাজার বছরের বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রেখে দিতে চায় তার শাঁখা পরা হাতে তুলসি তলায় সান্ধ্য প্রণামের রোজকার আচারের মধ্যে৷
আগেরদিনই পুকুরঘাটে তার হাতের শাঁখা ভেঙেছে৷ পরিবার, স্বজনের অমঙ্গলের আশঙ্কায় দুরুদুরু করে ওঠে তার অন্তর৷ হাজার হাজার বছরের সংস্কারেরর বেড়ায় জুড়ে থাকা বিবাহিত স্ত্রীটিধনকে বেঁধে রাখা যায়নি৷ পরের দিনই সক্কাল সক্কাল আপিস যাবার পথে বরকে তাড়া দিয়েই সে নিয়ে গিয়েছে শহরের শাঁখারি বাজারে৷ সেখান থেকে সে প্রায় মনেরমত শাঁখা পরে এসেছে৷ দাম বেড়েছে, মন খারাপ৷ মনেরমত মকরমুখী শাঁখাটি পেতে তাকে গুণতে হয়েছে বেশ কয়েকশ টাকা৷ তবুও আগের ভেঙে যাওয়া শাঁখাটির ওপর করা কাজেরমত হয়নি৷ তবুও সন্তুষ্ট সে৷ বাড়িতে ফিরে নতুন মকরমুখী শাঁখাটিতে একটু সিঁদুর ছুঁইয়েই তার শান্তি৷ সেই সন্ধ্যায় তুলসিতলার পুজোটা আরও একটু গাঢ় হয়ে ওঠে তার৷
সকালে শাঁখারিবাজারের শাঁখা পরার উপাচারের পর সন্ধ্যায়ও মেয়েটার হাত তাই রীতিমতো লাল৷ দু বেলা চলে গিয়েছে, তবু তখনও প্রচণ্ড জ্বলছে হাতখানা৷ তার পরও তার মুখে হাসি৷ পরিবারের মঙ্গল কামনায় তার যত কষ্টই হোক, সে তা সইবে৷ সে জানে তার মা দিদিমা শ্বাশুড়িরাও এই ঐতিহ্যকে বুকে করে বেঁচেছেন, কৃষ্টি সজল চোখে তাদের দেখানো পথে সেও হাঁটতে চায়৷
বাংলার মফস্বলের শহরে শহরে শাঁখারীবাজারে গিয়ে চোখে জল আনা এমন নানান ঐতিহ্যবরণ চিত্র আজও এই শপিংমল সংস্কৃতির ভাঙাহাটে আদুরি সরারমত পরতে পরতে আনন্দে নীরবে খেলা করে চলে৷ বাংলার চিরাচরিত লৌকিক কৃষ্টির ঐতিহ্য মরেও যেন মরে না৷ শতাব্দের পর শতাব্দ মন্বন্তর, লুঠপাট, মারী, রাষ্ট্র বিপ্লব, ঝড়-জল-বণ্যা সয়ে সে তার রেশ টুকু ছড়িয়ে দিয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, যুগ থেকে যুগান্তরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে৷ শুধু লৌকিক ধর্ম বিশ্বাসই নয, এই পশ্চিমি সংস্কৃতির পালতোলা সময়েও হাজার হাজার বছরের মাটির গন্ধ ভরা বাঙলিত্বের আঘ্রাণে মাখোমাখো বর্ণময় ভিন্ন ভিন্ন কৃতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছেন বাংলার মেয়ে বউরা৷ বাংলার শহরে শহরে পুরনত্বতে ভরদিয়ে শাঁখারীবাজারের দোকানগুলো বাংলার মিষ্টি মিষ্টি এই ঐতিহ্যকে বিশ্বায়নের নানান ব্যবসায়িক টানা পোড়েনের মধ্যেও ধরে রেখে দিয়েছেন আগলে৷ পেটে প্রায় কিল মেরে শাঁখারিরা আজও নানান আনুষঙ্গিক ব্যবসার মুনাফার হাতছানি উপেক্ষা করে বাংলার এই অমর ঐতিহ্যকে শুধু বাপদাদার ব্যবসারূপেই নয়, বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গ রূপেই বহন করে আসছেন৷ তাদের দোকানে বিবাহিত হিন্দু মেয়েরাই মূলত এই শাঁখা কিনতে আসেন৷ শাঁখা পরার অধিকার একমাত্র সধবা বিবাহিত মেয়েরাই৷ ভাঙাগড়ার দিনেও গ্রামের মেয়েদের হাতে শাঁখা আর মাথার সিঁদুরের ঐতিহ্যকে অজর অমর করে রেখেছেন এই শাঁখারিরা তাদের অপার লৌকিক ভালবাসায়৷
যে শাঁখা পরে বাঙালি বিবাহিত মেয়েরা তাদের দেশের ঐতিহ্য বহন করে চলেন, বিশেষজ্ঞরা বলেন, সেই শাঁখার রমরমা ব্যবসার শুরু নাকি ঢাকার শাঁখারি বাজার থেকে৷ মনেরাখতে হবে, বাংলার উপকূলে কিন্তু শাঁখা পাওয়া যায় না৷বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাঁখারিরা নাকি এসেছিলেন বাংলার বাইরে থেকে – মাত্র কয়েক শতাব্দ আগে৷ অথচ শহরে-গ্রামের নানান লেখায়, কথকতায়, সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছে বাঙালি মেয়েদের শাঁখ আর শাখা৷
বুড়িগঙ্গার উত্তর পাড় থেকে তিনশ গজ দূরে দশ ফুট প্রশস্ত একটি গলিই ঢাকার প্রখ্যাত শাঁখারিবাজার৷ এপার বাংলায় আবার বিষ্ণুপুরের শাঁখার কদর দেশের প্রান্ত ছাড়িয়ে পৌঁছেছে বিদেশের বাজারে, তবুও পশ্চিম বাংলার জেলা শহরগুলো জুড়েই শাঁখারিপাড়ার মাদকতাময় সোঁদা গন্ধ৷ দুই বাংলারই নানান শহরের শাঁখারিবাজারের, শাঁখারিপাড়ার নানান গলির পুরোনো পুরোনা বাড়িঘরের কাঠামোর সঙ্গে শহরের অন্য অঞ্চলগুলোর কোনো মিল নেই৷ একই বাড়িতে বসত, কর্মগৃহ এবং দোকান৷ বাজারের ভেতর সারিবদ্ধভাবে অনেক বাড়িঘর এবং তার সামনে সাজিয়ে রাখা শাঁখারি দোকানের পসরা৷ রোদের আলো দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে না৷ স্যাঁতস্যাঁতে ঘর, তার ভেতর শাঁখারিরা বসে শঙ্খের গহনা তৈরি করেন৷ শঙ্খ কাটার জন্য শাঁখের করাত লাগে৷ শঙ্খের মাঝামাঝি চিকন জলের ধারা পড়লে ইস্পাতের সঙ্গে ঘর্ষণ লেগে পুরো ঘর বাষ্পের আকার ধারণ করে৷ ফলে কাটায় শ্রমিকরা স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসে কাজ করে৷ এ কারণে পুরুষ শিল্পীরা অনেক সময় গুল ও নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে৷ পুরুষদের সঙ্গে নারী শ্রমিকরাও রয়েছেন৷ নারীরা সাধারণত শঙ্খ কাটার পর নকশা ও পলিশ করার কাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন৷
সাধারণত আরো অনেক লোকশিল্প ও লোকশিল্পকেন্দ্রিক পেশাদার মানুষের বসবাস কিন্তু শাঁখারি এলাকায়৷ শাঁখারিদের পাশাপাশি মহল্লায় বাস তাঁতব্যবসায়ী, কাঁসারী, কাঠমিস্ত্রি, স্বর্ণকার, কুমারটুলী ইত্যাদি৷ এ বাংলার নানান শহরের শাঁখারি পাড়াগুলোর চেহারাও কিন্তু খুব একটা পার্থক্য নেই, শহরের অন্যান্য পাড়াগুলো যখন বেড়ে চলছে পশ্চিমি ঢংএ তখন এধরনের ঐতিহ্যমণ্ডিত পুরোনো লৌকিক শিল্পীঅধ্যুষিত পাড়াই যেন উন্নয়ণের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে নিজস্বতা আঁকড়ে বিদ্রোহীরমত মাথাতুলে দাঁড়িয়ে৷
তবে শাঁখা এখন ফ্যাশনও৷ সব সম্প্রদায়ের মেয়েরাই ব্যবহার করে শাঁখা৷ শহরে শহরে শাঁখারীবাজারে বেশ কয়েকটা দোকান আছে শাঁখার৷ তাই বেশ ঘুরে ঘুরে, যাচাই-বাছাই করে শাঁখা কিনতে পারেন ক্রেতারা৷ বাংলার অন্যান্য ব্যবসায়ীদেরমতই আজও শুধু ঢাকার শাঁখারিবাজারের দোকানিরা নয়, এ বাংলার শহরগুলোর প্রায সব শাঁখারিবাজারের শিল্পীরা ক্রেতাকে দেবতা মনে করেন৷ ফলে সমাদরটা একটু বেশিই পান ক্রেতারা৷

Taluqdar

Taluqdar Sanskrit and Hindi word, also Arabic (ta'al-luk), meaning to hang or depend. The term taluqdar has different meanings in different parts of India. In north India a taluqdar is a great landholder. But in Bengal, a taluqdar is next to a ZAMINDAR in extent of land control and social status. Eighteenth century Bengal witnessed the rise of great territorial zamindaris at the expense of smaller landholders who were reduced to the status of dependent taluqdars, because they were required to pay their revenue to government through the intermediary of the great zamindars called rajas and maharajas. Yet many old taluqdars paid revenues to government directly.
The great zamindars themselves had created many taluqs under several denominations, such as, junglburi taluq, mazkuri taluq, shikimi taluq, and so on. These were created partly as a strategy of zamindari management and partly as a fiscal policy for raising zamindari funds for specific purposes. These were virtual sales of land in the name of creating dependent taluqs. Under the rules of the PERMANENT SETTLEMENT all such dependent taluqs were separated from their parent estates and assessed as independent revenue paying estates. All independent and dependant taluqs of various denominations were thus turned into independent zamindaris.
After the Permanent Settlement new variety of taluqs were created by zamindars. Under the pressure of the Permanent Settlement many zamindars had been creating dependent taluqs denominated as pattani taluq, noabad taluq and osat taluq. These were all intermediate tenurial rights having rights and obligations of the nature of the Permanent Settlement. A taluqdar's rent was fixed permanently and taluqdari right was transferable on payment of salami to the zamindar. All these subordinate taluq tenures sprang up without any clear legal validity of their bonafide. However, the BENGAL TENANCY ACT of 1885 (Act VIII) had recognised these tenures as regular intermediate tenures with definite rights and obligations. All taluqa rights were abolished with compensation under the East Bengal Estate Acquisition Act, 1950.

Thursday, September 9, 2010

Bagdi

Bagdi a cultivating, fishing and menial caste of Dravidian descent and akin to the aboriginal tribes of the subcontinent. There are different sub-castes of bagdis living in different regions. A bagdi was traditionally restricted from marrying outside the sub-caste. Social and economic factors, especially the intent of not allowing their property to be enjoyed by people outside their community, produced strict endogamy among them. Currently, however, they are flexible in MARRIAGE customs. Bagdis practise both infant and adult marriages, though cases of infant marriage are not common today. Polygamy is permitted, depending on a man's material condition. A bagdi can marry two sisters at a time. Bagdis have borrowed many rituals from the Brahminical system. But they have also preserved some interesting rituals, which belong to different and perhaps more primitive societies. Before formal marriage, the bridegroom goes through a mock marriage to a Mahua tree. The bagdi allow widows to marry again by the ceremony known as sanga marriage rite, in which a Brahmin officiates, but no mantras are recited. As for divorce, the general opinion seems to be that a wife might be divorced for barrenness, unchastity, and disobedience, when those are duly proved to the satisfaction of the council of the caste elders. A divorced wife was entitled to claim maintenance from her previous husband for a period of six months after divorce.
All sub-castes of bagdis admit into their circle members of any other caste higher than themselves in social standing. The religious practices of bagdis combine orthodox HINDUISM and nature worship of their ancestors. They worship the snake goddess MANASA Devi. Legal transactions of Bagdis in the past were of a very simple nature and were supervised by some elder caste members. Currently, they have been absorbed into formal institutions. The occupation of bagdis differs from region to region and from sub-caste to sub-caste. Some bagdis still work in fishing, some as PALANQUIN bearers, lime producers, gunny bag makers and COTTON weavers. Some bagdis are also engaged in AGRICULTURE, usually as under-RAIYATs, and a few of them have attained the position of occupancy tenants. From the olden times, a large number of bagdis in Bengal worked as day labourers and were paid in cash or kind. Many worked as nomadic cultivators, tilling other men's land on the bhag-jot system, under which they were remunerated by one half or less the share of produce.
Bagdis are socially ranked very low and are treated by others as dwellers on the outskirts of Hinduism. Many of them eat beef or pork, though according to the prevailing Hindu custom, some of them abstain from all sorts of flesh. With the dispersion of modern amenities, customs and values amidst all strata of society, bagdis are currently able to change their social standing along with their life style and are able to engage in several occupations.

Wednesday, September 8, 2010

Chandra Kumar

Chandra Kumar (1889-1946) writer and collector of folklore, was born in the village of Raghbpur in the district of NETROKONA, Bangladesh. He lost both his parents early and had to start working young. Apart from a brief stint at a Sanskrit tol, Chandra Kumar had no formal schooling.
Chandra Kumar initially started working at a grocery shop, at a monthly salary of one rupee. But he was an indifferent worker and soon lost his job. He was later appointed tahsildar by Taranath Talukder on a monthly salary of two rupees. In 1912 Chandra Kumar published some essays on folklore in the Saurabh, edited by Kedarnath Majumder, who also helped Chandra Kumar get a job at the zamindari of Gouripur. Chandra Kumar's work as gomasta, on a monthly salary of eight rupees, included visits to different villages to collect taxes. It was on these visits that he had occasion to hear KAVIGAN and PALA GAN, which he started writing down.
Meanwhile DINESH CHANDRA SEN came across Chandra Kumar's essay, 'Mahila Kavi Chandravati' ('Chandravati, the Poetess') in the Falgun 1320 BS (1913 AD) issue of the Saurabh. Dinesh Chandra was impressed by the essay and appointed Chandra Kumar, who was again out of a job, as a folklore collector of CALCUTTA UNIVERSITY at a monthly salary of 70 rupees. This appointment freed Chandra Kumar to travel throughout Bengal collecting folklore and folk songs.
Chandra Kumar collected several ballads, many of which were subsequently edited by Dinesh Chandra Sen and included in MAIMANSINGHA GITIKA (1923) and PURBABANGA-GITIKA (1926). The ballads collected by Chandra Kumar in Maimansingha-Gitika are 'Mahuya', 'Maluya', 'Chandravati', 'Dasyu Kenaram', 'Kamala', 'Rupavati', 'Kanka O Lila', 'Dewana Madina', and 'Dhopar Pat'. The ballads collected by him in Purbabanga-Gitika are 'Bheluya Sundari', 'Maisal Bandhu', 'Kamalarani', 'Dewan Isha Khan', 'Firoze Khan Dewan', 'Ayna Bibi', 'Shyamaray', 'Shiladevi', 'Andha Bandhu', 'Bandular Baramasi', 'Ratan Thakur', 'Pir Batasi', 'Jibalani', 'Sonaramer Janma', and 'Bharaiya Raja'. Besides these, Chandra Kumar also collected some other ballads: 'Adhuya Sundari', 'Suratjamal', 'Kajalrekha', 'Asma', 'Satyapirer Panchali', 'Chandravatir Ramayana', 'Lilar Baramasi', and 'Gopini Kirtan'. Most of these ballads were collected from MYMENSINGH and SYLHET. Though Dinesh Chandra Sen became famous for publishing these poems, the original credit for collecting these songs and transcribing them must go to Chandra Kumar. Chandra Kumar died in Mymensingh in 1946.

Monday, September 6, 2010

মসলিন

মসলিন নিয়ে গল্প-গাঁথা, কিংবদন্তীর কেন শেষ নেই । মসলিন কত পাতলা হত, দেশলাই বাক্সতে পুরে ফেলা যেত আস্ত একটা শাড়ি! এসবের পাশাপাশি মসলিন যাঁরা তৈরি করতেন সেই তাঁতিদের প্রতি অত্যাচারের কাহিনী, আঙুল কেটে ফেলার কাহিনী এসব আমাদের সবারই কম বেশি শোনা। মসলিন নিয়ে আলোচনা এটাই প্রমাণ করে আজও মসলিন আমাদের ভারি আগ্রহের বিষয়।
মসলিন শব্দের উদ্ভব কিভাবে ?
হেনরি ইউল এর প্রকাশিত অভিধান হবসন জবসন থেকে আমরা পাই মসলিন শব্দের উদ্ভব মসূল থেকে। ইরাকের এককালের নামি ব্যবসা কেন্দ্র মসূলে তৈরি হত সূক্ষ্ম সব কাপড় । যতদূর জানা যায়, ইংরেজরা আমাদের এই সূক্ষ্ম কাপড়কে নামকরণ করে মসলিন হিসেবে । কিন্তু ঢাকা আর আশেপাশের এলাকাতে- মুঘল আমলে সপ্তদশ শতকে মসলিন শিল্প বিকাশ লাভ করেছিল চূড়ান্ত রকম। আজও আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই যুগের মসলিসকেই মনে করি। ঢাকাই মসলিনের অনন্যতার কাহিনী ছড়িয়ে পরেছিল সর্বত্র। মসলিন রপ্তানি হতো ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে, এমনকি তা রপ্তানি হতো ইউরোপ-আফ্রিকাতেও।
আমরা যেমন আজকেও মসলিন নিয়ে গর্বিত, তেমনি মসলিন দেখে অভিভূত হয়েছিলেন ভিনদেশী ভূগোলবিদ আর পর্যটকরা। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত লোকজন ঢাকা-সোনারগাঁও এর এই উঁচুমানের মসলিন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। নবম শতকে ভূগোলবিদ সোলায়মান একটি বই লিখেছিলেন- ‘সিলসিলাত উত তাওয়ারীখ’ । তাতে রুমী নামের এক দেশের কথা আছে যেখানে এত সূক্ষ কাপড় তৈরি হত যে চল্লিশ হাত লম্বা আর দুইহাত চওড়া কাপড়ের একটি পুরো টুকরো প্রবেশ করানো যেত একটি সাধারণ আংটির মধ্যে দিয়ে। ধারনা করা হয় রূমী হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে এ দেশের কাপড়ের ঐতিহ্য আজকের নয়-বহু শতকের পুরানো।
তবে প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের সুখ্যাতি থাকলেও মূলত মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন থেকেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে । সম্রাট, নবাবেরা মসলিন কাপড় কেনা আরম্ভ করেন চড়া দামে। সে যুগে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর। জঙ্গলবাড়ি অধিকাংশের পেশা তখন মসলিন বোনা। উনিশ শতকের প্রথমভাগেও সেখানে একাজে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় একশ তাঁতি পরিবার। জঙ্গলবাড়ি থেকে মাইল কুড়ি দূরে বাজিতপুর- ওখানে জন্মাতো উচুঁমানের কার্পাস, যা থেকে তৈরি হতো উঁচুমানের মসলিন। আজ থেকে দু’শ বছর আগেও বিদেশী বণিকেরা সোনারগাঁ থেকে মসলিন বিদেশে রপ্তানী করতো। ওখানকার প্রায় দেড়হাজার তাঁতি সে সময় মসলিন বুনে সরবরাহ করতো ইংরেজ কোম্পানিকে। জেমস টেলর সাহেব ১৮৫১ সালে যখন মসলিনের উপর একটি পান্ডুলিপি তৈরি করেন মসলিনের স্বর্ণযুগ তখন পড়তির দিকে; অথচ যা জানা যায় ঢাকাতে তখনও সাতশ’ ঘরের বেশি তাঁতি নিয়োজিত ছিল এই কাজে।
মসলিন তৈরি করার জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা, ফুটি কার্পাস। এ বিশেষ ধরনের কার্পাসটি জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে ঢাকা জেলার কয়েকটি স্থানে। একদম ভাল মানের কার্পাস উৎপন্ন হত মেঘনার পশ্চিম তীরে। শ্রীরামপুর, কেদারাপুর, বিক্রমপুর, রাজনগর ইত্যাদি স্থানগুলো ফুটি কার্পাসের জন্য বিখ্যাত ছিল। আজকের যে কাপাসিয়া নামটি আমরা জানি তা এসেছে এই কার্পাস হতে। মেঘনা এমনিতেই খুব বড় নদী, তার উপর সমুদ্রের কাছাকাছি আবার বর্ষাকালে নদীর দু’কূল ভেসে যেত। তার ফলে যে পলি জমতো তার কারনেই ফুটি কার্পাসের উৎপাদন খুব ভাল হতো এসব স্থানগুলোতে। কিন্তু একজন কার্পাস চাষী একবিঘা জমিতে ভালমানের মসলিন তৈরির জন্য মাত্র ছয় কেজির মতো তুলা পেত। তাই মসলিনের চাহিদা যখন খুব বেড়ে গেল, সেই সময় ভারতের গুজরাট হতেও তুলা আমদানি করা হতো- কিন্তু ওগুলো দিয়ে ভালমানের মসলিন তৈরি করা যেত না- যা হতো তা খুব সাধারন মানের হতো।
সাধারনত, মহিলারাই সুতা কাঁটা আর সূক্ষ্ম সুতো তোলার মত পরিশ্রম এবং ধৈর্যের কাজে নিয়োজিত ছিল। সুতো তোলার সময় কম তাপ এবং আর্দ্রতার দরকার হতো। তাই একেবারে ভোর বেলা আর বিকালের পরে এ কাজ করা হতো। মজার ব্যাপার হলো- আর্দ্রতার খোঁজে অনেক সময় এমনকি নদীতে নৌকার ওপর বসে সুতা কাটার কাজ চলত। একজন মহিলা এভাবে প্রতিদিন সুতো কেটেও মাসে মাত্র আধা তোলা সুতা তুলতে পারতেন। এই পরিশ্রমসাধ্য কাজের কারণে দক্ষ সুতা কাটুনির সংখ্যা অনেক কমে আসতে থাকে উনিশ শতকের শুরু থেকেই। জানা গিয়েছে- এই রকম সূক্ষ্ম সুতো কাটার কাজ অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও এতোটা ভাল হতো না । এর কারণ ধরা হয় দু’টো- ঢাকার ফুটি কার্পাস আর শ্রমিকের দক্ষতা ও পরিশ্রম।
বিভিন্ন সুত্র হতে যা জানা যায়- ১৮৫১ সালে লন্ডনে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ঢাকা থেকে কিছু মসলিন পাঠানো হয়। সেখানে এক পাউন্ড সুতা দেখানো হয়েছিলো যা প্রায় আড়াইশো মাইল ছিল !! আরও মসলিন সম্বন্ধে, “মর্নিং ক্রনিকল” পত্রিকায় লিখা হয়- হাবিবুল্লাহ তাঁতির বোনা দশ গজ লম্বা একখন্ড মসলিনের ওজন মাত্র তিন আউন্স !!
মসলিন তৈরির কাজটি ছিল ভীষন জটিল, কঠিন, সময়সাধ্য- তারচেয়েও বড় কথা হলো সেটা তৈরির জন্য দরকার হতো অসামান্য নৈপুণ্য আর আসুরিক ধৈর্য। মোটামুটি যে ক’ধাপ পেরিয়ে তৈরি হতো মসলিন সেগুলো হলো; সুতা নাটানো, টানা হোতান, সান বাঁধা, নারদ বাঁধা, বু-বাধাঁ, আর সবশেষে কাপড় বোনা । এসব শেষে একজন তাঁতি আর তার দু’জন সহকারীর লাগতো কমপক্ষে দু’তিন মাস।
মসলিন তৈরি শেষে ওগুলো ধোয়া হতো। সম্রাট আকবর এর আমালে সোনারগাঁ’র কাছে এগোরো সিন্ধুর জল কাপড় ধোয়ার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। আসলে এটা যে শুধু জলের গুনে হতো তা নয়, এর সাথে ছিল ভাল ক্ষার বা সাবান আর ধোপার দক্ষতা। মসলিন ধোবার জন্য রীতিমতো একটা শ্রেনীর মানুষই তৈরি হয়েছিল। আঠারো শতকের গোড়ায় একখন্ড মসলিন ধোয়ার খরচ পড়তো দশ টাকা। আবার ধোয়ার সময় কাপড়ে কোন দাগ লাগলে বিভিন্ন ফলের রস দিয়ে সেটা তুলে দেয়া হত। কাপড় ধোবার সময় কোনো সুতো সরে গেলে সেটা ঠিক করতো দক্ষ রিফুকাররা, তাদেরকে বলা হতো নারোদিয়া। এরপর শঙ্খ বা ছোট মুগুর দিয়ে পিটিয়ে মোলায়েম করা হতো। মোলায়েম করার সময় ছিটানো হতো চাল ধোয়া জল। একাজে নিয়োজিতোদের বলা হতো কুন্ডুগার। তারপর সাবধানে ইস্ত্রি করা হতো মসলিন। কোন কোন মসলিনে সুঁচের বা চিকনের কাজও করা হতো।
কোন কোন সময় রঙও করা হতো। ঢাকার চিকনের কাজেও যথেষ্ট সুনাম ছিল, এখনও আছে । এরপর কাপড়গুলোকে ভালমতো ঠোঙাবন্দী করা হতো, একাজ যারা করতো তাদের বলা হতো বস্তাবন্দ। ইংরেজদের কারখানা ছিল তেজগাঁও-এ (অন্য আরেকদিন সুযোগ পেলে তেজগাঁও এর নামকরন হয়েছিলো কিভাবে তা আলোচনা করবো)। কেনা মসলিন ওখানে এনে ধোয়া থেকে শুরু করে ঠোঙা করার কাজ শেষ করে পাঠিয়ে দেয়া হত কলকাতায়-সেখান হতে ইউরোপে।
মসলিন ছিল নানা রকমের। এর পার্থক্য নির্ণীত হত সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন আর নকশা বিচারে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুতার তৈরি, সবচেয়ে কম ওজনের মসলিনের কদর ছিল সবার চেয়ে বেশি, দামটাও ছিল সবচেয়ে চড়া। “মলবুস খাস” ছিল সবচেয়ে নামী, সেরা মসলিন। সম্রাটের জন্য তৈরি হত এই মসলিন। আঠারো শতকের শেষদিকে মলবুস খাস সম্রাটের দরবারে পাঠানো বন্ধ হলে তৈরি হয় “মলমল খাস”। দশগজ লম্বা আর একগজ চওড়া মলমল খাসের ওজন হত মাত্র ছয় তোলার মতো, যা অনায়াসে ছোট্ট একটা আংটির ভিতর দিয়ে গলে যেত! মলবুস খাসের সমগোত্রীয় আরেকটি মসলিন “সরকার-ই আলা”।
দশগজ লম্বা আর একগজ চওড়া ‘সরকার-ই আলা’-র ওজন হত দশ তোলার মতো। ঝুনা মসলিনে সুতার পরিমান থাকতো কম- দেখতে হত অনেকটা জালের মত। ঝুনা হিন্দী শব্দ যার অর্থ ‘সূক্ষ্ম’। নকশা করা মসলিনকে বলা হতো জামদানি, কিন্তু আজকের জামদানির সাথে আদি জামদানির আকাশ-পাতাল তফাৎ। মসলিন তৈরির প্রক্রিয়াটা এত জটিল আর সময় সাপেক্ষ ছিল যে সম্রাটদের জন্য উন্নত মসলিন তৈরি করেই দিন কাটতো তাঁতিদের- বাড়তি মসলিন তৈরি করার সময় মিলতো তাই কম।
যতদূর জানা যায়, ঢাকা শহরে ‘মলবুস খাস’ তৈরির কারখানা ছিল বর্তমানের নাজিমুদ্দিন রোডে। ১৭৭২ সালের এক হিসাব থেকে দেখা যায় যে ওই বছর সম্রাটকে পাঠানো হয় একলক্ষ টাকার ‘মলবুস খাস’ আর বাংলার নবাবকে পাঠানো হয় তিনলক্ষ টাকার ‘সরকার-ই-আলি’। ওলান্দাজ ব্যবসায়ীরা ইউরোপে রপ্তানীর জন্য ১৭৮৭ সালে একলক্ষ টাকার মসলিন রপ্তানী করে। ইংরেজ কোম্পানী ওই বছর সংগ্রহ করে তিন লাখ টাকার মসলিন।
১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা যখন বাংলার কর্তা হয়ে ওঠে তখন তারা বছরে আট লাখ টাকার মসলিন রপ্তানী করতো। সেই সময়ে ফরাসিরা কিনেছিলো প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন। এরা ছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশী ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে ব্যবসা করতেন। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সে আমলে ঢাকা আর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানীর জন্য কেনা হয়েছিল প্রায় ঊনত্রিশ কোটি টাকার মসলিন।
পরবর্তীতে মসলিন রপ্তানীর ব্যবসা প্রায় পুরোটাই করায়ত্ত করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি, গায়ের জোরে। তাদের রপ্তানী হত মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত দালালরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দামি মসলিন সংগ্রহ করে কোম্পানিতে সরবরাহ করতো। পলাশীর যুদ্ধের পর মসলিন সংগ্রহের জন্য গোমস্তা নিয়োগ করা হয়, যারা ছিল কোম্পানির বেতনভুক্ত কর্মচারী। এই গোমস্তারা মসলিন সংগ্রহের জন্য হয়ে উঠে নিষ্ঠুর, চালাতে থাকে অমানুষিক অত্যাচার। মসলিন তাঁতীরা দিশেহারা হয়ে উঠে এই গোমাস্তাদের অত্যাচারে। এখানে লক্ষণীয় যে, দেশীয় গোমাস্তারাই হয়ে উঠেছিলো দেশের মানুষের শত্রু। মসলিনের সাথে জড়িত আমাদের দেশের প্রতিটি কৃষক, শ্রমিক, তাঁতীকে নানাভাবে ঠকানো হত, নির্যাতন করা হত। গরীব চাষিকে টাকা ধার দিয়ে তার কাছ হতে খুব কম দামে কার্পাস নিয়ে যেত একশ্রেনীর দেশী মানুষ। দেশী মানুষরা যারা দালাল-পাইকার হিসেবে কাজ করতো তারাও তাঁতীদেরকে ঠকাতো নানা ভাবে। গোমস্তারাতো রীতিমত অত্যাচার করতো তাঁতীদেরকে। হিসেবে দেখা যায়, আনুমানিক ১৭৪০ সালের দিকে এক টাকায় পাওয়া যেত প্রায় একমণ চাল। আর একজন তাঁতী মসলিনের কাজ করে পেত মাসে দুই টাকা, অর্থাৎ দুই মণ চালের দাম! যাতে তার পরিবারের খাবারই ঠিকমত চলতো না, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যতো অনেক দূরের কথা।
যারা তৈরি করতেন বাংলার গর্ব-যাদের তৈরি কাপড় গায়ে উঠতো সম্রাটের, রপ্তানী হত বিদেশে, তাঁর গায়েই থাকতো না কাপড়, পেটে পড়ত না ঠিক মত খাবার। আর সবচেয়ে দুঃখজনক বোধহয় এটাই যে-এই অবিচারের পিছে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলো এ দেশেরই দালার, পাইকার আর গোমস্তারাই।
ইংরেজরা মসলিন তাঁতীদের আঙুল কেটে ফেলত - সেই কাটা আঙুলেক ওপর জন্মনিয়েছে ম্যানচেস্টারের কাপড় শিল্প। আবার এও শোনা যায় যে- তাঁতীরা নিজেরাই নাকি নিজেদের আঙুল কেটে ফেলতো, যাতে কম পারিশ্রমিকের কাজে তাদের বাধ্য না করা হয়। কার্পাস কৃষক আর তাঁতীদের উপর কোম্পানী, ব্যবসায়ী, গোমস্তা আর পাইকাররা যে অমানুষিক অত্যাচার চালাত সেটি জাজ্বল্যমান সত্যি। আমাদের গর্বের এই মসলিনের সঙ্গে কালিমার মত লেপ্টে আছে এই রূঢ় সত্যটাও।
চার-পাঁচশো বছর আগে যে মসলিন হয়ে উঠেছিল পৃথিবী বিখ্যাত, মাত্র দেড়শো বছরের মধ্যেই তা হারিয়ে গেল কেন?
১৮৪৪ সালে ঢাকার কমিশনার আই. ডানবার কোম্পানীর সদর দপ্তরে মসলিন শিল্প বন্ধ হবার কারণ উল্লেখ করে একটি রিপোর্ট পাঠান। ডানবার সাহেবের মতে মূল কারণগুলো ছিলঃ
১) ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে সস্তায় সুতা আর কাপড় উৎপন্ন হতে থাকে(এটি একটি মিথ - ভারতের বুনন শিল্পের ধংসের ওপর দাঁড়িয়ে মুনাফা করেছে ইংল্যন্ড)। ফলে দামি মসলিনের চাহিদা কমে যায়।
২) বিলেতের সস্তা সুতা ঢাকায়, ভারতে আসতে থাকে, সে থেকে তৈরি হতে থাকে কাপড়, হারিয়ে যেতে থাকে মসলিন।
৩) বিলাতে ঢাকাই মসলিনের ওপরে উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়, ফলে মসলিনের দাম ওখানে বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। স্বভাবতাই বিক্রি কমে যায় মসলিনের।
মসলিনের পড়তির সময়টায় পতন ঘটতে থাকে আমাদের নবাব-সম্রাটদেরও। তাঁরা আর বেশি টাকা দিয়ে মসলিন কিনছেন না- চাহিদা কম ছিল অভ্যন্তরীন বাজারেও। তাছাড়া মুঘল সম্রাট, নবাব, ব্যবসায়ী-কেউই এ শিল্প রক্ষা কিংবা প্রসারে কোন সময়ই তেমন কোন উদ্যোগ নেননি, সব সময় চেষ্টা করেছেন কিভাবে কৃষক-তাঁতীদের যতটা সম্ভব শোষণ করে নিজেরা লাভবান হওয়া যায়- এই সব মিলিয়ে এভাবেই ধিরে ধিরে আমাদের আরও অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মত হারিয়ে যায় মসলিনের স্বর্ণযুগও।

চটকা গান

ভাওয়াইয়া গানের একটি ধারা হলো চটকা গান। এ গান নাচুনে গান বলেও পরিচিত। এ গান আসাম, জলপাইগুড়ি, গোয়ালপাড়া অঞ্চলে প্রচলিত । চুটকি কথা থেকেই চটকা কথাটি এসেছে। এর আভিধানক অর্থ হলো যে গানে কান্তি, সৌন্দর্য, সৌষ্ঠব প্রতিভাত হয়। যেখানে রাজবংশী সম্প্রদায় আছে সেখানেই এ গানের প্রচলন বেশি।। চটকা রাজবংশী সম্প্রদায়ের নিজস্ব লোকসংগীত। সব ধরনের ঘরোয়া ব্যাপার নিয়েই এ গান রচিত।। সাধারণত প্রেম বিষয়ক বা গভীর ব্যঞ্জনাময় সমাজ চিত্র বা হালকা চটুল কথাবার্তাই এ গানের বিষয়বস্তু। কখনো আবার প্রকাশ পায় গভীর দীর্ঘশ্বাসের মর্মবেদনা। সুর ও ছন্দের দিক থেকে চটকা গানের সুর চটুল ও নাচুনে এবং তার গতিও দ্রুত। উত্তরবঙ্গের একটি চটকা গানের নমুনা:
হাত ধরিয়া কন্যা কওরে/কন্যা না করেন আর গোস্যা/ তোমার বাড়িত যাইতে কন্যা/পায় পড়ল ফুসা
এছাড়া একটি জনপ্রিয় চটকা গানের নমুনা:
প্রেম জানে না রসিক কালাচাঁদ/ওসে গুইওে মরে/কতদিনে বন্ধুর সনে হরি দর্শন বন্ধুরে।
যদিও সুরের কাঠামো ভাওয়াইয়া গানের মতো তবুও এ গান দ্রুত ছন্দে গীত হয় বলে গায়কীতে হাস্য-ব্যাঙ্গাত্মক রস ফুটে ওঠে।

উত্তরবঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে জনগণের মনোরঞ্জের জন্য বিভিন্ন উপকথা বা বেদ-পুরাণের কাহিনী নিয়ে তৈরি হতো বিভিন্ন পালা গান বা পালাটিয়া গান, এই পালাটিয়া গানে দীর্য় সময় ধরে একঘেয়ে সুরে গাওয়ায় শ্রোতাদের মাঝে মনোরঞ্জনের জন্য মূল গায়ক (আঞ্চলিক ভায়ায় ‘‘গীদাল’) সাময়িক স্বস্তির জন্য কিছু ভাঙা গান পরিবেশন করেন। এই ভাঙ্গা গানের সঙ্গে মূল গানের কোনো সম্পর্ক থাকত না, মূল পালাটিয়া গানের একঘেয়েমি কাটাতেই মূল কাহিনী থেকে সরে এসে পরিবেশিত হয় হালকা ছন্দ বা হাস্যরসের কিছু গান। স্বভাবতই এ গান কিছুটা কৌতুক মিশ্রিত হয়। চটুল ছন্দের লঘু বিষয়ের রঙ্গ-হাস্যরসে মিশ্রিত এসব ভাঙা গান বিশেষতঃ পালাটিয়া গানের টানা সুর থেকে স্বতন্ত্র। অন্যভাবেও বলা যায় জনজীবনের ভাবগম্ভীর অবস্থা থেকে সাময়িক বিচ্যুতি। ভাওয়াইয়া গান যেমন অনুভূতির দ্বারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করার গান, গায়কী অনুযায়ী চটকা গান সেই জাতীয় গান নয়। ভাওয়াইয়া যেখানে বিচ্ছেদ আত্মবিলাপের দীর্ঘ রেশ সেখানে চটকার চটুল ছন্দ নৃত্যের লাস্যভঙ্গিতে আনে আশার সঞ্চার, আরোপিত মনে আনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের একাগ্র সাধনা। উদাস করা হৃদয়ও আশার নিবিড়তায় ঘর বাঁেধ এক টুকরো আশ্রয়ের জন্য, নিভৃতে পাবার পরম সৌভাগ্যের জন্য। চটুলর ছন্দের গভীরে যে স্থিরতা আছে তারই আলোড়নের বহিঃপ্রকাশ ঘটে দয়িতার অন্তরে, দুঃখ-সুখের আঘাত তীব্র হয় প্রাণে। চটকা গান ভাওয়াইয়া গানের পাশাপশি চললেও ভাওয়াইয়া গান যদি হয় বিরহের বা না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস, চটকা গান তবে মিলনের স্বচ্ছন্দ আবেগ।
চটকা গানের সঙ্গে মারফতি গানের খানিকটা মিল পাওয়া যায়, কেবল ছন্দ ও পরিবেশনার ক্ষেত্রে।। অবশ্য মারফতি গানের সুর হয় নিচু পর্দায়, চটকা গানের শুরু পঞ্চম থেকে। অন্যদিকে চটকায় যেখানে চটুল ভাবের গানের কথা ও সুরের প্রকাশ, মারফতি গানে প্রকাশ হয় আত্মনিবেদন। এই চটুল ভাবই চটকায় উচুঁ পর্দায় সুর বাধতে বাধ্য করে। এই চটকদারি গায়কীাই এর প্রাণভোমরা এবং গায়কীর স্বকীয়তা।
চটকা গান মূলত বিধৃত-দাদরা বা ডাবল দাদরা তালের। এ গানের সুর তার ছন্দের ন্যায় কাটা কাটা, তাই গানের এক কলি থেকে অন্য কেিলতে যাওয়ার সময় মিড়ের চল নেই রয়েছে ছন্দময় তালের বিন্যাস। গান ও সুরের প্রকাশে শব্দের উপর যে শ্বাসাঘাত তার জন্য এ গানের অন্যতম প্রধান আনুষাঙ্গিক বাদ্যযন্ত্র বিশেষ ধরনের দোতারা। দোতারার কাটা কাটা ছন্দ চটকার প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। কথার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ভাওয়াইয়া কাঠামোয় সুরারোপিত এই গানের গায়কীতে বিশেষ ধরনের রীতি আছে যা উত্তর বাংলার লোককৃষ্টি, যা সহজ-সরল জীবনের দৈনন্দিন ছবি, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, হাসি-কান্না, ঠাট্টা-মশকরার অনাবিল আনন্দের সাংগীতিক প্রকাশ।
০০ শাহনাজ জয়া ০০

বাহের দেশের ভাওয়াইয়া নারীর ব্যথা

'তোর গলায় রসের কাঠি, গধাদরের পারে পারে রে,
কী মায়া না গাইলেন মাহুত রে'

প্রায় পিঠাপিঠি চারটি সিনেমা হল। চারটিতেই একযোগে নাইট শো ভাঙলে সাতমাথার মোড়টা অনেকক্ষণ গমগম করতে থাকে মানুষের ভিড়ে। যে যেদিকেই যাক, সাতমাথায় আসতেই হয়। তারা আসে খেলাশেষে স্টেডিয়াম থেকে বেরুনো মানুষের মতো। একটু আগে দেখা সিনেমাটি গরম চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে না খেলে তাদের আশ মেটে না। সেটা মেটাতে আর দিনের শেষ আড্ডাবাজি সারতে বড়জোর আরও পনেরো মিনিট। রাত তখন বারোটা পেরোয়।

সাতটি রাস্তা যেখানে মিলেছে সেখানটায় চা-লাড্ডু-বনরুটি-পান-সিগারেটের দোকানগুলো ঘিরে কিছু লোক তার পরও খামোখা থেকে যায়। ঢাকা থেকে আসা যাত্রীদের ধরবে বলে পনেরো-বিশটা রিকশাও মোটামুটি জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের চালকেরা সাধারণত বগুড়ার পুবের যমুনার নদীভাঙা এলাকার কৃষক। লোকে বলে ‘পুবা’। বাদবাকিদের বেশির ভাগই রংপুর-কুড়িগ্রামের আধিয়ার। তখনো ঢাকার লোকেরা ‘মফিজ’ বলে এদের নাম ফাটায়নি। তবে তারা পরস্পরের ‘বাহে’, মানে ‘বাবা হে’। তাদের দেশ-গ্রামের পরিচয়ও নাকি ‘বাহের দেশ’।

যাত্রী না আসা পর্যন্ত এই বাহেরা রিকশার হ্যান্ডেলে পা, পিঁড়ির মতো সিট আর যাত্রীর আসনে শরীরটা এলিয়ে সটান শুয়ে জিরোয়। থানার দিকে যে রাস্তাটা গেছে তার গোড়ার ফ্রেন্ডস অডিওতে তখনই ফুল ভলিউমে বাজতে শুরু করবে বাবুল কিশোরের বিচ্ছেদী গান, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখি গো’, কিংবা ফেরদৌসী রহমান কি আর কারও কণ্ঠে ভাওয়াইয়া, ‘ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে’। এই মধ্যরাতে বিক্রিবাট্টার আশা না থাকলেও কী আশায় দোকান খুলে রেখে গানে গানে পত্র লেখা বা কাজল ভোমরার কথা বলে বোঝা ভার। হয়তো আমারই মনের খেয়াল, কিন্তু মনে হয় বিদেশ-বিভুঁইয়ে আছে বলেই ওরা এমন উতলা। ওদিকে ফেরদৌসী তাঁর পরমা গলায় গাইতে শুরু করেন—
‘ও কি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে\
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়
নারীর মন মোর বুরিয়া রয় রে\
ও কি গাড়িয়াল ভাই
কত কাঁদিম মুই নিধুয়া-পাথারে।
ও কি গাড়িয়াল ভাই
হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে।’

তারা কি তবে নিধুয়া-পাথারে হাহাকার করে বেড়ানো কোনো নারীর জন্য পথে পথে বাওকুংটা বাতাসের মতো ‘ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে’? যখন আর সে মৈষাল নয়, নয় গাড়িয়াল বন্ধু; সে যখন ওই গরু বা মহিষের ঢংয়েই দুই উরু আর পাছা নাচিয়ে রিকশা চালায়, তখন তার চ্যাংড়া মনে কিসের ফাপর গুমরে মরে কে জানে?
‘মইষ চড়ান মোর মইষাল বন্ধু রে
বন্ধু কোন বা চরের মাঝে
এলা কেনে ঘণ্টির বাজন
না শোনেঙ মুই কানে মইষাল রে।’
কৃষ্ণের বাঁশি শুনে নয়, গাড়িয়ালের গরুর গলার ঘণ্টি শুনে আকুল হয়ে বাড়ির বাহির হয় ভাওয়াইয়া রাধা। কিন্তু গাড়িয়ালের গাড়ি কি আর এ পথে আসে? মৈষাল গেছে সেই চেংড়িদের দেশে, যারা ‘জানে ধুলা পড়া’, যারা ‘ছল করিয়া কাড়িয়া নিবে/হাতের দোতরা মইষাল রে।’ এবং ‘সেই না দেশে পুরুষ বান্ধা/থাকে নারীর কেশে রে।’ কিন্তু আমাদের রাধাও কম যায় না। ওঝা যেমন সাপের বিষ ঝেড়ে নামায়, তেমনি ‘মুই অভাগী ঝারেঙ বন্ধুক/ক্যাশের আগাল দিয়া রে।’
বাহেদের পূর্বপুরুষ ছিল কৃষিসমাজের সবচেয়ে তলাকার মৈষাল-গাড়িয়াল—মূলত রাখাল। ভাওয়াইয়া গানের মর্মে যে বিরহ-বেদনার গল্প, তার নায়ক এই মৈষাল আর নায়িকা তার ‘যুবা নারী’। এরাই বাহের দেশের রাধা-কৃষ্ণ। তিস্তা বা ধরলা এদের যমুনা। নিধুয়া-পাথার এদের বৃন্দাবন, শিমিলা বৃক্ষ (শিমুল) এদের কদম, বগাবগি কিংবা ডাহুকডাহুকি এদের শুকসারি। আর চিলমারীর বন্দর এদের মথুরা। কৃষ্ণ যেমন মথুরায় গিয়ে আর ফেরে না, ভাওয়াইয়া নারী তার গাড়িয়াল বন্ধুকেও তেমনি হারায় চিলমারীর বন্দরে বা আরও ওপরে কোচবিহারের গোয়ালপাড়ায় কিংবা আসামের কামাখ্যা পাহাড়ে। কিংবা সে বান্ধা পড়ে ব্রহ্মপুত্র কি তিস্তার কোনো চরে জোতদারের বাথানে—
‘বাথান বাথান করেন মৈষালরে
মৈষাল, বাথান কইরচেন বাড়ি—
যুবা নারী ঘরে থুইয়া,
কায় করেন চাকিরি মৈষাল রে।...
বাথান ছারেক, বাথান ছারেক রে
ও মৈষাল ঘুরিয়া আইসেক বাড়ি,
গলার হার বেচেয়া দিম মুঞি
ঐ চাকিরির কড়ি মৈষাল রে।’
মৈষাল আর তার যুবা নারীর প্রেম-দাম্পত্য মিলনহীন। তারা যেন চিরবিরহী ডাহুক-ডাহুকি। সামন্ত সমাজে মৈষালের স্বাধীন কোনো ভূমিকা নেই। বাপ-ভাই আর স্বামীর শাসনে নারীটি অবরুদ্ধ। তার প্রেমিক পেটের টানে দূরের দেশে ঘোরে কিংবা আটকে যায় চাকরির ফাঁদে। এই করুণ জীবনের মর্মব্যথা ফুটে ওঠে আব্বাসউদ্দীনের গলায়—
‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে।
উড়িয়া যায়রে চকোয়া পঙ্খি
বগীক বলে ঠারে
তোমার বগা বন্দী হইছে ধর্লা নদীর পারে।
এই কথা শুনিয়া বগী দুই পাখা মেলিল—
ওরে ধর্লা নদীর পাড়ে যায়া দরশন দিলরে;
বগাক দেখিয়া বগী কান্দেরে
বগীক দেখিয়া বগা কান্দেরে।’
ভাওয়াইয়া নারী-পুরুষ এভাবে তাদের সমাজের বন্ধন আর জমিদারি শোষণের ফাঁদে বন্দী হয়ে পরস্পরের জন্য কাঁদে। কিংবদন্তির গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন, ‘এইসব ছবি কালিদাসের বা রবীন্দ্রনাথের হাত থেকে কোনো দিনই আসতে পারে না।’ কারণ, ‘প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও মিলনের সম্পর্ক যে জনসমাজের, তাদের কণ্ঠেই এই ধরনের গান জাগতে পারে।’ (গানের বাহিরানা) তাই ভাওয়াইয়া উত্তরের জনসমাজের জাতীয় গীত।
জনসমাজ বললে আসলে তেমন কিছু বোঝায় কি? আঠারো/উনিশ শতক পর্যন্ত বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর-কোচবিহার অঞ্চলে ব্যাপক আকারে নতুন জনবসতি ও আবাদের পত্তন হতে থাকে। বন কেটে পতিত জমি হাসিল করতে গিয়ে কোচ ও রাজবংশী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বাঙালি কৃষিজীবীরা একাকার হয়ে যায়। এদের বিরাট অংশ মুসলমানও হয় (রিচার্ড ই ইটন, রাইজ অব ইসলাম ইন বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার)। রাজবংশী ও কোচ সমাজের কৌম জীবনের ছাপ তাই ভাওয়াইয়া গানের পরতে পরতে। সংস্কৃতির ভেতর সমন্বয়ের মধ্যে সংঘাতের লক্ষণগুলো চামড়ায় বসন্ত দাগের মতো এখনো ধরা পড়ে। মৈষাল, গাড়িয়াল বা মাহুতের স্বাধীন বিচরণের আকাঙ্ক্ষা আর দরিদ্র কৃষক-কন্যার প্রণয়-প্রতিবাদ সেই ইশারাই করে।
এক নদীতে কয়েকটি স্রোতের মধ্যে একটি যেমন প্রধান, ভাওয়াইয়ার আবহে নারী-মনের বাসনা-বেদনা-বিদ্রোহ তেমনই এক প্রধান স্বর। নারীর এই নিরন্তর আকুলতাই ভাওয়াইয়া গানের প্রাণভোমরা। তাদের মনে তখনো কৌম সমাজের সাম্য ও প্রকৃতিবাসের টান ফুরায়নি। গণনাট্য সংঘের অন্যতম প্রাণপুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস মনে করেন, নারীর স্বাধীন প্রেমকে রক্ষণশলীতার নিগড়ে বাঁধার চেষ্টা হলে ভাওয়াইয়া নারী তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বাপ-ভাই যখন তাকে বাল্য বয়সে স্বামী নামক এক অচেনা লোকের কাছে টাকা নিয়ে বিয়ে দেয়, সেই অভাগিনী তখন বাবা-ভাই ও সেই স্বামীকে ক্ষমা করে না। মন পোড়ে তার বগার জন্য, মৈষাল বা গাড়িয়াল বন্ধু বা প্রেমিক কাজল ভোমরার জন্য। মদাসক্ত স্বামীর অত্যাচারে জর্জরিত এই নারীর আশ্রয় তখন চ্যাংড়া দেবর।
‘ও মোর ভাবের দেওরা
থুইয়া আয় মোক বাপ ভাইয়ার দেশে রে
বাপ ভাই মোর দুরাচার
বেচেয়া খাইছে মোক দুরান্তর রে
বেচেয়া খাইছে মোক মদকিয়ার ঘরেরে।’
তার কাছে, ‘স্বামী আমার যেমন তেমন/দ্যাওরা আমার মনের মতোন/দ্যাওরা মরলে হবো পাগল, হবো দেশান্তরী রে’। তার এমন প্রণয়ই তার প্রতিবাদ। সমাজপতিদের চাপে তার আপনকীয়া প্রেম যেখানে অবরুদ্ধ, সেখান থেকেই তা পাহাড়ের তলার ঝরনার মতো পরকীয়া প্রেমের খাতে বইতে শুরু করে। তার আপনকার প্রেমের কথাই সে বলে রাধা-কৃষ্ণের বরাতে। কিন্তু তার এই প্রেম রাধা-কৃষ্ণের লীলা নয়, এ তার ব্যক্তিগত ‘সোনার চান্দ’কে পাওয়ার বাসনা। আমরা দেখব, কৌম সমাজের আপনকীয়া প্রেম যখন নিয়ম ও শাস্ত্রের চাপে আর প্রকাশিত হতে পারছে না তখন তার প্রেমিক কালা হয়ে যায় কৃষ্ণ, আরও পরে প্রেমিক কৃষ্ণ প্রভু কৃষ্ণে রূপান্তরিত হন। কিন্তু ভাওয়াইয়া নারীর প্রেম নিজেকে বদলাতে অস্বীকার করে। তার মৈষাল তার আপনকীয়াই, পরকীয়া নয়। কীর্তন-পদাবলি ইত্যাদির সঙ্গে এখানেই তার তফাত। এ পার্থক্য কেবল সুরে বা ভাষায় নয়, এখানেই ভাওয়াইয়া নারীর নিজস্ব স্বর ও আবেগের বিশিষ্ট গড়নটিকে প্রেমের অন্যান্য আখ্যান থেকে আলাদা করা যায়।

দুই.
ভাওয়াইয়ার সুর-কাঠামো আধুনিক গান তো বটেই ‘লোকগীতি’র অন্য অন্য ধারা থেকেও আলাদা। অনেকে একে আর্য ঘরানার বাইরে অনার্য বাহিরানা হিসেবে চিনতে চান। লালনের গান বাউলে গাইলে এক রকম, ভাটিয়ালির ঢংয়ে গাইলে এক রকম আর রাবীন্দ্রিক ভঙ্গিতে গাইলে আরেক রকম। মনের ভাব প্রকাশেও পার্থক্যটা স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ যদি বলেন, ‘আমার মন কেমন করে’, ভাওয়াইয়া নারী বলবে, ‘সোনা বন্ধু বাদে রে কেমন করে গাও রে’। প্রেয়সীর বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ হলে ভাওয়াইয়া বলবে, ‘তুই কালা যেমন দান্তাল হাতি/মুঞিও নারী তেমন ভর যুবতীরে।’ এমন জীবন্ত আর মন-দেহের সপ্রাণ প্রকাশে কীর্তন বা বৈষ্ণব গানের কৃষ্ণের দেহজ কামের বর্ণনাকেও পানসে মনে হতে পারে। ভাব প্রকাশের সকল উপাদান ও রূপক কর্মের আর চারপাশের দেখা জগত্ থেকে নেওয়া। বিমূর্ততার কোনো সুযোগ সেখানে নেই।
বাহের দেশের প্রকৃতি চড়া সুরে বাজে। এই গান মানব-মানবীর ভাবাবেগকে প্রকৃতির উচ্ছ্বাস দিয়েই বোঝে। নিধুয়া-পাথারের রুক্ষতা আর তিস্তা বা ধরলার খরস্রোতের মতোই তাদের জীবন। প্রকৃতির লীলার মধ্যেই তারা তাদের জীবনের অর্থ ও মনের ভাষা খুঁজে পায়। মানবশরীর আর প্রকৃতিশরীরের আলোড়ন-বিলোড়ন ছাড়া কিছুই প্রকাশ হতে পারে না সেখানে। হয়তো তাদের মধ্যে তখনো শরীর আর মনের ভেদ জাগেনি। এ দুয়ের টানাপোড়েনে ভোগা বা এদের শাসন করার ধাত তাদের নয়।

তিন.
একটি প্রশ্ন তার পরও উঠতে পারে: গানের কল্পনা আর জীবনের বাস্তবতার মধ্যে কি কোনো যোগাযোগ ধরতে পারা সম্ভব? জীবনের কোন অভিজ্ঞতা থেকে আসে এই আবেগ, কীসে গড়া হয় ভাবনার ভুবন? দিগন্তে যেভাবে আকাশ আর মাটিকে মিলতে দেখেও সেই মিলন অধরা রয়ে যায়, শিল্প আর জীবনের সম্পর্কের সুতাটিও কি তেমনই অধরা? গীতিকার সুরকার আব্দুল লতিফের আত্মজীবনীতে বলা একটি ঘটনায় সেই সুতার একটা প্রান্ত যেন সহসা মিলে যায়। সেই গল্প দিয়েই শেষ করি: ভাষা আন্দোলনের পরে আব্দুল লতিফ হুলিয়া মাথায় পালিয়ে গিয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের এক গ্রামে, বন্ধুর বাড়িতে। গ্রামের সম্পন্ন কৃষক পরিবার। আদর-যত্নের কমতি নেই। কিন্তু বিড়ম্বনা শুরু হলো সেই বাড়ির পরিচারিকা মেয়েটিকে নিয়ে। চৌদ্দ-পনেরো হবে বয়স। দিনের বেলা সেবা-যত্ন যা করার করে, কিন্তু রাতে সে তাঁর ঘরে শুতে আসে। হাত-পা টিপে দিতে চায় ইত্যাদি। এহেন দশায় পড়ে তিনি ধরলেন শিল্পী বন্ধুকে। বন্ধু ততোধিক বিব্রত হয়ে যে ব্যাখ্যা দেন তা অনেকটা এ রকম। ওই অঞ্চলের রীতি হলো, অতিথি এলে বাড়ির ‘দাসী-বাঁদীদের’ দিয়ে তাঁকে খুশি রাখতে হয়। লতিফ সাহেব তারপর মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেন এবং জানতে পারেন তার বাড়ি রংপুরে। খুবই গরিব তারা। বাপ-ভাই তাকে এক রকম বেচেই দিয়েছে এদের কাছে। বলতে বলতে মেয়েটি কাঁদে।

গানটিতে এক অভাগিনী নারী বলছে—ও কাক তোমার হাতে আমি এই চিঠি তুলে দিলাম। তুমি এই চিঠি মাকে দিও। কিন্তু মা যখন জলের ধারে যাবে, তখন এ চিঠি দিয়ো না, মা জলে ঝাঁপ দিয়ে মরবে। মা যখন ভাত রাঁধে তখনো দিয়ো না, তাহলে মা অনলে ঝাঁপ দেবে। যখন মা শাড়ি পরবে, তখনো না, মা তাহলে সেই শাড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস নেবে। গানটির শেষে মেয়েটি বলছে—
‘যখন মাও মোর নিদ্রারে যাইবে
পত্র থুইবেন কাগা সিথানের পরে
ওকি কাগা দেইখবে মাও মোর সকালে উঠিয়ারে।’
গানের সুরে ও ভাষায় এক বিষাদসিন্ধুর কলকল ধ্বনি কি আমরা শুনতে পাচ্ছি? আব্দুল লতিফের বর্ণিত কাহিনীর মেয়েটিই যেন লিখেছে ওই চিঠি?
শিল্প ও জীবন হয়তো কোথাও মিলে আছে আমাদের অগোচরে; এমনকি ইতিহাসও। বাংলার লোকগীতি আসলে বাংলার পল্লী পরিবেশে বয়ে যাওয়া কৃষক জীবনের আখ্যান, আঞ্চলিকতার খোপে খোপে বেড়ে ওঠা এই ভূখণ্ডের মানবিক ইতিহাস। সেই মানুষের আদমসুরত ওখান থেকেই এঁকে নেওয়া সম্ভব। আমাদের নিম্নবর্গীয় সমাজের লিখিত সাহিত্য নেই বললেই চলে। যা আছে তা তাদের নিজস্ব লিখন নয়। একমাত্র লোকগান-লোকসাহিত্যই সেই আধার, সেখানে তাদের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-ভালোবাসার খাঁটি বয়ান আমরা শুনতে পারব। পাব সেই দেশজ মনের খোঁজ যা হয়তো বিদেশি শাসনে, নানান বিপরীত সাংস্কৃতিক চাপে নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি, বিকৃত হয়নি। আমাদের যৌথ মনের শৈশব জানতে তার কাছে তাই ফিরতেই হয়।
বাহের দেশ দূরের কোনো অঞ্চল নয়, কুড়িগ্রামের সীমান্তে তিস্তা, ধরলা আর ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানে আড়াই হাজার বছর পুরোনো চিলমারীর বন্দর আজও আছে। সেই বন্দরে এখনো অজস্র দেশি নৌকা ভেড়ে। তার পরও চিলমারীর পথে-বন্দরে পা রেখে মনে হয় সেটা যেন অন্য কোনো জগত্, অন্য কোনো সময়। তার বাস যতটা বাস্তবে মনের গভীরেও ততটাই। গাড়িয়াল-মৈষাল-মাহুত বন্ধুরা সেখান থেকে আর ফিরতে পারে না। ভাওয়াইয়া নারী তার কাছে কিরা কাটে, ‘কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যান কয়া যান রে’। কিন্তু সে ফেরে না। কারণ, ‘মইষের চাকরির ভীষণ দায়, মনের বাঘ মইষালক ধরিয়া খায় রে’।
পিছুডাক মৈষালকে ছাড়ে না। সময়ের খাদ থেকেও কে যেন ফের জিজ্ঞেস করে, ‘ও তোমরা গেলে কি আসিবেন, আমার মাহুত বন্ধুরে।’